পথুয়া গল্প ১: কান্ডারি

মাহবুব লীলেন's picture
Submitted by leelen on Sun, 03/05/2015 - 12:31pm
Categories:

বহু আগে এক ঝড়ের সন্ধ্যায় কুশিয়ারা নদী পার হওয়া প্রয়োজন ছিল আমার। বৃষ্টি ও বাছাড়ে তখন সকল খেয়া বন্ধ করে বসেছিল মাঝিদের দল। যাত্রীরা নদীপারে কেউ ছাতা কেউ কলাপাতা কেউ হাতের তালু মাথায় দিয়ে নিজেদের বিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতা হাতড়িয়ে আশাবাদী কিংবা হতাশ হচ্ছিল সম্ভাব্য শীঘ্র প্রথম খেয়া নৌকার যাত্রাকালে। কিন্তু কেউই তাড়া দিচ্ছিল না মাঝিদের...

খেয়াঘাটে এক চক্কর মেরে আমি গুটিসুটি মাঝিদের কাছে দাঁড়িয়ে একটা টিটকারি মারি- এই ঘাটের মাঝিরা সব নয়ামাঝি নাকি?

যাত্রীরা কেউ আমার কথা শোনে না কিন্তু পাশ থেকে এক বয়স্ক গলা বের হয়ে আসে- মাঝিরা নতুন হবে কেন?
- মাঝি যদি নতুন না হয় তবে নৌকা বন্ধ করে আছে কেন?

তিড়িং করে এইবার লাফিয়ে উঠে প্রবীণ অহংকার- তুমি যদি নৌকায় উঠতে ভয় না পাও তবে আমি ডরাব কেন?
- আপনি যদি নৌকা ছাড়তে না ডরান তবে নৌকা চড়তে আমার কী ভয়?

আর একটাও কথা না বলে বৈঠা বাগিয়ে গটগট করে মাঝি গিয়ে নৌকায় দাঁড়ায় আর যারা নিজের অভিজ্ঞতার চেয়ে মাঝির বিচক্ষণতায় বেশি ভরসা রাখে তারা পিলপিল করে উঠে পড়ে নৌকায় আর দূরে এক ছাপড়ার নীচে বসা সহকারীকে বাদ দিয়েই নৌকা ভাসিয়ে দেয় খ্যাপাটে মাঝি...

অতিরিক্ত যাত্রীর ভারে নৌকার কানা পানি ছুঁই ছুঁই করে। এইবার যাত্রীরা একে অন্যরে সাবধান করে- সিধা হয়ে খাড়াও মিয়া। দেখো না নড়লে নৌকায় পানি উঠে?

সিধা হয়ে খাড়াতে গিয়ে যাত্রীরা আবার নৌকা নাড়ায়। এইবার সকলের খেয়াল হয় ধারণ ক্ষমতার বাইরে যাত্রী উঠে গেছে নৌকায়। এইবার সকলে গালাগাল শুরু করে মাঝিরে- বুইড়া হইছ মিয়া কিন্তু কোনো আক্কেল হয় নাই তোমার। অত মানুষ কেন উঠাইছ নৌকায়?

ঢেউ খেলানো পানিতে বৈঠার ঘাই মারতে মারতে মাঝিও উল্টা ঝাড়ি লয়- আমি কি কাউরে কোলে নিয়া উঠাইছি? নিজেগো আক্কেল নাই মিয়া? এইটুকু নৌকায় কয়জন মানুষ উঠতে পারে না পারে দেইখা বোঝো না তোমরা?

যাত্রীরা মাঝিরে খেপায় আর মাঝি জোরে ঘাই মারে জলে আর ঘাইয়ের ধাক্কায় তার পুরোনো বৈঠাটা মটাৎ করে ভেঙে ভেসে যায় জলে...

মাঝির খেয়াল হয় নৌকার দ্বিতীয় বৈঠাটা রয়ে গেছে পাড়ে ফেলে আসা সহকারীর হাতে। মাঝি এইবার চুপচাপ বসে থাকে। যাত্রীরা এইবার মাঝিরে জিগায় কার বুদ্ধিতে এই বাছাড়ে নৌকা ভাসিয়েছে সে...

মাঝি আমার দিকে একবার তাকায়; কিন্তু দোষটা সে আমারে দেয় না। এইবার সে সমস্ত বিপন্নতার দায় কাঁধে নিয়ে ভাঙা বৈঠার বাঁট ধরে ঝড় বৃষ্টি আর পানিকে নাড়ায়। একেবারে চুপ; একেবারে একা। কারণ সে জানে একবার মাঝি হয়ে গেলে বহু মানুষকে নিয়ে তাকে একেবারে একলাই ভেসে যেতে হয়...

