বৈদ্যুতিক “সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে” সমাচার

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture
Submitted by silent_watcher [Guest] on Mon, 24/04/2023 - 3:34am
Categories:

নাট্যজন মামুনুর রশীদ ক’দিন আগে রুচির দুর্ভিক্ষের কথা বলে বেশ তোপের মুখেই পড়েছিলেন। এতে তাঁর কমেনি কিছুই, তবে তারস্বরে ‘আমি কলা খাই না’ বলতে আসা তোপ দাগিয়েরা তাঁর কথার প্রমাণ দিয়েছেন হাতে নাতে। অধুনা, এই ভাইরালের যুগে সেটাই নিয়ম। নইলে পদার্থবিজ্ঞানে ডক্টরেট করা জনৈক অধ্যাপক মহোদয় (আড়ালে যাঁকে অনেকে ঠাট্টা করে ডাকেন professor blue-tick) অবলীলায় পাতার পর পাতা ডাহা মিথ্যে দিয়ে ভরিয়ে রাখেন ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস’ নামের আবর্জনা, এবং সেগুলো ভাইরালও হয় বটে। ভদ্রলোকের সাথে ভারতীয় ওয়াজ ব্যবসায়ী কাম চ্যানেল মালিক আরেক ডাক্তারের (PhD নয়, MBBS) মিল আছে বৈকি। দুজনকেই মুখের ওপরে ভুল ধরিয়ে দিলে উনারা দাবী করেন, ‘ক’ বলতে উনি বুঝিয়েছেন ‘খ’, আর ‘খ’ মানে যেহেতু ‘গ’, তাহলে ব্যাপারটা আসলে হবে ‘ঘ’, and, brother has asked a good question, ব্যাস তাল গেল গোলে, গোল গেল মালে! একেবারেই চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’, বেড়ালের তালব্য ‘শ’ আর রুমালের ‘মা’… শেষমেশ, হাতে রইল পেনসিল। তা, বড় বড় মানুষেরাই যখন এই কুৎসিত (কিন্তু অব্যার্থ) পদ্ধতিতে সফলভাবে বিখ্যাত হয়েছেন, প্রান্তজনেরাই বা বসে থাকবেন কেন? এবারে ঈদের আগের চাঁদরাতে তাই অন্তর্জাল মাতিয়েছেন হিরো আলমের মাসতুতো ভাই জনৈক ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’, এ যেন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির Ray! আরও অনেক ভাইরালজীবির মতন তিনিও মৃদুল আহমেদের আইকনিক হয়ে ওঠা সেই ‘সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে’ ছড়াটির নতুন আরেকটি অনুচ্ছেদ হয়ে উঠেছেন সুপরিকল্পিত মিথ্যাচারের মধ্য দিয়ে।


অভিজ্ঞতা বলে, বিদ্যুৎ কুমার রায় কথা বদলে ফেলেন খুব দ্রুতই। সেজন্য, শুরুতেই এই ছবিটি প্রমাণক হিসেবে সংযুক্ত রাখলাম, যেন পরবর্তীতে এই কুৎসিত মিথ্যাচার তিনি অস্বীকার করতে না পারেন।

নিজেকে ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ বলে দাবীকৃত ভাইরালজীবি মহোদয়ের দাবি বদলেছে বেশ ক’বার। প্রথমে নিজের ফেসবুক আইডি থেকে প্রচারিত ভাইরাল হয়ে ওঠা এক ‘ফেসবুক লাইভে’ নাম অপ্রকাশিত জনৈক ছাত্রের বরাত দিয়ে তিনি দাবি করেন- “জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত নবম-দশম শ্রেণীর রসায়ন বইতে শুধুমাত্র মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম আছে, এবং আর কারও নাম নেই।” এর প্রেক্ষিতে তিনি বেশ আবেগঘন ফন্টে দাবী করেন বইটির “একমাত্র লেখক তিনি বিদ্যুৎ কুমার রায় স্বয়ং" এবং "মুহম্মদ জাফর ইকবাল এতে এক লাইনও লেখেন নি!” নেটিজেনদের একটি ক্ষুদ্র অংশ যে Professor blue-tick কিংবা ডা. সায়েবের মুরীদদের মতন নন, এটা বোঝা গেছে এর পরপরই। সংখ্যায় অতি ক্ষুদ্র হলেও এই চক্ষুষ্মান অংশটি আলোচ্য বইটির প্রথম পাতা (ছবি দ্রষ্টব্য) যাচাই করে বিদ্যুৎ কুমার রায়ের ভাইরাল দাবিটির ‘সত্যতা’ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। ছবিটিতে দেখা যায় সম্পাদনা প্যানেলের শুরুতেই ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ এই নামটি আপন ঔজ্জ্বল্যে জাজ্বল্যমান। অর্থাৎ বিদ্যুৎ কুমার রায়ের ভাইরাল দাবিটি ডাহা মিথ্যা!

