বুড়োদেওয়ের সাক্ষাৎ

হিমু's picture
Submitted by himu on Sat, 26/10/2019 - 7:18pm
Categories:

লালদেড়ে প্রৌঢ়ের গায়ে কড়া ক্ষারে কাচা খানিক-রোঁয়া-ওঠা ক্ষৌম কুর্তা যেন আরেকটু ফেঁপে উঠছিলো তারই খনখনে ধমকে, "...গেরস্ত বাড়ির বৌ-ঝির কাপড় তুলে চোরডাকাত খুঁজতে হচ্ছে রাজার ঠোলাকে? আরে একেই কি বলে সভ্যতা...?" পাশে সন্ত্রস্ত মুখে দাঁড়িয়ে তার কিশোরী মেয়েটি, দু'হাত ঘাগড়ায় চেপে রেখেছে সে, কিন্তু ভারি টুলটুলে তার চেহারাটি, আমার চোখ তার দিকেই ফিরছিলো একটু পরপর।

ওদিকে ঘাটের এক প্রান্তে তাঁবু খাটানো হয়েছে, তরুণী-যুবতীরা যে যার অভিভাবকের হাত চেপে ধরে তার সামনে সারি বেঁধেছে, তাঁবুর বাইরে দু'হাত লম্বা লগুড় হাতে নীরবে দাঁড়িয়ে দু'জন আমা। থানাদার উলটকেতু উল্টোদিকে ঘাটের সিঁড়িতে বেজার মুখে বসে হুঁকো টানছিলো, সে সটকা মুখ থেকে নামিয়ে একটু পরপর বলছে, "খুবৈ জঘন্য ব্যাফার!", আর প্রত্যেকবার সে কথা শুনে আমার টহলসাথী, আধবুড়ো উম্বারাখা, খিকখিক করে হেসে উঠছে। উম্বারাখা রক্ষী হওয়ার আগে কিছুদিন এক নটের দলে সাগরেদি করেছে, কবিদের সাথে তার ওঠবোস ছিলো বলে অনেক শক্ত কথার আড়ালের অর্থ সে জানে, হাসির কারণটা সে-ই বুঝিয়ে বলেছে আমায়; জঘন মানে কোমরের ঠিক নিচের অঞ্চলটা, এদিক-ওদিক দু'দিকেই। মুনিতোয়া নদীর এপার থেকে ওপার শেকল তুলে আটকে রাজধানী থেকে উজানে আসা সব নৌকা এ ঘাটে থামতে বাধ্য করে সব যুবতী যাত্রীর বাম নিতম্বে জন্মদাগ খোঁজা চলছে যখন, এটা জঘন্য ব্যাপার না হলে জগতে কোনো কিছুই জঘন্য নয়। কিন্তু উলটকেতু সর্দিজ্বরের বাহানা তুলে থানাদারির দায়িত্ব আরেকজনকে দিয়ে শুয়ে-বসে তাস পিটিয়ে দিন কাটাচ্ছিলো, যুবতী মেয়ের পেছনে জন্মদাগ খুঁজতে হবে শুনে গতকাল সে লাফাতে লাফাতে কাজে ফিরেছে এ জঘন্য ব্যাপারটা যাকে বলে হাতে-নিতম্বে সামলাতে; আজ সে মধুর খাটুনি হাতছাড়া হওয়ায় তার হুঁশ হয়েছে।

উম্বালুম্ফাধুম্পা
তাঁবু ছেড়ে একটি তরুণী ক্রোধ-লজ্জা-বিড়ম্বনা মুখে মেখে বেরিয়ে এলো, পাহারায় দাঁড়ানো একজন আমা কলেবরের সাথে বেমানান মিঠে স্বরে সারিতে দাঁড়ানো পরের মেয়েটিকে ভেতরে যেতে ডাকলো। আমারা খোদ রাজার হারেম পাহারা দেয়, অধীরা মেয়েদের সামলে তাদের বিলক্ষণ অভ্যাস আছে। মেয়েটি ফোঁসফোঁস করে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলো, তার সাথী যুবকটি চোখ পাকিয়ে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, অপর বিশালবক্ষা আমা চারহাত ওপর থেকে শক্ত ধমক দিলো তাকে, "রাজার ফরমান! য়্যাকদম চোপ! একপাশে আরামেএএএএএ দাঁড়াও!"

আমার বা উম্বারাখার খাটনি এখানে নয়, নদীর ওপারে, নগরের পেছনের এক ফটকে, কিন্তু থানাদার উলটকেতুর সাথে ঝামেলা না বাড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ বলে চুপচাপ সড়কি হাতে দাঁড়িয়ে লোকের মনে ভয় জিইয়ে রাখছিলাম। কুড়িদেড়েক ছোটবড় নৌকা এসে ভিড়েছে, উলটকেতুর রক্ষীরা সেগুলো আঁচড়ে তল্লাশি চালাচ্ছে। যদিও হুলিয়ায় বলা আছে ফর্সা-নাকখাড়া-তামাটেচুলো-বলিষ্ঠা যুবতীর কথা, যার বাম নিতম্বে তিনকোণা জন্মদাগ আছে, কিন্তু উলটকেতু জঘন্য ব্যাপারে নেমে কোনো ঝুঁকি নিতে নারাজ; ঘোর শ্যামাঙ্গিনী থেকে শুরু করে ফ্যাকাসে শুক্লাঙ্গিনী কিশোরী-তরুণী-যুবতী-মধুবয়স্কা সকলকেই তাঁবুর সারিতে দাঁড় করাচ্ছে রক্ষীরা। নৌকার আরোহীদের একাংশ স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত, কিন্তু যাদের সঙ্গে আপাতত কোনো মেয়ে নেই, তাদের বেশ আনন্দিত দেখছি। এদের একজন এ কাজে পরীক্ষক হতে স্বেচ্ছাসেবা দিতে আর লোক না পেয়ে উলটকেতুর কাছে খোঁজ করতে গিয়ে বিকট এক চড় খেয়েছে খানিক আগে। আমা-দের দলটা এ কাজে চলে আসায় উলটকেতু নিজেই এ ক্লেশমধু থেকে বঞ্চিত আছে সকাল থেকে, মেজাজটা তার চড়ে আছে।

ওপার থেকে খেয়া আসার কথা, বিকেলের আগে বাঘাবট নগরের পেছনের ফটকে হাজির হতে হবে আমাদের দু'জনকে। আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, সূর্য অনেক ওপরে উঠে পড়েছে। রোদ খুব একটা কড়া নয় অবশ্য, শেষ শরতের মিঠে হাওয়া আর ছেঁড়াফাটা মেঘ এসে খানিক রেহাই দিচ্ছে। আটক যাত্রীরা চেঁচিয়েই যাচ্ছে।

হুলিয়াটা যেখানে টাঙানো, তার নিচে বসেই উলটকেতু হুঁকো টানছিলো, মাঝবয়সী আলখাল্লা-আর-কোমরবন্ধ-পরা এক ঘোর কৃষ্ণাঙ্গ লোক গটমটিয়ে সেটার সামনে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে বিড়বিড় করে কিছুক্ষণ লেখাগুলো পড়ে হেঁকে উঠলো, "এখানে পষ্ট লেখা, পলাতকা তস্করা ফর্সা!"

উলটকেতু হুঁকো নামিয়ে বললো, "তো কী হৈছে?"

আলখাল্লাপরুয়া হুলিয়াপড়ুয়া ফুঁসে উঠলো, "আরে আমার বোনঝির গায়ের রংটা তো দ্যাখো! তোমাদের আক্কেল আর চোখের মাঝখানেও কি তাঁবু টাঙানো?"

ঝামেলাটা গতকাল উলটকেতুই পাকিয়েছে। রক্ষীরা গুনগুন আপত্তি তুলছিলো, কিন্তু উলটকেতু ফর্সা-কালো সব মেয়েকেই আটকে জামা তুলে জন্মদাগ খুঁজেছে বিকেল থেকে সন্ধ্যা। এ নিয়ে দু'চারবার যাত্রীদের লাঠিপেটা করতেও ছাড়েনি সে। একটা দাঙ্গা প্রায় লেগে যেতো, আজ ভোরে আমারা আসায় রক্ষা। উলটকেতু আমা দলশিরের সাথে তর্ক করার সাহস পায়নি, চুপচাপ দাগ খোঁজা ছেড়ে নৌকা আটকাতে নেমেছে।

হুঁকোয় এক ছোট টান দিয়ে উলটকেতু দরাজ গলায় বললো, "ঠাঠা রৈদ। ফর্সা মাইয়া কালা হৈতে কতক্ষণ?"

আলখাল্লাপরুয়া গর্জে উঠলো, "আরে, হাকুচরাটের লোক আমরা, ছিষ্টির শুরু থেকে সবাই কালো!" চোখ রাঙালো সে, "বাঘাবটে পৌঁছেই আমি কোটালের কানে নালিশ তুলবো। কতবড় থানাদার তুমি, দেখা যাবে তখন!"

উলটকেতু লোকটাকে মন দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে হাত নাড়লো, "সব চোরৈ ধরা পড়ার পর এইসব কয়। এইবার গিয়া সারিতে তর বৈনঝিরে লগে লৈয়া খাড়াছে!" আরেক কালো মেয়ের উদ্বিগ্ন পুরুষ কুটুমও এসে কী যেন বলতে চাইছিলো, তাকেও হাঁকিয়ে দিয়ে দু'চরণ কোবতে শুনিয়ে দিলো সে, "কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভেতরে সবার সমান সন্দেহজনক।" তাঁবুর দিকে হাত তুললো সে, "আর মাইয়ারাই তো তোমাগো বৌ-ঝির দাগ বিছরায়, য়্যাতো চ্যাতো ক্যান?"

আমারা যে মেয়ে, এ কথা অবশ্য প্রথম দর্শনে বিশ্বাস করা কঠিন। দীর্ঘ সরঙা নৌকায় করে আটজন আমা আজ হাজির হয়েছে ঘাটের থানায়, কারো উচ্চতাই চারহাতের নিচে নয়। আমা-দের দলশির উলটকেতুর তল্লাশির আয়োজন কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে তাকে শুধু আঙুল দেখিয়ে দূর হওয়ার ইঙ্গিত করেছে, সুড়সুড় করে সরে গেছে থানাদার। দলশির তারপর তাঁবু খাটিয়ে মেয়েদের ডেকে দাগ পরীক্ষা করে যাচ্ছে সকাল থেকে।

কিছুক্ষণ গুড়গুড় হুঁকো টেনে অপেক্ষমান যাত্রীদের দিকে গজগজ করে উঠলো উলটকেতু, "আর রাজার ফরমান লৈয়া এত গোসসা ক্যান? রাজা হুকুম না দিলে কার কী ঠ্যাকা পড়ছে তোমাগো বৌ-ঝির গায়ে দাগদুগ পরীক্ষার? তোমাগো কী মনে হয়, এই কাম আমাগো ভাল্লাগে? যত্তসব জঘন্য ব্যাফার!"

গতকাল কম করে হলেও চার কুড়ি মেয়ের ঘাগড়া তুলে তাদের পেছনে দাগেষণা করেছে উলটকেতু, সকালে ঘাটে এসে অন্য রক্ষীদের কাছে শুনেছি। থানার এক গোলাদারও কালো মেয়েদের আটক নিয়ে একটু ঘেনিয়েছিলো, উলটকেতু তাকেও কড়কে দিয়েছে। গতকালও নাকি কয়েকজন সাক্ষর অভিভাবক হট্টগোল করেছিলো, হুলিয়ায় বাম নিতম্বের কথা লেখা আছে, উলটকেতু কেন বাম-ডান সবই পরখ করছে তা নিয়ে, বিশেষ লাভ হয়নি। "কুনটা বাম আর কুনটা ডাহিন, সেইটা কে ঠিক করবে? তুই না আমি?" ধমকে উঠে চড়চাপড় চালিয়েছে সে।

আমা-দের দলশির তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে মুখে আঙুল পুরে শিস বাজিয়ে আরেক আমা-কে কাজ গছিয়ে দিয়ে গটগটিয়ে এক ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলো। উম্বারাখা আমার কানে কানে বললো, "তোমার কী মনে হয়, শম্বরাদ? ওরা কি আসলেই মেয়ে?"

