রুদাই (৩)

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Wed, 10/05/2017 - 11:34pm
Categories:

বৃত্ত ভাঙা নিয়ে ভাববার খুব একটা অবকাশ পাচ্ছিনা। এখানে এখন রুদেলান্তির সময়, ঈশ্বরের অনুগ্রহ হাত ভরে নেবার কাল। সোনালি স্রোতের যেন কোন শেষ নেই, শেষ নেই ছাঁকনদারদের ব্যাস্ততার, তারচেয়েও ব্যাস্ত বাদামিরা। এরই ফাঁকে আমাদের তল্লাটে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। বৃত্ত গুলো এখন আরও বড়, আরও উষ্ণ। আর্দ্রতা কমে এসে অমৃতের স্বাদটাকে কেমন যেন পাল্টে দিয়েছে। তবে নিজেকে দারুণ শক্তপোক্ত আর চনমনে লাগে আজকাল, বাকি একুশ জনের দিকে তাকিয়ে টের পাই কলেবরে বেশ বেড়েছি আমি।

ভাগ্যিস বেড়েছি, কেননা সবুজ তল্লাটে যাবার পথটাও যে বেড়ে গিয়েছে দুই গুন! আগের মতো ঢিমে তালে নয়, অমৃত আর রুদাই নিয়ে সময়ের সাথে রীতিমতো পাল্লা দিয়ে ছুটতে হয়।

বাদামিরা এখন বেশ গল্প টল্প করে। গল্পগুলো অর্থহীন, মূলত খাওয়া কেন্দ্রিক। কে কতটা অমৃত খেয়েছে সেই নিয়ে এদের বাগাড়ম্বরের কোন শেষ নেই। অমৃতটা যে দুর্দান্ত তা অস্বীকার করছি না, তাই বলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প ফাঁদার কী আছে?

একদিন বিরক্ত হয়ে পাশের দুজনকে বললাম,

“এমন খাই খাই করো কেন তোমরা? এতো খাবার দরকার কী শুনি? পেট ফেটে মরবে তো!।”

দুজন খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর একজন ফিসফিস করে আমাকে জিগ্যেস করলো,

“তুমি খাওয়া বাড়িয়ে দাও নি!”

খাওয়া বাড়িয়ে দেবো কেন! খাওয়া মানেই তো সময় নষ্ট করা, খাই যতটুকু না হলেই নয়। তারপর ঘরের ছাঁদটা ধ্বসে না যাওয়া পর্যন্ত খুঁজে ফিরি বৃত্ত ভাঙার পথ। এছাড়া সময় কই? বৃত্তে ঢোকার পর খুব দ্রুত শরীরটা অবসন্ন হয়ে আসে, ক্লান্তি অর্থে নয়, কেমন সুখ সুখ একটা অবসন্নতা, না চাইলেও ঘুমিয়ে পড়ি, সে ঘুম ভাঙে অমৃতের ছোঁয়ায়।

হুমহাম ছুটে চলেছে বাদামি মিছিল। দুরে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছাঁকনদারের দল, ঈশ্বরের নৈবেদ্য হাতে প্রতীক্ষায় তারা, তাদের সীমাহীন ঘন সবুজে।

ফেরার পথে আমাকে টেনে লাইনের পেছনে নিয়ে গেলো দলপতি। অন্যদের দ্রুত পা চালানোর হুকুম দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললো,

“ঈশ্বরের কৃপাকে অবহেলা করোনা ছোকরা। রুদেলান্তির কাল অসীম নয়।”
“অবহেলা করছি ভাবছো কেন?”
“শুনতে পেলাম তুমি নাকি ঠিক মতো খাচ্ছো না?”
“খাচ্ছি না তা নয়। যতটুকু দরকার ততোটুকুই খাচ্ছি।”
“ভুল করছো, খাবে যতটুকু সাধ্যে কুলায়।”
“পেট ফেটে যেতে চাইলেও!”
“পেট ফাটবে না, ঈশ্বরের বিধান।”
“এমন অদ্ভুত বিধান কেন?”

