অণোরণীয়ান থেকে মহতোমহীয়ান(৫)

তুলিরেখা's picture
Submitted by tuli1 on Thu, 16/04/2009 - 10:52pm
Categories:

কোয়াসার শক্তি-উত্‌স রহস্যের ধরতাই পাওয়া যাচ্ছে আজকাল৷ কোয়াসার থেকে প্রায় সবরকম তরঙ্গদৈর্ঘের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ আসে৷এক্স রে থেকে আরম্ভ করে রেডিও তরঙ্গ পর্যন্ত বিশাল পরিসরে।

জানা গেছিলো কেন্দ্রকীয় সংযোজন থেকে এই শক্তি উত্‌পাদন হতে পারে না, কারণ ঐটুকু আঁটোসাঁটো জায়গা থেকে এত বিপুল শক্তি উত্‌সারিত হতে গেলে কেন্দ্রকীয় সংযোজনে কুলোবে না৷ বর্তমানে বলা হচ্ছে মারাত্মক ভরের কৃষ্ণ গহ্বর হলো এদের শক্তি-উত্‌স৷ ভর এদের মানে যে সে না, কয়েক বিলিয়ন(১০^৯) সৌরভরের৷

এখন কৃষ্ণ গহ্বর নিয়ে জানতে গেলে আমাদের একটু বিস্তারিত জানতে হবে৷ এতে সাধারণ আপেক্ষিকতাও ভালোমতন লাগবে৷ ষাটের দশকে যখন প্রথম কোয়াসার আবিষ্কার হয় তখন এদের যা যা পর্যবেক্ষণ করা গেছিলো সেগুলো খুবই আশ্চর্য লেগেছিলো লোকের কাছে৷ কারণ তখনো আইন্সটাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে খুব একটা বেশী সিরিয়াস কাজ হচ্ছিলো না যদিও এটার আবিষ্কার সেই ১৯১৫ সালে৷ কিছু কিছু কাজ যা হয়েছিলো কৃষ্ণ গহ্বর নিয়ে, তা খুব শক্তপোক্ত ফ্রেমের উপরে বসে নি৷ লোকে চল্লিশের দশকের পরে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর কেন্দ্রকীয় কণাপদার্থবিদ্যা নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত ছিলো, কারণ শিয়রে শমন৷ এই বুঝি উড়ে গেলো সব বোমায়৷ হয় মারো নয় মরো৷ কি অবস্থা!!

সত্তরের দশকের বৃটেনে কিছু তরুণ বিজ্ঞানী, তখনো তাঁরা গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার ছাত্র, খুঁজতে খুঁজতে এই সাধারণ আপেক্ষিকতায় গিয়ে পড়লেন৷ কিছু কিছু খুব আকর্ষণীয় সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে ইতিহাসের ধুলা ঝেড়ে আগের কাজ বার করে আনলেন৷ তারপরে দিনরাত পরিশ্রমে নিজেরা তা অনেক পরিস্ফুট করলেন৷ প্রধানত এদের কাজের দ্বারাই কৃষ্ণ গহ্বর নামক তখনো পর্যন্ত কিছুটা সন্দেহের চোখে দেখা গাণিতিক ধারনাটি জোরের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা পেলো৷

কৃষ্ণ গহ্বর নিয়ে শুনতে গেলে আমাদের নক্ষত্রের জীবন সম্পর্কে জানতে হবে৷ নক্ষত্রে শক্তি উত্‌পাদিত হয় হাল্কা মৌলের কেন্দ্রক জুড়ে গিয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী মৌলের কেন্দ্রক তৈরী হওয়ার আর সামান্য ভর শক্তি হিসাবে ছাড়া পাবার দ্বারা৷ প্রথমে শুরু হয় হাইড্রোজেন দিয়ে, সেটা সবচেয়ে হাল্কা মৌল৷ নক্ষত্রের বিপুল ভর কেন্দ্রে যে প্রচন্ড চাপ ও তাপের পরিবেশ তৈরী করে, তাতেই হাইড্রোজেনের কেন্দ্রক কুলম্বীয় বিকর্ষণ কাটিয়ে জুড়ে যায়৷ নইলে এমনিতে এদের কাছাকাছি আনা বড়ো শক্ত৷ কিন্তু যখন জুড়ে হিলিয়াম কেন্দ্রক তৈরী করে, তখন যে শক্তি মুক্ত হয় তা গামা রে হিসাবে বেরোয়৷ এই বিকিরিত রশ্মিসমূহ বাইরের দিকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে বলে একটা চাপ তৈরী হয় যাকে বলে বিকিরণ চাপ। আর নক্ষত্রের নিজের ভরের ফলে যে অভিকর্ষ তা সবকিছু কেন্দ্রের দিকে টেনে আনতে চায়৷ এই দুই বিপরীতমুখী চাপ যতক্ষণ সমান সমান থাকে, ততক্ষণ নক্ষত্র স্থিতিশীল ৷ অসুবিধে কিছু নেই, সমান হারে তাপ ছড়িয়ে যায় তারা৷

