আমাদের শহরে একটি কালো রেলগাড়ি

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Thu, 29/03/2012 - 2:22pm
Categories:

ভোরবেলা পুকুর ঘাটে এসে মধুসূদন বাবু হকচকিয়ে গেলেন।

ঘাটের বেদির উপর ইতস্তত পিপুল গাছের পাতা আর ডালপালা ছড়ানো। এপ্রিল মাসে প্রায়ই ঝড়জল হয়। ঝড়ের প্রচণ্ড দাপটে গাছপালাগুলো জবুথবু হয়ে থাকে। পাতা আর ডালপালাও ঝরে পড়ে মাঝেশাঝে। পিপুল গাছের ডাল আর পাতাগুলো বেশ শক্তপোক্ত। সহজে অল্পস্বল্প ঝড়ের তোড়ে ভাঙ্গে না। গেলো রাতে তেমন ঝড় হয়েছিল কি? মধুসূদন বাবু মনে করার চেষ্টা করেন। তাঁর রাতের ঘুম বেশ পাতলা। রাতের সবকটি ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ শুনে একেকবার করে অনেকবার তাঁর ঘুম ভাঙ্গে। এমনকি গোয়ালের কাজলা গাই গরুটার ধুপধাপ এপাশ ওপাশ ফেরার শব্দও তিনি আঁচ করতে পারেন কখনো সখনো। ষাট বছরের বৃদ্ধ চোখে ঘুম একটু পলকাই হবে। কাল রাতে অবশ্য ঘুম হয়নি মোটেও। মধুসূদন বাবু তাঁর গত রাতের পলকা ঘুমের সমস্ত ইতিবৃত্ত টেনে ডান বামে প্রবল বেগে ঘাড় নাড়তে থাকেন। গতরাতে মোটেও ঝড়জল হয় নি। তবে গাছের এতো ডালপালা উপড়ে ফেলল কিসে? বিপুল বিস্ময় নিয়ে উপরে, পিপুল গাছের সারির দিকে তাকান তিনি।

মাথার উপর আকাশ আড়াল করে সার দেয়া গাছের সারি। সেখানে বিচিত্র বর্ণের পাতা অল্প হাওয়ায় কাঁপছে তিরতির। মাত্র দশ বছরে গাছগুলো কত বড়ই না হয়ে উঠেছে! মধুসূদন বাবুর দিনের অনেকটা সময় এই গাছগুলোর ছায়ায় কেটে যায়। পুকুরের বেদির উপর গাছের ছায়ায় বসে তিনি মাছেদের জলক্রীড়া উপভোগ করেন। বড় চিতল আর কাতলা মাছগুলো যখন তখন বেমক্কা ঘাই মারে। জল তোলপাড় করে ঘপাত ঘপাত শব্দে তুমুল আলোড়ন উঠে পুকুরের শান্ত জলে। এই মাছগুলো যেন তাঁর সন্তানের মতন। শীত গ্রীষ্মে সকাল বিকাল নিয়ম করে ওদের ভুষি খাওয়াতে তাঁর ভুল হয়না কখনো। মাছগুলোও যেন তাঁর পায়ের শব্দ পড়তে পারে। ভুষির বস্তা কাঁধে ঘাটে পা দিতেই জলের নীচে সাড়া পড়ে যায় যেন। মধুসূদন বাবু বেশ বুঝতে পারেন, এই জলার মাছেদের কাছে তিনি অনেক বেশি বিশ্বস্ত আর চেনা একজন। এই মাছেদের বড় করতে করতে তাঁর অবসরের সময় এসে গেলো। চাকুরি শেষ হলে তিনি দিন কি করে কাটাবেন এদের ছেড়ে? অজান্তেই একটা বড় দীর্ঘশ্বাস নেমে এলো তাঁর শ্বাসনালী জুড়ে। ভাবতে ভাবতে মধুসূদন বাবুর চোখ নেমে আসে ঘাটের দিকে। সিঁড়ির তিন ধাপ নীচে জলের খুব কাছে চেয়ে তিনি আঁতকে উঠেন।