যেন প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি- দলপতি বলে চলে,

“বাদামি তল্লাটে প্রিংতার হামলা হয় না, কিন্তু তাই বলে এ জায়গাটাকে বিপদমুক্ত ভাবার কোন কারণ নেই। বিপদ এবং বিপদের ভয় আসলে ঈশ্বরের মতোই, সর্বত্র বিরাজমান।”
“কিসের বিপদ? ভয় কাকে?”
“বিপদ অবাধ্যতায়, ভয় নিজেকে। ঈশ্বরের অনুগ্রহ যে অগ্রাহ্য করে সে হিমগ্নের দাস।”
“হিমগ্নের দাস হলে ক্ষতি কী? আমি তো দাস হয়েই আছি এখানে।”
“ঈশ্বরের দাসত্ব সৌভাগ্যের।”
“কী করে বুঝবো বলো! সৌভাগ্য তো সব গোল ঘরের বাইরে।”
“সময় হলে তুমিও বাইরে যেতে পারবে।”
“কখন সময় হবে? কন্ড্রিয়া কি কিছু বলেছেন?”
“রুদেলান্তির পর তাঁর এখানে আসার কথা।”
“আচ্ছা, হিমগ্নের দাস হয়ে যাবার ব্যাপারটা আসলে কী? কী হয় দাসেদের? বলছি না যে তাঁর দাস হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি আমি…”
“দাসেদের দেহ-আত্মা-অস্তিত্ব ঈশ্বরের অভিশাপ বয়ে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকে শেষের সে দিন পর্যন্ত, পাপীদের জন্য ঈশ্বরের কোন অনুকম্পা নেই।”
“সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু দাসেরা করেটা কী? কোথায় থাকে তারা, এখানেই? নাকি অন্য কোন তল্লাটে?”
“কন্ড্রিয়া আসলেই সব জানতে পারবে। তোমার ভালোর জন্যেই বলছি হে, যত পারো খাও- কষ্ট হলেও।”

ঈশ্বর এবং হিমগ্নকে নিয়ে এদের ভাবনাগুলো খুব সরলরৈখিক। এই যেমন, ঈশ্বর দারুণ গোছানো, তাঁর সুনির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা রয়েছে। অপরদিকে হিমগ্ন খেয়ালি, তিনি পরিকল্পনার ধার ধারেন না, তাঁর আনন্দ কেবলই বিরুদ্ধাচরণে। ঈশ্বর নির্মাণ করেন, তিনি জোগান দাতা, প্রতিপালক। উলটোদিকে হিমগ্ন ধ্বংসপরায়ণ, হিংসুটে, আর স্বপ্নহীন। ঈশ্বর ক্ষমতাবান, আর হিমগ্ন ক্ষমতালোভী এবং দুর্বল। শুধু যে দুর্বল তাইই নয়, হিমগ্ন একরোখা এবং নির্বোধ। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও তিনি লড়ে চলেছেন ঈশ্বরের সাথে।

হিমগ্নের প্রতি একটা আকর্ষণ, ঠিক আকর্ষণ নয়, বলা যায় কৌতূহল জেগেছে আমার। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যার লড়াই তিনি খেয়ালি কিংবা পরিকল্পনাহীন এটা আমি বিশ্বাস করিনা। ক্লোরো কিন্তু অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলো,

....................এই লড়াইয়ে ঈশ্বর হেরে যাবেন। সোনালি স্রোতটা শুকিয়ে আসবে, থেমে যাবে বাডের আত্মার কোলাহল যা তুমি কান পেতে শুনেছো। বিলীন হয়ে যাবে সমস্ত ছাঁকনদার………......

