বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-৩৪ : ধুতরা

আব্দুল গাফফার রনি's picture
Submitted by ronygaffar [Guest] on Sat, 21/06/2014 - 5:15pm
Categories:


ধুতরাকে গাঁয়ের মানুষে ভয় পায়। কারণ এর ফুল বড্ড বিষাক্ত। আমরাও ভয় পেতাম। কিন্তু মাঝে-মাঝেই ভুলে যেতাম ভয়ের কথা, ধুতরার বিষের কথা। মা-দাদীরা বলতেন, ধুতরোর ফুল নাকে শুঁকলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। কথাটা কতটা সত্যি জানতাম না। তবে ধুতরোর ফুল নিয়ে খেলা করলেও নাকে শুঁকতাম না কখনও।


গাছিদের জন্য ধুতরার ফুল মোক্ষম অস্ত্র। রাতে রস চুরি হয়। রস চোরের সিংহভাগই কিশোর। এরা শুধু খাওয়ার জন্য রস চুরি করত, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়। এদের ঠেকাতে সন্ধ্যাবেলায় রসের ভাড়ের ভেতর ডালসহ ধুতরা ফুল ভরে আসতেন গাছিরা। রস থাকত নিরাপদ। ফুলের বিষের ভয়েই নিরাপদ।


ধুতরাকে আমরা আর সব পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষার মতো বলতাম ধুতরো। ধুতরোর ফল নিয়ে খেলা করতাম আমরা। খেলাঘরের সব্জি। নিষ্ঠুর খেলাও ছিল একটা--হাতের তালুতে রেখে ওপর দিকে ছুঁড়ে মারা। তারপর সেটা মাটিতে পড়ার আগেই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে পতন ঠেকানো। অনেকটা গুটি খেলার মতো। কিন্তু এটাই খেলার আসল উদ্দেশ্য নয়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে যখন ধুতরো ফলের পতন ঠেকানো হত, তখন এর কাঁটা বিঁধে যেত হাতে। সেখান থেকে উঁকি দিত এক ফোঁটা রক্ত। যার হাতে যে যত বেশি রক্তের ফোঁটা, খেলায় তারই জিত। সুতরাং নিষ্ঠুর খেলা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে তাকে?


আগে রাস্তার পাশে ঝোপের ভেতরে যেখানে সেখনে দেখা যেত ধুতরো গাছ। ফুলে ফুলে সাদা হয়ে উঠত রাস্তার দু’পাশ। এখন ধুতরো গাছের সংখ্যা কমে এসেছে গ্রামাঞ্চলে। শহরে তো এ ফুল আগেও দেখা যেত না, এখন দেখার প্রশ্নই ওঠে না। তবু কিন্তু কয়েকটা গাছ আছে ঢাকা শহরে! আমিও জানতাম না। একদিন বলধা গার্ডেনে গিয়েছিলাম গাছ-পালার ছবি ওঠাতে। ওখানেই পেয়ে গেলাম ফুল-ফলসহ বেশ কয়েকটা গাছ।


বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই ধুতরো গাছ দেখা যেত আগে। সাধারণত শুষ্ক মাটিতে জন্মায় এরা। গাছ ৩-৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। ঝোপালো। গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ।


কাণ্ড সাদাটে ধূসর। কাণ্ডের প্রায় গোড়া থেকেই ডাল বের হয়। তাই পুরোপুরি ঝোপ তৈরি করতে পারে ধুতরো গাছ। কাণ্ড মোটামুটি শক্ত। হালকা-পাতলা। ডাল-পালা নরম।


ধুতরোর পাতা সবুজ রঙের। উপবৃত্তাকার। পাতা বেশ বড়। ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা হয়, চওড়া ৩ ইঞ্চির মতো। একটা বোঁটায় একটা মাত্র পাতা থাকে। পাতা নরম।