কিন্তু নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অংশে সব হাইড্রোজেন যখন হিলিয়াম বনে যায় তখন হয় মুশকিল৷ হঠাত্ কেন্দ্রীয় অংশের বিকিরণ চাপ যায় কমে, কিন্তু অভিকর্ষ একই থাকে! এদিকে বাইরের খোলে প্রচুর হাইড্রোজেন তখনো রয়ে গেছে, সেগুলো জ্বলে ওঠে মানে সেখানে তখন কেন্দ্রকীয় সংযোজন চলতে থাকে৷ তাই সেখানে বিকিরণচাপ নক্ষত্রটিকে ফুলিয়ে তোলে, ভেতরের কেন্দ্রীয় অংশটি সঙ্কুচিত হয়৷ সংকুচিত হলে তাপ বাড়ে, তখন হিলিয়ামের কেন্দ্রকীয় সংযোজন শুরু হয়৷ এইভাবে ধাপে ধাপে পর্যায়সারণীর ভারী মৌল তৈরী হতে থাকে৷ নইলে মহাবিস্ফোরণ মডেল অনুযায়ী আদি বিষ্ফোরণে শুধু হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম তৈরী হয়েছিলো৷ বাকীরা তৈরী হয়েছে নাক্ষত্রিক চুল্লীতে।

যাই হোক, এইভাবে পারমাণবিক সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যখন কেন্দ্রে লোহার কেন্দ্রক তৈরী হয়ে ভরে যায় তখন সেটাকে জ্বালিয়ে তোলার মতন তাপ আর ওঠে না সেইখানে, কেন্দ্রকীয় সংযোজন বন্ধ হয়ে যায়৷ কেন্দ্রীয় অংশটি সংকুচিত হয় অভিকর্ষের জন্য৷

এই পড়ে থাকা কেন্দ্রীয় অংশটির ভর যদি প্রায় দেড় (1.44 solar mass ) সৌরভরের বেশী হয় তাহলে সেটাকে নিজের অভিকর্ষে নিজের দুমড়ে করে যাওয়া থেকে কেউ ঠেকাতে পারেনা৷ কারণ কোনো বহির্মুখী বিকিরণচাপ নেই, কোনো ডিজেনারেসিও এটাকে দুমড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেনা যদি ভর এই সীমার বেশী হয়৷ এই ভরসীমা চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন আবিষ্কার করেন, একে বলে চন্দ্রশেখর লিমিট৷

কিন্তু তখন তাহলে কি হয়? যদি থেকে যাওয়া ভর চন্দ্রশেখর লিমিটের বেশী হয়? তখন প্রচন্ড অভিকর্ষের প্রভাবে চুপসে যেতে যেতে এর ঘনত্ব এত বেশী হয়ে যায় যে এর উপরিতল থেকে ছুটে বেরুতে পাবার বেগ যাকে মুক্তিবেগ বা এসকেপ ভেলোসিটি বলে তা আলোর বেগের চেয়ে বেশী হয়ে যায়৷ তাই আলো আর এর থেকে বেরুতে পারেনা, এটি পরিনত হয় কৃষ্ণ গহ্বরে৷ মহাবিশ্বের এমন এক জায়গা যেটা থেকে কোনো কিছুই আসতে পারেনা৷ আলোর বেগই হলো কিনা এই মহাবিশ্বের গতির চরম, তাই আলোই যদি না আসতে পারে, তাহলে আর কি আসবে?


Comments

মূলত পাঠক's picture

টুলে চইরাও নাগাল পাই না। লেকিন হের লাইগ্যা গাড়ি থামাইবেন না, সমঝদারেগো বঞ্চিত করবেন না অজ্ঞজনের কথা ভাইব্বা।

বজলুর রহমান's picture

চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন নোবেল পান আণবিক বর্ণালী বিশ্লেষণে রমন এফেক্ট আবিষ্কারের জন্য। তার আপন ভাইপো সুব্রামানিয়ান চন্দ্রশেখর কৃষ্ণ বিবরের ভরের এই নিম্নসীমা আবিষ্কার করে পুরস্কৃত হন।
ইনি অসাধারণ বিনয়ী নম্র ভদ্রলোক ছিলেন। খাবার সময় ক্যাফেটারিয়াতে বিখ্যাত ব্যক্তিদের টেবিল বাদ দিয়ে আমাদের টেবিলে এসে চুপচাপ খেতেন আর একটু আধটু গল্প করতেন। শিকাগোতে ৮৪ বছর বয়সে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন।
জ়েঠামশাই তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না, সবাই বলত অহঙ্কারী। অবশ্য পরীক্ষা সঙ্ক্রান্ত কাজে মাঝে মাঝে ঢাকায় সত্যেন বসুর কাছে এসেছিলেন।

লুৎফুল আরেফীন's picture

এই পর্বটাও জোস লাগলো যথারীতি!
ক্রমে ভারী মৌলের দিকেআগাবার বিষয়টা জানতাম না। মুধু জানতামফিউশন হতে হতে যখন কেবল নিউট্রনগুলো পরে থাকে, তখনই সেটা bw এ পরিনত হয়। কারণ নিউট্রন ভারী কণা হলেও আয়তনে তো পিচ্চি!

