পরাস্তপরতার কথকতা

অনিকেত's picture
Submitted by Aah on Tue, 20/10/2015 - 11:47pm
Categories:

Quote:
“There are two tragedies in life. One is to lose your heart's desire. The other is to gain it.”

― George Bernard Shaw, Man and Superman

মানুষের প্রেম যে খালি মানুষের সাথে হয়--এমন না।
এক মানুষ আরেক মানুষ ছাড়াও নানান জিনিস ভালবাসে। মানুষ ভালবাসে বন-মানুষ, পাখি, ফুল, নদী, গান, কবিতা, নাটক--এমনি আরো কত কী! এছাড়াও মানুষ রাজনীতি ভালবাসে, যুদ্ধ ভালবাসে, বোমা ভালবাসে, খুন করতে ভালবাসে। মানুষের ভালবাসার বিষয়ের অভাব নেই।

আমার জীবনে যে সব অ-মানুষিক ভালবাসা এসেছে--তারমধ্যে অগ্রগণ্য হল -- পদার্থবিজ্ঞান!
মনে আছে খুব ছোট থাকতে একবার আমার কিজানি এক অসুখ করেছিল। অসুখের জন্যে স্কুলে যাওয়া মানা। বাসায় বসে থাকতে হয়। রাতে উথাল-পাথাল জ্বর আসে। ঘুমে চোখ বুজলেই দেখি ওপর থেকে বড় বড় সব পাথর এসে আমার উপর পড়ছে। ভয়ঙ্কর ত্রাসে হাতপা ছুঁড়ে জেগে উঠি। বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের নীচে পিষ্ট হয়ে মারা যাবার ভয়ে ঘুমুতে যেতে ইচ্ছে করে না। ডাক্তার এসে মা কে বললেন--ওকে ব্যস্ত রাখুন, গল্প করুন, ওকে গল্প বলতে বলুন। মা আমাকে বলল, একটা গল্প বানা দেখি। বালিশ থেকে মাথা তুলে জ্বলজ্বলে চোখে বললাম, কী গল্প বানাব মা?

--তোর যা খুশি বানা--এইটা তোর গল্প!

কিছুখন ভেবে টেবে মনে একটা প্লট এল।

মা কে বললাম, 'মা, কাগজ কলম আনো--গল্প লিখব'। কিন্তু চড়াই পাখির মত শরীরে আমার এক ফোঁটা শক্তি নেই তখন। মা বলল যে, আমি মুখে মুখে বললে সে নিজে লিখে দেবে। এইটা আরো ভাল আইডিয়া! আমি বলে যাব--মা লিখে যাবে!

আমি গল্প শুরু করলাম। আমার গল্পের 'হিরো' বিশাল করিৎকর্মা লোক। নানান জিনিসপত্র সে আবিষ্কার করে। এই সে রকেট আবিষ্কার করে তো পরক্ষনেই সে মহাদেশ আবিষ্কার করে। লোকটার ধ্যানজ্ঞানে খালি আবিষ্কার আর আবিষ্কার করা! জ্বরের ঘোরে আমি ছাড়া ছাড়া গল্প বলে যাই--মা আমার কেন জানি চোখ মুছতে মুছতে একটা খাতায় গল্প লিখে চলে (আমার মায়ের কান্না-রোগ আছে--যেকোন কিছুতেই চোখে জল চলে আসে)। গল্প বলতে বলতে এক পর্যায়ে আমি উত্তেজিত হয়ে বলি--মা, আমি আসলে বড় হয়ে 'ওর' মত হবো--আমার গল্পের হিরোর মত হবো! মা ঘাড় কাত করে বলে, আচ্ছা হবি না হয়।
--মা, ঐ রকম হতে হলে আমাকে কী করতে হবে বলো তো?
--ঐ তো, ভাল করে পড়াশুনো করতে হবে, বাবা-মায়ের কথা শুনতে হবে--
--আর কী কী করতে হবে?
মা একটু ভেবে বলে ফিজিক্স-কেমিস্ট্রিতে ভাল করতে হবে!

