১৮ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কাছে...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর's picture
Submitted by nazrul islam on Mon, 08/05/2017 - 5:01pm
Categories:

দোয়ারা বাজার থেকে নদী পার হয়ে আমরা যখন ছাতক পৌঁছলাম, তখন সন্ধ্যা নেমেছে। দোয়ারা বাজার, নৈনগাঁও, মহব্বতপুরের নির্জনতা ছাপিয়ে বেশ ক'দিন পর কোলাহল আর যান্ত্রিক শব্দের সম্ভার। এখান থেকে আমাদেরকে যেতে হবে আরেক নির্জন গ্রামে। নদী পার হয়ে সে গ্রামের নাম ইসলামপুর। হাসান মোরশেদের বাল্যবন্ধু মুরাদ সাহেবের বাড়ি। সেখানেই আমাদের রাত্রিযাপন হবে। সেখান থেকে পরদিন আবার যাত্রা শুরু, গন্তব্য পাণ্ডব গ্রাম। যেখানে গ্রামবাসী ৪৬ বছর ধরে আগলে আছেন ১৮ জন অচেনা মুক্তিযোদ্ধার গণকবর।

পাণ্ডব গ্রামটা বেশ একটু দূরেই। একটু দুর্গমও বটে। অনেকটা পথ কোনো যানবাহন নেই। টানা দুই ঘন্টা হেঁটে অবশেষে আমরা একটা বাহন পেলাম। আমরা বলতে আমরা তিনজন, তিনজনাই সচল। আমি, হাসান মোরশেদ আর ওয়াসিম সায়ীদ দীপু। ক্যামেরা, লাইট, ট্রাইপড, ল্যাপটপ ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় ২০ কেজি ওজন কাঁধে নিয়ে দীর্ঘ পথ পদব্রজে পারি দিয়ে অবশেষে যখন একটা সিএনজির দেখা মিললো তখন মনে হলো এরচেয়ে শান্তির কিছু নেই।

আমরা পৌঁছলাম পাণ্ডব গ্রামে। এখান থেকে আবার পদব্রজ, সেও কম নয়। এবার আমাদের সঙ্গী বেশ ক'জন গ্রামবাসী। তাঁরাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের। যেতে যেতে শুনছি... পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার বিবরণ শুনছি। শুনছি কিভাবে রাজাকারেরা 'জয় বাংলা' শ্লোগান অপব্যবহার করে ফাঁদে ফেলে হত্যা করেছিলো ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে!

সীমান্তের কাছাকাছি হাদাটিলা। সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর শক্ত ক্যাম্প। আশপাশের গ্রাম থেকে অসংখ্য নারীদের ধরে এনে এই ক্যাম্পে মাসের পর মাস অত্যাচার নির্যাতন নিপীড়ন ধর্ষণ করে। আশপাশের গ্রামগুলোতে নির্যাতন লুটপাট চালায়, আগুন জ্বালায় আর মানুষ মারে। এই জায়গাটি পরেছে ৫ নম্বর সেক্টরের বাঁশতলা সাব সেক্টরে। পাপা কোম্পানি, আলফা কোম্পানি আর থার্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু মুক্তিযোদ্ধার সম্মিলিত একটি দল অক্টোবর মাসের শেষদিকে এই ক্যাম্প আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। পাকিস্তানীদের অত্যাচারে ততোদিনে আশপাশের সব এলাকা জনমানবশূন্য হয়ে গেছে। হাদাটিলা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে পাণ্ডব গ্রামের আব্দুর রহিমের পরিত্যক্ত বাড়িতে ১৩/১৪টা বাঙ্কার ঘিরে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ডিফেন্স গড়ে ওঠে। প্রায়ই পাকিস্তানীদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হয়। অপেক্ষা শক্তিবৃদ্ধি করে একদিন পাকিস্তানী ক্যাম্পের দখল নিবে।

নভেম্বর মাসের এক শীতের সকালে তাঁরা শুনতে পান উত্তর দিকের মুক্তাঞ্চল থেকে 'জয় বাংলা' শ্লোগান দিয়ে একটি দল এগিয়ে আসছে। তাঁরা ভেবে নেন হয়তো সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে তাঁদের সাহায্যে পাঠানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। কিন্তু একটু পরেই তাঁদের দিকে ছুটে আসে বুলেটের ঝাঁক। 'জয় বাংলা' শ্লোগান দিচ্ছিলো রাজাকারের দল, আর তাদের পেছনে অস্ত্র হাতে আসছিলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ধোঁকা দিতে 'জয় বাংলা' শ্লোগান ব্যবহার করে রাজাকারেরা। অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হন ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা।

ডিসেম্বরের ৬ তারিখে ছাতক মুক্ত হলে গ্রামবাসী ফিরে এসে খুঁজে পায় ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ। দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অল্প দুয়েকজনের পরিচয় উদ্ধার করা গেলেও বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ই উদ্ধার করা যায়নি। সুলতান উল্লাহ সাহেব এই মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য নিজের এক খণ্ড জমি দান করলেন। গ্রামবাসী সবাই মিলে অবশিষ্ট দেহাংশ সংগ্রহ করে জানাজা পড়ে দাফন করলো। ৪৬ বছর পরেও গ্রামবাসী পরম আদরে আগলে রেখেছেন ১৮ জন অজ্ঞাত পরিচয় মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি।