ছবিটি থেকে আরও জানা যায় এই প্যানেলে ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ এবং ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল’ ছাড়া আরও তিন জনের নাম আছে। যদিও, ভাইরাল হওয়ার প্রক্রিয়ায় বাকি তিনজনের নাম তেমন ‘লাভজনক’ নয় বিধায় লাইভকারী সেটা বেমালুম চেপে গেছেন। তবে, কথিত ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ তাঁর আয়োজনে সম্পূর্ণ সফল। কথিত বলছি, কেননা এই ফেসবুক আইডির আড়ালে লাইভে আসা ব্যক্তি আর বইয়ে উল্লেখিত ব্যক্তিদ্বয় যে একই, তার কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ইত্তেফাকের বহুল প্রচারিত ‘বাসন্তী-কান্ড’ এবং প্রথম আলোর সাম্প্রতিক ‘জাকির-কান্ডের’ মতন এই “বিদ্যুৎ-কান্ড” আসল বিদ্যুৎ কুমার রায়কে ঘিরেই শুটিং করা হয়েছে, নাকি কোনও পেশাদার অভিনেতাকে ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে- এটিও সাইবার ক্রাইম নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা, কোনও ঠগ-বাটপার এসে ‘বিদ্যুৎ’ সেজে এই লাইভটি করে থাকলে, আসলেই বইয়ে যার নাম ছাপা সেই প্রকৃত ‘বিদ্যুৎ’ বিপদে পড়ে যাবেন। আর সেক্ষেত্রে, এই লাইভকান্ডের প্রকৃত কুশীলবেরা আড়াল হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, লাইভকৃত ফেসবুক আইডিটি কিন্তু ভেরিফায়েড কোনও আইডি নয়। অর্থাৎ, এর আড়ালে কোনও ঠগ-বাটপার গোষ্ঠী লুকিয়ে আছে- সেটি ঘটা খুবই স্বাভাবিক। আর, আলোচিত লাইভটি যে বা যারাই করে থাকুক, এর অসঙ্গতিগুলো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। আর, সেকাজটি এখনই করা না হলে দেখা যাবে, ক'দিন পরে কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায়কে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। তখন কিন্তু....