আমি মাথা চুলকালাম, "মেয়ে না হলে কি হারেম পাহারা দিতে পারতো?"

উম্বারাখা ফোঁস করে এক শ্বাস ফেললো, "তা-ও কথা। আহা, যদি নিরেলায় ওদের একটার সঙ্গে শুয়েবসে সুখ-দুঃখের দুটো কথা কইতে পাত্তুম...।"

উলটকেতু হেঁকে ডাকলো আমাদের, "কী রে, তরা দুইটা খাড়ায়া রৈছস ক্যান? কামে যাবি না?"

আমি সবিনয়ে বললাম, "খেয়ার অপেক্ষায় আছি, জনাব!"

তাঁবু থেকে তামাটেচুলো এক ফর্সা কিশোরী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বেরিয়ে এলো, তার সঙ্গী পুরুষ উলটকেতুর সামনে এসে চেঁচিয়ে উঠলো, "এই বেইযযতি কিৎনে দূরতক চোলবে?"

উলটকেতু ঢুলুঢুলু চোখে তার দিকে চেয়ে বললো, "যতদূর পন্ত মুনিসন্ধের রাজার ফরমান চলে।"

লোকটা হাতে কিল মেরে বললো, "হামার জরুর দাবনায় দাগদুগ নাই, এই মর্মে মোহর-ছাপ্পড় মারিয়া কাছু দস্তক-উস্তক তো দেও! নাকি ঘাটে ঘাটে ঘাগড়া উতারকে চোলতে হোবে?"

উলটকেতু হুঁকো মুখে রাঙা চোখে বললো, "যদি চলতে হয় তো চলবা! রাজার হুকুম!" মেয়েটার দিকে হুঁকো তাক করলো সে, "তোমার জরু তো দেহি ফর্সা, তামা চুল! সে-ই যে জাদুগীর বজ্রপটাশের গুদাম ছারখার কৈরা পলায় নাই, আমরা তার কী জানি? দস্তক দিয়া শ্যাষে গর্দান খোয়াই! যাও যাও!"

লোকটা অভিসম্পাত দিতে দিতে কাঁদো-কাঁদো কচি বৌ নিয়ে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে এক নৌকার দিকে চলে গেলো।

উম্বারাখা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, "আচ্ছা, জাদুগীর মশায় কী করে জানলেন, তাঁর ঐ বাঁদী, যে গুদাম লুটে পালিয়েচে, তার পেচোনে জন্মদাগ আছে?"

আমি মাথা নাড়লাম, "বলতে পারি না, ভায়া। গাঁয়ের লোক আমি, রাজধানীর হালচাল জানি না।" যদিও আমি জানি, বড় মানুষদের কাছে পেছন লুকানো ছোটদের জন্যে কঠিন। কেন যেন আমার মনে হলো, জাদুগীর বজ্রপটাশের পেছনে কোথায় কী দাগ আছে, সেটা ঐ পলাতকা গুদামলুণ্ঠিকারও জানা। এক পক্ষের পেছনের আবরণ উঠে গেলে সচরাচর অন্য পক্ষেরটাও ওঠে কি না।

উম্বারাখা মাথা চুলকালো, "অবশ্য জাদুগীর যখন, জাদুর বলে কী-ই না করতে পারে? হয়তো কোনো মন্ত্র পড়ে ঝোলের হাঁড়িতে ফুঁ দিয়েচে, আর ঝোলের পর্দায় ঐ বাঁদীর বাম নিতম্বের ছবি একেবারে জন্মদাগসমেত ভেসে উটেচে?"

আমি সবে খেয়ে বেরিয়েছি, উম্বারাখার কল্পনার আঘাতে পেটটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠলো। উম্বারাখা আমার দৃষ্টি দেখে মাথা চুলকে বললো, "না, মনে হয় তেমনটা ঘটেনি, তাই না ভায়া? ওরকমটা হলে জাদুগীর নিশ্চয়ই মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিয়ে ঐ চুন্নি ছুঁড়ি এখন কোতায় আচে কী কচ্চে সব হাঁড়ির ঝোলে দেখে নিয়ে তার পিচু পিচু আমা লেলিয়ে দিতো।"

আমি এখনও প্রশ্নটার উত্তর পাইনি অন্য রক্ষীদের কাছ থেকে, তাই লাভ নেই জেনেও উম্বারাখাকে শুধালাম, "কিন্তু সে মেয়েটা জাদুগীর সায়েবের গুদাম থেকে কী চুরি করেছে, সে কথা কি জানা গেলো?"

উম্বারাখা মাথা নাড়লো, "শুধিয়েচিলুম দু'চারজনকে, কেউ কিচু বলতে পারলো না। হয়তো ওরা জানবে...", কেমন এক সতৃষ্ণ চোখে আমা-দের দলটাকে দেখে নিলো সে। "জাদুগীরের গুদাম ভায়া, সেখান থেকে যা সরাবে সেটাই নির্ঘাত মারাত্মক কিচু।" কথার ফাঁকেই সড়কির বাঁট বাড়িয়ে সারিতে আগে দাঁড়ানো নিয়ে হাতাহাতি করা দুই প্রৌঢ়ের পেছনে ঠাস ঠাস করে দুটো বাড়ি কষালো সে দক্ষ হাতে, "বজ্রপটাশের গালিচাটা যদি ঝেড়ে দেয়?"

আমি খানিক খতিয়ে দেখলাম সম্ভাবনাটুকু। রাজার জাদুগীরের জাদুর গালিচার কথা প্রচুর শুনেছি, চোখে দেখিনি যদিও। গাঁয়ে মুরুব্বিদের মাঝে কে যেন একবার ভিনভূমে ফৌজের সাথে গিয়ে চাক্ষুষ দেখে এসেছিলো সে বস্তু, গ্রীষ্মের দুটো মাস গাছতলার আড্ডা সে ফিরিস্তি দিয়েই জমিয়ে রেখেছিলো সে। "গালিচা ঝেড়ে দিলে হুলিয়া জারি করে কী লাভ, উম্বাভায়া? সে মেয়ে তো গালিচায় চড়েই যেখানে পালানোর, পালাতে পারে।"

উম্বারাখা থুতনি চুলকালো খানিক, "তা বটে। তাহলে ঝেড়েচে হয়তো কোনো দত্যির চেরাগ। আমি শুনিচি জাদুগীরের কেল্লা থেকে বেশ ক'টা দত্যি ঝড়ের রাতে চরতে বেরোয়। চেরাগে আটকা থেকে থেকে গায়ে খিল ধরে যায় তো, খিল ছোটাতে মাঝেমধ্যে বের করে এনে একটু হাওয়া খাওয়াতে হয় ওদের... আর সঙ্গে অনুপান ধরোগে দু-চারটা মহিষ?"

সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু উম্বারাখা আরো অনেকগুলো বিকল্প দিলো হড়বড়িয়ে; বজ্রপটাশের অক্ষয়শিঙার কথা কে না জানে (আমি জানতাম না), যেটাকে এক ছটাক মাংস বা রক্ত খেতে দিলে বিনিময়ে দুই সের আঙুরসুধা উপচে ওঠে, বাঁদি হতভাগী সেটাও চুরি করতে পারে। বজ্রপটাশের মা গুল-এ-গোখরা, আগে যিনি রাজার জাদুগীর ছিলেন, কোন এক ফৌজের ঘোড়শিরকে নাকি ভেড়া বানিয়ে আটকে রেখেছিলেন বেআদবির শাস্তি হিসেবে, ঝাড়া দশটি বছর সে পশম দিয়ে গেছে চুপচাপ, সে পশমে বোনা কম্বল দিয়ে কাউকে একবার জাপটে ধরলে সেও নাকি ভেড়া হয়ে যায়, বজ্রপটাশের গুদামেই সে কম্বল থাকার কথা। তাছাড়া জোড়াপাছোর মুনিদের একজনের খুলিও নাকি বজ্রপটাশের দখলে আছে, যদিও সে স্বীকার করে না।

আমার মাথায় ভাবনাগুলো একেবারেই জট পাকিয়ে গেলো। অক্ষয়শিঙা চুরি যেতে পারে বৈকি। কিন্তু ফর্সা তামাটেচুলো যুবতীরা কাউকে ভেড়া বানাতে চাইলে কষ্ট করে বজ্রপটাশের কম্বল চুরির ঝুঁকি কেন নিতে হবে? কথাটা শুধাতে উম্বারাখা পেট চেপে কিছুক্ষণ খ্যাখ্যা করে হেসে উদাস হয়ে বললো, "তা বটে। আমায় একটু মিষ্টি করে বললে আর মাঝেমধ্যে কাঁথার নিচে সেঁধোতে দিলে আমিও ওরকম কোনো জোয়ান মেয়ের গোয়ালে থাকতে রাজি।"

জোড়াপাছোর মুনিদের খুলির বৃত্তান্তও আমি জানতাম না, উম্বারাখা আরও দু'চারজন অধীর ও বিশৃঙ্খল লোককে ঠেঙিয়ে সারিতে ঠিক জায়গায় দাঁড় করানোর ফাঁকে সেটা খুলে বললো। জোড়াপাছোর মুনিরা বহু আগের জমানার মুনি, যমজ ভাই, কিন্তু পাছুর কাছে পরস্পর জোড়া লাগানো, উলটকেতুর ভাষায় যাকে বলে জঘন্য ব্যাফার। হয়তো এ অসুবিধা পোষাতেই মহাকাল বাড়তি তেজ দিয়ে পাঠিয়েছিলো তাঁদের, মুনিকূট পাহাড়ে বসেই দুনিয়া জুড়ে নানা অলৌকিক কীর্তি তাঁরা সাধন করে গেছেন। সারা জীবন মৌনী হয়ে কাটিয়ে বিপুল কথা বুকে জমিয়ে রেখেছিলেন জোড়াপাছোর মুনি দু'জন, মৃত্যুর পর দেখা যায় তাঁদের দুটো করোটি সমানে বকবক করে যাচ্ছে। অলৌকিক তেজে দুই করোটির এমনই সংযোগ, দুটিকে দু'জায়গায় নিয়ে গেলেও তা কাটে না, একটিকে কিছু শুধালে আরেকটি সে কথা আওড়ায়। জনশ্রুতি আছে, এরই একটি বজ্রপটাশের কবলে, অন্যটি মুনিকূটের মুনিদের কাছে, বজ্রপটাশ মাঝেমধ্যে তাঁদের সাথে খুলি মারফৎ আড্ডা মারে।

আমার একটু ধন্ধ লেগে গেলো গল্পটা শুনে। মুনিকূটের মুনিরা কথা বলেন না বলেই না তাঁদের অত তেজ আর বুদ্ধি। কথা একবার বলে ফেললে তাঁদের সব শক্তি উবে যায় বলেই জানতাম। বজ্রপটাশের সাথে আড্ডা মেরে তাঁরা কেন তেজ খোয়াতে যাবেন? উম্বারাখার কাছেও সে প্রশ্নের উত্তর নেই, সে গল্পের গরু গাছে চড়াতে লাগলো, "মুনিদের হয়ে হয়তো কোনো চাকরবাকর কথা বলে। বড় বড় মানুষরা কি কোনো কাজ নিজে করে ভায়া? আমি শুনিচি বজ্রপটাশের একটা জাদুর কেলে হুলো আচে, সেটা নাকি শীতের রেতে বজ্রপটাশের হয়ে বাইরে হিসি করে আসে। ঐ তামাটেচুলো বাঁদি সে বেড়ালটাকেও ঝেড়ে দিতে পারে, অসম্ভব নয়।"

আমি উম্বারাখার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম, ফর্সা তন্বী ঈষৎ-তাম্রকেশী এক তরুণী একটা কালো গুঁফো বেড়াল কোলে আধবুড়ো এক লোকের হাত ধরে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উম্বারাখার আষাঢ়ে গল্প মাথা থেকে দূর করে দিয়ে নদীর বুকে খেয়া খুঁজতে লাগলাম। ওপারের নাও আসতে কেন দেরি হচ্ছে কে জানে?