ধুতরো ফুল সাদা রঙের। মাইকের মতো দেখতে। লম্বাটে। এক পাপড়ি বিশিষ্ট। মঞ্জরী এক পুষ্পক। ফুল ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা হয়। ফুলের ব্যাস ২-৩ ইঞ্চি। ফুলের পরিধির কিনারগুলো চার পাঁচ জায়গায় কোঁচকানো। প্রতিটা কুঁচিতে একটা করে চূড়া থাকে। ফুলের ভেতর ৩/৪ টা কেশর থাকে। কেশরের পরাগরেণুতেই থাকে বিষাক্ত উপাদান।

Quote:
পুকুর পাড়ে ধুতরা ফুলের সমারোহ। গুনে গুনে চারটে ফুল হাতে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে সেগুলো মুখে পুরে দিয়ে নীরবে ঘুমিয়ে পড়লেন।
--হাজার বছর ধরে, জহির রায়হান

]
ফুলের কুড়ি সবুজ, মোঁচাকৃতির।


ধুতরো ফল গোলাকার। সবুজ রঙের। গায়ে কাঁঠালের মতো সবুজ রঙের ভোঁতা কাঁটা থাকে। ভেতরে মোটর দানার মতো সাদা বীজ থাকে। পাকলে বীজ ছাই রং ধারণ করে।
ধুতরো বারোমাসী গুল্ম। সারা বছর ফুল-ফল ধরে। ধুতরোর বৈজ্ঞানিক নাম: Datura metel Linn.

আগের পর্ব : বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-৩৩ : ময়নাকাঁটা

ছবি: 
17/05/2012 - 12:40পূর্বাহ্ন

Comments

এক লহমা's picture

চলুক
কিন্তু একটা খটকা লাগছে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ধুতুরা বা ধুতরা গাছের সমস্ত কিছুই বিষাক্ত। উইকি-তে জানানো হচ্ছে ধুতরা "এক প্রকারের বিষাক্ত উদ্ভিদ। এর সমস্ত অংশই বিষাক্ত। এতে আছে বিপজ্জনক মাত্রার tropane alkaloids নামক বিষ। এই গাছের বিষক্রিয়ায় মানুষ বা পশুপাখির মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।" "All parts of Datura plants contain dangerous levels of tropane alkaloids (highly poisonous) and may be fatal if ingested by humans or other animals, including livestock and pets." এই রকম ভয়ানক গাছ-কে গাছিরা রস চুরি ঠেকাতে ব্যবহার করত? আপনি জানাচ্ছেন "গাছিদের জন্য ধুতরার ফুল মোক্ষম অস্ত্র। ... ... সন্ধ্যাবেলায় রসের ভাড়ের ভেতর ডালসহ ধুতরা ফুল ভরে আসতেন গাছিরা। রস থাকত নিরাপদ। ফুলের বিষের ভয়েই নিরাপদ।" নিরাপদ থাকত হয়ত, ভাল থাকত কি? বিষিয়ে যেত না? ঐ রস খেয়ে মানুষের ক্ষতি হত না? ব্যবসা চলত কি করে তা'হলে?

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আব্দুল গাফফার রনি's picture

দিদি/দাদা, এই ব্যাপারটা আমি নিশ্চয়ই করে বলতে পারছি না, হয়তো তা-ই, ধুতরো গাছের সবটাই হয়তো বিষাক্ত। রস নিরাপদ থাকত, তবে বিষাক্ত রস কেউ খেত না। গাছিরা কিন্তু রসের ব্যবসা করত না। মাঠে চাষিদের বিরাট বিরাট খেজুর বাগান ছিল। গুড় উৎপাদনই যার মূল লক্ষ্য্য, রস বেচা নয়। গাছিদের ধারণা রস জ্বালানোর পর গুড় হলে তাতে আর ওই বিষাক্ত উপাদান থাকে নাম, প্রচন্ড তাপে নষ্ট হয়ে যায়। আর রস খাওয়ার জন্য খুব বড় বড় গাছগুলো বাছাই করা হত, অতবড় গাছে উঠে রস চুরি করা কষ্টকর, সেই গাছের রসই সকালে আমাদের ভাগে জুটত।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

দীনহিন's picture

Quote:
কাণ্ড মোটামুটি শক্ত। হালকা-পাতলা।

শক্ত, পাতলা?