২০১৫.০৪.০৪ শনিবার


Comments

অতিথি লেখক's picture

Quote:
কারণ সে জানে একবার মাঝি হয়ে গেলে বহু মানুষকে নিয়ে তাকে একেবারে একলাই ভেসে যেতে হয়...

বাহ।

খুব ভালো লাগলো লীলেনদা।

গল্প-২ এর আশায়।

স্বয়ম

অতিথি লেখক's picture

এতটুকু পরিসরে, মানুষের হীনতাবোধ আর কাণ্ডারীদের চিরাচরিত নিসঙ্গতা এতো দারুনভােব ধরা যায় কেমনে। এতো অল্প কথায় এতো দারুন---কেমনে কি?

স্বয়ম

শোহেইল মতাহির চৌধুরী's picture

মাঝি আমার দিকে একবার তাকায়; কিন্তু দোষটা সে আমারে দেয় না। এইবার সে সমস্ত বিপন্নতার দায় কাঁধে নিয়ে ভাঙা বৈঠার বাঁট ধরে ঝড় বৃষ্টি আর পানিকে নাড়ায়। একেবারে চুপ; একেবারে একা।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

তাপস শর্মা's picture

শুরু করলাম... তবে তৃপ্তি হয়নি। কিন্তু অন্যরকম একটা জিজ্ঞাসা জাগালো মনে। তাই যেহেতু সিরিজ হতে যাচ্ছে সামনের দিকের তাকিয়ে রইলাম

০২

গল্পের ধরণটা দেখে মনে হলো 'বেবাট' গল্পগ্রন্থের গল্পগুলির ধারার সাথে কিঞ্চিত মিল হতে পারে। কিন্তু আবার কোথায়ও মনে হচ্ছে - না, পুরো মিল নেই...

০৩

শেষ কথা, 'কথাকলি'র জন্য রেগুল্লার চিল্লাচিল্লি করা চলতে থাকবে...

হাসিব's picture

শেষ প্যারাটা লেখার জন্যই গল্পটার জন্ম এরকমটা মনে হলো। ঠিক ধরলাম?

এক লহমা's picture

"একবার মাঝি হয়ে গেলে বহু মানুষকে নিয়ে তাকে একেবারে একলাই ভেসে যেতে হয়..."

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

শান্ত's picture

শেষ লাইনটা নিয়া অনেক অনেক কিছু চিন্তা করা যেতে পারে।

__________
সুপ্রিয় দেব শান্ত

জিল্লুর রহমান (সোহাগ)'s picture

শুরুর দিকে খুব একটা ভালো না লাগলেও একদম শেষের দিকে এসে মনে হলো ভাবার মতো অনেক রসদ আছে গল্পটার মাঝে।

বিঃদ্রঃ লীলেন ভাই, "অভাজনের মহাভারত" পড়া শুরু করছি। যতটুকু পড়েছি, ভালোলাগাটা প্রকাশ করবার কোন ভাষা নেই। সিম্পলি ব্রিলিয়ান্ট....

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই's picture

Quote:
একবার মাঝি হয়ে গেলে বহু মানুষকে নিয়ে তাকে একেবারে একলাই ভেসে যেতে হয়...

খুব ভালো লাগলো।

dr.tamjid's picture

এক কথায় ‌অসাধারণ। কোলাকুলি

সোনালী  ইসলাম 's picture

আমরা কবে এমন মাঝি হয়ে উঠতে পারব জানিনা, তবে লিলেন যে ভাবতে পেরেছেন এমন এক মাঝির কথা তার জন্য কৃতজ্ঞতা রইল। আর ও অনেক এমন চরিত্রের অপক্ষায় রইলাম।

আবদুর's picture

একেবারে কাবাব-কাবাব লেখা, খেলাম, মজা পেলাম, আর পরের পর্বের জন্য টেবিলে বসে রইলাম। একটু তারাতারি দিয়েন ভাই নাহলে যে বসে-বসে মরতে হবে।

অতিথি লেখক's picture

লীলেন'দা এককথায় অসাধারন! হাসি
কি বলব,সবার মত আমার নিকটও শেষোর্ধ্ব চরণ টির
ভাবগাম্ভীর্য অপরূপ লেগেছে।

অতিথি লেখক's picture

রামায়ণের কারণে এমন ভালো গল্প থেকে বঞ্চিত হচ্ছি লীলেন!

---- মোখলেস হোসেন

মাহবুব লীলেন's picture

আর বইল না। জীবনটা তামা তামা হয়ে আছে রামায়ণে। না আছে অন্য কিছু পড়ার উপায় না আছে লেখার। আবার শেষ করত্ওে পারছি না সহজে

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.