আগেই বলেছি, কথিত ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ তার অবস্থান বদলেছেন একাধিকবার। ফেসবুক লাইভ করে পর্যাপ্ত লাইমলাইট প্রাপ্তির পরের ধাপে তিনি একাধিক চ্যানেলে ‘সাক্ষাৎকার’ দিয়েছেন। এর মধ্যে দীর্ঘতমটি ‘ফেস দ্য পিপল’ নামের একটি অনলাইনভিত্তিক চ্যানেলে, যা যথারীতি ভাইরাল হয়েছে। উল্লেখ্য যে, এই সাক্ষাৎকারের আগেই অন্তর্জালে মূল বইয়ের প্রথম পাতার ছবিটি ছড়িয়ে পড়ে, এবং তিনি সামান্য হলেও প্রশ্নের সম্মুখীন হন। সুচতুর এই ভাইরালজীবি পরবর্তী সাক্ষাৎকারের থাম্বনেইল ও শিরোনাম হিসেবে ব্যবহৃত ‘ক্লিকবেইট’ অংশে আগের বক্তব্য বজায় রাখলেও ভেতরের আলোচনায় সুর পাল্টান। এখানে তিনি স্বীকার করেন তিনি ‘বইটির একমাত্র লেখক’ নন। সাথে ‘তাপস কুমার আচায্য’ এবং ‘মো. মোকাদ্দেছুল ইসলাম’ নামে আরও দুজন সহলেখক ছিলেন। আগের আমি-আমি-আমি ভারাক্রান্ত ঝাঁঝালো বক্তব্য থেকে সরে এসে তিনি কিঞ্চিৎ নম্রস্বরে দাবি করেন বইটি আসলে প্রথম তিনজন সম্মিলিতভাবেই লিখেছেন। সেই সাথে এটিও স্বীকার করেন যে ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল’ এবং ‘মোহাম্মদ কায়কোবাদ’ বইটির সম্পাদনা প্যানেলে ছিলেন, এবং তাঁরা প্রচ্ছদ-ছবি-ভাষা ইত্যাদি জুড়েছেন। বইটির শেষের দিকে দশম অধ্যায়ের ২৪৭ নং পৃষ্ঠায় ‘বাত্যাচুল্লিতে আয়রন নিষ্কাশন’ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত অংশটুকু ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল’ জোড়পূর্বক জুড়ে দিয়েছেন বলেও তিনি দাবী করেন। এই দাবীর মধ্য দিয়ে কথিত ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ তাঁর ফেসবুক লাইভে করা “মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক লাইনও লেখেন নি!” দাবিটি নিজেই খণ্ডন করে বসেন। আলোচ্য বইয়ের কাজে তিনি সিলেটস্থ শাবিপ্রবিতে মুহম্মদ জাফর ইকবালের তৎকালীন কর্মস্থলে গিয়েছিলেন, এটিও মুখ ফসকে বলে ফেলেন। আলোচ্য বইয়ের মুহম্মদ জাফর ইকবালের কোনও সংশ্লিষ্টতাই না থাকলে এই সফরের ঠিক কি প্রয়োজন ছিল, সেটি তিনি স্পষ্ট করেন নি। আবার 'ফেস দ্যা পিপল' নামক চ্যানেলটির উপস্থাপকের পর্যাপ্ত ‘হোমওয়ার্ক না থাকায়’ অথবা ‘আদৌ সদিচ্ছা না থাকায়’ তিনি এসব বিভিন্ন অসঙ্গতি চিহ্নিত করতে পারেন নি। অবশ্য এদেশে টক-শো নামের কুৎসিত আয়োজনের সঞ্চালকেরা যে আদৌ সদিচ্ছা কিংবা হোমওয়ার্কের ধার ধারেন না, তা তো বেশ ভালভাবে প্রমাণিত হয়েছে সেই ঝিঙ্গে-বেগুনের কেচ্ছাতেই। এই উপস্থাপকের ‘হোমওয়ার্কের ঘাটতি’ অথবা ‘সদিচ্ছার অভাব’ বেশ প্রকটভাবে ধরা পড়ে অনুষ্ঠানের শুরুতেই। কেননা, শুরুর নানান তথ্যের মধ্যে তিনি একবার এটিও জানান যে- “সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতির দায়ে জাফর ইকবাল আলোচিত… ইত্যাদি… ইত্যাদি…”। উল্লেখ্য যে, নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল দায়িত্ব নিয়েছেন ‘বিজ্ঞান’ বইয়ের। বিজ্ঞান বইয়ে ঠিক কিভাবে ‘ইতিহাস বিকৃতি’ করা যায়, স্বাভাবিক চিন্তায় সেটি বোঝা একটু দুরহ ব্যপার। অবশ্য, কারো যদি ইশপের সেই ‘উজানে থাকা ধুরন্ধর নেকড়ে কর্তৃক ভাটিতে থাকা গড্ডলশাবককে পানিঘোলা করার দায়ে অভিযুক্ত করা’ সংক্রান্ত গল্পটি জানা থাকে, সেক্ষেত্রে চিন্তা উজানে বইতেই পারে। এর উত্তরে আবারও মৃদুল আহমেদের কাছেই ফিরতে হয়, যিনি ‘সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে’ বাক্যবন্ধে ত্রিকালদর্শী একটি সংকটের মূলটি তুলে ধরেছেন সুচারুরূপে।

এবারে বৈদ্যুতিক সমস্যাটির গোড়ায় অর্থাৎ ব্যাটারিতে একটু হাত দেই, তাহলে ভাইরালাকাঙ্ক্ষী কথিত বিদ্যুৎ রায়ের ‘লেখকত্ব’ নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক আলোচ্য বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে, যেটি ২০১৩ সাল থেকে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে শ্রেণীকক্ষে পৌঁছে যায়।