সেই প্রথম ফিজিক্স আর কেমিষ্ট্রির নাম শোনা। সেই প্রথম প্রেমে পড়া। সেই প্রথম ছোট্ট একটা মানুষের জ্বর তপ্ত মস্তিষ্কে একটা চিরস্থায়ী ঘোর লেগে যাওয়া।

সেই ঘটনার বিশ বছর পরের ঘটনা।

আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পাঁচজন লোক গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বিশাল একটা সবুজ রঙের বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কুল কুল করে ঘামছি। আক্ষরিক অর্থে ঘামছি। কারণ আমেরিকা আসার সময় ভেবে এসেছি এইটা তো ঠান্ডার দেশ--সবাই সারা বছরই ঠান্ডায় জুবুথুবু হয়ে থাকে। আমিও তাই দেশ থেকে আসার সময় মন-প্রাণ ভরে গরম ফুলহাতা শার্ট নিয়ে এসেছি। এসেছি অগাস্ট মাসে। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি গুলোতে ফল সেমিষ্টার তখন শুরু হয়। এসে দেখলাম দেশের চেয়ে গরম এখানে কোন অংশে কম না! কিন্তু উপায় কী?! হাতে অত টাকা নেই যে গিয়ে নতুন জামা-কাপড় কিনে ফেলব। তার উপর একগাদা টাকা খরচ করে এই সব অসম্ভব গরম ফ্লানেলের ফুলহাতা শার্ট কিনে এনেছি। এইগুলো ফেলে দিই কী করে?! ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন উঠে গিয়ে আমাকে কিছু ন্যাপকিন এনে দিলেন ঘাম মুছার জন্যে।

পাঁচজনের মধ্যে যার চেহারা সবচেয়ে সদয়, তিনি হাসি মুখে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তো টাড়িক, ফিজিক্স পড়তে চাইছ কেন?

বিশাল একটা রুম, একটা টেবিল ঘিরে বসা পাঁচ পাঁচটি কৌতুহলি মুখ, পেছনে আরো বিশাল সবুজ রঙের বোর্ড, গরমে ঘামে দুশ্চিন্তায় পর্যুদস্ত ---সবকিছু ছাপিয়ে আমি এক মহূর্তে চলে গেলাম আমার সেই ছোট্ট বেলার জ্বরে বিছানায় পড়ে থাকার দিন গুলোতে। চোখের সামনে থেকে দৃশ্যাবলী মুছে গিয়ে আমাকে নিয়ে গেল সাড়ে আট হাজার মাঈল দূরে পৃথিবীর এক সবুজ ছোট্ট কোনে, বিশ বছর আগের এক দিনে ---সেখানে এক বৃষ্টির দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এক রুগ্ন শিশু কিছু গল্প বলছিল তার মা কে। আমি জানিনা ঠিক কী কী বলেছিলাম সেদিন--তবে ভিনদেশি লোকগুলো খুশি হয়েছিল সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। সদয় মুখের ঐ লোকটা এসে কাঁধে চাপড় দিয়ে বলেছিল, গুড লাক, আর কিছু হাফ-হাতা শার্ট কিনতে পারো কি না দেখো!

ফিজিক্স নিয়ে পড়াশুনা দেশেও করেছি। আমি ছিলাম শাবিপ্রবির প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ফিজিক্স নিয়ে পড়ব বলে মেডিকেল-বুয়েট কোনটারই কোন প্রস্তুতি নেই নি--যদিও পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। জীবনের প্রথম দুই দুইটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারার আনন্দ আমাকে আত্মহারা করেছিল। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়া শুরু করেছিলাম। আমার পরিবারে এর আগে কেউ এই পথে পা বাড়ান নি (এতে বোঝা যায় আমার পরিবারের বাকীদের বুদ্ধিশুদ্ধি আমার চেয়ে কতটুকু ভাল ছিল)। আমি কলম্বাসীয় জোশ নিয়ে পথে নেমে পড়লাম।

অচিরেই আবিষ্কার করলাম ভয়াবহ কিছু জিনিসঃ

  • নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান ভাবতাম, আমি আসলে ততটা বুদ্ধিমান নই
  • পদার্থবিজ্ঞান এমন একটা বিষয়--যা প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে চ্যালেঞ্জ করবে, তোমার বুদ্ধিশুদ্ধিকে চ্যালেঞ্জ করবে! চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সামর্থ না থাকলে এইটা পড়া বিপদজনক!