টহলরক্ষীদের খাটুনি মাসভর এক জায়গা ঘিরে চলে না, থানাদাররা নিজ মর্জিমাফিক সেটা বাঁটে। উলটকেতুকে চটালে সে রাতের টহলে পাঠাতে পারে, এ ভয়ে হয়তো বাকি রক্ষীরা বেশি সাড়াশব্দ করেনি, কিন্তু আমারা আজ না এলে ব্যাপারটা অনেকদূর টকতো, সন্দেহ নেই। মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে পুরুষদের সারি আস্তে আস্তে টগবগিয়ে উঠছে, দেখতে পাচ্ছি। তাঁবুর সামনে এক যুবক পিছু ফিরে সারির বাকিদের উদ্দেশ করে হেঁকে উঠলো, "মুনিসন্ধে কবে চেহারা দেখে চোর ধরা শুরু হবে? আজ বগলে জখমের দাগ তো কাল দাবনায় জন্মদাগ তো পরশু কুঁচকিতে আঁচিল... এসব ঘেঁটে দেখার কী ঠ্যাকা রাজামশায়ের পড়েছে, হ্যাঁ? ভাইসব, চলুন সব কাজ ফেলে রাজদ্বীপ বরাবর একটা মিছিল করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ভাইসব, এখানে রাজার নাম ভাঁড়িয়ে এই যে চরম নিগ্রহ চলছে, প্রজাসাধারণের ঘরের বৌঝিদের যেভাবে খুল্লামখুল্লা আব্রুচ্যুত করা হচ্ছে, রাজামশাই এসব কিছুই জানেন না। তিনি হয়তো দরবারে বসে কাসুন্দি দিয়ে আমশুঁটকি চাবাচ্ছেন আর ভাঁড়দের ভাঁড়ামো দেখে তালি দিচ্ছেন। প্রাসাদের বাইরে একটা প্রজাবন্ধন না করলে প্রজার দুর্দশা তাঁর অগোচরেই থেকে যাবে... উফফ বাপরে!"

বিশালকায়া আমা যুবকের কান আরেকদফা মুচড়ে দিয়ে তাঁবুকাঁপানো হুঙ্কার দিলো, "য়্যাকদম চোপ! একপাশে আরামেএএএএএ দাঁড়াও!"

সারিতে দাঁড়ানো বাকিরা খানিক পিছিয়ে কানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পাল্টা গর্জে উঠলো, "বাম নিতম্বে জন্মদাগ মানি না মানবো না!"

উলটকেতু হুঁকো নামিয়ে হাতে সড়কি তুলে গলায় ঝোলানো শিসবাঁশিটা মুখে পুরে একটা কড়া ফুঁ দিলো। ঘাটের রক্ষীদের কয়েকজন দ্রুত পায়ে ছুটে এসে সড়কির বাঁট দিয়ে কয়েকজন অভিভাবককে ঠাসঠাস বাড়ি কষালো, আধেক আগ্রহ নিয়ে তাদের সাথে যোগ দিলাম আমিও। লোক ঠ্যাঙাতে সবসময় ভালো লাগে না। যেসব লোককে দেখে এই ফুটফুটে কিশোরী-তরুণীর স্বামী বলে সন্দেহ হলো, তাদের মাঝে জনাচারেককে একটু হালকা মন নিয়ে কিছুক্ষণ পেটালাম, যাদের দেখে বাবা-কাকা-মামা মনে হলো তাদের কিছু বললাম না। কে জানে, ভবিষ্যতে হয়তো আরো হৃদ্য পরিবেশে তাদের সাথে সম্ভাব্য কুটুম্বিতা নিয়ে আলাপসালাপ হবে? পেটালে যদি চেহারা চিনে রাখে?

শ্বাশুরিকতার পরোয়া উম্বারাখার নেই, সে যুবক-প্রৌঢ় সবাইকে ধুমসে পেটাতে পেটাতে হেঁকে উঠলো, "রাজার সাতে বেআদবি? প্রাসাদে হামলার ষড়যন্ত্র?"

জনতার সারিটা চারদিক থেকে মার খেয়ে গোল হয়ে গিয়েছে, মেয়েদের সামনে ঠেলে ব্যাটাছেলেরা সে চক্রব্যূহের আড়ালে লুকিয়েছে, নারীপুরুষ সবাই চেঁচিয়ে রাজাকেই অভিসম্পাত করছে, পরিস্থিতি বেশ ঘোলাটে হয়ে উঠেছিলো, সবাইকে আচমকা থামিয়ে গম্ভীর শিঙা বেজে উঠলো হঠাৎ।

থানশির গুড়বচন বাঘরা এক পা নায়ে আর অপর পা ঘাটে রেখে তার গম্ভীর-কিন্তু-মধুর স্বরে হেঁকে উঠলো, "এসব কী হচ্ছে? লাঠি বন্ধ‌।"

যেসব যাত্রীর সঙ্গে মেয়ে নেই, তারা মজা দেখছিলো বসে বসে, এবার তারা রক্ষীদের বিরুদ্ধে একযোগ পোঁ ধরলো। গুড়বচনের সঙ্গী শিঙাদার রক্ষী ইশারা পেয়ে ফের গাল রাঙিয়ে শিঙায় ফুঁ দিলো। সবাই ফের থেমে গেলো।

গুড়বচন বাঘরাকে বাঘাবটের নাগরীরা তো বটেই, আশেপাশের নগর-গাঁয়ের লোকও চেনে আর সমঝে চলে। মন্থর পায়ে ঘাট বেয়ে উঠে জনতার রোষগোল্লার মাঝে সেঁধোলো সে। "কী সমস্যা এখানে, মুরুব্বি?"

এক প্রৌঢ় হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন, "আমার আবিয়াতো মেয়েটাকে এই রক্ষীর দল, আর ঐ মেয়েদানোরা, দেখুন তো একদম কাপড় তুলে কী একটা অবস্থা...!"

বাঘরা প্রৌঢ়কে এক হাতে জড়িয়ে বগলতলায় গুঁজে নিলো। "চাচাজান! বোনটি আমার! কী করবো বলুন? রাজদ্বীপে বিরাট চুরি হয়েছে। আপনার আমার ঘরে সিঁদ দিলে দুটো ঘটি, দুটো বাটি মিলবে, সেগুলো আজ চুরি গেলে পরশু আরেকটা জুটবে। জাদুগীরের গড়ে সিঁদ দিলে কী ভয়ানক সব জিনিস মিলবে, একবার চিন্তা করেছেন আপনারা?" এক ফুটফুটে তরুণীর চিবুকে আঙুল ছোঁয়ালো সে। "সেই যে সে বছর সব কচি মেয়ের থুতনিতে দাড়ি গজালো বেহাত জাদুর ঘায়ে, ভুলে গেলেন?"

অমনটা কোথায় কোন বছর কাদের সাথে ঘটেছিলো, সে চিন্তায় জনতা থমকে গেলো, কিন্তু গুড়বচন বাঘরা থামলো না। "খবর এসেছে, চোর এদিক পানেই ভেগেছে। হয়তো সে আমাদের মাঝেই মিশে আছে। আমরা সবাই কি সবাইকে চিনি? দশের ভালোর জন্যেই এ অভিযান চলছে, চাচারা, ভায়েরা, বোনেরা। নিজেদের ভালোর জন্যেই তো। কচি মেয়েদের থুতনিতে দাড়ি উঠলে থোক ক্ষতি কার?"

জনতা মিইয়ে গেলো। গুড়বচন আরেক যুবকের পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করলো তাকে। "সব বুঝি ভাইটি। কিন্তু ভালোমন্দ মিলিয়েই জীবন। নাও, এই যে ছায়ায় দাঁড়াও... ইশশ, ঘেমে-নেয়ে এ বোনটির কী অবস্থা...।" যুবকের গলা থেকে গামছা টেনে নিয়ে তার স্ত্রীর কপালের ঘাম মুছে দিলো সে। তারপর একেবারে তলপেট থেকে দম তুলে হাঁক দিলো, "থানাদার!"

উলটকেতু মাটিতে গোড়ালি ঠুকে সড়কি সোজা করে ধরলো, "হাজুর!" ধমকের চোটে হাজির আর হুজুর হুড়োহুড়ি করে গলা ছেড়ে বেরোতে গিয়ে মিশে এক হয়ে গেলো তার মুখে। থানশির নীরবে ঝাড়া একটি পল অপলক তার দিকে রক্তচক্ষু মেলে চেয়ে রইলো। জনতা সে দৃশ্য দেখে ফের গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে সারি বাঁধলো, মনকালা ভাবটা অল্প দুয়েকজনের মুখে লেগে রইলো ঝুলের মতো।

গুড়বচন বাঘরা ঠাণ্ডা চোখে বাকি রক্ষীদের একবার দেখে নিয়ে ঘুরলো, আমা দলশিরকে দেখে তার মুখে এক ঝলক সানন্দ হাসি ফুটলো। গটমটিয়ে এগিয়ে হাত তুলে চৌকস ঢালেবাড়ি দিলো সে। মুশকো আমা দলশির ঝোপ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, বাঘরাকে দেখে তার সারা শরীর থেকে লড়িয়ের মূর্তিটা যেন বাতাসে উবে গিয়ে কেমন এক লাজুকলতার ঢং ফুটলো। থানশির তার দুটি হাত চেপে ধরে নিচু গলায় হাসিমুখে কী যেন বললো, দলশির আমা মাথা নিচু করে কী যেন উত্তর দিলো।

উম্বারাখা হাঁ করে সে দৃশ্য দেখছিলো, আমার কানে কানে সে বললো, "বাঘরার সামনে পড়ে আমাটা কেমন গলে গেলো দেক্লে?"

তাঁবুর বাইরে দাঁড়ানো আমারাও আড়চোখে থানশির আর তাদের দলশিরের আধানিভৃত আলাপ দেখছিলো, তাদের একজন হেঁকে উঠলো, "পরের জন!" এক তরুণী মাথা নিচু করে তাঁবুতে ঢুকলো, সারির বাকি অংশ বাষ্প হারিয়ে নিজেদের মাঝে গুজগুজ সামাজিকতায় ডুবে গেলো। বাঘাবটের থানশিরের সাথে হারেমরক্ষী দলশিরের এমন মধুর সাক্ষাৎ দেখলে নিজেদের আব্রুর খেয়াল ক'জনেরই বা থাকে?

উম্বারাখা গদোগদো গলায় বিড়বিড়িয়ে বললো, "রাজরক্তের দাপটই আলাদা, বুঝলে ভায়া? আমাদের থানায় যদি রাজবাড়ির গোটাদুই ছেলেপিলে এসে থানাদারের কাজ নিতো, আহা, নগরের চেহেরা পাল্টে যেতো।"

রাজরক্তের দাপট নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা তেমন সুখের নয়, তাই উম্বারাখার বেশিরভাগ কথার মতো এটাও ওকান দিয়ে বের করে দিলাম। বাঘভূমের লোক যে দু-চারজনকে দেখেছি, প্রত্যেকেই মারমুখো আর প্যাঁচালোমনা, হয়তো মিষ্টি কথারই সবচে অভাব সে দেশে; বাঘভূমের ভূঁইয়ারা যে মিঠেবুলিতে লোকজনকে বশ করায় পারদর্শী হবে, এ আর বিচিত্র কী? তবে এ-ও সত্যি, বাঘাবটের তাবৎ রক্ষীশক্তিতে গুড়বচনের মতো কর্তা আর নেই। বাকি তিনজন থানশির কমবেশি উলটকেতুর মতোই, নিমকোটাল দু'জন নিমপ্যাঁচার মতোই বিবরবিলাসী; আর খোদ কোটালমশায় রীতিমতো রক্তপিপাসু।