চিত্রঃ আলোচিত রসায়ন বইয়ের প্রিন্টার্স লাইন

পরবর্তীতে, ২০১৭ সালে ‘সহজপাঠ্য, আকর্ষনীয় ও সহজবোধ্য’ করার জন্য এর ‘পরিমার্জিত’ সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যা মূলত ২০১২ সালে প্রকাশিত বইটিকে ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়। এই ২০১৭ সালে প্রকাশিত বইয়ের প্রয়োজনীয় ‘সংযোজন, পরিবর্ধন, পুনর্লিখন ও সম্পাদনা’ প্যানেলের সদস্য ছিলেন পাঁচজন, যাদের নাম আগেই বলা হয়েছে। অর্থাৎ, ২০১৭ সালে নতুন করে কোনও বইই লেখা হয় নি। কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায়ের দাবীটি সর্বৈব মিথ্যা।

চিত্রঃ আলোচিত রসায়ন বইয়ের প্রথম পাতা

২০১২ সালের সংস্করণ রচনা করেন- অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর, ড. মো. ইকবাল হোসেন, ড. মো. মমিনুল ইসলাম এবং নাফিসা খানম এই চারজনের সমন্বয়ে গঠিত একটি লেখক প্যানেল। উক্ত সংস্করণের সম্পাদনা করেন প্রফেসর ড. নীলুফার নাহার। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালের এবং তৎপরবর্তী প্রতিটি সংস্করণেই এই তথ্যটুকু লিপিবদ্ধ আছেন। অর্থাৎ, যেই বই আদৌ লেখাই হয় নি, কেবল পরিমার্জন/সম্পাদনা করা হয়েছে- সেই বইয়ের লেখকস্বত্ব দাবী করছেন জনৈক বিদ্যুৎ কুমার রায়। এই বইয়ের ‘লেখক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারেন কেবল অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর ও বাকি তিনজন। প্রকাশের এক দশক এবং পরিমার্জনের অর্ধ দশক পরে এসে অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর এবং অন্যান্যদের লেখা বইয়ের লেখকস্বত্ত্ব রাতারাতি কোনও এক বিদ্যুৎ কুমার রায় দাবি করবেন-এটি অত্যন্ত হাস্যকর‍! এই প্রেক্ষিতে, কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায়ের ভাইরালাকাঙ্ক্ষী এই ভয়ানক মিথ্যাচারের উৎস খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, যে ২০১৭ সালে কেবল রসায়ন নয়, অন্যান্য বইয়েও একইভাবে প্রয়োজনীয় ‘সংযোজন, পরিবর্ধন, পুনর্লিখন ও সম্পাদনা’ করা হয়েছে। এবং, প্রতিক্ষেত্রেই ভিত্তি ছিল পূর্ববর্তী অর্থাৎ ২০১২ সালে প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বইটি। প্রতিটি বইতেই পূর্ববর্তী সংস্করণের লেখকবৃন্দের ঋণ স্বীকার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পদার্থবিজ্ঞান বইটির আগের সংস্করণ রচনা করেন ড. শাহজাহান তপন, ড. রানা চৌধুরী, ড. ইকরাম আলী শেখ ও ড. রমা বিজয় সরকার আর সম্পাদনা করেন ড. আলী আসগর।

পাঠকের সুবিধার্থে এর পাশাপাশি গণিত, উচ্চতর গণিত, জীববিজ্ঞান ও বিজ্ঞান বইয়ের সংশ্লিষ্ট পাতার ছবি দেয়া হল। প্রতিটি বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইটে পিডিএফ রূপে সংরক্ষিত আছে। আগ্রহী পাঠক যাচাই করে দেখতে পারেন। এবং, পূর্ববর্তী সংস্করণের সাথে মিলিয়েও দেখতে পারেন। ভাইরাল হতে চাওয়া কোনও পেশাদার ঠগবাজের ডাহা মিথ্যা কথায় চোখবুজে বিশ্বাস করার চাইতে, সেটি বরং বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