দলাপাকানো একটা পাখির ছড়ানো পালক। রক্তাক্ত। সিঁড়ির নীচে জল ছুঁইছুঁই অংশটাতে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। কোথা থেকে এলো এই পাখির শরীর! মধুসূদন বাবু ভয় পেয়ে যান এবার। কাল রাতের কথা মনে পড়ে।

সুতিয়াখালির দিক থেকে দ্রিম দ্রিম আওয়াজ এসেছে কাল সারারাত। বিচিত্র সব কান ফাটানো শব্দ। কখনো একটানা ঢুস ঢুস। একটু থেমে বিকট ধ্রিম ধ্রিম। একেকটা শব্দ আসে। আর মনে হয় গোলাটা বুঝি মাথার উপরই পড়ল। ঢাকা ময়মনসিংহ রেলপথ ধরে হানাদার পাক বাহিনী গোলা ছুড়তে ছুড়তে এগুচ্ছে। সবাই বলছিল কাল ওরা সুতিয়াখালিতে ঘাটি গেড়েছে। শহরে ঢোকার আগে বোধকরি একটু দূরে থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। মধুসূদনদের গ্রাম ছত্রপুর সুতিয়াখালি থেকে খুব দূরে নয়। গুলির শব্দ পেয়ে আশেপাশের অনেকেই বাড়ি ফেলে চলে গেছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপারে ভাগনামারি বা আরও দূরের কোন গ্রামে গিয়ে উঠেছে কেউ কেউ। মধুসূদনের কোথাও যাবার নেই। বউ বাড়ি ছাড়ার তাগাদা দিলে তাঁর কেবল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের পুকুরের চিতল কাতল মাছগুলোর কথা মনে হয়। তিনি চলে গেলে মাছেদের কে খাবার দেবে? অগত্যা মধুসূদন বাবুদের কোথাও যাওয়া হয় না। কাল সারারাত গুলির শব্দের পর ভোরের দিকে হঠাৎ চারদিক শুনশান হয়ে এলে তাঁর মাছেদের কথা মনে পড়ে। সূর্য ওঠার আগেই ওরা খাবারের জন্য ঘাটের কাছে ভিড় করবে। ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বউয়ের নিষেধ উপেক্ষা করে তিনি পড়িমরি পুকুরের ঘাটে ছুটে আসেন। অতঃপর ঘাটে এসে ছড়ানো বিক্ষিপ্ত গাছের ডালপালা আর একটা মৃত পাখির রক্তাক্ত পালক তাঁকে প্রবলভাবে মনে করিয়ে দেয়- যুদ্ধ এখন অনেক গভীর! এখানে পাখির নির্দোষ পালক অথবা গাছের অহিংস ডাল পাতাও নিরাপদ নয়।

এমনটি যে হবে, মধুসূদন বাবুরাও অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এইতো, গত মার্চের মাঝামাঝি তাদের ছত্রপুর গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে অনেকেই এসেছিলেন। সেখানে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকও ছিলেন। আর ছিলেন বেশ কিছু নেতা। তাঁরা সবাই বলছিলেন এবার যুদ্ধ শুরু হবে অধিকার আদায়ের। আর স্বাধীনতার। অন্যদের মতই মধূসুদন বাবুও ভোট দিতে গিয়েছিলেন গেলো বছর। ভোট দিয়ে নৌকা মার্কার নেতাদের জেতালেন সবাই মিলে। কিন্তু তাদের ক্ষমতা দিচ্ছে না- উলটো মার্শাল ল জারী করছে । নেতাদের ভাষণে এই কথাগুলো সবাই বুঝতে পারছিল খুব সহজে। একজন বক্তা, কি সরকার যেন নাম, তিনি খুব সুন্দর করে বলছিলেন-

