মুজাহিদের টিনের ক্যানভাস

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Tue, 16/02/2016 - 9:05pm
Categories:


রাজশাহীর রিকশার ছবি গুলোতে শিল্পীর স্বাক্ষর থাকেই, তবে প্রচুর ছবিতেই নেই। হয়তো বাহুল্যবোধে শিল্পী নামটা লেখেননি অথবা ঠিক নামটার ওপরই রিকশার লাইসেন্স নাম্বারটা চেপে বসে গেছে। কখনও কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনী ষ্টিকারে আড়াল হয়ে গেছে ছবি আঁকিয়ের নাম, এমনকি ছবিটার অনেকখানি অংশই। তারপরও ছবিতে ছবিতে কিছু নাম এসেই যায়। একটু খোঁজ করলে বেরিয়ে পড়ে আরো নাম। যে নামটা খুব বেশি চোখে পড়ে তা মুজাহিদের, মুজাহিদ আর্ট। শুধু স্বাক্ষর আছে বলেই নয় ছবির মান, বিষয় বস্তুর উপস্থাপনেও অনন্য এই ছবি গুলো। কেউ একটু মনোযোগ দিয়ে রিকশার ছবি গুলো দেখতে থাকলে অব্যর্থভাবে এই নামটিই সব সময় উঠে আসে। পুরো নাম মুজাহিদুল ইসলাম মুজাহিদ। বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ। জন্ম সেই ১৯৭০ সালে। খুব ছোটবেলা থেকেই অসুস্থ বাবার জায়গায় তাকেই পরিবারের ভরন-পোষনের ভার কাঁধে তুলে নিতে হয় বলে পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি। কেউ একজন অবশ্য ভর্তি করে দিয়েছিলেন মাদ্রাসায়।

রাজশাহী নিউমার্কেট এর কাছেই কোন এক কাশিমি হুজুরের মাদ্রাসায় পড়ার সময়ই ক্যালেণ্ডারের ছবি দেখে ছবি আঁকানোর প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন তিনি। সে সময় এক পাতার রং-বেরঙের ক্যালেণ্ডার হাতে ঝুলিয়ে রাস্তায় রাস্তায় কিছু লোক বিক্রি করে বেড়াতো। হাতে আঁকা নারীর মুখশ্রী বিশিষ্ট ঘোড়ার শরীরের বোররাক, মক্কার কাবা শরীফ, কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্য ছাপা থাকতো সেই একপাতার ক্যালেণ্ডারে। ছবির নিচের দিকে তিন-চার ইঞ্চি প্রস্থের অনেকগুলো কাগজ ষ্ট্যাপলার পিন দিয়ে আটকানো থাকতো যাতে ছাপা থাকতো মাসের নাম আর তারিখ। এক একটা মাস পার হলে সেই মাসের কাগজটা ক্যালেণ্ডার থেকে ছিঁড়ে ফেলে দিতে হতো। সেই সব ছবি দেখেই বালক মুজাহিদের আগ্রহ জাগতো কিভাবে শিল্পীরা এসব ছবি আঁকেন। ভাবতে ভাবতেই দোকান থেকে এনামেল পেইন্টের ছোট ছোট কৌটা কিনে নিজেই আঁকতে শুরু করে দেন।

এখন যেখানে রাজশাহীর বাস টার্মিনাল সেখানেই মুজাহিদের বালক বয়সে ছিল রিকশা পট্টি। প্রচুর রিকশার গ্যারেজ ছিল সেখানে। রিকশার অনেক ধরনের কাজও হতো এখানেই। রাজশাহী রেল ষ্টেশনের কাছেই ছিল জায়গাটা। মুজাহিদ এই রেল ষ্টেশন সংলগ্ন বিহারী বা শিরোইল কলোনীতেই থাকতেন। রিকশা বানানোর সময় প্রায়ই তাকে অনুরোধ করা হতো সে যেন রিকশায় মালিকের নাম কিংবা দুটো ফুলের ছবি রিকশায় এঁকে দেয়। এভাবেই ধীরে ধীরে রিকশার ছবি আঁকা শুরু হয়ে যায় মুজাহিদের।