গিরগিরটির গায়ের রঙের চেয়েও দ্রুততম সময়ে বদলে যায় কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায়ের বক্তব্য। ভাইরাল হওয়া সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি আবারও "সংযোজন, পরিবর্ধন ও সম্পাদনা" অনুল্লেখ্য রেখে শুধুমাত্র 'পুনর্লিখন' নিয়ে গোল গোল ত্যানা পেঁচিয়েই যাচ্ছেন। এজন্যই বোধহয় ভবিষ্যতদ্রষ্টা সুকুমার রায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন- "আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না কেবল মিচ্‌‌কেমি করে?" মজার ব্যাপার হল, এই ফেসবুক আইডির বিভিন্ন স্ট্যাটাস এবং লাইভ ভিডিওর ভাষা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে আইডিটির মালিক প্রমিত নিয়ম মেনে শুদ্ধ বাংলা লিখতে ও বলতে পারেন না। অথচ, আলোচ্য রসায়ন বইটি প্রমিত ভাষারীতি মেনে শুদ্ধ বাংলায় রচিত। কল্পনা করুন, হিরো আলমের কোনও ভিডিওতে যদি রাতারাতি আলম সাহেবের মুখ থেকে আসাদুজ্জামান নূর কিংবা আলী যাকেরের মতন ভরাট কণ্ঠে এবং প্রমিত বাংলায় সংলাপ শুনতে পান- তবে কি আঁতকে উঠবেন না? ফেসবুকের নানান স্ট্যাটাসে কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায়ের ব্যবহৃত ভাষাজ্ঞান এবং আলোচিত রসায়ন বইটির ভাষারীতি পাশাপাশি মিলিয়ে দেখতে গেলে, ঠিক একইভাবে আঁতকে উঠতে হয়। আরও মজার ব্যাপার যে, বইটির কিছু কিছু বাক্যে জাফরীয় ছাপ লক্ষনীয়। যারা মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা নিয়মিত পড়ে থেকেন, তারা সম্ভবত ধাঁচটি চিনতে পারবেন। অর্থাৎ, এই লোকের ‘সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে’, সেটা কেবল অনুমিতই নয়, বরং প্রমাণিত। এমন ভাইরালাকাঙ্ক্ষী ঠগবাজদের জন্য একটাই টোটকা- প্রকৃত তথ্য। তাই নিজে জানুন, অন্যকেও জানান। বাঁচতে হলে জানতে হবে। আশার কথা এই যে, কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায়ের স্ট্যাটাসে কেউ কেউ অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরছেন। সংখ্যায় অল্প হলেও অন্তত কিছু মানুষ যে- 'আপনার দাবী মিথ্যা' এটি মুখের উপর বলতে শুরু করেছেন এটি আশাব্যাঞ্জক। এই নির্লজ্জ মিথ্যাচারের আশু অবসান ঘটুক, এটুকুই চাওয়া।

পুনশ্চঃ কি ভয়ংকর ব্যাপার! এখানে নিজের শেয়ার করা একটি ভিডিওতে বিদ্যুৎ কুমার রায় নিজেই স্বীকার করছেন- 'নিজের ছাত্র এবং কলেজের অফিস সহকারীকে দিয়ে বই লেখানোর গল্প' (এই ভিডিওতে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা ১৮ মিনিট পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনুন), আর গদগদ হয়ে সেই ঠগবাজির গল্প 'মোটিভেশনাল স্পীচ' হিসবে শুনে মোহিত হচ্ছে লাখো ফেসবুক গাড়ল! যিনি নিজের বই লেখান অন্যকে সাবলেট দিয়ে, তাঁর মাঝে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে দেখে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সের উদ্ভব হওয়া খুবই স্বাভাবিক। উনার এত হইহল্লা করার একটা সম্ভাব্য মনস্তাত্বিক কারণ বোঝা গেল! ভদ্রলোক মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে থাকলে, তাঁর বোধহয় আশু চিকিৎসা প্রয়োজন, তাচ্ছিল্য নয়।

(পরবর্তীতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই অনুচ্ছেদ দুটি ২৪/০৪/২৩ তারিখ সকাল ৯.৩০ ও দুপুর ২.৩০ এ যুক্ত করা হল।)