আমি পুতুপুতু টাইপের ছেলে ছিলাম। পরম গ্লানি নিয়ে স্বীকার করছি---ইউনিভার্সিটিতে ওঠার পর আমি প্রথম নিজ হাতে কোন চিঠি পোষ্ট করি। এর আগে আমি জানতামই না কী করে লোকজন চিঠি পোষ্ট করে! তখন আমরা মাত্র জনাবিশেক ছাত্র ক্যাম্পাসে থাকি। রাজ-কামলারা এখানে কাজ করার সময় কিছু অস্থায়ী ঝুপড়ি তুলে ছিল। আমরা যারা গৃহহীন--তাদের জন্যে ঐ ঝুপড়ি গুলো বরাদ্দ করা হয় ছাত্রাবাস হিসেবে। পাশে একটা ছোট ক্যান্টিনও খোলা হল। আমরা ছোট ছোট খাটিয়া পেতে রাতের বেলা বাতি জ্বেলে ফিজিক্স পড়তে লেগে গেলাম। আমাদের খাটিয়ার প্রতিটা পায়ার নীচে দুই তিনটা করে ইট। কারণ? মাঝে মাঝেই ঘরে সাপ ঢুকে পড়ে। ঘুমের ঘোরে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে যদি ওদের গায়ে পা দিয়েছেন তো সরাসরি স্বর্গবাস হবার সম্ভাবনা। বিকেলে বেলা আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সাপ মারা! সন্ধ্যের পর হিসাব মেলানো হত কোন দল কতটা সাপ মেরেছে।

আমি যে পুতুপুতু টাইপ ছিলাম, সেইটা বলেছি? রাতে কেন্টিনের খাবার ছিল ভয়াবহকে ২০০ বার গুন করলে যা দাঁড়ায়, তাই। দাগ ওঠা পাতলা খরখরে টিনের প্লেটে তরকারী বলে যা দেওয়া হত--সেইটা যে আসলে কী ছিল---এই রহস্য আজো অমীমাংসিত। আমি দুয়েকবার চেষ্টা করে বাদ দিয়ে দিলাম। বন্ধুরা বলল, রাতে এবং দিনে না খাওয়া নাকি স্বাস্থ্যের জন্যে হানিকর। আমি তাই দিনে রাতে নান-খাতাই নামের বিস্কিট খাওয়া শুরু করলাম। রাতে এক মগ চা আর তিনটা নানখাতাই এবং দুপুরে চিড়া। মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে পড়লে শহর ( যেটা ভার্সিটি থেকে অনেক দূরে) গিয়ে ভাল-মন্দ খাওয়া। এত করেও শেষ রক্ষা হল না--সমগ্র 'হোস্টেল' জুড়ে সবার চর্মরোগ দেখা দিল। আমাদের হোস্টেল বাসী প্রায় সকলের হাতের আঙ্গুলে, কাঁধে বীভৎস ফুসকুড়ির মত কিছু দেখা দিল। ভয়াবহ অবস্থা! দিনের বেলা ভার্সিটিতে গেলে দেখা যেত আমাদের সবার হাত প্যান্টের পকেটে! এর মাঝে কারো কারো মনে আবার প্রেমোদ্গম হয়েছে। উদ্দিষ্ট নারীর সঙ্গে কথা বলার সময় সর্বক্ষন হাত প্যান্টের পকেটে রাখাটা খুবই সন্দেহজনক!!

যা হোক, এত কষ্ট যার জন্যে---সেই ফিজিক্স দেখা গেল আমার প্রতি বিরূপ। কিছুতেই তার মন পাই না। জিনিসটা আরো ঘোরালো করার জন্যে আমার দেখা দিল স্মৃতিলোপ সমস্যা--পরীক্ষার হলে গিয়ে মাথা পুরাপুরি সাফা হয়ে যায়--একেবারে ঝকঝকে তকতকে। গতরাতে, গত সপ্তাহে, গত মাসে কী পড়েছি---তার কিছুই মনে নেই। সবাই পরীক্ষার খাতার উপর আঁকুপাঁকু করছে--আর আমি অবাক হয়ে সবার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছি।

ফলাফল যা হবার তাই। মহান অভিকর্ষ বলের মত খারাপ রেজাল্ট আমাকে টেনে সবার নীচে নামিয়ে দিল। আমার যারা শিক্ষক ছিলেন তারাও অনেক উপকারী ছিলেন---কথায় কথায় আমাদের মনে করিয়ে দিতেন যে এইটা কত শক্ত এবং সবার ফিজিক্স পড়ার সাধ্য নাই এবং দখিন দুয়ার খোলা--চাইলেই আমরা মেজর বদলে ইকোনমিক্স বা কেমিষ্ট্রিতে চলে যেতে পারি--এখনো সময় আছে!