কিন্তু গুড়বচন কী করে প্রথম দেখায় ঐ আমা দলশিরকে অমন গলিয়ে ফেললো, সে এক রহস্য বটে। আমারা মুনিসন্ধের বাসিন্দা নয়, মুনিকূট পর্বতের উল্টো ঢালে তাদের দেশ, সেখানে বাঘাবটের রক্ষীদের আনাগোনা হওয়ার কথা নয়। মুনিকূটের পশ্চিমঢালের ধারা বয়ে নিয়ে এঁকেবেঁকে মরুর মাঝে বিশাল আমাঝিল হ্রদে গিয়ে মুখ গুঁজেছে আমাজল নদী, তার দু'ধারে ঘন আমাবন অরণ্যে আমা-দের বাস। গাঁয়ে গাছতলার আড্ডায় মুরুব্বিদের মুখে অনেক শুনেছি সে আমাজনের গল্প, তাদের মেয়েরা সব দত্যিদানো আর ছেলেরা সব ছোটখাটো, সে দেশে মেয়েরা বর্ম-কঙ্কট পরে লড়াই করে আর ছেলেরা আলতা পায়ে কুটনো কোটে। মুনিকূটের মুনিরা টুকরো টুকরো রাজ্যগুলো জুড়ে মুনিসন্ধ রাজ্য তৈরির সময় নাকি আমা-দের রাজি করাতে পারেননি। মুনিসন্ধের অনেক রাজা নানাভাবে আমাদেশ দখল করতে চেয়েছেন, সুবিধা করতে পারেননি, উল্টে আমারাই নাকি একবার বন ছেড়ে বেরিয়ে গুলভূমের আদ্ধেকটা গিলে নিয়েছিলো। কোন এক রাজা কী এক শান্তিচুক্তি করার পর আমারা নাকি মুনিসন্ধের রাজার হারেম পাহারা দিতে তাদের লড়িয়ে মেয়েদের ক'জনকে ফি বছর পাঠানোর কড়ার করে, সেই থেকে আমারা রাজদ্বীপে আসছে। আর যদিও শুনেছি গুড়বচন বাঘরা অনেক বছর ধরে বাঘাবটের রক্ষীকর্তা, কিন্তু রাজার হারেমে তার কোনো কাজ নেই; আমা দলশিরের সাথে তার আগে কোথাও ভাব হয়েছে, সে সম্ভাবনাও তো দেখি না।

উম্বারাখা ইশারায় আমাকে পিছু নিতে বলে গুটি গুটি পায়ে ঘাটে দাঁড়ানো থানশিরের নাওয়ের দিকে এগোলো। আমি আড়চোখে নদীর দিকে নজর রাখছিলাম খেয়ার আশায়, বাঘরা ওপার থেকে আসেনি, নৌকাটা এ কূল ঘেঁষেই এসেছে উজান থেকে। থানশিরের শিঙাদার বেজার মুখে শিঙা বগলে দাঁড়িয়েছিলো, উম্বারাখাকে দেখে হাত নাড়লো সে।

"খবরটবর নতুন কিচু শুনলে ভায়া?" উম্বারাখা কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে শুধালো। গুড়বচন বাঘরা অধস্তনদের সাথে কথা কম বলে, নতুন খবর সরাসরি তার মুখ থেকে জানার সুযোগ শিঙাদারের নেই, কিন্তু অন্য থানাদার বা থানশিরদের সাথে বাঘরার কথোপকথন সে শুনে থাকতেও পারে।

"রাজদ্বীপে ব্যাপক গ্যাঞ্জাম চলতেয়াছে!" শিঙাদার নৌকার মাঝির কান এড়িয়ে বললো। "এক ছেমরি বজ্রপডাশরে কী জানি এক ওষুদ খাওয়াইয়া অচেতন বানাইয়া তার গুদাম ভাঙ্গিয়া সব ওলটপালট করিয়া ভাটির দ্যাশ বরাবর পলাইছে আইজ তিন দিন হৈছে। জাদুগীরের চেতনা ফেরছে গত পরশু রাত্রে। আমরা খবর পাইতে পাইতে গতকাল বিকাল ফুরাইয়া সন্ধ্যা। থানশির সাব পহরে পহরে নিমকোডালগো লগে কবাট বন্দো করিয়া ফুসুরফুসুর কতা কইতেয়াছে আর আমাগোরে লৌড়ানির উপরে রাখছে। তাবৎ নগরে টহল দুগনাইছে, মোড়ে মোড়ে ধনুক বসাইছে।" গলা আরো নামালো সে, "গাঞ্জার ফডকডা চেনছো তো? ঐডার পুবকূলে সোনারুর গল্লির শ্যাষ মাথায় একটা চাইরতলা বাড়ি আছে, চেনছো তো? ঐহানে ষোল্লজনের পাহারা বসাইছে।"

আমার মাথায় দুটো কথা শুনে দুশ্চিন্তার এক ডাঁশ দু'বার কামড়ে দিলো। যে বাঁদি বজ্রপটাশকে অচেতন করে তার গুদাম লুটতে পারে, সে নির্ঘাত দুর্ধর্ষ কেউ, কিন্তু ভাটির দেশ বরাবর পালালে উজানে বাঘাবটে এতো হট্টগোল কেন? আর গাঁজার ফটকেই আমার আর উম্বারাখার পাহারার পালা আজ বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। গাঁজার ফটকের কাছে সোনারুগলিতে বাড়তি পাহারাই বা বসছে কেন?

খেয়ার আশায় একটা চোখ নদীর দিকে, আর রগড়ের টানে আরেকটা চোখ বাঘরার দিকে রাখতে গিয়ে আমার চোখে যেন হাতির টান পড়লো। আমা দলশিরকে পাশে নিয়ে বাঘরা ভিড় থেকে দূরে পায়চারি করছে, কোন এক ফাঁকে এক মুঠো বুনো ফুল ছিঁড়ে নিয়েছে সে ঝোপ থেকে, সেগুলো শুঁকছে, আমা দলশির কেমন যেন জড়োসড়ো হয়ে হাঁটছে আর হাত নেড়ে কী যেন বলছে নিচু গলায়। ধমকের রেশ উলটকেতুর ওপর থেকে এখনও কাটেনি বলে সে শিসবাঁশি মুখে সড়কি হাতে তাঁবুর সামনে সারি বরাবর পায়চারি করছে মুখ কালো করে। জনতার চোখ অবশ্য সেঁটে আছে বাঘরা-আমা জুটির ওপরই।

চোখ আর কানের মাঝে এমনই নিবিড় মৈত্রী, একটা একটু বেশি খাটালে অন্যটা দুবলে আসে; রক্ষীদের জন্যে ব্যাপারটা অসুবিধারই বটে। কানটা শিঙাদারের দিকে ফেরাতেই বাঘরা-আমা-তাঁবু-জনতা সব কেমন যেন আবছা হয়ে হারিয়ে গেলো, "...নিমকোডালের ধমক খাইয়া থানশির সাব চেইত্তা রৈছে। সময় থাকতে থাকতে ফডকে গিয়া খাড়াও। আয়-রোজগারের চিন্তা সামনে কয়দিন বাদ দ্যাও। রাওয়ার টেংরি থুইয়া কয়দিন কদু-কোম্বা দিয়া কাম চালাও।" হাঁক ছেড়ে খানিক দূরে ঘাটের টংদোকানিকে ডাকলো শিঙাদার, "অদুদু! দুই খোলা ব্যালের পানা হৈবে?"

টংদোকানি মওকা পেয়ে তার নাকখানা গুড়বচন আর হাঁকখানা আমাদের দিকে তাক করে তারস্বরে চ্যাঁচালো, "পয়সা দিলে সগলই হৈবে!" রক্ষীদের জুলুম সব দোকানিকেই খানিক সইতে হয় এখন-তখন। অবশ্য মাগনা এক কড়ঙ্ক গরম পানা সাঁটানোর সুযোগ কে-ই বা হাতছাড়া করে?

উম্বারাখা বিগলিত মুখে আমাকে বললো, "তো ভায়া, হয়ে যাক, কী বলো?"

দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ালাম টংদোকানের দিকে। উম্বারাখা বেজায় কঞ্জুস, তবে উপরি ভাগাভাগির বেলায় সে চোরামি কম করে; সে পানি-মেশানো সততার দাম পানা-পাকোড়ায় উসুল করে আসছি সেই শুরু থেকে। পেছনে আবার গুজগুজ শুনে মনে হলো, উম্বারাখা আমাকে দূরে ঠেলে কোনো গূঢ় আলাপ করতে চায় শিঙাদারের সাথে; সম্ভবত গাঁজার আনাগোনা নিয়ে। গাঁজার ফটকে টহল বেশ ক্লান্তিকর, মাঝে মাঝে কঠিন আর বিপজ্জনকও বটে, কিন্তু বুড়োদেওয়ের কৃপায় রোজগার সেখানে মন্দ নয়। বাঘাবটের বাসিন্দা অনেক, গাঁজার সমঝদারও সংখ্যায় অনেক, গাঁজার দোরশুল্কটিও সেখানে চড়া। নগরের প্রধান তোরণগুলো দিয়ে তাই কম গাঁজাই ভেতরে ঢোকে, এদিক-সেদিকে নানা রন্ধ্রপথে কখনও রক্ষীদের এড়িয়ে, কখনও রক্ষীদের পেরিয়ে সেরকে সের গাঁজা বাঘাবটের হাটেবাটেঘাটে ছড়িয়ে পড়ে, প্রায় রোজই। নগর আমায় খেতেপরতেথাকতে দেয় কোনোমতে, বেতন যা দেয় তা কহতব্য নয়। গাঁজার চোরাচালানিরা আছে বলে মাঝেমধ্যে উমদা হাঁসমুরগির ঝলসির সাথে দুটো নানপরোটা চালাতে পারি, বাঈজিদের আসরে দু'দণ্ড জিরোতে পারি, কবিল্লড়াই আর হেটোগানের আসরে গিয়ে শ্রান্ত তনুমন চাঙাতে পারি। এ ছাড়াও টুকিটাকি খরুচে বদভ্যাস তো একজন যুবকের থাকেই। উম্বারাখা বহুদিন ধরে যুবক বলে তার খরচটা আরেকটু বেশি, উপরির বড় চাঙড়টা সে রেখে ছোটটা আমাকে সাধে, তবে এ ব্যাপারে তার জানাশোনা প্রচুর বলে তফাৎটা গুরুদক্ষিণা বলে মেনে নিয়েছি। বাপজান আমায় ভূঁইয়া মশায়ের কাছে বিক্রি করার আগে কিছু কাজের উপদেশ দিয়েছিলেন, এটাও ছিলো তার মাঝে: শেখার বেলায় কম পেলেও সই।

গাছতলার মুরুব্বিরা অবশ্য উল্টো বলেছিলেন; কেউ বলেছিলেন বাঘাবট বড় শহর, পদে পদে সেখানে একে অন্যকে ঠকাতে বেচেইন, বিশেষ করে ভিনভুমো লোকগুলো, আমি যেন ছাড় না দিই, ছাড়তে শুরু করলে কিছুই আর নিজের রবে না। চরিত্রই সকল সুখের ঘানিগাছ, সেটাও তাঁরা বলেছিলেন আমায়, ওটা খোয়ালে সব রোজগারই নাকি বৃথা। আমি সব শুনে এসেছি; সমস্যা হচ্ছে মুরুব্বিদের কেউ বাঘাবটে আসেননি কখনও, তাই ওদের কথার মূল্য দিতে গেলে নিজের আর কিছুই রবে না। ঠকানোর বেলায় ভিনভুমোদের সাথে গাঁয়ের মুরুব্বিরাও কম পাল্লা দেয় না, বলেছিলেন পাশের বাড়ির জেঠু। বাপজান জেঠুর সাথে একদিন বকবকানোর ফাঁকে বলেছিলেন, আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম, মুরুব্বিদের কথা শুনতে হবে, না শুনলে পরে নিজে বড় হয়ে ফালতু বকার শিল্পটাই রপ্ত হবে না, আর সেটা রপ্ত না হলে এত খেটেখুটে ঠেকেঠকে বেলা শেষে মুরুব্বি হওয়াটাই বৃথা।

টংদোকানি পাটখড়ি গুঁজে চুলো উসকে দিলো, "সঙ্গে আর কিছু দেবো গো কোটালখোকা? শুঁটকিপাটি? ঝাঁঝমুলি-চিতৈ? নারকেল-চিংড়ির ভাঁপা পুলি?"