রুদেলান্তি কাল শেষ হলো হঠাৎ করেই। একদিন দেখি বড় রাস্তার মোড় পেড়িয়ে যেখানে সবুজ তল্লাটের শুরু, সেইখানে রঙটা কেমন যেন বদলে গিয়েছে। খানিকটা কাছে যেতেই বোঝা গেলো কারণ, ছাঁকনদারদের সবুজ টুপিতে লাল লাল ছোপ।

আমাদের চোখে পড়তেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলো ওরা। সবচেয়ে উল্লসিত বুড়ো ফিল। খুব ইচ্ছে করছে ক্লোরোকে ডেকে একবার জিগ্যেস করি, ব্যাপার কী! দলপতির দিকে তাকিয়ে আর সাহস হলো না। কিছু একটা ঘটেছে এখানে, বাদামিদের মুখ এতো গোমড়া দেখিনি কোনোদিন। রুদাই ভরা ভাণ্ডগুলো নিতে নিতে ফিলের দিকে তাকিয়ে দলপতি বলল,

“শেষ হলো তাহলে?”

ফিলের হাসিটা আরও চওড়া হয়ে এলো, হাসতে হাসতেই বললো,
“কিছুক্ষণ আগে আমরা সেই শব্দ শুনেছি।”

আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম,
“কিসের শব্দ? কী হয় শুনলে?”

দারুণ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো ফিল। সবুজ তল্লাট ছেড়ে আসার পর ওর চোখে এমন কর্তৃত্বের ছাপ দেখিনি আর। বাদামিদের সাথে লেনদেনের সময় ফিল একরকম নতজানু হয়েই থাকে। আজ তাঁর গলায় সেই পুরনো ঝাঁজ, দুটো মাত্র বাক্য বললো, ধীরস্থির শান্ত গলায়, মেপে মেপে।

“ভুল করেছো একশো বাইশ। এখানে থাকলেই ভালো হতো তোমার।”

কিছু একটা হয়েছে, এমন একটা কিছু যা ছাঁকনদার আর বাদামিদের অবস্থানকে পুরো ওলট পালট করে দিয়েছে।

ফেরার পথে কেউ কোন শব্দ করেনি। না গল্প, না কোন গান। কী এতো ভাবছে এরা!

রুদাই নিয়ে ফিরে আসার পরপরই আমাকে ঢুকে যেতে হয় গোল ঘরে। আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন, সাধারণত যে জায়গায় আমি থেমে যাই সে জায়গাটা পেড়িয়ে আরও অনেকক্ষণ হাঁটলাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতেই টের পেলাম আশেপাশের রঙ ফিকে হয়ে এসেছে, এখন আর বাদামি নয়, ধূসর একটি অঞ্চলে দাঁড়িয়ে আমরা। পথের শেষ প্রান্তে চৌকোনা একটি ঘর, ঘরের খানিকটা আগেই আরেকটি ঘর, দ্বিতীয় ঘরটি তুলনায় ছোটো, দেখতেও কেমন যেন কুৎসিত আর এবড়ো থেবড়ো। দুটো ঘরের কোনটিই আমাদের বৃত্ত গুলোর মতো ক্ষণস্থায়ী নয়, দেখলেই বোঝা যায় বহুকাল টিকে থাকার মতো করে তৈরি এগুলো।

দ্বিতীয় ঘরটি পেছনে ফেলে চৌকোনা ঘরের সামনে দাঁড়ালাম সবাই। দলপতি গুনগুণ করে গান ধরলো, সেই একঘেয়ে গান।

নিস্প্রানে থাকে প্রাণ
ঈশ্বর (দুর্বোধ্য) তাই
(দুর্বোধ্য) ঈশ্বর
(দুর্বোধ্য) দিলে তাই
তুমি প্রভু তোমাকেই
(দুর্বোধ্য) সেবাতেই
আরও (দুর্বোধ্য) তাই
…………………
…………………
…………………
ঈশ্বরে ভয় যার
(দুর্বোধ্য) জয় তার
ঈশ্বর তোমাকেই
(দুর্বোধ্য) (দুর্বোধ্য) চিন্তার
………………
………………
………………

