পরাবাস্তব

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture
Submitted by mahbub on Mon, 08/10/2018 - 10:06am
Categories:

সিয়াটল বিমানবন্দরে নেমেই ব্যাগ উদ্ধারের জন্য ছুটছি ট্রেনের দিকে। আমার পর পর হন্তদন্ত হয়ে উঠলেন এক মা আর তার ১১ থেকে ১৩ বছর বয়সী ছেলে। দেখে বোঝা গেলো ছেলেটার অটিজম আছে। মা ট্রেনে হ্যান্ডেলবারের সাথে ছেলেটার হাত চেপে রাখলেন।

ট্রেন চলা শুরু করতে ছেলেটা ট্রেনের দুলুনির সাথে তাল মিলিয়ে দোলা শুরু করল। মা লজ্জ্বায় কাঁচুমাচু হয়ে ছেলেটাকে থামানোর চেষ্ঠা করতে লাগলেন।

পরের স্টেশনে ট্রেন থামতে ছেলেটা নেমে যেতে চাইলে মা আটকাল। এতগুলো লোক নেমে এবং উঠে পড়ার হৈ-চৈয়ে ছেলেটা একটু অস্থির হয়ে উঠল। ট্রেন আবার চলা শুরু করতেই ছেলেটা অস্থির হয়ে দুলুনি শুরু করল আর আচমকা পাশের বয়স্ক ভদ্রলোকের লাল জ্যাকেটের চেইন ধরে টান দিয়ে বসল। ভীষণ লজ্জ্বায় মা তাকে ঠেকালো এবং দুঃখপ্রকাশ করল। লোকটা বলল এটা কোনো ব্যাপারনা, আমি বুঝতে পেরেছি।

মা ভীষণ লজ্জায় কান্না ঠেকাতে ঠেকাতে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। পারলে মাটির সাথে মিশে যান লজ্জ্বায়। অথচ ট্রেন ভর্তি লোকের কেউই কিন্তু কিছু বলেন। খারাপ দৃষ্টিতে তাকায়নি। আমি বলতে চাইলাম আপনি ভীষণ শক্ত। আমার আট বছর বয়সী ছেলেটারও অটিজম আছে। প্রতিনিয়ত এই লজ্জ্বা আমাদেরও পীড়া দেয়। কিন্তু জড়তা কাটিয়ে কিছু বলা হলো না।

গন্তব্য ট্রেন থামতেই মা-ছেলের পিছু পিছু আমিও নেমে পড়লাম। ছেলের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মা খুঁট করে চোখের কোনাটা মুছে নিলেন। আমি বলতে চাইলাম, মা আপনার এই দুঃখের একটা অংশ আমারও। আপনি ভীষণ সহনশীল। এতো সহজে হাল ছাড়বেন না। কিন্তু কিছু বলা হলো না।

এসকেলেটরে আমার ঠিক সামনে মা ছেলে দাঁড়ানো। মায়ের সারা মুখ জুড়ে মেঘ। এসকেলেটরের উপর প্রান্তেই দাঁড়ানো বাবা। দুজনকে স্বাগতম জানিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। এদিক মা অথৈ সাগরে ভাসছেন। আমার গলায় তখন একটা দলা পাকিয়েছে। অনেক চেষ্ঠা করেও বলতে পারলাম না আপনাদের কষ্ট শুধু আপনাদের না, সারা বিশ্ব সংসারের। ভালো থাকবেন আপনারা।

আমাদের প্রতিদিনের কষ্ট বহুল জীবনের ছোট একটা টুকরো আজ চোখের সামনে অভিনীত হতে দেখলাম। ভীষণ পরাবাস্তব এই দৃশ্য দেখেই পা রাখলাম সিয়াটলের মাটিতে। হ্যালো সিয়াটল। গুড বাই শিকাগো।


Comments

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

পশ্চিমে ফিরলেন তাহলে। আশা করি আপনাদের পশ্চিমের দিনগুলো 'দ্য উইন্ড সিটি'র দিনগুলোর চেয়ে ভালো হবে।