বাঘরার চোখ কিছুই এড়ায় না জেনে বিমর্ষ মুখে বললাম, "তিন খোলা পানা হলেই চলবে খুড়ো।" জামার ঘোপ থেকে তিন আনা বের করে দিলাম তার হাতে। "রাজদ্বীপের খবরটবর কিছু শুনলে?"

টংদোকানি আড়চোখে বাঘরাকে এক নজর দেখে নিয়ে বললো, "শুনলাম তো কতকিছুই। লোকের কথার সত্যিমিথ্যি বোঝা শক্ত।" গলা খাঁকরালো সে। প্রচুর রংচড়ানো গল্প শুনতে না চাইলে এ তল্লাটের টংদোকানিদের কিছু না শুধানোই ভালো। হাঁড়িতে পানি ফোটার আগ পর্যন্ত বকে গেলো টংদোকানি, আমি শুনে গেলাম।

বজ্রপটাশের গালিচা নিয়ে গপ্পো সবচে বেশি ছড়িয়েছে। বাঁদি এটা ঝেড়ে দিয়েছে, নাকি পুড়িয়েছে, নাকি গালিচাটা নিজেই "জানে" বাঁচতে বজ্রপটাশের কেল্লা থেকে সটকেছে, সেটা নিয়ে নানা তত্ত্ব দাঁড়িয়ে গেছে এদিকে পানে যাত্রা করা ফর্সা-তাম্রকেশিনীদের বাপ-চাচা-মামা-বরদের মাঝে। তবে এটা স্পষ্ট, বজ্রপটাশ ঘটনার পর আর গালিচায় চড়েনি। গালিচাটা নাগালে থাকলে বাঁদির নামে হুলিয়া রটিয়ে কেল্লায় পড়ে থাকার পাত্র সে নয়। বাঁদি চুন্নিটার যে আক্কেল সামান্য আছে, সেটা নিয়ে সবাই একমত। শত্রুতা যদি করতেই হয়, তো উড়ুক্কু বজ্রপটাশের চেয়ে ভুঁইবন্দী বজ্রপটাশের সাথে করাই ভালো। অনেক যাত্রীর ধারণা, কাজটা মহারাজই তাঁর কুখ্যাত জানলুট লাগিয়ে করিয়েছেন, নইলে আম ঘরের বাঁদি-চাকরের সাধ্য নেই বজ্রপটাশকে কাবু করার। রাজার সাথে সব জাদুগীরের সম্পর্কই যে যুগে যুগে খানিকটা টক-তেতোর দিকে, সে কথা কে না জানে? রাজার ডানহাত গোপনে জানলুটকে লেলিয়ে দিয়েছে, বাঁ হাত আমা পাঠিয়েছে লোক দেখাতে। এতে সাপও মরলো লাঠিও আস্ত থাকলো।

ফুটন্ত পানিতে বেলশুঁঠের সঙ্গে শুকনো কুচোনো কী এক পাতা ঢেলে খোল থেকে গোলের গুড় বের করলো পানাওয়ালা বুড়ো, "জাদুগীরের গুদামে কোনো ভালো জিনিস নেই ভায়া, সবাই জানে। রাক্ষস-খোক্কস নিয়ে তার কারবার, পেত্নী-পিচেশের সাথে সে পাশা খেলে, আমার বড় শালা নিজে দেখেছে, এক কুড়ি আধপচা মড়া বজ্রপটাশের কেল্লার দেয়ালে ভারা বেঁধে চুনকাম করছে। শুনেছি জাদুতে ভোলানো গুলবাঘ তার উঠোন পাহারা দেয়। আমার মন তো বলছে, বাঁদির গপ্পো সে ছড়িয়েছে সবার চোখে ধুলো দিতেই। নির্ঘাত কোনো অপদেও ডেকে এনে বশ করার ফিকিরে ছিলো ব্যাটা, কুলিয়ে উঠতে পারেনি। অপদেও তার গুদাম জ্বালিয়েছে, তাকেও ঠেঙিয়েছে, তারপর সটকেছে। ওটার হ্যাপা এখন তোমাকে-আমাকে সামলাতে হবে। মেয়েদের কী সাধ্যি, বজ্রপটাশের সাথে টক্কর নেওয়ার?"

ধোঁয়া ওঠা কনকবরণ বেলের পানা থেকে একটা অচেনা চিত্তহর্ষক তিতকুটে গন্ধ ছড়িয়েছে, দোকানিকে আমার খোলা একটু পরে ভরতে বলে ফিরে গেলাম উম্বারাখার কাছে। বাঘরা তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে আমা দলশিরের কথা শুনছে মন দিয়ে, দলশির কথার ফাঁকে একটু পরপর হাত তুলে কোপ মারার ভঙ্গি করে খুবসে বকে যাচ্ছে। শিঙাদার নিচু গলায় কী যেন বলছিলো, আমাকে দেখে থেমে গিয়ে খোলাটা হাতে নিয়ে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিলো সে, "...বজ্রপডাশের গুদামডা এক্সের জ্বালাইয়া দেছে। কেল্লার খাডালডা ভরা খালি ছাই আর ফাডা ভাণ্ডবাডি।"

উম্বারাখা বিগলিত হেসে বললো, "তোমার পানা জুড়োচ্চে ভায়া। গিয়ে গিলে এসো নাহয়?"

নির্ঘাত গাঁজা পরিস্থিতি নিয়েই বিচলিত উম্বারাখা। আমায় শুনিয়ে শিঙাদার হয়তো বকতে নারাজ, কিংবা উম্বারাখা সামনে কোন এক দাঁও একা মারতে চাইছে।

টংদোকানি আমার জন্যে খোলায় পানা ঢালতে ঢালতে বললো, "এই দত্যি ঠুলুনিরা কি এ তল্লাটেই আড্ডা গাড়বে নাকি এখন থেকে?"

আমারা রাজদ্বীপের বাইরে কোথাও খাটনি দেয় কি না, আমার জানা নেই। কুঞ্জরগিরিতে হারেমের চল নেই, ভূঁইয়াদের বৌ-ঝিদেরও বাড়তি পাহারা দিয়ে রাখতে হয় না। আমা-দের কেউ এ সাজে আমাদের গাঁয়ে হাজির হলে লোকের চাষ-শিকার শিকায় চড়তো। কুঞ্জরগিরির মেয়েরা কুঁদুলে বটে, কিন্তু লড়িয়ে নয়। মেয়েরা হাতে ডাণ্ডা নিয়ে ছেলে প্যাঁদাচ্ছে, এ দৃশ্য দেখতে লোকে এক কাঁদি কলা খরচ করবে অক্লেশে। টংদোকানির প্রশ্নভরা আশা; আমারা যেখানে টহলে দাঁড়াবে, তার আশেপাশে তামাশার কাঙালরা টং ব্যবসা জমিয়ে রাখবে কয়েক হপ্তা। আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে নারকেলের কড়ঙ্কে চুমুক দিলাম, বেলের গন্ধ, গুড়ের মিঠে স্বাদ আর অচেনা তেতো ঝাপটায় ভেতরটা কেমন চনমনে হয়ে উঠলো।

দোকানির জানলুটতত্ত্ব উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জাদুগীরের সাথে পাঙ্গা নেওয়ার স্পর্ধা মুনিসন্ধে খুব কম লোকেরই আছে। মুনিকূটের মুনিরা হয়তো বজ্রপটাশকে কাবু করতে পারবেন, নইলে রাজা ছাড়া আর কেউ পেরে উঠবে না তার সাথে। কিন্তু বজ্রপটাশের সাথে রাজার কোনো রেষারেষি হলে সে খবর তুরন্ত ছড়াতো। রাজা গোপনে তাকে জানলুট লেলিয়ে ঢিঁঢ করার মতো চটে যদি থাকেন, সেটা গোপন থাকবে না। অবশ্য বড়সড় যে কেউ কোনো অপঘাতের মুখে পড়লেই রাজার জানলুটের কথাটা কেউ না কেউ বলে ওঠে।

জানলুট একজন নাকি একাধিক, নারী না পুরুষ, কুঞ্জরগিরিয়া নাকি হাকুচরাটি, বাঘভূমি নাকি কামটচরি, সে কথা রাজা ছাড়া আর কেউ জানার কথা নয়। লোকে গোলটা সেখানেই বাঁধায়, বড়সড় অঘটন ঘটলে ধারেকাছে উপস্থিত যে কোনো লোককে রাজার জানলুট বানিয়ে দেয়। কুঞ্জরগিরিতে একবার ভূঁইয়ামশায়ের পিঠাপিঠি ভাই, বদরাগী শালতোড় সায়েবের তাঁবুর ওপর গাছ আছড়ে পড়লো। শীতে গাঁয়ে গাঁয়ে খাজনার হুড়ো দিতে বেরিয়েছিলেন, দমকা-বাতাস-বুনো-হাতি-কাঠপোকা কোনো কিছুর উৎপাতই ছিলো না তখন। আগের রাজা তখন হামজ্বর থেকে উঠেছেন, নতুন রাজা বাছার গল্প রটে গেছে চারদিকে, এমন পরিস্থিতিতে শালতোড় সায়েব শালগাছেরই নিচে থেঁৎলে মরায় কুঞ্জরগিরি অস্থির হয়ে উঠলো। ভূঁইয়ামশায়ের বড় ছেলে তখনও নাবালক, তিনি রাজা হলে কুঞ্জরগিরির ভূঁইয়াগিরি গিয়ে পড়তো ভাই শালতোড়ের ওপরই। আর শালতোড় যে বেজায় মারমুখো ঝামেলাবাজ লোক, সেটা কুঞ্জরগিরির ভেতরে-বাইরে সকলেই জানে। মুনিসন্ধের হাতিবাহিনীর চৌদ্দ আনা যোগায় কুঞ্জরগিরি, শালতোড় তার নিয়ন্ত্রণে থাকলে রাজ্য জুড়ে ঝামেলা বাঁধতোই। কাজেই রাজার জানলুট এ ঘটনার ফোকলা অংশে একেবারে খাপে খাপ এঁটে যায়। তাছাড়া, ফর্সা লম্বা এক অচেনা কাঠুরেকে মাসখানেক আগে এ এলাকায় ঘুরঘুর করতে দেখেছে কাছের গাঁয়ের লোক। এক মাস আগে কেটে রাখা গাছ কী করে এক মাস ঠায় দাঁড়িয়ে বেছে বেছে ঠিক শালতোড়ের ওপরই গিয়ে পড়বে, সে বিশ্লেষণ যারা করতে গেছে, তারা ভুগেছে। বেশি বুদ্ধি কপচে ভালো গল্প টকায় যারা, সমাজে কেউ তাদের ভালোবাসে না।

অবশ্য সে যাত্রা আমাদের ভূঁইয়া, শমশের মাতং, রাজা হননি। আগের রাজা হামের পর আবার গা ঝেড়ে উঠে বসে বছরপাঁচেক রাজত্ব করে গেছেন। তিনি অকালে গলায় খাবার আটকে না মরলে হয়তো এখনও রাজা থাকতেন, কে জানে। গোঁফ পুরো পাকার পর কেউ আর রাজা থাকবেন না, মুনিরা এমন বিধি পাকা করে গেছেন, আদ্যিকালের চুক্তিমাফিক তিন বছর পরপর সব ভূঁইয়া-রাও-দেশমুখরা খুব ধুমধাম করে এসে তাই তেলে-জলে-ক্ষারে-মদে মহারাজের মুখ ধুইয়ে কাঁচা গোঁফের অস্তিত্ব পরীক্ষা করে দেখেন। গাছতলার মুরুব্বিরা মুনিদের রাখা শক্ত নামেই ডাকেন সে পরবকে, গুম্ফক্ষালন; আমলোকে বলে মোচমাজি। রাজদ্বীপ তো বটেই, রাজ্যগুলো থেকে রাজধানী বরাবর পথের শেষ নগরগুলোও তখন ভিনভুমোদের পদচারণায় গমগম করে।

এ বছর মোচমাজি আছে সামনেই, বসন্তে।

পেছনে হঠাৎ বিরাট হল্লা শুরু হলো, "পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে!"