“‘মারশিয়াল-ল’ মানে হইলো শিয়াল কুকুরের মত মানুষ মারণের আইন। ওই যে কইছে ‘মারশিয়াল-ল’ ওই কথা দিয়া মিলিটারির বড় সাবরা সিপাইগো বুঝাইছে: যহন তারার অর্ডারে মানুষ মারতো, তহন মনে করবো মানুষ মারতাছে না, শিয়াল — আমরার ভাষায়, ‘হিয়াল’ মারতাছে। ভাইসব, যার যা আছে তাই লইয়া রুইখ্যা খাড়াইলে পাকিস্তানি মিলিটারিরা আমরারে ওই বায় হিয়াল কুত্তার লাহান মারতারতো না।”

এসব শুনে মধুসূদন বাবুরও ইচ্ছে জাগে পাক হানাদারদের রুখে দাড়াতে। মার্চের ছাব্বিশ তারিখের কথাও স্পষ্ট মনে পড়ে তাঁর। ঐদিন সাপ্তাহিক ছুটি। ভিসি কাজী ফজলুর রহিম স্যার হঠাৎ সবাইকে ডেকে পাঠালেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালার সামনে সকলেই হাজির হল একে একে। ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব রফিকউদ্দিন ভুঁইয়াও উপাচার্যের পাশে দাঁড়ানো ছিলেন। এখানে ওখানে জটলার মতো, এ ওঁর সঙ্গে কথা বলছেন। এক মুখ থেকে অন্য মুখ হয়ে গত রাতের ঢাকা শহরের শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসা ঘটনাবলী জানা হয়ে গেছে সবার। একটু পরেই যথারীতি সভা শুরু হলো। রফিক ভুঁইয়া সাহেব একটি ছোট তেজোদীপ্ত বক্তৃতায় ঢাকায় নিরীহ মানুষকে হত্যার কথা বললেন এবং বললেন বাঙালির রক্তের ঢলের মধ্যে জন্ম হয়েছে, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’।

এইরকমভাবে একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে একদিন ভোরে মধুসূদন বাবু আবিস্কার করেন তাঁর ছেলেটি ঘরে নেই। ছেলের বউ শাশুড়ির কাঁধে মুখ লুকিয়ে খুন খুন করে কাঁদে। দিন দশেক আগে দক্ষিণ পাড়ার মন্তাজ আলীর মেয়ের জামাই এসে জানায় তাঁর ছেলেকে হালুয়াঘাটের এক মুক্তি ক্যাম্পে দেখা গেছে। ছেলের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া এবং তাঁর বেঁচে থাকার সংবাদে মধুসূদন বাবু নির্ভার হন। যাক। নিজে যুদ্ধে যেতে না পারলেও ছেলেটাতো গেছে! ওরা নিশ্চিত হানাদারদের রুখেই বাড়ি ফিরবে। ভাবতে ভাবতে মধুসূদন বাবুর হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। সিঁড়ির উপর উবু হয়ে মৃত পাখিটার পালক জড় করতে করতে হঠাৎ তিনি ট্রেনের বিকট ঝিকঝিক শব্দটা শুনতে পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়েই সাপের মতন বিলি কেটে ট্রেন লাইনটা তিন কিলোমিটার দূরে শহরে চলে গেছে। বেশ কিছুদিন হল এপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ। আজ তবে কোন ট্রেন এলো!

২।
গত রাতে ক্যাপ্টেন সালিমের একফোঁটা ঘুম হয় নি। ট্রেনের ভিতর তাঁর বগিটা বেশ সাজানো। বার্থের উপর মোটা গদি আঁটা। তার উপর দুটো নরম কম্বল বিছানো। ঘুমানোর জন্য বেশ ভালো আয়োজন বলা যায়। ট্রেনটা রাতে যে জায়গাটিতে থেমেছে, তার আশেপাশে জনবসতি নেই। দুপাশে বিস্তীর্ণ মাঠের উপর দিয়ে হু হু করে হাওয়া আসছে। রাত তিনটার দিকে ফায়ারিং ক্লোজ করে অবশ্য সবাই জানালা দরজা বন্ধ করেই রেখেছিল। এরপর চারিদিকে শ্মশানের নীরবতা। ঘুম তাঁর আসেনি তবুও। একেকটা বড় অপারেশনের আগে তাঁর এমন হচ্ছে ইদানিং। কারণ অবশ্য আরও একটা আছে। দিনভর ফায়ারিং করেও একটা বাঙ্গালীর রক্ত বইতে দেখা গেলো না। এটা কোন যুদ্ধ হল? শহরে ঢোকার আগে কোনই প্রতিরোধ নেই। এমনটি অবশ্য ওরা আশা করেনি। ট্রেনের শব্দ পেয়ে ভীতুগুলো আগেই পালিয়েছে ভেবে একটু হাসল সে।