পুরোপুরি পেশাগত ভাবে রিকশার ছবি আঁকা শুরু হয় ১৯৮৭-৮৮ সালের দিকে। রিকশার ছবি আঁকতে গিয়ে ছেলেবেলার ছবি আঁকার শখের সাথে সাথেই উস্তাদ আকবর আর উসমানের কাছে দীক্ষা পেয়ে আরো সমৃদ্ধ হয়েছিলেন মুজাহিদ। শিল্পী আকবর ও শিল্পী উসমান ছিলেন মুজাহিদের গুরু স্থানীয়। স্বাধীনতার কিছু আগে এবং পরেও এরাই ছিলেন রাজশাহীর রিকশা অলঙ্করন শিল্পের দু’জন সেরা শিল্পী। মুজাহিদ বলেন এদের কাছ থেকেই ছবি সম্পর্কে তিনি অনেক কিছু শিখেছিলেন। এদের আবার গুরু ছিলেন দাউদ উস্তাদ । দাউদ উস্তাদ স্বাধীনতার আগের আমলে রিকশার ছবির সেরা শিল্পী ছিলেন। রাজশাহীর দরগা পাড়ায় বাস করতেন দাউদ উস্তাদ, সেখানেই রিকশার ছবি আঁকতেন। আকবর ও উসমান তার কাছ থেকেই তালিম পেয়েছিলেন। দু’জনেই রানীবাজারে তাদের দোকান দিয়েছিলেন যেখানে অনেক কিছুর সাথেই রিকশার ছবি আঁকানো হতো। শিল্পী আকবরের ছিল ‘শিল্পীএ্যাড’ আর উসমানের ছিল ‘লিপিকা আর্ট’। ‘কাজলরেখা’র শিল্পী মান্নানও প্রচুর রিকশার ছবি এঁকেছেন। মুজাহিদ বলেন সাইনবোর্ড সহ অনেকরকম বানিজ্যিক ছবি আঁকায় সিদ্ধহস্ত হলেও শিল্পী মান্নান প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকার ক্ষেত্রে কিছুটা দুর্বল ছিলেন। কিন্তু শিল্পী আকবর ও উসমান সব ধরনের ছবি আঁকাতেই ছিলেন ওস্তাদ ।

শিল্পী মুজাহিদুল ইসলাম মুজাহিদ ১৯৯৪ সালে

আব্দুল হক মুজাহিদুল ইসলামের শ্বশুর। তিনিও রিকশার ছবি আঁকতেন। (১৯৮৭ সালে তোলা ছবি)

