বিলাতি কুত্তা

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Sun, 09/03/2014 - 10:37am
Categories:

কুত্তারে যে ভদ্রসমাজে কুকুর নামে ডাকা হয় সেটা হয়ত সবুজবাগ মহল্লার লোকজন ভুলে গিয়েছিলো অথবা কুত্তাকে তারা কখনো কুকুর নামে ডাকার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে নাই। কিন্তু যখন সবুজবাগ মহল্লায় একটা মালিক বিহীন পা-ভাঙ্গা বিলাতি কুত্তার আবির্ভাব হয় তখন ওই কুত্তাকে "বিলাতি কুত্তা" কইতে তাদের সংকোচ লাগে। আবার "বিদেশি কুকুর" শব্দদ্বয়েও তারা ঠিক স্বাছন্দ বোধ করেনা। তখন তারে তারা টমি নামে ডাকা শুরু করে। টমি কেন? কারন টমি ছাড়া বিলাতি কুত্তার আর কি নাম হইতে পারে সেইটা তাদের জানা ছিল না।

সবুজবাগ মহল্লার লোকজন যারা মোড়ের টংয়ে বইসা দেশ-কালের নিকুচি করে অথবা মফিজের পুড়ির দোকানে বইসা দেশ উদ্ধারের উপায় বাতলায়, তাদের নিয়মিত আলোচনায় বিলাতি কুত্তা ঢুকে পড়ায় তারা খানিকটা বিরক্ত হয়। তারা জানতে চায় "কুত্তডা আইলো কোত্থনে" তাদের প্রশ্নের অনুসন্ধানে জানা যায় চা দোকনদার মজিদ এই বিলাতি কুত্তা মানে টমিরে প্রথমে তার টং-দোকানের ঝাপির পাশে দেখতে পায়। চা দোকনদার মজিদ টমি আবিষ্কারের ক্রেডিট নিয়া নিতাছে দেইখা টংয়ের অদূরে দাঁড়ানো হাফিজ কয় "হাওয়ার পো, মিছা কথা কও কেলা?বিয়ান বেলা, আমিই তো তোমারে দেখায়া কইলাম, “এই ল্যাংড়া কুত্তাডার মালিক কেডা?" মজিদ নাকি হাফিজ এই তর্ক জমার আগেই মজিদ পেছন হটে, বলে "হ, এইডার মালিক কেডা?"। হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া এই কুকুরের মালিক বের করা সবুজবাগ মহল্লার লোকজনের জন্যে কঠিন হয়ে দাড়ায়। তখন মালিকবিহীন বিলাতি কুত্তার মালিক হইতে অনেকেই আগ্রহ দেখায়। মুফতে একটা বিলাতি কুত্তার মালিক হওয়ার চান্স হাত ছাড়া করতে চায়না কেউই। কিন্তু বিলাতি কুত্তার ভরন-পোষন সংক্রান্ত কথা আসলে তারা দ্বিতীয় বার ভাবে। অতঃপর তারা সিদ্ধান্তে আসে মালিক না পাওয়া পর্যন্ত এই বিলাতি কুত্তার ভরন-পোষন তারা প্রত্যেকে বহন করবে। ফলাফলে মজিদের টং অথবা মফিজের পুড়ির দোকান ছেড়ে বিলাতি কুত্তা ঢুকে পড়ে সবুজবাগ মহল্লার মানুষের প্রতিদিনের যাপিত-জীবনে। তাদের পারিবারিক অথবা ব্যক্তিগত আলোচনায় বিলাতি কুত্তা সংক্রান্ত একটা বাড়তি অংশ আংশ যুক্ত হয়। কে কিভাবে বিলাতি কুত্তার আদর যত্ন করছে কিংবা কার সাথে বিলাতি কুত্তা থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সেটা নিয়ে মজিদের টংয়ে অথবা মফিজের পুড়ির দোকানের আলোচনা জমে। বাড়ি ফিরলে হাফিজের বউ জিগ্যাসা করে, মজিদের মেয়ে জানতে চায়; তারা বলে "বিলাতি কুত্তার কি খবর?"

বিলাতি কুত্তার বিলাতি খাওন আনতে মফিজ একবেলা দোকান বন্ধ কইরা কাটাবন মার্কেট যায়। ফিরার টাইমে পাশের খামারবাড়ি মহল্লার সবাইরে জানান দিয়া আসে - সবুজবাগ মহল্লায় কেবল নেড়ি কুত্তা না বিলাতি কুত্তাও থাকে। খামারবাড়ি মহল্লার লোকজন ব্যাপারটা প্রথমে উড়াইয়া দেয়, কয় "ছাল নাই কুত্তার বাঘারাম ডাক"।. তবে তাদের অস্বস্থি টের পাওয়া যায়।গত মাসে তারা কেরাম খেলায় সবুজবাগরে হারাইয়া ট্রফি নিছে। কুত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারে সবুজবাগের আগাইয়া যাওয়া তাদের পছন্দ হয় না। ছুতো ধরে তাদের কেউ কেউ মফিজের পেছন পেছন টমিরে দেখতে আসে। টমিরে দেইখা তারা কয় "হালাগো ল্যাংড়া কুত্তা লইয়া ভাব দেহ?"।. কথা শুইনা হাফিজ হাসে কয় "হাতি মরলে লাখ টেকা- ল্যাংড়া হইলেও এইডা বিদেশী কুত্তা”।. তারপর চেহারায় বিরক্ত ফুটাইয়া কয় "আর ল্যাংড়া ল্যাংড়া মারাইতেছো কেন? পাওডাতে একটু জখম হইছে সাইরা উঠব"।. তারপর সবুজবাগ এলাকার লোকজন আমোদ নিয়া খামারবাড়ির এলাকার লোকজনের পিত্তি পোড়া গন্ধ শুঁকে।বাড়ি ফিরলে হাফিজের বউ জিগ্যাসা করে, মজিদের মেয়ে জানতে চায়; তারা বলে "খামারবাড়ি মহল্লার মাইনষের নাকি পিত্তি জ্বলে?"