তাঁর সাথে আরেকজন, আরও একজন, তারপর সবাই। সম্মিলিত গুঞ্জনে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড় আমার। একুশ বার গাইবার পর চৌকনা ঘরের দেয়ালটা একদিকে সরে গিয়ে একটা পথ বেরিয়ে এলো। প্রথমে দলপতি, তারপর একে একে সবাই, ভেতরে ঢুকে রুদাই এর ভাণ্ড গুলো নামিয়ে রাখলাম আমরা।

ঘরের মাঝখানে একটা আসন, আসনে কেউ নেই। দলপতি আসনের পাশে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে বললো,

“রুদেলান্তির অবসান হয়েছে। ছাঁকনদারদের কাজ শেষের পথে, যে শব্দটার কথা বলছিলো ফিল তাঁর অর্থ তোমরা জানো, বাইশ নম্বরের জন্য আবার বলছি। প্রিংতা চলে যাবার শব্দ ওটা। একটা দুটো নয়, সমস্ত সবুজ তল্লাট ছুঁয়ে ঘিরে থাকা সকল প্রিংতা বিদায় নিয়েছে। সোনালি স্রোতটা কমে আসবে এবার। কমে আসবে ঈশ্বরের নৈবেদ্যর পরিমাণ। হিমগ্ন এখন চোখ রাখবেন বাদামি তল্লাটে। তোমরা যারা ঈশ্বরের অবাধ্য হয়েছ তাদের উপর ভর করবেন তিনি। তাঁর দাসেদের মাধ্যমে চেষ্টা করবেন এই পবিত্র ঘরে ঢোকার। কিন্তু ঈশ্বর সহায়, আমরা সেটা হতে দেবোনা। তাদের স্থান বাইরের ওই কুৎসিত ঘরটায়।"

-চলবে

প্রথম পর্বের লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56534

দ্বিতীয় পর্বের লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56557


Comments

অতিথি লেখক's picture

ভাই, দিনের শুরুতেই উদ্ভিদবিদ্যার নতুন অধ্যায় পড়তে পেরে খুব ভালো লাগছে। দারুন চলছে। এখন হিমগ্নের দেখা পাওয়ার পালা।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।

--মোখলেস হোসেন

তুলিরেখা's picture

সাগ্রহে পড়ছি ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ তুলিরেখা।

--মোখলেস হোসেন

এক লহমা's picture

চলুক হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক's picture

আপনি এখনও কষ্ট করে পরে যাচ্ছেন তাহলে!

-- মোখলেস হোসেন

আয়নামতি's picture

চলুক

আবার পরের পর্বের জন্য পোস্ট প্রথম পাতা থেকে সরে যাবার বিরক্তিকর অপেক্ষা। ছাতামাথা কিছু লিখে ভীড় ঠেলবো কিনা ভাবছি চিন্তিত

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ আয়নামতি।
--মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক's picture

মোখলেস হোসেন ভাই, কোথায় আপনি? এরকম ডুব দিলেন কেন?

-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।

হাতুড়ি's picture

রুদাই কুড়াচ্ছি বলে ফসল বিলাসী হাওয়া খেতে কি ভুলে গেছি? না ভাই, ভুলি নাই। সত্যি মোখলসে ভাই, হাওয়া থেমে গেল কেন? পাঠকদের উপর লেখকদের এ কিন্তু ভারী অত্যাচার।

--হাতুড়ি

সোহেল ইমাম's picture

পরের পর্বের জন্য জোর দাবী রইলো। কলম বন্ধ করে বসে থাকলে হরতাল করবো মোখলেস ভাই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা's picture

রুদাই(৪)কই? বহুদিন হয়ে গেল যে! হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক's picture

আসলেই অনেকদিন হয়ে গিয়েছে। লিখে ফেলবো।

---মোখলেস হোসেন

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.