২০০০ সালে ট্রাকের অলঙ্করনে ব্যস্ত শিল্পী মুজাহিদ

রাজশাহী শহরে মোটর সংযোজিত নতুন রিকশার ছবি গুলো প্রথম দিকে ছিল কেবল শিল্পী মুজাহিদেরই আঁকা। রিকশার ছবি আঁকছেন সেই প্যাডেলমারা রিকশার যুগ থেকেই। সেই সময়েই তার হাতের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন অনেকেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রিকশা মালিকরাও মুজাহিদ ছাড়া আর কারো কাছ থেকে রিকশার ছবি আঁকাতে চাইতেননা।
রিকশার ব্যবসা যখন যান্ত্রিক জনপরিবহনের দৌরাত্ম্যে ঝিমিয়ে পড়লো, রিকশার ছবি আঁকানো যখন প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল তখনও তিনি ছবি এঁকে চলেছিলেন ট্রাকের কাঠামোতে। সেই সময়ের কিছু আগে থেকেই অন্যান্য রিকশার শিল্পীরাও রিকশার ছবি আর আঁকছিলেননা। হাতে গোনা যে কয়জন ছিলেন তারা দায়সারা গোছের কোনরকমে রং বুলিয়েই দায়িত্ব সারছিলেন। ভারতীয় চলচিত্রের তারকারাই তখন ছিলেন রিকশার ছবির বিষয় বস্তু। রিকশার ছবি আঁকা বন্ধ হয়ে গেলে মুজাহিদ ট্রাকের গায়ে অলঙ্করনেই মনোনিবেশ করেন। অন্যান্য বানিজ্যিক ছবি আঁকাও অবশ্য চলছিল। লিভার ব্রাদার্স কিংবা প্রাণ কোম্পানীর মত বড় বড় কোম্পানীর পন্যের বড় আকারের বিজ্ঞাপন চিত্র এঁকেছেন তিনি। সম্প্রতি রাজশাহীর আমচত্বরের বিশাল তিন আমের ভাস্করযে রং চড়ানোর দায়িত্বও পেয়েছিলেন তিনি।
২০১৩-১৪র দিকে ‘নাহার-অটো’ যখন রিচার্জেবল ব্যাটারী আর মোটর সংযোজন করে রিকশা নামাবার পরিকল্পনা করে তখন সেই নতুন রিকশার কাঠামো কি রকম হতে পারে সে সংক্রান্ত পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতাও দিয়েছিলেন মুজাহিদ। সেই সময়ই আবার যখন এই নতুন যন্ত্রসংযোজিত রিকশায় ছবি আঁকানো শুরু হয় তখন তার সহশিল্পীরা ভেবেছিলেন এই রিকশা চলবেনা, সুতরাং রিকশায় ছবি এঁকে লাভ নেই। তারা তখন প্রায় সবাই ট্রাকের অলঙ্করনের কাজে নেমে পড়েছিলেন, রিকশায় ছবি আঁকানোর চল উঠেই গেছে এরকমটাই তারা ভেবেছিলেন। কিন্তু মুজাহিদ বুঝতে পেরেছিলেন এই নতুন রিকশা আবার রিকশার ব্যবসা ফিরিয়ে নিয়ে আসবে, সতীর্থদের একথা বলেওছিলেন তিনি। সত্যি সত্যি রিকশার ব্যবসা ফিরে এলো, রিকশার ছবি আঁকাতে মুজাহিদ এতই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে ট্রাকের অলঙ্করনের কাজটা শিষ্যদের হাতেই ছেড়ে দিলেন। পরের দিন গুলোয় এই শিষ্যদের কয়েকজন আবারও রিকশার ছবি আঁকতে শুরু করেন।

এই মোটর সংযোজিত নতুন ধরনের রিকশা গুলোয় ছবি আঁকানোর সময় মুজাহিদ ইচ্ছে করেই যেন চলচিত্রের তারকাদের বিষয় হিসেবে আর নিলেন না। জীবনের প্রারম্ভে মাদ্রাসা শিক্ষার রেশ এবং পারিপার্শ্বিক রক্ষণশীল মুরুব্বীদের প্রভাব সম্ভবত এর পেছনে কাজ করছিল। অথচ এই মুজাহিদই এক সময় দেদার ফিল্মের তারকাদের ছবি রিকশার টিনের ক্যানভাসে এঁকেছেন। অবশ্য সেই সাথে বাংলাদেশের হাল আমলের হিজাবী ফ্যাশনের ধরনে যে ধর্মীয় উৎসাহ জনমনে দেখা যাচ্ছে তার প্রভাবও এর পেছনে কাজ করে থাকতে পারে। আর এ কথাতো সর্বজন বিদিত সিনেমা জনমনে আর ঠিক আগের জায়গায় নেই। পারিবারিক বিনোদন হিসেবে সপরিবারে সিনেমা হলে যাওয়াটাও উঠে গেছে বহুদিন হলো। রিকশার ছবিতে জন মানুষের আকাঙ্ক্ষার ছবিই প্রতিফলিত হয়। হয়তো সে সূত্রেই বাংলাদেশের ফিল্মের তারকাদের ডিঙিয়ে ভারতীয় তারকারা রিকশার টিনের ক্যানভাস দখল করে ফেলেছিলেন এক সময়। মুজাহিদ কিন্তু ভারতীয় নায়ক-নায়িকাদের আর আঁকতে চাইলেননা।