পুনঃ পুনশ্চঃ আরও ভয়ংকর ব্যাপার! এখানে নিজের শেয়ার করা একই ভিডিওতে বিদ্যুৎ কুমার রায় নিজেই তাঁর ক্লাসরুমে শিক্ষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানাচ্ছেন- 'ক্লাসরুমে ঢুকেই আমি আগে বলে নিইঃ কেমিস্ট্রি একটা ভুয়া সাবজেক্ট, বিজ্ঞানীরা অনেক কথা বলেন, অথচ পরমাণু ইত্যাদি দেখা যায় না.... এভাবে ছাত্ররা বেশ মজা পায়!' (এই ভিডিওতে ১ ঘন্টা ৪ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা ৬ মিনিট পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনুন), ক্লাসরুমে একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক নিজের বিষয়কে এতটা তাচ্ছিল্য করে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ছাড়াই পড়াচ্ছেন, সেটা জোরগলায় গর্বভরে প্রচার করছেন, এবং এহেন ব্যক্তি জাতীয় শিক্ষাক্রমের বই রচনার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছেন! এই ভয়াবহ জিনিস হজম করা কঠিনই বটে। এই ভিডিওতে বিদ্যুৎ কুমার রায় আরও স্বীকার করছেন- 'বিসিএস পরীক্ষায় আমি ইসলাম শিক্ষা পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে এসেছি!' (এই ভিডিওতে ৪১ মিনিট থেকে ৪৬ মিনিট পর্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনুন), ইয়ে, মানে "সিএসইর জাফর ইকবাল কেমিস্ট্রির কি জানে?" এই প্রশ্ন তুলে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে ফেলা মহাজ্ঞানী বিদ্যুৎ কুমার রায় নিজের বিষয় বাদ দিয়ে ইসলাম শিক্ষা বেছে নিয়েছিলেন কেন? আমার মা ছোট থেকেই সাবধান করতেনঃ "সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর" অর্থাৎ, যে লোক বেশি কথা বলে, তার থেকে সাবধান- অবশ্যই সে প্রচুর মিথ্যে বলে! মানে অসম্ভব-খ্যাত জলিল সায়েবের সেই উক্তি- "একটা মিথ্যা কথা বললে, আরেকটা মিথ্যা আবার..... অনেকগুলি মিথ্যা কথা.....ইত্যাদি!" তা, এই ভিডিওতে বিদ্যুৎ কুমার রায় দাবী করেছেন, কথিত বই লেখা বাবদ তাঁর নাকি ২৭,০০০ টাকা প্রাপ্তি হয়েছে। যদিও তিনি দাবী করেন যে, NCTB'র সাথে এই বইয়ের সম্পর্ক নেই। তাহলে NCTB তাঁকে এই টাকা দিল কেন এটি নিয়ে প্রশ্ন জাগতেই পারে। এই ভিডিওতে বিদ্যুৎ কুমার রায় আরও বলেছেন কথিত বই লেখা বাবদ তাঁর নাকি সাত লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। একই চ্যানেলের বিজ্ঞাপনী পোস্টার, যেটি এই পোস্টের শুরুতে আছে, সেখান থেকে জানা যায়, তৎকালীন সময়ে তিনি ভাসানটেক সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত ছিলেন। চলুন প্রচলিত বেতন স্কেল অনুসারে তাঁর আয়-বায়্যের খতিয়ান খতিয়ে দেখি!

এখানে, A-কলামে সরকারি পে-স্কেল অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রেড, B-কলামে সংশ্লিষ্ট মাসিক মূল বেতন বা বেসিক, C-কলামে বোনাসসহ এক বছরের মোট বেতন, D-কলামে চিকিৎসা/বাড়িভাড়া খাতে এক বছরের মোট ভাতা, E-কলামে NCTB থেকে প্রাপ্ত লেখক সম্মানী, F-কলামে বাৎসরিক মোট প্রাপ্য, G-কলামে আয়কর ও প্রভিডেন্ট ফান্ড (ন্যূনতম ৫% ধরে) বাবদ এক বছরের মোট কর্তন, H-কলামে আছে G-কলামে উল্লিখিত কর্তন বাদে পাওনা, I-কলামে আছে H-কলামে উল্লিখিত পাওনা থেকে ৭ লক্ষ টাকা বাদে বাৎসরিক প্রাপ্তি, আর সবশেষে J-কলামে I-কলামে উল্লিখিত বাৎসরিক প্রাপ্তিকে ১২ দ্বারা ভাগ করে মাসিক আয় দেখানো হয়েছে! উল্লেখ্য যে, গ্রেড-৬ হল সহকারী অধ্যাপকের বেতনক্রম, গ্রেড-৫ হল সহযোগী অধ্যাপকের বেতনক্রম, গ্রেড-৪ হল পূর্ণ অধ্যাপকের বেতনক্রম! ফেসবুকে জনাব বিদ্যুৎ কুমার রায়ের সরবরাহকৃত তথ্য বিশ্লেষণ করেই হিসাবটি করা হয়েছে। আচ্ছা, ঢাকা শহরে মাসিক ৩,৮৪১ টাকায় তিনি ঠিক কিভাবে দিন কাটিয়েছেন? অন্যান্য খাত নাহয় বাদই দিলাম, তিনি বাড়িভাড়া কত দিতেন? খাবার খরচ বাবদ তাঁর কত টাকা লাগত? এই অশালীন প্রশ্নগুলো কাউকে করাও বিব্রতকর! তিনি নিজে যেহেতু শালীনতার ধার ধারেন না, সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো বোধহয় করাই যায়। কেননা, তাঁর নিজের দাবী থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারেই তাঁর আয়-ব্যায়ের মধ্যে বেশ গরমিল দেখা যাচ্ছে। প্রাসঙ্গিকভাবে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সেই গল্পটা মনে পড়ে যাচ্ছে- "এটা বিড়াল হলে মাংস কই? আর, এটা মাংস হলে বিড়াল কই!" তিনি তাঁর উদ্ভট শখ মেটাতে ফেসবুকে যথেষ্ট ভাইরাল হয়েছেন। এবারে কি "আয়কর বিভাগ" কিংবা "দুদক" থেকেও কেউ এগিয়ে আসবেন, তাঁর ভাইরালাকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণভাবে মিটিয়ে দিতে? আসা উচিৎ বোধহয়!

