ইমা(৪)

তুলিরেখা's picture
Submitted by tuli1 on Mon, 20/04/2015 - 4:58am
Categories:

গ্রীষ্মের ছুটি ফুরিয়ে গিয়ে একদিন স্কুল খুলে গেল আমাদের। আমি আর রিমা আবার স্কুলে যেতে শুরু করলাম।

কিছুদিন ক্লাস হয়েই শুরু হয়ে গেল ষাণ্মাসিক পরীক্ষা। সেই প্রথম আমাদের অত বড়ো এক একটা টানা আড়াই ঘন্টার লিখিত পরীক্ষা। আগে প্রাথমিক স্কুলে পরীক্ষা ছিল ছোটোখাটো, এক একটা বড়োজোর ঘন্টাখানেকের। মৌখিকও হতো কিছু কিছু। কিন্তু হাই-স্কুলে আমাদের সেই প্রথম বাংলা অংক ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান সব বিষয়ের লিখিত পরীক্ষা হলো। ক্লাস ফাইভে তখন ইংরেজী ছিল না, ক্লাস সিক্স থেকে শুরু হবার কথা ছিল।

আলাদা ঘরে সীট পড়া, সীট নম্বর মিলিয়ে বসা, পিচবোর্ডে কাগজ আটকে পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর লেখা, সব লেখা হয়ে গেলে সুতো দিয়ে বেঁধে জমা দেওয়া-পুরো ব্যাপারটাই নতুন ছিল আমাদের কাছে। আগের স্কুলে ঐ রকম পরীক্ষা হতো না। বেশ ঘাবড়েই গি্যেছিলাম প্রথম দিন। পাশে সীট পড়েছিল ক্লাস এইট-নাইনের দিদিদের, ওরা খানিকটা স্নেহভরেই আমাদের সব নিয়ম টিয়ম শিখিয়ে দিচ্ছিল।

এক একদিন দুটো করে পরীক্ষা, সকালে আড়াই ঘন্টা, মাঝে ঘন্টাখানেকের টিফিন বিরতির পরে আবার বিকেলে আড়াই ঘন্টার পরীক্ষা। পরদিন ছুটি। তারপরে আবার দুটো পরীক্ষা। আবার ছুটি একদিন, শেষে পঞ্চম পরীক্ষা হয়ে আর সেই বিকেলে কিছু নেই। পরদিনও ছুটি। শেষ পরীক্ষা হয়ে যাবার পরে আমরা সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। পরদিন কী একটা মেলা ছিল, অনেকেই সেখানে যাবে বলছিল। পরীক্ষা শেষের আনন্দ সেলিব্রেট করতে।

তবে পরীক্ষা হয়ে গেলে ঐ একদিন ছুটির পরেই আবার নিয়মিত ক্লাস হতে শুরু করে দিল। আবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে বিকেল সাড়ে তিনটে অবধি চলতে লাগলো। শনিবারে অবশ্য হাফ-ছুটি আর রবিবারে একদম ছুটি। ক্লাসের বন্ধুরা অনেকেই অবশ্য শনিবারে আর রবিবারে গানের ক্লাসে বা নাচের ক্লাসে যেত। শনি রাবিবারে আমার আর রিমার ছিল ক্লাবের পুকুরে সাঁতার ।

হাফ ইয়ার্লির রেজাল্ট বেরোলে বেশ অবাক কান্ড দেখা গেল। এতকাল প্রাইমারি স্কুলে আমাদের দুই বোনের রেজাল্ট মোটামুটি একরকমই ছিল, মাঝারি। এখন দেখা গেল আমার অঙ্কে, ভূগোলে আর বিজ্ঞানে রিমার তুলনায় অনেক বেশী নম্বর। ওর থেকেই যে বেশী তাই শুধু না, গোটা ক্লাসের মধ্যেই অঙ্কে আর বিজ্ঞানে হায়েস্ট।

আমার এত অসুখের মধ্যে গ্রীষ্মের ছুটিটা কেটেছিল বলে কেউ আশাই করেনি আমার রেজাল্ট আদৌ ভালো হবে, কোনোমতে পাশ করলেই যথেষ্ট এইরকম ভাবই ছিল। তারমধ্যে এই অদ্ভুত কান্ড। আমার কেমন যেন একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছিল যা আগে কোনোদিন হয় নি। একধরণের প্রতিশোধের আনন্দ আর তারই সঙ্গে হঠাৎ একলা হয়ে যাবার শিরশিরে শীত।

রেজাল্ট বেরোনোর দিন কিন্তু বাড়ীতে আমাকে সামান্য কিছু উৎসাহবাক্য আর রিমাকে সামান্য বকাঝকা করা ছাড়া আর কিছু হলো না। রিমা খুব ভয়ে ভয়ে ছিল ওকে হয়তো শাস্তি টাস্তি দেবে বাবা অথবা মা, তা সেরকম কিছু হলো না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে শান্ত মেয়ে রিমা আরো চুপচাপ হয়ে গেল।

