তিনটি মেয়ের গল্প

তুলিরেখা's picture
Submitted by tuli1 on Thu, 18/05/2017 - 4:53am
Categories:

এইটা আসলে অনেক অনেক দিন আগে, যখন একটা বিশেষ নারী সপ্তাহ পালন হচ্ছিল, সেই সময়ে লেখার কথা ছিল । কিন্তু তখন নানা কারণে লেখাটা দেওয়া হয়ে ওঠে নি ।

এ কাহিনি তিন প্রজন্মের । শিশুবালা বনলতা মণিদীপার গল্প । দিদিমা মা মেয়ের এই তিন প্রজন্মের গল্প যেন একটা ছোট্টো আয়না, পরনির্ভরশীল পুরুষশাসিত সমাজের মধ্যে মেয়েদের স্থান কী, সুখ কী দুঃখ কী আর কালের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে অবস্থার বদল হয়েছে সেই গল্প ।

কাহিনি একঃ

শিশুবালা
শিশুবালা ছিলেন বেশ ধনী বাপের বড় মেয়ে । প্রচুর জমিজমা, বাড়ীতে যাকে বলে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ ধরণের ব্যাপার ছিল । শিশুবালারা মোট চার বোন, তিন ভাই । নিজের ভাইবোন তো বটেই, পাড়ার ভাইবোন স্থানীয়রাও শিশুদি বলতে অজ্ঞান ছিল। সুস্থসবল বুদ্ধিমতী কিশোরী, লেখাপড়ার সামান্যই সুযোগ পেয়েছিলেন কিন্তু নানা ধরণের সূচীকর্মে শিশুবালা ছিলেন তুলনাহীন ।
এই শিশুবালার বিবাহ স্থির হয় তার চোদ্দো/পনেরো বছর বয়সে, তাঁর নিজের হ্যাঁ বা না জানানোর কোনো স্কোপই ছিল না। বিবাহ হয় এক ধনী পরিবারের ছোটো ছেলের সঙ্গে। বিবাহের পরে তিনি বুঝতে পারেন স্বামীটি রুগ্ন ও কর্মহীন। স্রেফ তাকে দেখাশোনা সেবাযত্ন ইত্যাদি করানোর জন্যই শাশুড়ী(শ্বশুর প্রয়াত) খুঁজেপেতে এই ধনী ঘরের সুস্থসবল কিশোরী বধূ এনেছেন।
সুখেদুখে সংসার চলে। শ্বশুরকুলের পারিবারিক ব্যবসার আয়ের কিছু অংশ পাওয়ায় সংসার চলে, মাঝে মাঝে স্বামীটিও কিছু খুচরো ব্যবসাকাজ করেন। প্রথমে একটি কন্যা ও তারপর পর পর তিনটি পুত্র হয় ওদের, পিঠোপিঠি চার ভাইবোন।
শিশুবালার শাশুড়ী যখন মারা যান, তখন শিশুবালার কন্যাটির বয়স নয় বছর, ছেলে তিনটির বয়স যথাক্রমে সাত, পাঁচ ও তিন বছর। শাশুড়ীর শ্রাদ্ধশান্তি মিটে যাবার পরেই ভাসুরেরা ও ভাসুরপত্নীরা এই চারটি নাবালক সন্তানসমেত শিশুবালা ও তার স্বামীকে বলতে গেলে ভদ্রভাবে বিতাড়িতই করেন। শিশুবালা এসে ওঠেন নিজের পিতার আশ্রয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই মারা যান স্বামী।
তারপরে কন্যাটি ও পুত্র তিনটিকে নিয়ে প্রায় আশ্রিতের মতন অসহায় জীবন কাটাতে হয় শিশুবালার। সবচেয়ে ছোটো ছেলেটি মারা যায় সর্পাঘাতে, মেয়েটিকে মানুষ করার জন্য নিয়ে যায় শিশুবালার বড়ভাই ও এক বোন। বাকী ছেলে দুটিকে নিয়ে শিশুবালা বাপের বাড়ীতে প্রায় দাসীবৃত্তি করে দিন কাটান বহু বছর । পরে ছেলেরা বড় হলে তাদের নিয়ে স্বতন্ত্র আশ্রয় হয় তাঁর