দুদিন আগে একটা ছোট্ট স্টেশন পেরিয়ে এসেছে ওরা। ঐ স্টেশনে রেললাইন একটু উপড়ানো ছিল। কিছু গাছের গুড়িও ছিল পাতের উপর। বেটা আহাম্মকদের আস্পর্ধা দেখে কিছুটা ক্ষেপে উঠেছিল বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা। ট্রেন থেকে নেমে আশেপাশের গ্রামগুলোয় একটু তল্লাশি করে দেখতে চাইছিল কার এতো বুকের পাটা যে ওদের ট্রেন লাইনে বাঁধা সৃষ্টি করে! বৃগেড কমান্ডার অবশ্য ট্রেন থেকে নামার অনুমতি দেননি কাউকে। বলেছেন- একেবারে মাইমেনসিং পর্যন্ত লাইন পরিস্কার করা তাদের দায়িত্ব। শহরে পৌঁছে গেলে এমন অনেক মুক্তিকে খতম করার জন্য হাতের নাগালে পাওয়া যাবে। তবুও ওদের হাত কেবল নিশপিশ করছিলো গুলি ছোড়ার জন্য। রক্তের নেশায় ৫৬ এসল্ট রাইফেলগুলো ক্রমাগত ককিয়ে বারুদ উদগীরন করছিলো। ঢিমেতালে খুব সচেতনভাবে দেখেশুনে ওরা অগ্রসর হয়েছে মাইমেনসিংয়ের দিকে। আজ শহরে ঢুকে পরবে ট্রেনটি ওদের নিয়ে। অভিযানের আপাত সমাপ্তি।

খুব ভোর ভোর ট্রেন চলা শুরু হলেও পেছনের বগিতে যুক্ত মার্ক কামানগুলো এখনো গর্জন শুরু করে নি। ক্যাপ্টেন সালিম ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে জানালার সাটার তুলে বাইরে তাকাল। সূর্য উঠেছে কেবল। আকাশ পরিস্কার হওয়ায় অনেকদূর অব্দি ধূধূ মাঠ নজরে আসছে অনায়াসে। সালিমের হঠাৎ তাঁর নিজের দেশের বালুময় শুষ্ক প্রান্তরের কথা মনে পড়ে। চারিদিকে খরা। ফসল নেই। আইয়ুব সরকার অবশ্য অজস্র গভীর নলকূপ বসিয়ে মরুর বুকে ভালই চাষবাস শুরু করেছিল। দুষ্ট লোকেরা বলে ওসব নলকূপ নাকি পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় কেনা। বললেই হল! তাঁর ঘুমহীন চোখে হঠাৎ এক বোবা আক্রোশ জেগে উঠে। এই মুল্লুককে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবেনা। আর মাথা তুলতে দেয়া যাবে না কালো কালো নোংরা চেহারার এই মানুষগুলোকে। চায়ের কাপ রেখে ক্যাপ্টেন সালিম তার কোল্ট এলএমজিটির দিকে হাত বাড়ায়।