আবার দীর্ঘ পথ পার হয়ে ফিরে আসি ছাতক... সেখান থেকে সিলেট... পরদিন আবার যেতে হবে শ্রীরামসি গ্রামে। যেখানে পাকিস্তানীরা ডেকে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছিলো শত শত নিরীহ মানুষকে। আমরা, মানে ১৯৭১ আর্কাইভ হাঁটবো, যাবো সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষের কাছে আমরা যাবো। আমাদের সন্তানেরা একদিন জানবে এই দেশের জন্য আর এই দেশের মানুষের জন্য কতোটা মূল্য দিয়েছেন আমাদের পূর্ব পুরুষেরা...

ভিডিও লিঙ্ক: http://1971archive.org/stories/killing-and-rape-by-pakistan-army-at-Hada-Pandob-area


Comments

এক লহমা's picture

চলুক
শ্রদ্ধা
"... রাজাকারেরা 'জয় বাংলা' শ্লোগান অপব্যবহার করে ফাঁদে ফেলে হত্যা করেছিলো ... "

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আয়নামতি's picture

কত বছর চলে গেছে, এখন জানতে পারছি এসব আনটোল্ড হীরোদের বীরত্বের কথা! বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা এসব যোদ্ধাদের প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম, কৃতজ্ঞতা। আগামির জন্য পথে নেমে এঁদের খুঁজে বের করে তথ্য/কাহিনি সংগ্রহ করার এমন মহতী উদ্যোগের জন্য ১৯৭১ আর্কাইভের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

অতিথি লেখক's picture

একটা ছোট প্রশ্ন। ঘটনার কোন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল কি? অর্থাৎ টিমের কোন মুক্তিযোদ্ধা কি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন বা সরে পরতে পেরেছিলেন, নাকি পাণ্ডব গ্রামের কেউ ঘটনা দূর থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন? সোর্সের নাম উল্লেখ করুন। এটা যেহেতু ইতিহাসের অংশ তাই সোর্সের বিবরণ একই সাথে থেকে যাওয়া ভালো। এতে ভবিষ্যতে যারা আরও গবেষণা করবেন তখন তারা এই রেফারেন্স ব্যবহার করতে পারবেন। তাছাড়া ঘটনার সম্ভাব্য তারিখটি উল্লেখ করুন। পাণ্ডব গ্রাম কোন ইউনিয়ন, কোন উপজেলা, কোন জেলায় অবস্থিত সেটাও উল্লেখ করুন। আর গণকবরটির ছবি দিলেন না!

ছবিতে দুই সচল ছাড়া বাকিদের পরিচয় উল্লেখ করুন। আশা করছি বয়োজ্যেষ্ঠদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা।

ঈয়াসীন's picture

এখানে আব্দুর রাজ্জাক নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সর্ববামে নীল জ্যাকেট পরা। তাঁর বাবার
দেয়া জমিতেই এই গণকবরটি।

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

সোহেল ইমাম's picture

Quote:
'জয় বাংলা' শ্লোগান অপব্যবহার করে ফাঁদে ফেলে হত্যা করেছিলো ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে!

এ ধরণের ধোকাবাজির জন্য মনে হয় আমাদের এই আজকের কালটাতেও সতর্ক থাকতে হবে।

খুব ভালো একটা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আপনারা। আমাদের আসে পাশের সেই একাত্তরের স্মৃতি নিয়ে যারা আজও বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে যথাসম্ভব তথ্য এখনই জেনে নিতে হবে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক's picture

1971archive.org এর ব্যপারে এই প্রথম জানলাম। এটা খুবই জরুরী, ভাল কাজ হয়েছে। কিছু আইডিয়া -

১. যেহেতু নির্যাতন ক্যাম্পের কাছাকাছিই যাচ্ছেন, এইভাবে একে একে সব ক্যাম্পের (বা ক্যাম্পের অবস্থানের) ছবি উঠিয়ে আর্কাইভে রাখা যায় কিনা, সাথে সম্ভব হলে কিছু পরিসংখ্যান, যেমন কতজন বন্দি ছিলেন, ধারণক্ষমতা কত ছিল ইত্যাদি।

২. এক নম্বর পয়েন্টের মত করে গণকবরের অবস্থান, ছবি, কিছু পরিসংখ্যান।

৩. এভাবে পুরা কাজটা ক্রাউড সোর্স করা যায় কিনা? যেহেতু দেশে এখন প্রায় সবার হাতেই মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেট।

৪. গুগল ম্যাপে এসব যায়গা ট্যাগ করা যায় কিনা, এবং সেই ট্যাগগুলা পাব্লিকলি এক্সেসিবল করা যায় কিনা। কিংবা জমাকৃত ট্যাগ (অক্ষাংশ - দ্রাঘীমাংশ) ইন্সটল করা যায় এমন প্লাগ-ইন হিসেবে আর্কাইভে রাখা যায় কিনা?

পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.