চাইলেও অনেক সময় সহমর্মিতা প্রকাশ করা যায় না। আচ্ছা নাইবা গেলো প্রকাশ করা, অনুভব তো করা যায়। এই অনুভবটুকুও যদি মানুষের মধ্যে থাকে তাহলে পৃথিবীটা অনেক সংবেদনশীল জায়গা হয়।

আমি আশা করতে চাই, আমাদের পৃথিবীতে সংবেদনশীল মানুষেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে। তারা যথাযথ আচরণ করবে। আমি আরও আশা করতে চাই, আমার জীবদ্দশাতেই বিজ্ঞান অতটুকু অগ্রসর হবে যাতে বিদ্যমান নানা প্রকার শারিরীক, মানসিক সীমাবদ্ধতাগুলো মানুষ অনায়াসে কাটিয়ে উঠতে পারে।

পাপুন্তুসের জন্য অনিঃশেষ শুভকামনা।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

ধন্যবাদ

সোহেল ইমাম's picture

ভাই আমাদের পাপুন্তুস কেমন আছে? অনেক অনেক ভালবাসা ওর জন্য।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

অনেক ধন্যবাদ।

 কাকাতুয়া's picture

আপনি কি পার্মানেন্টলি মুভ করলেন সিয়াটলে?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

হ্যাঁ

তিথীডোর's picture

পাপুন্তুসের আট চলছে! মনে হয় যেন এই তো সেদিন হয়েছিলো।

অনেক আদর রইলো ছানার জন্য।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

অনেক ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক's picture

আপনার ছেলের জন্য অনেক ভালোবাসা। অটিজম নিয়ে তেমন একটা জানিনা আমি। শুনেছি অনেক সফল মানুষেরই অটিজম ছিলো। ভাস্তে আমার সুখে থাকুক, সফল হোক।

---মোখলেস হোসেন

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

এটা একটা ভুল ধারণা। হাতে গোনা কিছু সফল মানুষের অটিজম থাকতে পারে। কিন্তু বেশীরভাগ অটিস্টিক শিশুরা খুব সাধারণ (বিশেষ শিশু হয়েও যতখানি সাধারণ হতে পারে ততটুকু)।

এক লহমা's picture

প্রিয় মুর্শেদ, এর আগে পাপুন্তুসের জন্মদিনে ওর অটিজম-এর কথা জানিয়ে যে পোস্ট দিয়েছিলেন, বারে বারে সেখানে মন্তব্য লিখতে গিয়ে থেমে গিয়েছি। আমার ভগ্নীসমা এক প্রিয় বন্ধুর ছেলেটির অটিজম নিয়ে তার মায়ের লড়াই চোখের সামনে দেখেছি, দেখছি - যতটুকু তারা দেখানোর অবস্থায় থাকে। তাই যা-ই লিখতে গিয়েছি, পারিনি। কোন মন-ভালো করা কথা বলতে পারিনি। কিন্তু, আজ একটু বলতে পারি। প্রায় ২৫ বছর তার বয়স এখন। চাকরীর জন্য তার বাবাকে অনেকটা সময় অন্যান্য শহরে থাকতে হয়। মায়ের সাথেই সময় কাটে বেশী। অনেক কিছু তারা শিখিয়েছে তাকে - একাধিক ভাষা বোঝে, বলে। নিজের মতে চলে, কিন্তু মায়ের পাহারাদার সে। আর, তার ছোটবেলার বন্ধুদের চেনে, মনে রেখেছে। আজকাল তার মা তাকে মাঝে মাঝে আমাদের উৎসব-আয়োজনগুলোতে অল্প সময়ের জন্য আনছে। খুব মেশে, উপভোগ করে - তার মত করে, কিন্তু মিলেমিশে থাকে। বেশীক্ষণ হয়ত থাকতে পারে না। একটা সময় একটু একটু করে অস্থিরতা আসতে থাকে। তখন তার মা উঠে পড়ে। তৃপ্ত মুখে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি রওনা হয়। কোনরকম লজ্জাকে এক চিলতে জমি না ছেড়ে মা-বাবা-ছেলের পরস্পরকে আঁকড়ে এ এক আশ্চর্য জীবনকাব্য রচনা।