(পরবর্তীতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই অনুচ্ছেদটি ২৫/০৪/২৩ তারিখ রাত ১০.৩০ এ যুক্ত করা হল।)

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, এটি শুভ লক্ষণ। বৈদ্যুতিক শক খেয়েও সব কিছু বোধহয় নষ্টদের অধিকারে যায় নি। এখানে দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ কুমার রায়ের ফেসবুক ওয়ালেই কেউ একজন খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে বসেছেন। তিনি উত্তর দিতে গিয়ে এত রেগে গেলেন কেন ঠিক বুঝলাম না, শিক্ষক মানুষ ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অভ্যস্থ হবার কথা। তিনি কি তবে প্রকৃত শিক্ষক নন, শরাফত করিম আয়নার মতন শিক্ষকের ভুমিকায় অভিনয় করছেন? যাক গিয়ে, তিনি ইতিমধ্যে মন্তব্য বন্ধ করে দিয়েছেন, মুছেও ফেলতে পারেন- এই আশংকায় প্রমাণ রেখে দিলাম।


এই আগ্রহোদ্দীপক মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যে আরও কিছু প্রশ্ন জেগেছে, যা ওয়ালে করার সুযোগ রহিত। তাই এখানেই টুকে রাখি।
১। মুহম্মদ জাফর ইকবাল যেই বইয়ের সাথে জড়িতই নন (তথ্য সূত্রঃ বিদ্যুৎ রায়ের প্রথম লাইভ) সেই মুহম্মদ জাফর ইকবালের অফিসে কারেকশনের কাজ কেন?
২। ফেসবুকে লাইভ হওয়া যাবে, ভাইরাল হওয়া যাবে, ডাহামিথ্য কথা বলে "অমুকের কু-কীর্তি" (দেখুন ভিডিওসহ) বলে ছ্যাঁচড়ামো করা যাবে- তাহলে লিখে বোঝানো যাবে না কেন? কেনু কেনু কেনু? আমাদের কি ব্রেইন দুব্বল?
৩। হিসাব রাখেন নাই, তাহলে "৭ লক্ষ টাকা" এই ফিগার এল কোথা থেকে? ভাইরাল হওয়ার সময় তো বেশ "বড়গলা" করেই বললেন!
৪। একটু আগেই বললেন কোনও হিসাব নাই, এখন আবার বলছেন ১ লাখ ২ হাজার? আমরা কি শিব্রামের মতন কাশি দিব? তাহলে লাখ থেকে হাজার কিংবা শ'এর ঘরে নামবে? আর এই শিক্ষা সম্মেলন জিনিসটা কি বস্তু, এটা কক্সবাজারে হয় কেন- কেউ জানা থাকলে একটু বুঝিয়ে বলবেন? শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-শিক্ষামন্ত্রী এনারা দাওয়াত পেতে পারেন, ফেসবুকের ভাইরাল বেচে খাওয়া হিরো আলমের মাসতুতো ভাই কেন?
৫। হেহেহে! সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে- আবারও প্রমাণিত। একেবারে লিখিত প্রমাণ! আগেরবার শিক্ষামন্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়েছিলেন, এবার দেখি প্রধানমন্ত্রী মহোদয়ের নাম ভাঙ্গানোও শুরু হয়েছে। ভাল ভাল।

এক বন্ধু জানালেন, বিদ্যুৎ কুমার রায় নাকি একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রতিমন্তব্য (ওপরের ছবি দ্রষ্টব্য) মুছে দিয়েছেন। বুঝলাম না, সত্য কথা বলে থাকলে উনার এত ভয় কেন?