আমা-দের ধমক শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, সারিতে দাঁড়ানো নারীপুরুষ সবাই সারি ভেঙে ফের গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তবে এবার সবার মুখেই কমবেশি স্বস্তি আর খুশির ছাপ। উলটকেতুর ধমক ভেসে এলো জনগোল্লার মাঝ থেকে, "সারিতে খাড়াও সবাই, সারিতে খাড়াও! আরে এহনই সব খতম নাকি?"

আমা দলশির বাঘরার সঙ্গ ফেলে গটগটিয়ে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে পড়লো। গরম বেলের পানার বাকিটা গিলবো নাকি সড়কি হাতে বাঘরার সামনে খাটনিতে অটল থাকার ভান করবো, ঠিক করতে না পেরে উম্বারাখার দিকে ফিরে দেখি, দুনিয়াদারি ভুলে শিঙাদারের সাথে মাটিতে কাঠি দিয়ে কী এক হিজিবিজি ছক কাটছে সে। বাকি রক্ষীরা উলটকেতুর হুকুমের অপেক্ষায় কান পেতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আশেপাশে।

টংদোকানি হতাশ গলায় বললো, "উম্বা রক্ষা করো! এত জলদি পেয়ে গেলো?" একটা ঘণ্টা তুলে সজোরে নেড়ে সারিভাঙাদের মনোযোগ কাড়ার চেষ্টা করলো সে, "চাই বেলেরররররর পানাআআআআআ!" লাভ হলো না তেমন, সবাই উৎসুক চোখে তাঁবুর দিকে চেয়ে।

এক আধবুড়ো লোকের কাঁধ পাকড়ে রেখেছে আমা-দের একজন, সে চেঁচিয়ে উঠলো, "আমার মেয়ে জীবনে কোনোদিন জাদুগীরের কেল্লার কাছে ঘেঁষেনি! থানশির সায়েব, লুম্ফার গজব পড়বে তোমাদের মাথায়! নিরীহ নিষ্পাপ লোকজনের আব্রু নিয়ে ছিনিমিনি...।"

বাঘরা দুগ্না কদম ফেলে এগিয়ে গিয়ে আধবুড়োর মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু গলায় কী যেন বললো, লোকটা থেমে গিয়ে হাতে চোখ মুছতে লাগলো।

দলশির একটু ভ্যাবলা মুখে বেরিয়ে এসে কেশে চড়া গলায় বিচিত্র টানে ভাঙা আমলোকি বুলিতে বললো, "ছোকরির পাছে জনমদাগ আছে। কিন্তুক তিনকোণা নহেক, ছেয়কোণা!"

মানুষের গোল্লাটা সরবে গুজুগুজুর করে যাচ্ছিলো, দলশিরের কথা শুনে কয়েক বিপলের জন্যে চুপ করে গেলো সবাই, তারপর ফের দ্বিগুণ আওয়াজে গুজগুজিয়ে উঠলো সবাই। উলটকেতুর উল্লসিত গলা শুনতে পেলাম, "কৈছিলাম না? আরে এইসব জঘন্য ব্যাফার এত জলদি শ্যাষ হৈব নাকি... সারিতে খাড়াও কৈলাম!"

টংদোকানি হাঁপ ছেড়ে বললো, "উম্বা রক্ষে! যাক বাবা, বিক্রির মাল বাসি হবে না। ...দুটো শুঁটকিপাটি দাঁতে কেটেই দ্যাখো না ভায়া? খালি পেটে কি লোক ঠেঙিয়ে পোষায়? তোমার বুড়োদেও কী বলে?"

আমি একটু চমকে গিয়ে খোলায় বড় চুমুক দিয়ে শুধালাম তাকে, "কী রে বুঝলে, আমি বুড়োদেওকে পূজি?"

দোকানি দাঁত বের করে বুকের সামনে আঙুল দিয়ে হাওয়ায় একটা গোল দাগ কাটলো। আমি একটু শরমে গিয়ে একটা শুঁটকিপাটির ফরমায়েশ দিলাম বিড়বিড়িয়ে। কুঞ্জরগিরিয়াদের এ এক ছেলেবেলার অভ্যাস, বুকে বুড়োদেওয়ের নামে চক্কর আঁকা। বাঘাবটের হাওয়া-জলের ঝাপটায় আমার মাঝে কুঞ্জরগিরির অনেক গ্রাম্যতা-জঙ্গুলেপনা ধুয়ে গেছে গত ছ'মাসে, বুড়োদেও চিহ্ন হয়ে টিকে আছেন। গাছতলার মুরুব্বিরা দেখলে খুশি হতেন হয়তো, বিশেষ করে বুড়োহিত জেঠু। পইপই করে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন তিনি, নগরের বেলাল্লাপনায় মজে যেন বাপপিতামোর ভজন-পূজন না ভুলি। "ঐ ত্রিনীতি না কী যেন বলে, ওসবে কান দিবি না!" একটা তাবিজ আদ্ধেক দামে গুঁজে দিয়েছিলেন তিনি আমার হাতে। "জলে জঙ্গলে যেখানেই বিপদে পড়বি, বুড়োদেওকে স্মরণ করবি। আর দশজনকে মানত করতে ঐ উম্বাগুম্বা না কী যেন বলে ওসবের থানে সারি বাঁধতে দেখলেই তাদের পিছে এগারো হবি না। বড় নগর, পৌঁছেই ঢুঁড়বি এ-গলি ও-গলি, কোথাও না কোথাও বুড়োবাওয়ার থান থাকবেই। সেখানে যা খর্চা করার করবি।"

বাঘাবটে পৌঁছে নগর ঘুরে দেখার সুযোগ পেতেই কেটে গেছে দুটো মাস। পুরো কুঞ্জরগিরি থেকে শমশের মাতঙের চাঁদা হিসেবে দু'শ জওয়ান রাজার খাতায় নাম তুলেছি গত ফাল্গুনে। তার মাঝে বাঘাবটে এসেছি পঞ্চাশ জন; বাকিরা কেউ রাজদ্বীপ, কেউ বাঘটিকর, কেউ কামটপত্তনের রক্ষীশক্তিতে বরাদ্দ হয়েছে। আমার গাঁয়েরই আরেক বিটকেল ছোঁড়া গেছে অশেষ গুজব আর গুলগল্পের অফুরান উৎস, গুলরঙ্গাবাদ নগরে; বুড়োদেও তাকে রক্ষা করুন। উলটকেতু আমার হাতে উর্দি, কোমরবন্দ আর সড়কি দিয়ে হাসতে হাসতে বলেছিলো, "অহন থিকা আমিই তগো ভূঁইয়া। তগো শমশের মাতং আমার বাঘাবটে কেউ না। মনে থাকবো?"

দু'মাস অনিদ্রা আর কড়া মারধর-দৌড়ঝাঁপ-ধমক-শাপান্তের ঠেলায় থানাদারের আওয়াজ পেলেই চোখে তখন সর্ষেফুল দেখতাম, উলটকেতুর কথায় ঘাড় নাড়লেও মনের কোণে বিশ্বাসটা রয়েই গেছে, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। শমশের মাতং কুঞ্জরগিরির ভেতরে যেমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ, বাইরেও কমবেশি তেমনই। কুঞ্জরগিরির হাতি ছড়িয়ে আছে মুনিসন্ধের সব ভূমের হাতিশালে, তার মাহুতরা বংশপরম্পরায় মাতংদের হাতে ভাত খেয়ে হাতিতে চড়েছে। রাজদ্বীপে মহারাজ যদি যুদ্ধের কেতন ওড়ান, শমশের মাতংই হবেন হাতিবাহিনীর সালার। আর সামনের মোচমাজিতে যদি রাজামশায়ের গোঁফ সব পাকা পাওয়া যায়, শমশের মাতংই হয়তো হবেন পরের মুনিসন্ধরাজ।

তবে আমি আর কুঞ্জরগিরির নই। আমরণ আমি এখন বাঘাবটের রক্ষী। মুক্তি মিলবে যদি কোটাল মশায় সসম্মানে আমায় ছাড়েন, যেটা সামনে আড়াই যুগের মধ্যে ঘটার সম্ভাবনা খুব কম। "হাত-পাও খোয়াইলেও সমস্যা নাই!" উলটকেতু একেবারে শুরুতেই হেঁকে শুনিয়েছে নতুনদের। "থানার আস্তাবল সাফ করনেল্লিগা একটা হাতৈ যথেষ্ট। পাও কম পড়লে থানায় বইয়া মাইনষের সড়কি ধার দিবি। চোখ একটা কানা হৈলে অট্টালে চৈড়া নজর রাখবি আরেকটা দিয়া। জান গেলেগা ফলবাগানে গোর পাবি, বাদবাকিগো আমকাঁঠালে রস যুগাবি।"

বুড়োদেওয়ের থান বাঘাবটে আছে অবশ্য, যেমন আছে আরও কুড়িখানেক দেওথান। নগরের বুড়োহিতও বাঘাবটি, তার স্বভাবটিও অকরুণ। প্রথম মাসের বেতন আদ্ধেকটাই বেরিয়ে গেছে শুদ্ধি-অর্চনায়। গ্রামে বুড়োদেও যেমন সস্নেহ আর সস্তা, নগরে তিনি যেন তেমনই রুখাশুকা আর খরুচে। উম্বারাখাকে টহলসাথী পাওয়ার সুবিধার পাশাপাশি জ্বালাও আছে, প্রায়ই সে আমায় উম্বার থানে যেতে উসকায়। "আরে বোকচাঁদ, আমাদের উম্বা-লুম্ফা-ধুম্পা তো তোমাদের বুড়োদেওয়েরই তিন টুকরো।" বুড়োহিত জেঠুর বারণের কথা শুনে দেঁতো হেসে ভেঙিয়েছে সে। "বুড়োদেও যখন গড়েন, তখন তিনি ধুম্পা। যখন লালেন-পালেন, তখন তিনি উম্বা। আর যখন মারেন, তখন লুম্ফা। আস্ত বুড়োদেওকে না জ্বালিয়ে তার কোন দিকটায় তোমার দরকার, সেদিকের দোরে গিয়ে ধর্না দাও।"

এই ত্রিনীতি থেকেই বুড়োহিত জেঠু হুঁশিয়ার করেছিলেন আমাকে, তাই উম্বারাখার উসকানিতে কান দিই না আমি। কোন হতচ্ছাড়া কোপ দিয়ে দেওতা ভাগ করেছিলো, কে জানে, কিন্তু কুঞ্জরগিরি থেকে বেরোতে না বেরোতেই এই উৎপাত দেখে আসছি। বাঘাবটে উম্বার বেশ রমরমা, আশেপাশের গাঁয়ে ফসল তোলার মৌসুমে ধুম্পার খাতিরের ধুম পড়ে যায়, আর লুম্ফার কদর দেখেছি কেবল লাশের ঘের আর জল্লাদচৌকে। বাঘাবটের বাকি থানগুলোয় নানা অচেনা দেও টিকে আছে এখনও, পুরনো কোনো রাজা বা সামন্তের পৃষ্ঠপোষকতার সাক্ষী হয়ে। কোনোটাই একেবারে ফাঁকা যায় না যখন, বোঝা যায়, বাঘাবটে বহু যুগের বহু ভূমের লোক এসে আস্তানা গেড়েছে।

তাম্রকেশিনীদের সাথে নিয়ে পুরুষরা আবার বেজার মুখে সারি বেঁধেছে, উৎফুল্ল উলটকেতু গটমট পায়চারি করছে এদিক-সেদিক। হয়তো অপেক্ষা করছে সে, আমারা কখন একটু হয়রান হবে, কিংবা নাইতে যাবে, তখন সে ফের স্বহস্তে তিনকোণা দাগ খুঁজবে আবার।

ঘাটে আরো নৌকা এসে ভিড়ছে, সেগুলো তল্লাশি করে তামাচুলো তরুণীদের অভিভাবকসহ এদিকে ঠেলে পাঠাচ্ছে রক্ষীরা, উম্বারাখা নৌকায় বসে শিঙাদারের সাথে আলাপ করেই যাচ্ছে, খেয়ার দেখা নেই এখনও। সাথে মেয়ে নেই এমন যাত্রীদের ক'জন গটমটিয়ে এগিয়ে এসে পানা-পিঠা হাঁকলো, টংদোকানি হৃষ্টমুখে ঝুড়ি থেকে পাটখড়ি বের করে চুলোয় গুঁজলো। শুঁটকিপাটিতে বড় কামড় দিয়ে ঠকে গেলাম, বেজায় ঝাল; আরেক খোলা পানা না খেলে চলছে না।