এতো কিছুর পরও আমি রয়ে গেলাম। হয়ত বোকা বলে, হয়ত কোন এক অসম্ভব জেদের কারণে অথবা হয়ত চির-রোমান্টিক বলে। আমার মনে তখনো আশা---আমি এত ভালবাসি একটা জিনিসকে, এত কষ্ট সহ্য করছি---এর প্রতিদান কি আর পাব না?

এর উত্তর পেতে আমার বিশ বছর সময় লেগেছিল। পৃথিবী অদ্ভুত কিছু বোকা আর গোঁয়ার লোকে পরিপূর্ণ। আমি জেনেছিলাম--আমিও তাদের একজন।

আমি গোঁয়ারগোবিন্দের মত লেগে রইলাম ফিজিক্সের পেছনে। ধীরে ধীরে রেজাল্ট একটু ভাল হল--কিন্তু প্রথম বছরের সেই অপরিসীম খামতি আমার পূরণ করা হয়ে ওঠেনি। এক সময় বুয়েটে আসলাম-- আলী আসগর স্যারের কাছে এম ফিল করলাম--সেও ফিজিক্সে! বিসিএস দিলাম, সরকারী কলেজে ঢুকলাম--ফিজিক্স পড়াতে। দেশের এক অখ্যাত প্রান্তে আমি কিছু কচি কচি মুখকে ফিজিক্স পড়াই--কখনো তাদের স্বপ্ন দেখাই--কখনও হয়ে উঠি আমারই সেইসব 'উপকারী' শিক্ষকের প্রেতচ্ছায়া! বিষাক্ত মুখে তাদের বলি--এইটা তাদের পড়ার যোগ্যতা নেই। এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিতে চাই তাদের মাঝের আলোক শিখাকে। এরপরও তারা আমাকে ভালবাসে। এতকিছুর পরও তাদের চোখের আলো নিবে যায় না।

আমার সেইসব ছাত্র-ছাত্রীদের কারো চোখে যদি কোনভাবে এই লেখাটা পড়ে--তবে জেনো, তোমাদের এক শিক্ষক হাত জোড় করে তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছে। আমার নিজের ব্যর্থতার ছায়া আমি তোমাদের উপর ফেলতে চেয়েছিলাম। আমার কোন অধিকার নেই একদল উৎসুক মানব শিশুকে এমন করে নিরুৎসাহিত করার। অনেক অনেক পরে আমি যখন দেশের বাইরে এসেছি--তখন আমি জেনেছি এরা ছাত্রদের কি অপরিসীম যত্ন নিয়ে পড়ায়। সবচেয়ে গাধা ছাত্রটিকেও তারা কখনো নিরুৎসাহিত করে না। আমি বোকা বলে আমার বুঝতে দেরী হয়েছে--কিন্তু আমি আমার কৃত অপরাধের জন্যে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থী।

যাই হোক, ফিরে যাই ফিজিক্সের সাথে আমার প্রেমের গল্পে!