একটু দূরে বেশ কিছু দালান দেখে সে বেশ অবাক হয়। বিশাল বিশাল মাঠে সবুজ রঙের খাটো খাটো কি গাছ যেন লাগানো। সরু সরু পাতাগুলো গোড়া থেকে চারদিকে ছড়ানো। তার ওপাশে বেশ বড় কয়েকটি পুকুর। পুকুর থেকে একটু দূরে কতোগুলো দালান। হঠাৎ পুকুরের ওপারে কিছু একটা নড়ে উঠল বলে মনে হল তার। ঠিকই তো! একটা অবয়ব যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে গাছগুলোর নীচে। ক্যাপ্টেন সালিমের শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা সূক্ষ্ম স্রোত আলতো নেমে যায়। তবে কর্তব্য স্থির করতে বেশিক্ষণ সময় নেয় না সে। শিকারটি ৬০০ মিটারের ভেতরেই আছে অনুমান করে একটু স্বস্তি পেল সে। ট্রিগারের ঠাণ্ডা বাঁকানো অংশটিতে খুব সন্তর্পণে তার তর্জনী চেপে বসলো।

৩।
মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের পুকুরের মাছেদের মন আজ ভীষণ খারাপ। আকাশে মেঘ নেই। তবুও কাল সাঁঝ বেলা থেকে ভীষণ গুড়গুড় শব্দ এসেছে কোথা থেকে যেন। মেঘেদের শব্দ পেলে কিছু মাছ উজানে যায়। কিছু মাছ আবার গুম মেরে নিজের খাড়ির ভেতর ডুব মারে। বান ডাকলেও কাতলা মাছগুলো যেতে চায় না কোথাও। তবে এটি বানের শব্দ নয়, মাছেরা বুঝতে পারে বেশ। কাল রাতে তাই মাছেদের কেউ ঘুমায়নি। আজ ভোরেই পুকুরঘাটে পায়ের সাড়া পেয়ে ওরা বুঝতে পারে খাবার এসেছে। তবুও সাহস করে ঘাটের দিকে কেউ যায়না। পানির একটু নীচে আস্তে আস্তে কানকা নেড়ে সাঁতার কাটতে থাকে। ছোট মাছগুলো ভয় পেয়েছে ভালই। অন্যদিন খাবারের লোভে ওরাই হুটোপুটি করে বেশি। কি সাহস ওদের! একেবারে পানির উপর ভেসে ভেসে সবটুকু ভুষি শুষে খেয়ে ফেলতে চায়। আজ কাউকে দেখা যাচ্ছেনা।

পানির উপর খুব চেনা দৈর্ঘের ছায়াটা এসে পড়লে বড় দুটো চিতল চওড়া পেট দুলিয়ে সাহস নিয়ে ঘাটের দিকে আসতে থাকে। আর ছোট ছোট চোখ মেলে বুঝতে চেষ্টা করে ছায়ার গতিবিধি। হঠাৎ পশ্চিমে ঠিক গতকাল রাতের মতন বিকট শব্দ উঠল যেন! চিতল দুটো ত্বরিত মাথা নিচু করে ছোটে ঘাটের একেবারে শেষ ধাপের নীচের খোঁড়লে। ওরা ওখানে পৌঁছানোর আগেই কিছু একটা যেন ঝুপ করে পড়ল পানির উপর। চিতল দুটো ভয় পাবারও ফুরসত পায়না। আরও একটু পরে ওদের পাতাহীন চোখে জলের থেকে ভারী কি যেন একটা এসে বেঁধে কাটার মতন।

মাছেরা কি রঙ বুঝতে পারে! ওরা কি সবুজ পুকুরের জলের উপর লাল রঙের ছোপ আলাদা করতে পারে! যদি পারে, তবে সেইদিন মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের পুকুরের কাতলা চিতলের ঝাঁক হয়ত মধুসূদন বাবুর রক্তের রঙ কেমন ছিল তা বুঝে থাকবে।

(২৩ এপ্রিল ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-এর মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের কর্মচারী মধুসূদন বর্মণ নিহত হন।)
দোহাইঃ ১। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিঃ ছত্রপুর, ময়মনসিংহ - সামসুজ্জামান খান।
২। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাল পাতা।