কাহিনি দুইঃ বনলতা

বনলতা এই শিশুবালার প্রথম সন্তান, বড় মেয়ে। দশবছর বয়সে বাবা মা ভাইদের সব ছেড়ে মামা আর মাসীর সঙ্গে শহরে থাকতে আসে সে। সেখানে, আশ্রিতের যা কপাল, সংকুচিতভাবে থাকা, খেটেখুটে শোধ করে দেবার চেষ্টা। যাই হোক স্কুলে ভর্তি তাকে করিয়েছিলেন তার মামা, সেখানে পড়ে সে মাধ্যমিক পাশ করে। তারপরে কলেজে বছর দুই পড়েছিল। তারপরেই বিয়ে স্থির হয়ে যায় তার।
মামামামী (ততদিনে মামা বিবাহিত, মামী খুব উচ্চশিক্ষিতা মহিলা, সেকালের দিনেই এম এ পাশ ) সমস্ত আয়োজন করে বনলতার বিয়ে দিয়ে দেন। বনলতার মামা ছিলেন ডাক্তার, বনলতার মনে মনে ইচ্ছে ছিল সেও ডাক্তার হবে, কিন্তু আশ্রিতা অবলা পরের ঘাড়ের বোঝা মেয়ের পক্ষে এরকম ভাবাও ধৃষ্টতা।

যাই হোক বনলতার যে পরিবারে বিয়ে হয় তারা বেশ সুশিক্ষিত পরিবার। বনলতার স্বামীর ভালো চাকরি। সুখের সংসারই বলতে গেলে। কয়েক বছরের মধ্যেই দুটি সন্তানের জননী হয় বনলতা , বড়টি মেয়ে আর ছোটোটি ছেলে।

কাহিনি তিনঃ মণিদীপা

বনলতার মেয়েটির নাম মণিদীপা । প্রথম সন্তানটি মেয়ে জানার পর বনলতা কেঁদে ফেলেছিল । মেয়েদের জীবন নাকি খুবই দুঃখের, তাই সে মেয়ে হোক একেবারেই চায় নি।
বনলতা ভেবেছিল বাড়িতে শাশুড়ী ও অন্যান্য গুরুজনেরাও বুঝি মেয়ে হয়েছে বলে তাকে দোষ দেবেন। কিন্তু সে অবাক হয়ে গেল যখন দেখল শাশুড়ী এই নাতনিকে একেবারে বুকে তুলে নিয়ে আনন্দাশ্রুতে ভেসে গেলেন। দশ বছর বয়স থেকে মাতৃসঙ্গবিচ্যুতা বনলতা জানতোই না মায়ের স্নেহ বা মায়ের কর্তব্য কী জিনিস, শাশুড়ী তাকে প্রায় হাতে ধরে সব শেখালেন, ক্ষুদ্র সদ্যোজাত সন্তানের যত্ন-আত্তি কীভাবে করতে হয়।
কিন্তু শুধু কর্তব্য নয়, তারও অধিক কোনো অদ্ভুত টান ছিল নাতনির দিকে ঠাকুমার। রাত্রে একঘুম দিয়ে উঠে প্রদীপ জ্বেলে পুত্রবধূর কাছ থেকে নাতনিকে চেয়ে কোলে নিতেন, কয়েক মিনিটের জন্য আলোর কাছে নিয়ে দেখবেন বলে।
মাস আট-নয় পর বাচ্চাটি দুধ ছেড়ে দেবার পর পরই ঠাকুমা তাকে নিজের কাছে নিয়ে নেন। তারপর থেকে বলতে গেলে মণিদীপা ঠাকুমার কাছেই মানুষ।
মণিদীপা পিতামহীর কাছেই মানুষ হতে লাগল আর বনলতা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার ছেলেটিকে নিয়ে। মণিদীপার ভাই জন্মেছিল মণিদীপার থেকে বছর তিনেক পর।
অন্য মেয়েদের যেমন লেখাপড়ার সঙ্গে নাচগান ইত্যাদি শেখানোরও ব্যব্স্থা করে তাদের বাড়ি থেকে, মণিদীপার ক্ষেত্রে তা হয় নি। তার জন্য শুধু পড়াশোনার ব্যবস্থাটুকুই হয়েছিল। আর পাড়ার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বিকেলে মাঠে খেলাধূলা, মণিদীপা সাগ্রহে যোগ দিত তাতে। তবে সত্যি বলতে কি মেয়েলিভাবে বড়ো করা হয় নি একেবারেই তাকে, সব সময় ছোটো করে চুল ছেঁটে রাখা হতো তার, বড় হয়ে উঠতে উঠতে চারদিক দেখেশুনে ক্লিপ টিপ চুড়ি হার এইসব একসময় নিজেই ত্যাগ করে সে, কানের দুলও খুলে ফ্যালে। শুধু কোথাও তার মনের মধ্যে মানুষ হয়ে ওঠার জেদ দেখা দেয়, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে দেখা দেয়। হয়তো বা তার মায়ের থেকেই পাওয়া সেই ইচ্ছে যা পরাশ্রিত অবস্থায় তার মা পূরণ করতে পারে নি।
স্কুল কলেজ পার হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যায় মণিদীপা, সেখানে শিক্ষা সমাপ্ত করে চাকরিও শুরু করে। পিতামহী ততদিনে পরলোকে। মা বাবা প্রৌঢ়ত্বের সীমায়।
মাঝে মাঝে সে ভাবে প্রায় একশো বছর আগে শিশুবালাকে দিয়ে যে কাহিনির সূচনা হয়েছিল সেই দীর্ঘ কাহিনির সমাপ্তি কোথায়?
উপলবন্ধুর পথে পথে রক্তজবার অঞ্জলি দিতে দিতে কোথায় তারা চলেছে?