আপনি যা লিখেছিলেন তা থেকে জানি আপনাদের পরিস্থিতি আরো কঠিন। বিশেষ করে, কথা বলতে না পারলে। তারপরও আশা রাখি একটু একটু করে হলেও খুশীর মুহূর্তরা কেউ না কেউ আসবে, আসতে থাকবে।

অনেক ভালোবাসা আপনাদের সবার জন্য।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

অনেক ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক's picture

বেশ কিছু দিন ধরে অটিজম নিয়ে একটা প্রশ্ন করছি নিজেকে; কেন এই মানুষ গুলো? জীবনের তাৎপর্য কি অটিস্টিক মানুষের? আমি ব্রাইট সাইড অফ লাইফ- দলের মানুষ। অটিজম নিয়ে যতই পড়ি ততই যে তাই যে উত্তর টা পাই; অটিস্টিকরা অন্যভাবে চিন্তা করা, সূক্ষ্ম বিষয় অনুভূত, প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি রেখার বাইরের স্নায়বিক পার্থক্যময় ঐশ্বরিক আশির্বাদপুষ্ট প্রতিভাধর এক দল মানুষ। প্রায় ১০০,০০০ বছর আগের মানব জিনোমে সাস্টেইন্যাবল অটিস্টিক বৈশিষ্ট্যগুলোর উপস্থিতি পাওয়া যায় । আদি প্রস্তর যুগে গুহার পর গুহা আঁকা মানুষদের কাজ নিয়ে গবেষনা করে বর্তমান সময়ের প্রত্নতত্ববিদ আর মানসিক সাস্থ্যবিদ যখন হয়রান হয়ে কপাল মোছেন আর বলেনঃ “work of talented artists with autism”, তখন আমি মনে ভাবি মাওরি দের শব্দ ‘টাকিওয়াটাঙ্গা’ ওদের ভাষায় যাকে ওরা বলে অটিজম, অর্থ ‘তার নিজের সময় ও জগতে’, হয়ত সে সময় হাজার বছর পরের!

উপরে এক লহমার একটা কথা অসম্ভব সুন্দর;

Quote:
কোনরকম লজ্জাকে এক চিলতে জমি না ছেড়ে মা-বাবা-ছেলের পরস্পরকে আঁকড়ে এ এক আশ্চর্য জীবনকাব্য রচনা।

--জে এফ নুশান

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

সজীব ওসমান's picture

পড়ে মন খারাপ হলো। ভালোও লাগলো।

স্বাস্হ্যবিজ্ঞানের গতি আর দিক যেরকম সেটা থেকে মনে হচ্ছে অটিজমের মতো অন্যান্য জিনগত রোগগুলাকে উপশমের আওতায় নিয়ে আসাটা হয়তো দুয়েক দশকের মধ্যেই সম্ভব হবে। সেরকম আশাবাদও আছে।

শুভকামনা।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

ধন্যবাদ সজীব।

মুস্তাফিজ's picture

মন খারাপ করেছিলাম। এখন কাছাকাছি এসেছেন জেনে ভালোও লাগছে। হয়তো শীঘ্রই দেখাও হয়ে যাবে।

...........................
Every Picture Tells a Story

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

অবশ্যই দেখা হবে। যোগাযোগ করব।

নীড় সন্ধানী's picture

মায়ের হাতে ধরা ছেলেটার সাথে অপেক্ষমান বাবার দেখা হবার দৃশ্যটা কল্পনা করতে গিয়ে দারুন এক ভালোলাগা ভর করলো।
সিয়াটলে নতুন ক্যারিয়ারের জন্য অনেক শুভকামনা মুর্শেদ। পাপুন্তুসের জন্য অনেক ভালোবাসা।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

অনেক ধন্যবাদ।

জাহিদ হোসেন's picture

সিয়াটলে স্বআগতম। হয়তো একদিন দেখা হবে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

অবশ্যই দেখা হবে জাহিদ ভাই।

নজমুল আলবাব's picture

এই লেখাটা ভিজিয়ে দিলো

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.