রিকশার ছবি আঁকা এক রকম বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। মোটর সংযোজনের পর যখন নতুন রিকশা গুলো রাস্তায় নামতে শুরু করলো তখন রিকশার ছবি আঁকিয়ে বলতে একা মুজাহিদই আছেন। তিনি ট্রাকের গায়ে ছবি আঁকবার সময় বাংলাদেশের যে গ্রামের আর প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলো আঁকতেন তাই আঁকতে শুরু করলেন এই রিকশা গুলোয়। ট্রাকের অলঙ্করনের ঢঙেই রিকশার ছবি আঁকানো শুরু হয়ে গেল। মুজাহিদ আর তার শিষ্যরা যখন এধরনের ছবি আঁকছেন তখন রিকশার ছবির ঐতিহ্যেই খানিকটা বদল এসে গেল।

নতুন রিকশা যখন রিকশার ব্যবসাকে আবার ফিরিয়ে আনলো তখন জোরে সোরেই এধরনের রিকশা গুলো তৈরী হতে থাকলো। রিকশার ছবিও আবার আঁকতে শুরু করে দিলেন অনেকেই। এদের মধ্যে নতুন শিল্পী যেমন ছিলেন তেমনি পুরনোরাও আছেন। কিন্তু সবাই মুজাহিদের ধাঁচটাই অনুসরন করলেন, চলচিত্র তারকারা আর রিকশার বিষয় হয়ে এলোনা। মুজাহিদ সচেতন ভাবেই মানুষের প্রতিচ্ছবি রিকশায় আঁকেননি। তার ছবির বিষয় হয়ে এসেছে গ্রামবাংলার শান্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য আর পশু-পাখির ছবি, কখনও বা হেলিকপ্টার বা স্পোর্টস কারের মত আধুনিক যানবাহনও। রাজশাহীর রিকশার পেছনে আঁকা ছবি গুলো দেখলে মুজাহিদের ছবি গুলো আলাদা ভাবে চিনে নিতে কারো অসুবিধে হবার কথা নয়। তার আঁকা হুঙ্কারের ভঙ্গীতে দাঁড়ানো ও বসে থাকা বাঘের ছবি সত্যিকারের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের রাজকীয়তায় অনন্য। কুড়েঘর সহ প্রাকৃতিক ছবির দৃশ্য হোক কিংবা বাহারি রঙ্গের পাখির ছবি মুজাহিদের দক্ষ হাতের কাজ দর্শককে বলে দেয় এ আর কারো ছবি হতে পারেনা।

ধর্মীয় রক্ষণশীল বিধি নিষেধ শিল্পের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে। এই বিধি নিষেধের বশবর্তী হয়ে শিল্প ঠিক মুক্ত স্বাধীন স্বরূপে বিকশিত হতে পারেনা। ইসলাম ধর্মে শুধু মানুষই নয় জীবন্ত পশু-পাখির ছবি আঁকানোর ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আছে। কিন্তু মুজাহিদ মানুষের প্রতিকৃতি এড়িয়ে গেলেও প্রচুর পশু-পাখির ছবি এঁকেছেন। আসলে শিল্পের সাথে যখন প্রাণের যোগ প্রতিষ্ঠা হয়ে যায় তখন শিল্পীকে রোখাই মুশকিল। মাদ্রাসায় শিক্ষাকালীন সময়েই আমরা বালক মুজাহিদকে যখন উদ্যমের সাথে, বিপুল উৎসাহ নিয়ে ছবি আঁকতে দেখি তখন বুঝি প্রাণের দাবীতেই মন তার আত্মপ্রকাশের সুযোগ বের করে নেবেই। আর হয়েছেও তাই। ঘটনাটা এক রকম শাপেবরই হয়ে উঠলো যখন অন্য শিল্পীরাও মুজাহিদকে অনুসরন করেই ছবি আঁকতে শুরু করলেন।