যাহোক, চরম লাগছে, চলুক।
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

শিক্ষানবিস's picture

ভাল লাগছে। ইংরেজি শব্দের ব্যবহার আরেকটু কমালে আরও ভাল লাগত। অবশ্য এভাবে লেখাটাকে স্টাইল করে নিলে ঠিক আছে। একসময় অভ্যস্ত হয়ে যাব।

সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের জীবনী নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম। লোকটা আসলেই বস ছিল। এডিংটনের সাথে তো তার মিল হয়নি। লন্ডনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে এই এডিংটনের হাতে তীব্র সমালোচনার শিকার হন। কারণ তার চন্দ্রশেখর সীমার ধারণা এডিংটনের সাথে মিলছিল না। এজন্যই বোধহয় আম্রিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। দেশে আসেননি কখনও। ভারতের নাগরিকত্বও পাননি। অনেক ভারতীয় এ নিয়ে আক্ষেপ করে শুনেছি। চাচা রমনও নাকি বেশ কয়েকবার তাকে অনুরোধ করেছিলেন দেশে এসে গবেষণা করতেন। কিন্তু তিনি আসেননি। দেশে গবেষণার বেহাল দশার কথা ভেবেই হয়ত।

হিমু's picture

আচ্ছা, এই যে সামান্য বাড়তি ভাংতি ভরটুকু শক্তি হয়ে ফেটে বেরোচ্ছে, তার মানে ভরও তো কমছে। হাইড্রোজেন হিলিয়াম হলে তো কেন্দ্রমুখী অভিকর্ষও (গ্র্যাভিটি) কমবে। এই যে আমরা ধরে নিচ্ছি, বিকিরণ চাপ (রেডিয়েশন প্রেশার) কমছে কিন্তু অভিকর্ষ একই থাকছে, এ কি ঠিক হচ্ছে? বান্দরের রুটিভাগের মতো সেটাও কি কমছে না? নাকি মূল ভরের তুলনায় এই ভাংতি ভর নিতান্তই নগণ্য বলেই এই "ম্যাস ক্রাম্বস"কে হিসাব থেকে বাদ রাখছি? একটু অঙ্কটঙ্ক রাখুন না।

আপনি একটা পিচ্চিতোষ মহাকাশপদার্থবিজ্ঞানের বই লেখায় হাত দিন। এই লাইনের আরো দুয়েকজন কামেল আছেন সচলে। প্রয়োজনে কয়েকজন মিলে লিখুন। খুব খুব কাজে দেবে। আমার কথার প্রমাণ যাদের কাছ থেকে পাবেন তারা হয় এখনো জন্মায়নি, বা এখনও নিতান্ত দুধখোর রয়ে গেছে।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

তুলিরেখা's picture

ভর যা কমছে তা খুব কম। আরে E=mc^2 তো! সামান্য ভর বিপুল শক্তিতে পরিণত হয়। c এর মান তো মারাত্মক বেশী! তার আবার বর্গ!
অঙ্কটঙ্ক রাখা যায় বটে, কিন্তু দিনের শেষে আরাম করতে আসেন লোকজন, এর মধ্যে অঙ্কটঙ্ক এনে ঝামেলা করা কি ঠিক?
কিশোরকিশোরীদের বই হলে অবশ্য ছোটোখাটো অঙ্কটঙ্ক দেওয়া যায় আর ডায়াগ্রাম তো দিতেই হবে!
------------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা's picture

পরীক্ষামূলকভাবে সম্পাদনা করে কিছু কিছু ইংরেজী শব্দ বাংলা করে দিলাম। দেখুন তো এই বারে কি সুবিধা হচ্ছে নাকি আরো জটিল লাগছে? হাসি
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

তুলিরেখা's picture

@ হিমু,
পিচ্চিতোষ বই নিয়ে ভাবলাম খানিক। মনে হলো ব্যাপারটা নিয়ে কিছু করার দরকার আছে।
সচলে এই নিয়ে উত্‌সাহী কামেল যাদের কথা বলছিলেন তাদের সাথে কিভবে যোগাযোগ করবো?
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.