আমেরিকায় আসার পরে আমার জন্যে ফিজিক্স যে সহজ হয়ে গিয়েছিল--তা নয়। বরং উলটো! এখানে এইটা আরো অনেক কঠিন! আর আমার মত মাঝারি-মানের ছাত্রের জন্যে বলাই বাহুল্য। কিন্তু আমি লেগে রইলাম। আমি ফিজিক্সকে ভাবতাম এক সুপার মডেল হিসাবে! সে যেন এক অপরূপ রূপসী নারী! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মস্তিষ্ক গুলো--যেমন আইন্সটাইন, হান্স বেথে, ভাইনবার্গ, ফাইনম্যান, হকিং প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের মনোযোগ, সান্নিধ্য আর প্রশস্তিতে তার দিন কাটে। অসম্ভব ধী-শক্তির অধিকারী না হলে তার কাছে ঘেষবার সুযোগ নেই কারো। সে যে সুরম্য অট্টালিকায় থাকে--আমি নিজেকে সেই অট্টালিকার সামান্য এক দৌবারিক ভাবি। অন্যান্য মহাজন মহাপুরুষরা যখন আসেন তার সাথে দেখা করতে--আমি দূর থেকে তাদের দেখি। সুবর্ণ কংকন পরা আমার প্রেয়সী ফিজিক্স তাদের সাথে কত রকম আমোদে হেসে যায়- মাঝে মাঝে হয়ত অবহেলে দৃকপাত করে আমার দিকে--আরা আমার শত বছরের কষ্ট সার্থক হয়!

এহেন রোমান্টিকতায় ডুবে থেকে আমি আমার সকল ব্যর্থতার গায়ে আঙুল বুলাই। মাঝে মাঝে মনে হয়-- আমার মা-বাবা আরেকটু স্বার্থপর হলেও তো পারতেন--আরেকটু শক্ত করে তারা বলতে পারতেন, না তোর ফিজিক্স পড়া চলবে না! অথবা অন্য কিছু। তারা তাদের নিজেদের সকল চাওয়া-পাওয়া একদিকে সরিয়ে রেখে আমার জন্যে দিয়েছিলেন উন্মুক্ত আকাশ। আমি সর্বোচ্চ ডিগ্রীটুকু নিয়েছি সত্যি, এমনকি এখন মোটামুটি একটা নামকরা জায়গায় গবেষনা করছি---কিন্তু দিনের শেষে আমি আজো জানি, আমার প্রেয়সীর প্রাসাদে আমি সামান্য এক দৌবারিক, তার মালঞ্চের সামান্য এক মালাকর। এর বেশি আমার কিছু হয়ে ওঠা হবে না। কখনোই হতে পারব না উপরে বলা বড় বড় নামের কোন একজন। এক জীবন আমার কেটে গেল শুধু তার চরণধ্বনি শুনে শুনে--

ভালবেসে পরাস্ত হবার কাহিনী তো কম নয়--এ আমার তেমনি এক পরাস্তপরতার গল্প, আমার এক অসফল ভালবাসার গল্প!!


Comments

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

Quote:
দিনের শেষে আমি আজো জানি, আমার প্রেয়সীর প্রাসাদে আমি সামান্য এক দৌবারিক, তার মালঞ্চের সামান্য এক মালাকর। এর বেশি আমার কিছু হয়ে ওঠা হবে না। কখনোই হতে পারব না উপরে বলা বড় বড় নামের কোন একজন। এক জীবন আমার কেটে গেল শুধু তার চরণধ্বনি শুনে শুনে--

মন খারাপ আমার পদার্থবিদ্যা পঠনের রোমান্টিকতা, ব্যাচের লাস্টম্যান হিসেবে টেনেটুনে স্নাতক পাসেই শেষ, এরপর আর এগুনো হয়নি। তবু স্বপ্ন দেখতে ভাললাগে হয়তো একদিন... শেষমেশ সুনীলের ভাষায়- আমার দেখা হয়না কিছুই। এককালের প্রেয়সীকে রক্ষিতা করে রেখে পেশাগত দায় মেটাতে চুপচাপ নীরেন্দ্রনাথের অন্ধকার ছাপাখানায় ঢুকি। কখনও অবসরে ভাবি- একদিন হয়তো রোদ্দুর হব... ... ...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অনিকেত's picture

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য সত্যানন্দ'দা!
সেই আমরা যারা রোদ্দুর হতে চেয়ে অমলকান্তি হয়ে রয়ে গেছি পৃথিবীর পথে পথে--কোন এক দিন তারা সকলে খুঁজে পাক প্রত্যাশিত ঠিকানা---এই কামনা রইল!!

তিথীডোর's picture

আমি গত ৭২ ঘন্টা ধরে পৃথিবীর তাবৎ একাডেমিশিয়ানদের গালি দিচ্ছি। ডেডলাইন নামক ভ্রান্ত ধারমা নিয়ে ছোটখাট পেপার লিখতে বসলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়। ডক্টরাল থিসিস ক্যামনে লেখে মানুষ, খুদা মালুম!