চলচিত্রের তারকাদের ছবি যখন রিকশায় আঁকা হতো তখন অন্য বিষয় গুলো খুব কমই রিকশার ছবিতে আসতো। তারকারাই জুড়ে ছিলেন সব গুলো রিকশার ক্যানভাস। নেহাত দু-একটা জোড়া ময়ুর কি জোড়া পায়রা বা দোয়েলের ছবি মাঝে মধ্যে যা চোখে পড়তো তার সংখ্যাও এমন কিছু বেশি নয়। এখন ফিল্ম তারকাদের অনুপস্থিতিতে রিকশার টিনের ক্যানভাসে আসতে শুরু করলো বহু বিচিত্র সব বিষয়। আগে যেখানে কেবল নায়ক-নায়িকাদের দেখা যেত সেখানে বিষয় হয়ে এলো নৌকা, বাস, ট্রেন, আধুনিক স্পোর্টস কার, জাহাজ, মসজিদ, তাজমহল, যমুনা সেতু, লণ্ডনের টাওয়ার ব্রিজ, জাতীয় স্মৃতি সৌধ, রাজশাহীর রেল ষ্টেশন, রাজশাহীর আম চত্বরের বিশাল তিন আমের ছবি, ময়ুর, টিয়া, কাকাতুয়া, পঙ্খীরাজ ঘোড়া, জিরাফ, পেঙ্গুইন, সিংহ আর বাঘের ছবির কথাতো আগেই বলেছি। মুজাহিদ ছাড়াও আর যারা রিকশার ছবি আঁকছেন তারা মুজাহিদের দৃষ্টান্তে উৎসাহী হলেও ধর্মীয় বিধি নিষেধ তেমন মানেননি। তাদের ছবিতে সাধারন মানুষ অনায়াসেই চলে এসেছে। লাঙ্গল সহ কৃষক, সানগ্লাস চোখে যুবক, শিশু সন্তানকে কোলে মা, হরিনকে জড়িয়ে ধরে নারী এরকম বহু দৃষ্টান্তে বোঝা যায় শিল্পের ধারা ধর্মীয় বিধি বিধানে বন্দি হবার জিনিস নয়। রিকশা অলঙ্করনে মুজাহিদের মত খ্যাতি না পেলেও আরো অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের আঁকা গ্রামের দৃশ্যগুলোয় দেখা যাবে ছোট ছোট করে আঁকা মানুষের ছবি। মানুষ বিহীন গ্রামদৃশ্যের ছবি গুলোতে ক্রমেই মানুষ দেখা যাচ্ছে এবং দিন দিন শুধু এদের সংখ্যা বাড়ছেইনা বরং স্পষ্টও হচ্ছে। আগে যেখানে কেবল হাত পা বিশিষ্ট দ্বিপদের আভাস ছিল সেখানে মানুষ মুর্তি গুলো আরো বিশিষ্টতা নিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। ফ্রক পরা শিশু কুড়ে ঘরের সামনে খেলছে, শাড়ি পরা নারী, লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পরা ছাতা মাথায় লোক, নৌকার মাঝি ক্রমেই আরো গুরুত্ব দিয়ে আঁকা শুরু হচ্ছে।

রাজশাহীর টিন ক্যানভাসের শিল্পীদের মধ্যে সেরাজুল ও জামালও একটা বড় স্থান নিয়ে আছেন। এদের বেশিরভাগ ছবিই মুজাহিদের ছবির অনুকরন হলেও ক্রমেই একটা স্বকীয় ধারাতে উঠে যাচ্ছেন তারা। শিল্পী সেরাজুলের আঁকা রাজশাহী রেল ষ্টেশনের ছবি দেখেই বোঝা যায় শুধু শিল্পীই নয় স্থানীয় স্থাপত্যে সাধারন মানুষও গর্ববোধ করতে শুরু করেছে নয়তো নিজের শহরের রেল ষ্টেশনের ছবি আমরা রিকশায় পেতামনা। তেমনি শিল্পী জামালের ‘স্মৃতি অম্লান’ নামের রাজশাহীর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধটিও সেই একই দ্যোতনা প্রকাশ করছে। রাজশাহীর নওহাটার আমচত্বরের বিশাল তিন আমের ভাস্করযটিও অনেক গুলো রিকশার পেছনেই আঁকা দেখা যায়। শিল্পী সেরাজুলের গ্রামদৃশ্য গুলোও প্রশংসা যোগ্য। জামালের ছবির বিশিষ্ট দিক হলো এর উজ্জ্বল রঙ্গের যাদু। রিকশার ছবির এই আকর্ষন। মানুষ পথ চলতে চকিতে এই ছবি গুলো দেখবে, বেশি সময়ের অবসর পাবেনা তাই এই ছবি হতে হবে নজর কাড়া রঙে রাঙ্গানো। শিল্পী জামালের ছবিতে রঙের এই উৎসব আছে। কিন্তু এই দুই শিল্পী যখনই মুজাহিদের অনুকরন করেছেন তখনই মুজাহিদের দক্ষ হাতের ছাপটি অনেক ক্ষেত্রেই আনতে পারেননি।