পথিক পরাণ
Pavel352 এট yahoo.com


Comments

ব্যাঙের ছাতা's picture

অসাধারণ। অসাধারণ। অসাধারণ। হাততালি

নীড় সন্ধানী's picture

এটা তো গল্প না। সত্য ঘটনাই। এরকম একেকটা গল্প মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রত্যেকটি নিহতের সম্মানে রচনা করা যেতো যদি!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

পথিক পরাণ's picture

এগুলো গল্প নয় আসলেই। খুব দুঃখময় একেকটা ঘটনা। একেকটা মৃত্যু একেকটা ইতিহাস।

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যর জন্য।

------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

পথিক পরাণ's picture

অনেক ধন্যবাদ ভাললাগা জানিয়ে যাবার জন্য।

------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

নজমুল আলবাব's picture

আরও লিখুন। এমন গল্প বার বার পড়তে চাই।

পথিক পরাণ's picture

আলবাব ভাইকে অনেক ধন্যবাদ।

অনেক শুভকামনা রইল।

------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

সুলতানা পারভীন শিমুল's picture

আমারো এটাকে গল্প মনে হয়নি।
ভীষণ ভীষণ ভালো লাগলো লেখাটা। চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পথিক পরাণ's picture

আপু
এমন হাজারটা মৃত্যুর সুতোয় আমাদের জয়ের ইতিহাস বোনা হয়েছে। এগুলো গল্প নয়- আমাদের স্বাধীন হয়ে উঠবার পথের বিমূর্ত চিত্র।

------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

আনন্দী কল্যাণ's picture

এরকম আরো কত না-জানা গল্প ছড়িয়ে আছে। গল্প না, গল্পের চেয়েও বেশি কিছু। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।

পথিক পরাণ's picture

ধন্যবাদ আপনাকেও সুন্দর পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য।

--------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

সুহান রিজওয়ান's picture

চলুক চলুক চলুক

এই অন্যরকম লেখাটির জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে। ইতিহাস এইভাবে উঠে আসুক।

পথিক পরাণ's picture

সুহান ভাই
আপনার

Quote:
একাত্তরের সেনাপতি

একটা ক্লাসিক। ঐ গল্পটা পড়েই মূলত মধুসূদন বাবুর ইতিহাসটা লেখার সাহস পেলাম।

অনেক কৃতজ্ঞতা রইল।

----------------------------
পথেই আমার পথ হারিয়ে
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া ঘুরছি ভীষণ---

ধুসর জলছবি's picture

অসাধারণ। এরকম সমস্ত সত্যি গল্পগুলো আমাদের লিখে রাখা উচিৎ। আপনি আরও লিখুন চলুক

পথিক পরাণ's picture

মুক্তিযুদ্ধকে খুব কাছে থেকে দেখা মানুষগুলো হারিয়ে যাবার আগেই আমাদের এই কাজটা করা দরকার খুব।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

হিল্লোল's picture

গল্প পড়ার সময় আমি ঐ সময়েই ছিলাম বলে মনে হচ্ছিল। অসাধারণ!

পথিক পরাণ's picture

মধুসূদন বাবুদের নিঃশ্বাসের শব্দ আমাদের আশেপাশেই জেগে আছে খুব মায়া মায়া স্বপ্ন হয়ে।

ভালো থাকুন।

তারেক অণু's picture

চলুক অসাধারণ !

পথিক পরাণ's picture

অসংখ্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা---

কুমার's picture

এত চমৎকার গল্প হয়! ভীষণ ভালো লাগলো।

পথিক পরাণ's picture

মন্তব্যর জন্য অনেক ধন্যবাদ।

সত্যপীর's picture

অসম্ভব চমৎকার।

..................................................................
#Banshibir.

পথিক পরাণ's picture

অনেক ধন্যবাদ--- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ's picture

অসাধারণ

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

পথিক পরাণ's picture

অনেক ধন্যবাদ।
আপনার অসম্ভব সুন্দর গল্পগুলো আসছে না অনেকদিন---

কিশোর's picture

এক কথায় অসাধারন

পথিক পরাণ's picture

জেনে ভালো লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.