লোকজনের পড়ালেখা করতে ক্যামনে ভাল লাগে, ক্যান ভাল লাগে সেটাই এখনো ভেবে বের করতে পারলাম না! এক তারা।

অন আ সিরিয়াস নোট, লেখা ভাল হৈসে।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অনিকেত's picture

অনেক ধন্যবাদ তিথী----
জন্মদিন মুবারাক হো---!!

নীলকমলিনী's picture

বিয়ের পর এই প্রথম লেখা নাকি? আশাকরি আমাদের আর অপেক্ষায় না রেখে মাঝে সাঝে লিখবে। খুব ভালো লাগলো। আমিও আমার ভালবাসার বিষয় নিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সংসারের ভালবাসার টানে নিজের ক্যারিয়ারের ভালবাসা শেষ হয়ে গেছে। বিনয় থাকা ভাল, কিন্তু এত বিনয় কেন? তুমি একটা নামকরা জায়গায় গবেষনা করছো সেটাই বা কজনায় করে। প্রাউড অব ইউ।

অনিকেত's picture

অনেক অনেক ধন্যবাদ নীলু'দি লেখাটা পড়ার আর মন্তব্য করার জন্যে। বিয়ের পরে এইটাই প্রথম না মনে হয়। এই আরেকটা লিখে ছিলাম।
আপনাদের স্নেহ আর ভালবাসা আমার চলার পথের পাথেয়!

আপনাদের সবার মঙ্গল হোক!

এক লহমা's picture

হুঁঃ, ফিজিক্স! শুনেছি, প্রেমে পড়লে বুদ্ধিমানে বোকা হয়ে যায়, বোকায় বুদ্ধিমান। তুমি যে আদতে বুদ্ধিমান সেটা বোঝা গেল। তা না হলে ফিজিক্স কেমিষ্ট্রি দুজনের মধ্যে ফিজিক্স-কে বেছে নিয়ে এমন করে তাকে মাথায় তুলে রাখো! কোথায় রহস্যময়ী রসে টইটুম্বুর রসায়ন, আর কোথায় পদার্থবিদ্যা! - আমার কথা নয় কিন্তু! আমি নিজে খুচরো নিয়ে জীবন কাটানো লোক, কোনও বিদ্যার-ই প্রেমে পড়ার গল্প ছিল না! আম বলছি রসায়নবিদ্যার প্রেমিক-প্রেমিকাদের কথা। যাকগে যাক, প্রেমে যখন পড়েইছ চুটিয়ে প্রেম করে নাও। কার সাথে প্রেম করলে তার সাথে প্রেমের কি! আর মাঝে মাঝে এমন রসময় লেখা দিয়ে যাও। তোমার প্রেমিকার কিছু ঝলক, পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ের এক ঝাপটা সুগন্ধ, কি মৃদু পদশব্দ - যত খোড়ো ঘরের আর আটপৌরে গতানুগতিকতার মানুষই হই না কেন, প্রেমের রূপকথায় আপ্লুত হব বলেই ত আড্ডাঘরে এসে ঘুরে ঘুরে যাই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অনিকেত's picture

Quote:
তোমার প্রেমিকার কিছু ঝলক, পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময়ের এক ঝাপটা সুগন্ধ, কি মৃদু পদশব্দ - যত খোড়ো ঘরের আর আটপৌরে গতানুগতিকতার মানুষই হই না কেন, প্রেমের রূপকথায় আপ্লুত হব বলেই ত আড্ডাঘরে এসে ঘুরে ঘুরে যাই।

এমন একটা মন্তব্য পেলে কার না ভাল লাগে বলুন দাদা? অনেক অনেক শুভ কামনা জানিয়ে দিলাম--

স্পর্শ's picture

অনবদ্য অনিকেত দা। খুব ছুঁয়ে গেল আপনার কথাগুলো। জাফর ইকবাল স্যার কি আপনাদের শিক্ষক ছিলেন শাহজালালএ?
আপনি আপনার স্বপ্নকে তাড়া করতে পেরেছেন। সবার সেই সৌভাগ্য, বা সাহস হয় না।

আপনার থিসিস/বর্তমান গবেষণার বিষয় কি জানতে কৌতূহল হচ্ছে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অনিকেত's picture