Comments

এক লহমা's picture

চলতে চলতেই জানবে মণিদীপা।

গল্পটা খসড়া থেকে গল্প হয়ে উঠলে আরও ভাল লাগবে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা's picture

পড়ার জন্য ধন্যবাদ। খসড়া থেকে গল্প হয়ে ওঠা যে কবে হবে, আদৌ হবে কিনা কেজানে!

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

দেবদ্যুতি's picture

বেশ লাগছিলো পড়তে। মণিদীপা উত্তর খুঁজে পেলে ভালো লাগবে খুব।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

তুলিরেখা's picture

মণিদীপা হয়তো উত্তর পেয়ে গিয়েছে বা পায় নি, কে বলতে পারে! পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মেঘলা মানুষ's picture

এভাবেই চলে আসছে। আশা করি পরের প্রজন্ম আরও ভাগ্যবান হোক!

শুভেচ্ছা হাসি

তুলিরেখা's picture

আশা করা যায় তাই হবে । যত সময় যাবে ততই তো মানুষের সমাজ ভালোর দিকে যাবে, এইটাই আশা । পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি's picture

কল্যাণী দত্তের 'পিঞ্জরে বসিয়া' পড়তে শুধু করেছি তুলিদি। সেখানে বিধবাদের কিছু কাহিনি পড়ে বাতাসে অক্সিজেন কম মনে হচ্ছে বার বার! সময় উজিয়ে শিশুবালা থেকে মণিদীপাদের ভাগ্য খানিকটা বদলেছে ঠিকই, কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতার বিষে নীল তাদের অনেকের অন্তরাত্মা। 'থার্টি ডেইজ ইন সেপ্টেম্বর' মুভির মা আর মেয়ের হাহাকারের গল্প কতশত মেয়ে বয়ে বেড়ায় তার খবর কেই বা রাখে!

তুলিরেখা's picture

ঠিক । সমাজ খুব একটা বদলায় না সহজে, বাইরে পরিবর্তন হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অনেকটাই আগের মতন থেকে যায় । তবু, তার মধ্য থেকেও তো সেই প্রথম প্রতিশ্রুতির সত্যবতীরা বেরিয়ে আসে, কোথাও না কোথাও ....

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক's picture

আপনার লেখা খুব সুন্দর। বাক্যগুলো কেমন যেন গোলগোল, দেখতে ভালো লাগে। পড়তেও আরাম ভারি।

---মোখলেস হোসেন।

তুলিরেখা's picture

অনেক ধন্যবাদ । হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতন্দ্র প্রহরী's picture

বিষয়বস্তু/আইডিয়াটা ভালো লাগল।

তুলিরেখা's picture

এই আইডিয়া থেকে উপন্যাস তৈরী হতে পারে তেমন হাতে পড়লে, আশাপূর্ণার সেই বিখ্যাত ট্রিলজি আছে ! কিন্তু আমার হাতে হবে না মনে হয় ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা's picture

বহু মাস পরে আবার সচলে লগিন করলাম। কতকাল কেটে গেল! হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা's picture

মাঝে মাঝে আসি, নতুন লেখা দেখলে পড়ি । কিন্তু লগিন করা হয় না ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.