আর লহমাদাদা যেই প্রশ্নখানি করেছেন, তা আমারও!

পরিশেষে, অনেক ধন্যবাদ গাফফার ভাই! আপনার এই সিরিজটি মিস্‌ করার মত নয়!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

আব্দুল গাফফার রনি's picture

কিছু গাছ আছে, একবারে হালকা-পাতলা, কিন্তু বেজায় শক্ত। ভাঙতে রীতিমত কসরৎ করতে হয়। ছবিতে এর কাণ্ড নরম দেখাচ্ছে, কারণ একেবারেই তরুণ গাছ, বয়সী গাছের কাণ্ড অন্যরকম।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

প্রৌঢ় ভাবনা's picture

ইদানিং সচলে লেখায় মন্তব্যের সংখ্যা কমে গিয়েছে। যাহোক, তারপরও বলবো আপনার এই সিরিজটা চালিয়ে যান।
লিখতে থাকুন। আরও সব বিষয় নিয়ে।

আব্দুল গাফফার রনি's picture

সম্ভবত ফুটবল বিশ্বকাপের কারণেই পৌঢ়দা। আমার সিরিজটার পেছনে আদাজল খেয়ে লেগেছি, ঈদে বাড়ি গিয়ে অমূল্য কিছু ছবি নিয়ে আসব, আশা রাখি।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক's picture

ভাল লাগল লেখাটা পড়ে! কিছু জানলাম! ধন্যবাদ! -মোঃ জাকির হোসেন

আব্দুল গাফফার রনি's picture

ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন এবং সচলের সাত থাকবেন আশা করি।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক's picture

এই ফলতো আমি অনেক দেখেছি! কিন্তু জানতামনা এইটাই ধুতরা। ছোটকালের একটা কাহিনী মনে পড়ল, আমাদের এক প্রতিবেশীর কাজের লোক এই গাছের পাতা তুলে এনেছিল ভাজি করে খাওয়ার জন্য, অন্য শাক মনে করে। দুপুরের পর ঐ বাড়ির একেকজন একধরণের পাগলামি শুরু করে। কাজের লোকটার ঘরের উঠোনে গামছা দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য আমার ঝাপসা-ঝাপসা মনে আছে, আরেক মহিলা হেঁড়ে গলায় সম্ভবত গান গাচ্ছিলো। শেষে পাড়া-প্রতিবেশীরা মিলে বাড়ীর সবাইকে মেডিকেলে দিয়ে আসে, পাকস্থলী ওয়াশ করার পর রক্ষে। আপনার সব সিরিজ পড়ে ফেলব শিগগির।

-- চুরূৎ-ফ্যাক্টর

আব্দুল গাফফার রনি's picture

ধন্যবাদ।
এই লেখা পোস্ট করার পর একটা একটা বই পড়তে বসেছিলাম, উইলবার স্মিথের রিভার গড। লেখাটা মৌলিক নয়। ১৯৮৮ সালে মিশরে সন্ধান পাওয়া যায় ফারাও রাজা মামোস সমাধী। সেই সমাধী প্লাস্টার ধ্বসে বেরিয়ে আসে প্যাপিরাসেরর মহামূল্যবান একরাশ স্ক্রোল। সেই স্ক্রোলের পাঠ্যোদ্ধার করে স্মিথ লেখেন অসান্য এই কাহিনী। অবাক হই, সেই চার হাজার বছর আগের মিশরে ধুতরার বীজ দিয়ে তৈরি হতো সবচেয়ে মারাত্মক বিষ!

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

Pintu's picture

বিষ কুটুলি কী ? Pls picture soho bolen

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.