Quote:
আপনি আপনার স্বপ্নকে তাড়া করতে পেরেছেন। সবার সেই সৌভাগ্য, বা সাহস হয় না।

সেইটার জন্যে আমার আসলেই নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়। মূল কৃতিত্বটা আমি অবশ্য আমার বাবা-মা কেই দিতে চাই। একটা সম্পূর্ণ সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের এমন ঘোড়া রোগ হলে সাধারণত চাবকে সেই রোগ ছাড়িয়ে দেওয়া হয়--- আমার বাবা-মা প্রথার সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে আমাকে একটা অসম্ভব স্বপ্নের পেছনে ছুটতে দিয়েছেন সংসারের সমস্ত ক্লেশ থেকে, দায় থেকে আমাকে দূরে রেখে! এইটার ঋণ শোধ হবার নয়!

Quote:
আপনার থিসিস/বর্তমান গবেষণার বিষয় কি জানতে কৌতূহল হচ্ছে।

আমার পিএইচডির কাজ ছিল আধান আবদ্ধীকরণ (Ion Trapping), দ্বিমাত্রিক ইলেকট্রন তরল (2D Electron Fluid) আর কম্পুটেশনাল ফ্লুইড ডিন্যামিক্স নিয়ে। ঐ সময়ে কষ্ট হলেও বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম কাজ করতে। এখন কাজ করছি Brookhaven National Lab এ Nationa Synchotron Light source-2 (NSLS II) এর Photon Science ডিভিশনে। এক্স-রে ডিটেকশনের জন্যে একটা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্যে।

লেখাটা পড়া আর সহৃদয় মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ স্পর্শ!

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

Quote:
একটা সম্পূর্ণ সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের এমন ঘোড়া রোগ হলে সাধারণত চাবকে সেই রোগ ছাড়িয়ে দেওয়া হয়--- আমার বাবা-মা প্রথার সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে আমাকে একটা অসম্ভব স্বপ্নের পেছনে ছুটতে দিয়েছেন সংসারের সমস্ত ক্লেশ থেকে, দায় থেকে আমাকে দূরে রেখে! এইটার ঋণ শোধ হবার নয়!

চলুক এই ঋণ আমারও শোধ হবার নয়!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তানিম এহসান's picture

ভাল লাগলো। হাসি

অনিকেত's picture

ধন্যবাদ তানিম--ভাল থাকবেন সকল সময়ে!

কনফুসিয়াস's picture

মায়াময় লেখা।
আপনার লেখা পড়ে আমার সর্ব প্রথম মাথায় এলো, কী সর্বনাশ, দৌবারিক শব্দের মানে আমি জানি না! অ্যাঁ

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অনিকেত's picture

হা হা হা ---পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ কনফু ভাই!

তাহসিন রেজা's picture

লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম। পড়তে পারিনি। তার বদলে গাছপালা, ডিএনএ আরএনএ নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। তবে আফসোস নেই, ভালোবেসে ফেলেছি এই বিষয়টাকেও। টেবিলের একপাশে ফ্রস্ট -কীটস -ওয়ার্ডসওয়ার্থ, অন্যপাশে প্ল্যান্ট প্যাথোলজি, ট্যাক্সোনমি নিয়ে সুখেই আছি।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

অনিকেত's picture

Quote:
তবে আফসোস নেই, ভালোবেসে ফেলেছি এই বিষয়টাকেও।

বাহ, তাহলে তো আর কোন ব্যাপারই না!
পড়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ!

তারেক অণু's picture

ভালো লাগল, আপনার গান আবার কবে শুনছি?

অনিকেত's picture

পড়ার জন্যে ধইন্যা বস!! গান আসিতেসে---
শুভেচ্ছা নিরন্তর!!!

মিলু's picture

মায়াভরা একটা লেখা। খুবই ভাল লাগল। আপনার জেদ আর একাগ্রতাকে সালাম জানাই। এমন শক্তি আমার কোনকালেই ছিল না, হবেও না জানি।

ভালো থাকবেন অনিকেতদা!

অনিকেত's picture

তোমার মত যদি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবার সাহস/সামর্থ্য আমার থাকত ---হায় !!!
পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ মিলু !!

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.