এরা ছাড়াও নামহীন, স্বাক্ষরহীন অনেক ছবিই রাজশাহীর রিকশায় চোখে পড়ে যা দেখে বোঝাই যায় আরো অনেকেই রিকশার ছবি আঁকছেন। এদের অনেকেই মুজাহিদের অনুকরন করছেননা বরং স্বকীয় একটা ছাপ রাখছেন তাদের ছবিতে। শিল্পীর স্বাক্ষরহীন ছবি গুলোও নেহায়েত কম নয়। জনিআর্টের ছবি গুলো দেখলে মনে হয় রিকশার ছবির ধাঁচ নয় যেন কোন কিশোরের স্বাধীন ছবিআঁকার খাতায় আঁকা হয়েছে। জনিআর্টের গ্রামের বা প্রাকৃতিক দৃশ্যে অন্য কোন ছাঁচে ঢালা ছবির অনুসরনের ছাপ নেই। দেখে মনে হয় রিকশার টিনের ক্যানভাসে শিল্পী নিজের মন খুলে ছবি এঁকেছেন। ভক্তদের সামনে একতারা হাতে বাউলের ছবিটি জনিআর্টেরই অবদান। ঠিক এধরনের ছবি কিন্তু এর আগে রিকশায় বিশেষ দেখা যায়নি। টিন ক্যানভাসের ছবির জগতে আরেকটি নাম ‘প্রবাহ’ এই স্বাক্ষরে শিল্পী জহুরুল ইসলামের অনেক গুলো ছবিই রাজশাহীতে দেখা যায়। জহুরুল ইসলামের ছবি গুলো বিশিষ্ট তার বিষয় নির্বাচনে। তার ছবিতে এমন কিছু বিষয় এসেছে বা এসে যাচ্ছে যা এর আগে রিকশার ছবিতে কখনও চোখে পড়েনি। এছাড়াও অনামা শিল্পীদের এত সুন্দর ছবি চোখে পড়ছে অথচ শিল্পীর হদিস করাই মুশকিল। এরকম একটা অনামা শিল্পীর আঁকা গ্রামদৃশ্যের ছবি এক্সপ্রেশনিষ্ট ধাঁচের চিত্রকলার কথা মনে করিয়ে দেয়। বহু নজর কাড়া ছবিতেই শিল্পীর নাম নেই। সেই সাথেই উল্লেখ করতে হয় আরো কিছু ছবির যা খুবই আনাড়ী হাতে আঁকা। এই ছবি গুলো সংখ্যায় বেশি না হলেও নেহায়েত কমও নয়। এই ছবি গুলো দেখে বোঝা যায় এখন সবাই চাইছে রিকশার পেছনের টিনের ক্যানভাসে একটা ছবি থাকুক। ভালো শিল্পীকে দিয়ে আঁকানোর সঙ্গতি না থাকলেও এই যে ছবি দিয়ে রিকশার পেছনের শূণ্য ক্যানভাসটা ভরিয়ে রাখবার এই চেষ্টা এটাও রিকশার ছবির সজীব আবেদনকেই প্রকাশ করছে। বিশেষ করে এই কিছুদিন আগেও বেশির ভাগ রিকশার পেছনে কোন ছবিই প্রায় দেখা যেতনা। এই শূণ্য ক্যানভাসটা ছবিতে অলঙ্কৃত করতে কারো মনে হতোনা কোন তাগিদ আছে। এখন যেন সবাই চাইছে ছবি থাকুক, খুব ভালো না হলেও, আনাড়ী হাতে আঁকা হলেও থাকুক।