তারপরের কটা মাস কোথা দিয়ে উড়ে গেল, বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলে আবার ছুটি, প্রায় মাসখানেকের। রেজাল্ট বেরোলো ডিসেম্বরের শেষে, জানুয়ারীর দু'তারিখে ক্লাস সিক্সে গিয়ে বসলাম আমরা। বার্ষিক পরীক্ষায় আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছিলাম বলে আমার রোল নম্বর হলো ১ আর রিমা মাঝারি রেজাল্ট করেছিল, ওর রোল নম্বর হয়েছিল ২৩।

রিমার ভয় ছিল ওকে বাড়ীর লোকেরা কী করবে সেই ভেবে। কিন্তু বাড়ীতে সেরকম ঝামেলা কিছু হয় নি। আসলে আমাদের আবাহনও ছিল না, বিসর্জনও না। হয়তো ধরেই নেওয়া হয়েছিল রিমা মাঝারিই থাকবে আর ইমাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে, কারণ ইমা যে কালো! রেজাল্ট ভালো না করতে পারলে তার চাকরিবাকরি জুটবে কীকরে, জীবন চলবে কী করে? ফর্সা সুন্দরী রিমাকে তো পক্ষীরাজে চড়ে রাজপুত্র এসে বিয়ে করে নিয়ে যাবে, কালীতারা রূপের ধ্বজা ইমাকে তো আর রাজপুত্তুর উদ্ধার করবে না, তার নিজের রাস্তা নিজেকেই দেখতে হবে। ভাবলে অবাক লাগে সেই ছোট্টো বয়সেই কেমন একরকম করে এই ব্যাপারগুলো বুঝতে পারতাম ঠিকই, হয়তো এইভাবে এত গুছিয়ে নয়, কিন্তু মূল ব্যাপারটা ধরতে পারতাম। চারিপাশে বড়দের হাবভাব আচার-আচরণ কথাবার্তা থেকেই হয়তো আভাস পেতাম, কেজানে!

ক্লাস সিক্সে উঠেই আমার আর রিমার ক্লাবের পুকুরে সাঁতার বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ীর লোকেরা রাজী না আর আমাদের যেতে দিতে। আমরা নাকি বড় হয়ে গেছি। রিমা সাঁতার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিল আনন্দেই, ওর এমনিতেও নাকি আর বিশেষ ভালো লাগছিল না।

কিন্তু আমার দুনিয়াটা হঠাৎ কেমন যেন খালি খালি হয়ে গেল। শনি রবিবার বিকেল ছিল আমাদের সাঁতারের। হঠাৎ সেসব বন্ধ হয়ে যেতে অদ্ভুত একটা অবসন্নতা ঘিরে ধরলো।

রিমা কিন্তু বেশ মজায় ছিল, আমাকে বল্লো, "ইমা, জানিস পিঙ্কি আর ওর দিদি মুনিয়াদি আমাকে বলেছে আমার গানের গলা ভালো। আমাকে সবুজবীথির গানের ক্লাসে ভর্তি করে দেবে মা। তুই যদি চাস, তুইও ভর্তি হবি। "
সবুজবীথি ছিল আমাদের অঞ্চলের খুব জনপ্রিয় নাচগানের প্রতিষ্ঠান।

অবাক হয়ে গেলাম রিমার কথা শুনে। কবে যেন দূরত্ব তৈরী হয়ে গিয়েছে আমাদের দু'জনের। কবেই বা ওর পিঙ্কির সঙ্গে এত বন্ধুত্ব হলো যে ওদের বাড়ীতে গিয়ে গান করা, ওর দিদির সাজেশন এতদূর অবধি পৌঁছে গেল?

তাহলে কি আমাদের পরীক্ষার ফলাফলের অতটা তফাতের পর থেকেই রিমা আলগা হয়ে গেল আমার থেকে? ওর অঙ্ক ভালো লাগে না, বিজ্ঞান ভালো লাগে না, সেকথা ও আমাকে বলেওছে। আমার কাছে কিছু বুঝতে চাইলে যদ্দূর সম্ভব বুঝিয়েও দিয়েছি। কিন্তু মনে হয় তাতে ওর সেরকম কোনো লাভ হয় নি। অবশ্য সবাই অঙ্ক বিজ্ঞান ইত্যাদি ভালোবাসবে তার কি মানে আছে? পড়াশোনা ছাড়াও অনেক রকম জিনিস আছে, সেগুলো করেও লোকে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। হয়তো রিমা গান নিয়ে এগোতে চায়।

আমি আস্তে আস্তে বললাম, "না রে রিমা, আমার গান সেরকম আসে না। আমি বরং তোর গান শুনবো তুই শিখে ফিরলে। "

(চলছে)

আগের ১ম পর্ব , ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব


Comments

মরুদ্যান's picture

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

তুলিরেখা's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

এক লহমা's picture

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক's picture

পড়ে যাচ্ছি ইমার গল্প।

স্বয়ম

তুলিরেখা's picture

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

অতিথি লেখক's picture

পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

তুলিরেখা's picture

ধন্যবাদ। পরের পর্ব লেখা হয়ে গেলেই দিয়ে দেবো। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.