"...বজ্রপটাশের বাঁদি কোন দুঃখে উজানে পালাবে, বলো তো ভায়া?" এক মাঝবয়েসী লোক হেঁকে শুধালো দোকানিকে। "ভাটিতে সটকালে স্রোতে-দাঁড়ে হেসেখেলে দু'দিনেই কামটচর গিয়ে ঠেকবে, ঐ বাদাভূমে কে ওকে খুঁজে পাবে? আর উজানে সারাদিন দাঁড় বাও আর গুণ টানো, এ শরতে প্রহরে এক দণ্ড বাতাস পালে পাবে কি পাবে না, বাঘাবটে আসতেই এক দিন লেগে যায়, বাকি বাঘভূমের কথা বাদই দিলাম। আর ফর্সা মেয়ে পালিয়ে হাকুচরাটে যাওয়া মানে কাদার মধ্যে শালুক হয়ে ফোটা।" হাত নেড়ে পেছনের আয়োজন দেখালো সে, "সব লোকদেখানো।" জ্বলন্ত এক চাহনি হেনে আমাকে খানিক দগ্ধে মুখে তালের পিঠা পুরলো সে, "ভদ্দরঘরের ঝিদের গতর হাতানোর ছোটলোকীয় ষড়যন্ত্র সব।"

দোকানি মাথা দুলিয়ে বললো, "মোক্ষম বললে ভায়া, মোক্ষম।"

এক যুবক সতৃষ্ণ মন্দ চোখে সারিতে দাঁড়ানো মেয়েদের দেখে নিয়ে চিংড়ির পুলিতে কুমিরি কামড় বসিয়ে বললো, "আচ্চা, হুলিয়ায় তামাচুলের কতা বলে লাভ কী বলো তো ভায়া? বাজারে কত রঙের কলপ মেলে, তা জানো? জাদুগীরের গুদামেও শুনিচি কত কিসিমের আরক-মলম-আবীর-অরিষ্ট ভাঁড়ে ভাঁড়ে ভাঁড়াক্কার সালা! ঐ বাঁদি মাগীটা কলপ মেখে তামা চুল কালো করে সটকায়নি, সেটাই বা ভাবচো কেন?"

টংদোকানি অনেকদূর খবর রাখে, জবাব শুনে টের পেলাম, "ঐ দানোর ঝিগুলো সঙ্গে কলসি কলসি সিরকা এনেছে। মেয়েদের চুল এক আঙুল করে কেটে সিরকায় ভিজিয়ে দেখছে, রং বেরোয় কি না। কলপের সাধ্যি নেই টেকে।" ফুটন্ত পানিতে বেলশুঁঠ আর পাতার গুঁড়ো ঢাললো সে মাপা হাতে। "আর চুলে না হয় কলপ দিলে, জন্মদাগ ঢাকবে কী করে?"

মন্দনজর যুবক কেমন এক খাচ্চর হাসি হেসে বললো, "মেয়েদের সাজগোজ নিয়ে রাজদ্বীপে কী হয়, জানলে এ কতা বলতে না ভায়া। আলোমাসির নাম শুনেচো? হাকুচরাটি বাদুড়কালো মেয়েকে পাঠাও একবার রাজদ্বীপের আলোমাসি ত্বকশালে। একটি বেলা পার করে তাকে দিনের আলোয় বের করে দেখো। মনে হবে মেঘভূমের রাওকন্যা বুঝি এলেন নগরে, ফর্সা টুকটুকে একেবারে।" একটা শুঁটকিপাটির দাম চোকালো সে। "জন্মদাগ তো কোন ছার, নাভি পর্যন্ত হাপিস হয়ে যাবে আলোমাসির মলমে।" নিজের কথায় নিজেই শিউরে উঠলো সে, অথবা শুঁটকিপাটির ঝালে।

আরো লোকজন এসে ভিড় করছে টংদোকানে, সবাই কেমন যেন উশখুশিয়ে উঠলো। এক ছোকরা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, "তা বাঘাবটে এমন বন্দোবস্ত নেই ভায়া? আলোমাসি এখানে কোনো শাখাটাখা মেলেছেন কি?"

ভাটিপন্থী মাঝবয়েসী পানায় ফড়াৎ করে এক চুমুক দিয়ে বললো, "আরে ধেত্তুরি আলোমাসি! ঐ বাঁদি জাদুগীরের কেল্লা ছেড়ে সবাইকে দেখিয়েই বেরিয়েছে। লাগোয়া ঘাটে এক দণ্ড বসে দারোয়ানের সঙ্গে রঙ্গঢঙ্গও করেছে। তারপর খেয়া ধরে ভাটির ঘাটে গিয়ে পাতাম নায়ে চড়েছে আর দশজনার সাথে। সাক্ষীর অভাব পড়েনি।"

আমার মাথায় প্রশ্নটা অনেকক্ষণ ধরেই কামড়ে যাচ্ছিলো, শুধিয়েই ফেললাম, "বজ্রপটাশের গুদাম থেকে কী চুরি গ্যালো বদ্দা?"

বদ্দা তড়পে হেসে উঠলো পানার মায়া ছেড়ে, "শুনলে? তোমরা শুনলে? রাজার ঠোলা আমলোককে শুধায়, কী চুরি গ্যালো!" আমাকে আপাদমস্তক ফের এক পশলা দগ্ধে চিংড়িপুলির ঝুড়ির দিকে দুটো আঙুল তাক করলো সে, "কী যে ছাই চুরি গেছে খোদ বজ্রপটাশও জানে না। তার গুদামের সব কুম্ভ এলোমেলো, আদ্ধেক ভেঙে মাটিতে গড়াগড়ি, বাকি আদ্ধেকের গায়ে সাঁটু ঐ ছুঁড়ি পুড়িয়ে রেখে গেছে। আদ্ধেক সিন্দুকের তালা খোলা, বাকি আদ্ধেকের চাবির ফুটোয় দেওদারের কষ ঢেলে থুয়ে গেছে। জাদুগীরের গালিচা লাপাত্তা, দুনিয়া দেখার কাচের গোল্লায় নাছোড় কালি মাখা, দত্যির চেরাগ টাটকা নেহারির হাঁড়িতে চোবানো।" থাবা দিয়ে একটা পুলি মুখে পুরলো সে। "আসার পথে নায়ের বাকি লোকে বকে বকে মাথাটাই ধরিয়ে দিলো। কখন জাদুগীর গালিচায় চড়ে চক্করে বেরোবে, না জানি কী তেলেসমাতি দেখাবে, বাঁদির সাথে খুব লড়াই জমবে, হ্যানো ত্যানো। আরে খোদ কেল্লায় নিজের ডেরায় বসে একটা ছুকরির হাতে কাবু হয় যে লোক, সে গালিচায় চড়ে কী হাতিঘোড়া মারবে?" আশেপাশে কী যেন খুঁজলো সে। "ও ভায়া কোটালের এঁচোড়, ঘাটে বাজির টং বসে না তোমাদের নগরে?"

আমি গুড়বচন বাঘরার দিকে আঙুল তুলে গলা নামিয়ে বললাম, "গুড়বচন বাঘরা। নাম শুনেছো?"

বদ্দা একটু সিঁটিয়ে গেলো। "আচ্ছা, থাক বরং।"

আলোমাসির শাখাপিয়াসী ছোকরাটা ফুঁ দিয়ে পানা জুড়াচ্ছিলো, সে মিনমিনিয়ে বললো, "আমার খুড়ো বলছিলেন, হালে নাকি রাজ্যে এখানে ওখানে অনেক নতুন জাদুগীর মাথা চাঁড়া দিয়েছে। তাদেরই কেউ কাজটা করিয়েছে নির্ঘাত। এমন ঘটনার পর বজ্রপটাশের চাকরিই টিকবে না।"

মন্দনজর যুবক এক পাশে কাত হয়ে সারির একটি তরুণীকেই পেছন থেকে খুঁটিয়ে দেখছিলো, সে গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বললো, "জাদুগীরের চাকরি আর জান গায়ে-গায়ে বাঁধা রে খুড়োর ভাতিজে! কখনও শুনেচিস, রাজা খেদিয়ে দেওয়ার পর জাদুগীর সেলাম ঠুকে ভদ্দরলোকের মতো দরবার ছেড়ে কাউকে না জ্বালিয়ে না ঘাঁটিয়ে কারো গাঁড়ে কাঠিটি না সেঁধিয়ে নিরিবিলি চরে বেড়াচ্চে? জখম জাদুগীরেচ্চে খতরনাক হোলো গ্যা তোর খারিজ জাদুগীর। খেদিয়ে দিলে সে সবার আগে রাজামশায়ের অনিষ্টি করবে।"

আরো লোক এর মধ্যে এসে ভিড় করেছে টংদোকান ঘিরে, এক বুড়ো খনখনিয়ে উঠলো, "এহ, এসেছে বিরাট জ্ঞানরত্ন! কেন সেই যে যখন দারাউস গুলের আমলে বজ্রপটাশের নানা, মানে আমাদের গোখরাদির মামু, জাদুগীরের চাকরি থেকে সটান বিদায় হলেন? হুকুম শুনে টুঁ শব্দটি করেননি, চুপচাপ ভাগ্নির হাতে চাবির গোছা দিয়ে মেঘভূমে ফিরে গেলেন। জাদুগীরের লাগাম রাজার হাতে না থাকলে জাদুগীররাই রাজা হতো মুনিসন্ধে।"

মন্দনজর মন্দতর নজরে বুড়োকে খানিক মেপে ফের কাত হয়ে সারিতে চোখ রাখলো। বুড়ো শুঁটকিপাটিতে কামড় দিয়ে ডুকরে উঠলো, "রাজাকে দুবলো ভাবিস তোরা? আরে চতুর্পাশে চেয়ে দ্যাখ। কুঞ্জরগিরির শমশের মাতং তার হাতি নিয়ে একবার গাং ডিঙালে রাজদ্বীপ টিকতো? গুলভূমের আক্সার গুল তার সব ঘোড়া পুবদিকে দাবড়ালে? কামটচরের লুম্ফাদাস কামট তার ডিঙ্গাবহর উত্তরে ঘোরালে? হাকুচরাটের মোবেম্বে খডগা তার তিরন্দাজদের নিয়ে জঙ্গল পেরোলে? বাঘভূমের ক্ষীরভাষণ বাঘরা তার পদাতিকদের দক্ষিণে ঠেললে?" হাতের ছড়ি টঙের তাকে ঠেসিয়ে দু'হাতে খোলে চুমুক দিলো সে, "রাজার হাতে ঐ ডাণ্ডা-কেতন ছাড়া রাজদ্বীপে আর আছেটা কী, বল তো শুনি?" একবার আমা-দের দলটাকে মন দিয়ে দেখে নিলো সে। "ঐ ধুমসীগুলোর ভরসায় তো আর মুনিসন্ধ চলে না। ছোটবড় সবার টিকি রাজার আঙুলে বাঁধা। জাদুগীরকে খেদাতে হবে না, সে নিজেই গালে চুনকালি মেখে ইস্তফা দেবে।"