এখন রাজশাহীর রিকশার ছবি আঁকানোয় শিল্পী মুজাহিদ আর একা নন। বহু বিচিত্রভাবে রিকশার ছবি এখন আঁকা হচ্ছে এবং তার অনেক গুলোই মুজাহিদের আঁকা নয়। কিন্তু এখনও দক্ষ শিল্পী বলে, ভালো হাতের কাজের ক্ষেত্রে বারবার শিল্পী মুজাহিদের নামই উঠে আসে। যন্ত্র সংযোজনের আগের দিন গুলোয় রিকশার ছবি যখন আর আঁকানো হচ্ছিলনা সেই অবস্থা থেকে রিকশার ছবিকে আবার সজীব খাতে বইয়ে দেবার অবদান শিল্পী মুজাহিদের। সিনেমা তারকাদের পরিবর্তে রিকশার ছবিতে অসংখ্য বিষয়ের প্রবর্তনার ক্ষেত্রেও মুজাহিদের নামই আসবে। শিল্পী মুজাহিদকে প্রত্যক্ষ ভাবে অনুকরন, অনুসরন না করলেও রাজশাহীর টিন ক্যানভাসের শিল্পীরা এখনও সিনেমার তারকাদের বদলে রিকশার ছবিতে যে বহু বিচিত্র, চমকপ্রদ বিষয়ের অবতারনা করে যাচ্ছেন সেখানেই শিল্পী মুজাহিদ অনন্য হয়ে আছেন।

মুজাহিদ আর্ট

মুজাহিদ আর্ট

মুজাহিদ আর্ট

মুজাহিদ আর্ট

সেরাজুল আর্ট

জামাল আর্ট

জনি আর্ট

প্রবাহ

প্রবাহ

প্রবাহ

নামহীন শিল্পীর আঁকা

নামহীন শিল্পীর আঁকা

সেরাজুল আর্ট

শিল্পী মুজাহিদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে তিনটা পুরনো ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, বাকী ছবি ও রিকশার ছবির ফটোগ্রাফ গুলো আমার তোলা

সোহেল ইমাম


Comments

অতিথি লেখক's picture

হ্যাঁ, কাজের মতো একটা কাজ কিন্তু করে ফেললেন সোহেল ইমাম।
--মোখলেস হোসেন।

অতিথি লেখক's picture

হাসি মোখলেস ভাই আপনার জন্যই হয়ে গেল। আরো কিছু তথ্য সংগ্রহ করবার চেষ্টায় আছি, বিশেষ করে পুরনো আমলের কিছু আর্টিষ্ট এর কাছ থেকে। দেখি কতদূর পারা যায়।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক's picture

আমি আপনার এই কাজটা নিয়ে দারুণ আশাবাদী।
--মোখলেস হোসেন।

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক's picture

হাসি ধন্যবাদ ভাই

সোহেল ইমাম

জীবনযুদ্ধ's picture
অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ ভাই

সোহেল ইমাম

শেহাব's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক's picture

হাসি , আপনাকেও আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক's picture

চমৎকার। চলতে থাকুক লেখালেখি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ ভাই

সোহেল ইমাম

তারেক অণু's picture

খুব ভাল লাগল শুভ্র ভাই, এইবার পদ্মার চরে সারাদিন থাকার কারণে দেখা হল না, পরের বার এই নিয়ে আলাপ হবে। কাজ চালিয়ে যান-

অতিথি লেখক's picture

হাসি হ্যা ভাই আপনাকেও মিস করলাম।

সোহেল ইমাম

কেহেরমান's picture

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম চলুক

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ ভাই

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক's picture

লেখা বরাবরের মতো অনবদ্য। রিকশা আর্টের ওপর আপনি খুব ভালো এবং ডিটেইলে কাজ করেছেন। আপনার এই কাজ সংরক্ষণ করা এবং চোরের হাত থেকে রক্ষা করা জরুরী। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব কাজগুলোকে কমপাইল করে বই বা ই-বুক আকারে প্রকাশ করুন। এবং একইসাথে কপিরাইট অফিসে রেজিস্ট্রেশনের জন্য দরখাস্ত করে দিন। নয়তো ‘সূত্রঃ ইন্টারনেট’ লিখে অনেক বড় বড় মানুষ আপনার পরিশ্রমের ধন গাপ্‌ করে দেবে।