সবুজবাগ মহল্লায় হঠাৎ কইরা যেমন বিলাতি কুত্তার আবির্ভাব হইছিল তেমনি হঠাৎ কইরা হারাইয়াও যায়। তারা টমির হারাইয়া যাওয়ার পিছনে খামারবাড়ি মহল্লার কালো হাতের যড়যন্ত্র খোঁজে। খামারবাড়ি মহল্লার লোকজন কয় "বিলাতিকুত্তা নিশ্চইয় পা ঠিক হইতেই মালিকে কাছে চইল্লা গেছে"।. এই নিশ্চিত যুক্তি সবুজবাগ মহল্লার লোকজন মানতে অস্বীকার করে। তারা খামারবাড়ি মহল্লার বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি করে। সেই রাইতে হাফিজের বউ জিগ্যাসা করে, মজিদের মেয়ে জানতে চায়;তার চোখ মুছে বলে "টমিরে পাওন গেছে?"

বিলাতি কুত্তা হারাইয়া যাওয়ার শোক সবুজবাগ মহল্লার সবার উপর নাইমা আসে। মজিদের টংয়ের সামনে হাফিজ ভেউ ভেউ কইরা টমির শোকে কান্দে। সেই কান্দনে চোখের পানি আটকাইয়া রাখতে বাকিরা আসমানের দিকে তাকাইয়া থাকে। তবে সবুজবাগ মহল্লার নেড়ি কুত্তাদের উপর এর কোন প্রভাব পড়ে না। তারা আগের মতই ডাষ্টবিনের ময়লা ঘাটে আর রাইত হইলে মহল্লার রাস্তায় পাহাড়া দিয়া বেড়ায়; সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা দেকলে ভৌউউউ করে চিল্লায়। তখন হাফিজের বউ কিংবা মজিদের মেয়ে ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরে অনুযোগ করে, "নেড়ি কুত্তাগুলার যন্ত্রনায় ঘুমানো গেলনা!"

--তানভীর রাব্বানী


Comments

মেঘলা মানুষ's picture

গল্পটা ঠিক যতটুকু হওয়া দরকার ছিল ঠিক ততটুকুই -এরচেয়ে ছোট/বড় হলে ভাল লাগত না।
আরও লিখবেন। সূক্ষ্ম খোঁচাটা ভালো লেগেছে।

শুভেচ্ছা হাসি

আনু-আল হক's picture

অনবদ্য ।

----------------------------
নয় মাসে হলো তিরিশ লক্ষ খুন
এরপরও তুমি বোঝাও কি ধুন-ফুন

সত্যপীর's picture

দারুণ!

..................................................................
#Banshibir.

সাফিনাজ আরজু's picture

চলুক চলুক
আরে চমৎকার লাগল তো ...... হাসি
আরও লিখুন ভাই!

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

টিউলিপ's picture

ভালো লাগলো, চমৎকার লেখার হাত আপনার।

কিছু টাইপো আছে, সময় পেলে শুধরে নিয়েন।

___________________

রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি

আয়নামতি's picture

সত্যি চমৎকার! চলুক
শহীদুল জহির খুব পছন্দের বুঝি?
আরো লেখুন।

মন মাঝি's picture

এল ক্লাসিকো!

****************************************

অতিথি লেখক's picture

লেখা পড়ে শহীদুল জহিরের প্রবল প্রভাব লক্ষ্য করলাম। ভুল হতে পারে আমার। তবে যদি না হয় তাহলে শামসুর রাহমানের একটা উদ্ধৃতি দিতে চাই যিনি বলেছেন অনুজ লেখকের উপর অগ্রজের প্রভাব স্বাভাবিক। তবে একটা সময় পরে অনুজ লেখককে তাঁর নিজস্ব কন্ঠস্বর খুঁজে পেতে হয়। ভালো থাকুন। লিখতে থাকুন। পরের লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
রাজীব মাহমুদ

ত্রিমাত্রিক কবি's picture

দুরন্ত। পাঁচতারা দিলাম।

ভাষারীতি আর বাক্যগঠনে শহীদুল জহিরের রীতির সাথে মিল খুঁজে পেলাম। আপনার আরও গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক's picture

ভাল লেগেছে লেখাটা। আমার কাছে মনে হয়েছে কনভার্সেশনগুলো আলাদা ভাবে দিলে পড়তে ভাল লাগে। প্যারাতে অন্য বর্ণনায় মিশে গেলে ডাউয়ালগগুলো মিস হয়ে যায়।

shah waez

এক লহমা's picture

বা:! খুব ভাল লাগল। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নীড় সন্ধানী's picture

এই সাইজে এরকম একটা প্রাণবন্ত গল্প লেখা সহজ কাজ না। আপনি খুব চমৎকার লিখেছেন। এই ধারার লেখা পড়তে আরাম। হাত খুলে লিখুন আরো। চলুক

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক's picture

খাসা!

কড়িকাঠুরে

প্রৌঢ় ভাবনা's picture

বাহ্। হাসি

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.