গাছতলার মুরুব্বিরা অবশ্য বলতেন, মুনিসন্ধের রাজা জরির জামাপরা ফকির, মুখবাঁধা কুমির, খাদঘেরা হাতি, পিঞ্জিরার বাঘ। তার কাজ একটাই, বাকি ভূমের রাও-ভূঁইয়া-দেশমুখের সামনে এই ফকিরি জাহির করা, যাতে তারা কেউ রাজা হতে না ক্ষেপে, যে যার ভূমের কর্তৃত্ব নিয়ে তুষ্ট থাকে। মুনিকূটের মুনিরা ছোটো পাঁচটা রাজ্য মিষ্টি কথায় জুড়ে মুনিসন্ধ রাজ্য তৈরি করার আগে এখানে নাকি শকুনের জ্বালায় কাক ভিড়তো না, এক ভূমের সাথে অন্যের এমনই কড়া মারপিট লেগে থাকতো বছরভর। বর্ষায় কামটচরের দুর্ধর্ষ নৌসেনা তাদের রণডিঙ্গা নিয়ে একেবারে উত্তরে মেঘভূমের গোড়ায় গিয়ে বাঘরা-প্রজাদের লুটতো, শরতে কুঞ্জরগিরি থেকে হাতির বাহিনী কামটচরে হামলা করতো, হেমন্তের শেষে গুলভূম থেকে অশ্বারোহীর স্রোত এসে গ্রাস করতো যা কিছু পুবে আছে, হাকুচরাটিরা সারা বছর মাঝারি দল বেঁধে টুকিটাকি চোরাগোপ্তা লুটপাট চালিয়েই যেতো। আরো দূরের রাজ্যগুলোও বসে থাকতো না, মকরধামের বিরাট রণতরী এসে কামটচর ছারখার করতো, উরবার থেকে সায়র পেরিয়ে দানবরা এসে গুলরঙ্গাবাদ গুঁড়ো করতো দুই যুগ পরপর, আণবদের ঘোগবাহিনী পাহাড় থেকে নেমে কুঞ্জরগিরি ছারখার করতো কয়েক বছর পরপর, বিরদিসোমের টুকুনরা মহিষে চড়ে হাকুচরাটিদের গ্রাম ছাই করতো যখন-তখন। এমনকি নিরিবিলি মেঘভূমের জটায়ু রাজবংশের ফর্সা হাতেও প্রচুর লুটের কালিমা লেগে আছে।

মুনিসন্ধ রাজ্য পত্তনের পর পাঁচখানা ভূম প্রথমবারের মতো সবাই সবার হাতে হাত মিলিয়ে লড়াইটাকে বাইরের দিকে নিয়ে যায়। কামটচরের ভূঁইয়ারা রাজ্যের সমুদ্র আগলে আছে তখন থেকেই, হাকুচরাটের তিরন্দাজরা তাদের সঙ্গে ভেড়ায় মুনিসন্ধের নৌশক্তির চেহারাই পাল্টে গেছে, মকরধাম এখন আর এসে মস্তানি করার সাহস পায় না। কুঞ্জরগিরির কুঞ্জরানীক এখন গুলভূমের কূল পাহারা দেয়, উরবারের দানব রাজা এদিকপানে ঘেঁষেনই না আর। বাঘভূমের পদাতিকরা কুঞ্জরগিরির সীমান্তে আণব দস্যুদের ঠেঙিয়ে জব্দ করছে সেই কবে থেকে, গুলভূমের অশ্বানীকের দাপটে বিরদিসোমের কাঁড়া বংশের রাজারা মহিষের পিঠ থেকে পালান নামিয়ে জোয়াল তুলে আসছেন নিষ্ঠার সাথে। মুনিরা বলেছিলেন, একতাই বল। কথাটায় দম আছে বলেই বাঘভূমের গুড়বচন বাঘরার তত্ত্বাবধানে গুলভূমের উলটকেতুর হুকুমমাফিক কামটচরের উম্বারাখার কাঁধে কাঁধ দিয়ে বাঘভূমের দক্ষিণে গোলমেলে গাঁওগেরাম আর বদলোকঘন বাঘাবট নগরের অলিগলি টহলে আগলে রাখছি আমি, কুঞ্জরগিরির শম্বরাদ। আর আমাদের সবার ওপর আগুন হয়ে জ্বলছেন হাকুচরাটি কোটাল রোঙ্গোরোঙ্গো মহাশয়। শুধু দমসম্পন্ন কথাই বলে যাননি মুনিরা, কিছু কায়দাও বাৎলে গিয়েছেন, নইলে রাজদ্বীপে মহারাজ দেওদোস্ত কামট শুধু গদিতে বসে রাজদণ্ড নেড়ে এই আন্তর্ভৌম মিত্রতা টিকিয়ে রাখতে পারতেন না।

বুড়োহিত জেঠু একদিন গাছতলায় বসে সংক্ষেপে বলেছিলেন, মুনিসন্ধে রাজার ছেলে রাজা হয় না বলে দেশমুখ-রাও-ভূঁইয়ারা রাজা বনতে পেগ্লে ওঠে না।

[মৃদু চা বিরতি]



ঝাঁঝমুলি = Horseradish, Armoracia rusticana


Comments

মেঘলা মানুষ's picture

চা চু তাড়াতাড়ি খান।
আর, "মৃদু চা" খাইবেন কেনু, বিরতি নিয়া যখন খাইতেছেন যখন কড়াটাই খান খাইছে

উম্ফালুম্ফার নাম জানতাম, কিন্তু ধুম্পা কিভাবে যুক্ত হইলো? উম্ফালুম্ফাদের মইধ্যে যারা বিড়ি-সিরকেট খায় তারাই বুঝি উম্ফালুম্ফাধুম্পা!

হিমু's picture

উম্ফালুম্ফা বলে কোনোকিছু চিনি না। উম্পা-লুম্পা ছিলো রোয়াল ডালের গল্পে। এখানে উম্বা-লুম্ফা-ধুম্পা, তার কী-কেন-কীভাবে জানতে হলে আপনিও চায়ের পানি গরম দেন।

মন মাঝি's picture

আমিও পানি গরম দিলাম। আপনার বিরতি তাড়াতাড়ি শ্যাষ করেন!!!

****************************************

হিমু's picture

এককাপ সা নাহয় পেলেন, কিন্তু একটা সপেরও তো বন্দোবস্ত করা উচিত, নাকি?

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

ধূমায়ূধটা শেষ করেন বাহে! মইরা গেলে স্বর্গ না নরকে যাই তার নাই ঠিক। আর সেইখানে সচল পড়তে পামু কিনা তারও নাই ঠিক। তাই আমি বাঁইচা থাকতে থাকতে ধূমায়ূধ শেষ করেন। চণ্ডীশিরার ব্যাপারে অসিয়তনামাতে লিখা যাইতে হইবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হিমু's picture

আচ্ছা দেখি, এটা শেষ করেই ধূমায়ুধের পানি আবার গরম দিবো। আপনারাও বড় দেখে একটা ডেগে চায়ের চামচে পানি ভরে পাশে থাকুন।

জে এফ নুশান's picture

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

যদ্যপি অতি জঘন্য ব্যাফার, তদ্যপি কাহিনী জানার জন্য মৃদু চা চু খাওয়ার বিরতিটাও অসহ্য বোধ হচ্ছে।

হিমু's picture

আরেকটু ধজ্জি ধরেন, গল্পের পরবর্তী প্যাঁচ নজদিক। অবসরে বখে না গিয়ে আমার পুরানা কোনো লেখা পড়ে নিন্দাবাদ জানিয়ে আসতে পারেন।

এক লহমা's picture

গল্প যেমন যেমন এগোচ্ছে, এসে এসে পড়ে যাচ্ছি। দেঁতো হাসি

এইটা সবচেয়ে মনে ধরেছে - "মুরুব্বিদের কথা শুনতে হবে, না শুনলে পরে নিজে বড় হয়ে ফালতু বকার শিল্পটাই রপ্ত হবে না, আর সেটা রপ্ত না হলে এত খেটেখুটে ঠেকেঠকে বেলা শেষে মুরুব্বি হওয়াটাই বৃথা।" হো হো হো

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

হিমু's picture

আজ তো তাহলে আরেকটু লিখতেই হয়।

নীড় সন্ধানী's picture

চা খাওয়া শেষ হইতে আর কত দেরী পাঞ্জেরী?

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু's picture

ছবিটবি এঁকে আরো হাজারতিনেক শব্দ এ সপ্তাহান্তে নামিয়ে দেবো ভাবছিলাম, কিন্তু কয়েকটা দারুণ বই হাতে পেয়ে পড়ে যাচ্ছি সমানে।

দেখি এক লোকমা দুই লোকমা করে আরো খানিকটা লিখে ফেলবো। আপনি সে অবসরে কিছু লিখে ফেলুন না? তবে চায়ের বদভ্যাস কইরেন না, শুনেছি গায়ের রং কালো হয়ে যায়।

এক লহমা's picture

বছর শেষে হঠাৎ পাওয়া এক ফাঁকা সময়ে আজকের সর্বশেষ পড়াটা পড়ে ফেলা গেল। ছোট হোক, চলছে ত! হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

হিমু's picture

অনেক ইচ্ছা থাকার পরও বছরটা কেমন যেন বাচ্চু রাজাকারের মতো হাতের মুঠো ফসকে পালিয়ে গেলো। দেখি জানুয়ারির মধ্যে বাকি আদ্ধেক (বা দুই তৃতীয়াংশ) লিখে শেষ করতে পারি কি না। নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

এক লহমা's picture

খুব ভালো সংকল্প হাসি

আমাদের এখানে ২০২০ এসে গেল। নতুন বছরের শুভেচ্ছা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সোহম্পাল's picture

আগুনি পড়ার মধ্যে এইটার সন্ধান পেলুম। লেখকের মাঝেমধ্যেই চা খেতে যাওয়ার অভ্যাস আছে মনে হচ্ছে। দোহাই মোয়াই, আপনার বাঙালী টোলকিন হবার পূর্ণ সম্ভাবনা আছে, আপনি বাঙালী মার্টিন হবেন না যেন!

হিমু's picture

দ্য হবিট প্রকাশের পর লর্ড অফ দ্য রিংস লিখে শেষ করতে টোল্কিন সময় নিয়েছিলেন ১২ বছর, ছাপাতে আরও ৫ বছর, মোট ১৭ বছর। মার্টিনবুড়োর বিরতি এখনও তারচেয়ে কম*, কিন্তু বেচারা সেই যে বদনাম কুড়িয়ে আসছেন, আর থামাথামি নেই। বিরতির জন্যে কানমলা যদি দিতেই হয়, টোল্কিনদাদুরই তা প্রাপ্য।। তবে 'বাঙালি টোল্কিন' হওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।

আমি মাঝেমাঝেই কিছু গল্প আংশিক লিখে চা গিলতে চলে যাই। এর অসুবিধার ভার আমার প্রিয় পাঠিকা-পাঠকরা খানিক বইতে বাধ্য হন, সে বাবদ আমি অপরাধী। এর সুবিধা (যা আমি স্বার্থপরের মতো একা ভোগ করি) হচ্ছে, আমি পরে ফিরে এসে গল্পটাকে নতুন চোখে আবার মাপতে পারি। ততদিনে আমার মাথায় আরও কিছু চিন্তা জমে, যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি গল্পটাকে কীভাবে কতদূর লিখে শেষ করবো (বা আদৌ করবো কি না)। গল্পের নতুন সংস্করণটা তখন প্রথমটার চেয়ে একেবারেই ভিন্ন হতে পারে, কলেবরে বেড়ে সে উপন্যাসিকা/উপন্যাস হয়ে উঠতে পারে, কিংবা তার পাঁজরের হাড় খুলে নিয়ে অন্য কোনো গল্পে গুঁজে দেওয়া যায়। এমন অপূর্ণাঙ্গ গল্প প্রকাশ না করে নিজের কাছে রেখে দেওয়াই হয়তো সমীচীন, কিন্তু সাধারণত গল্প লেখা শুরু হয় শেষ করার সদিচ্ছা নিয়েই; 'চায়ের পিপাসা'টা মাঝপথে kick in করে।

এ গল্পটা শেষ করার ইচ্ছা আমার আছে, কিন্তু এটা লিখতে গিয়ে যে বিকল্প জগতের আবছা ছবি আমার মনে গড়ে উঠেছে, তার পটভূমিতে ভিন্ন স্বাদের কয়েকটা গল্প এখন লিখছি (হয়তো শিগগীরই আসবে)।


* ১০ বছর, যদি আ ড্যান্স উইথ ড্রাগন থেকে মাপেন। কিন্তু বিটকেলদাদু সম্ভবত অধীর পাঠককে চ্যাতানোর জন্যেই তাঁর সিরিজ় সামনে না বাড়িয়ে পেছনে ঠেলছেন; ফায়ার অ্যাণ্ড ব্লাড থেকে মাপলে ৩ বছর।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.