Quote:
এরকম একটা অনামা শিল্পীর আঁকা গ্রামদৃশ্যের ছবি এক্সপ্রেশনিষ্ট ধাঁচের চিত্রকলার কথা মনে করিয়ে দেয়।

এই বাক্যটা পড়ে থমকে গেলাম। কারণ, এক্সপ্রেশনিস্ট ঘরাণায় বাস্তবের ডিস্টর্টেড রেনডিশন মোটামুটি অপরিহার্য। গ্রামবাংলার দৃশ্যের ডিস্টর্টেড রেনডিশন কেমন হতে পারে তা ভাবতে পারছি না। সাধারণ দর্শক সেটাকে কীভাবে গ্রহন করলেন সেটাও ভাবতে পারছি না। এই শিল্পীর অমন কোন কাজের ফটোগ্রাফ আপনার কাছে থাকলে দয়া করে এখানে পোস্ট করুন।

অতিথি লেখক's picture

ঠিক হুবহু যে এক্সপ্রেশনিষ্ট ঘরানার কাজ তা বলিনি। ছবিটা আগের একটা পোষ্টে দিয়েছিলাম, অনেকটা ছোপ ছোপ রং দিয়ে আঁকা সুন্দর ছবি। রিকশার শিল্পীদের ছবি নিশ্চয়ই অতখানি জটিল শৈলী সম্পন্ন হবেনা। তাছাড়া চিত্রকলা আমি বুঝিও কম। আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগছে, ধন্যবাদ ভাই।

সোহেল ইমাম

এক লহমা's picture

চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক's picture

লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ হাসি

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক's picture

চমৎকার। চালিয়ে যান ভাই। হাসি sonkhocil

অতিথি লেখক's picture

হাসি

সোহেল ইমাম

তাহসিন রেজা's picture

চলুক

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

অতিথি লেখক's picture

অনেক ধন্যবাদ ।

সোহেল ইমাম

সুলতানা সাদিয়া's picture

শুরু থেকেই পড়ছি, দেখছি। মন্তব্য করা হয়নি। আপনার প্রিয় শহরের এই ক্যানভাস এখন নিজের চোখে দেখি রোজ। হাসি

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক's picture

পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ছবি গুলো নিজের চোখে দেখছেন এটা জেনেও ভালো লাগলো।

সোহেল ইমাম

অতিথি লেখক's picture

আরে বাহ!
মুজাহিদ ভোইয়ের দেখছি বয়স হয়েছে!! ২০০৯ সালে যখন তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় রাজশাহীর শিরোইল কলোনিতে, তখন তিনি আরো চ্যাংড়া ছিলেন। যা লিখেছেন আমাকেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। যাইহোক, এটা দেখে ভালো লাগছে যে আমরা এখন আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে ও লিখতে শুরু করেছি। এটা খুবই ভালো কথা। আমি এই বিষয় নিয়ে খুবই কম লিখতে পারছি। কারণ এই বিষয়ে এমফিল থিসিস করছি। জমা দিয়েছি। ভালো লাগছে ভেবে যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়গুলো এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। এটা খুবই ভালো লক্ষণ।
দাউদ ওস্তাদ কি এখনো বেঁচে আছেন? জানাবেন।

অতিথি লেখক's picture

জেনে ভালো লাগলো আপনি এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে আপনার এমফিল বা পিইচডি সম্পূর্ণ হলে হয়তো আমরা আরো ভালো লেখা পাবো আপনার কাছ থেকে। সেই অপেক্ষায় থাকলাম। না ভাই দাউদ ওস্তাদ আজ আর বেঁচে নেই। তবে আকবর উস্তাদ এখনও বেঁচে আছেন, অসুস্থ কিন্তু এখনও আছেন।

সোহেল ইমাম

রানা মেহের's picture

কী চমৎকার একটা কাজ করেছেন, দুর্দান্ত।
আরো পর্ব আসুক।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক's picture

অশেষ ধন্যবাদ ভাই।

সোহেল ইমাম

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.