(পরবর্তীতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই অনুচ্ছেদটি ২৯/০৪/২৩ তারিখ বিকাল ৩.৩০ এ যুক্ত করা হল।)

মুহম্মদ জাফর ইকবাল কোনও পীর নন, রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে তাঁর হাজারটা দূর্বলতা থাকতেই পারে। কিন্তু, মনে রাখতে হবে গবাদি ও ছাগুকুলের বহুদিনের প্রচেষ্টায় এদেশের সবচেয়ে ‘সেলিং লাইক হট কচুরিস’ মার্কা ক্লিকবেইটের নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই ক্লিকবেইট ব্যবহার করে রাতারাতি 'হট কচুরি' হতে চাওয়া 'বিস্বাদ মানকচুর ঝাড়' শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলা প্রয়োজন শুরুতেই। কথিত ‘বিদ্যুৎ কুমার রায়’ নিজেকে ২২ তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দাবী করেছেন। ২২ তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে আসলেই এই নামে কেউ আছেন কি না, সেটি অনতিবিলম্বে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যদি না থাকে, অথবা এই নামে অন্য কেউ থেকে থাকেন তাহলে লাইভকারীকে খুঁজে বের করে অনতিবিলম্বে সাইবার ক্রাইমের দায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আর যদি লাইভকারীর প্রকৃত অস্তিত্ব আসলেই থেকে থাকে, তবে আরও ভয়ানক ব্যপার। সেক্ষেত্রে, হন্তদন্ত তদন্ত প্রয়োজন। ফেস দ্যা পিপলে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায় সাবেক একজন শিক্ষামন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে দাবী করেছেন- যে তিনি নাকি মন্ত্রী মহোদয় কর্তৃক রসায়ন বই লেখার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায়ের উচিৎ সাবেক মন্ত্রী মহোদয়ের স্বাক্ষরিত তৎসংক্রান্ত লিখিত আদেশটি প্রদর্শন করা। নতুবা, সাবেক একজন মন্ত্রীর (যিনি বর্তমানেও একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি) নাম ভাঙিয়ে সুবিধা নেয়ার অপচেষ্টা করার দায়ে বিধি মোতাবেক তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

তাঁর বিভিন্ন ফেসবুক পোস্ট ও ভিডিওতে আরেকটি ব্যাপার বেশ দৃষ্টিকটুভাবে লক্ষ্যনীয়। তিনি নিয়মিত বিরতিতে লিখিত বা মৌখিকভাবে মনে করিয়ে দিয়ে থাকেন- "আমি কিন্তু গোল্ড মেডালিস্ট"। এই কাজটি পঞ্চম শ্রেনীতে বৃত্তি পাওয়া শিশুরা বেশ সাবলীলভাবে করে থাকে, বাড়িতে নতুন অতিথি এলেই দৌড়ে এসে সার্টিফিকেট-প্রাইজ ইত্যাদি দেখিয়ে আনন্দ পায়। সেই বয়সে এই কাজটি একেবেরেই বেমানান লাগে না। কিন্তু, এমন শিশুতোষ "আমি-আমি-আমি" বয়স্ক কোন একাডেমিশিয়ানকে আজতক করতে দেখি নি। তাই, কথিত বিদ্যুৎ কুমার রায় যখন ঘনঘন (এমন কি, নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হলেও) গোল্ড মেডালের দাবী করেন, তখন দুষ্ট মনে ভর করেন কবিগুরু। তিনিই তো আজি হতে শতাধিক বর্ষ আগে এই ঘটনার পূর্বাভাস দিয়ে লিখে গেছিলেন- "কত বড় আমি/কহে নকল হীরাটি/তাই তো সন্দেহ করি/নহ ঠিক খাঁটি!" যা হোক, একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিৎ ঐ শিক্ষাবর্ষের ফলাফলে কোনও ঘাপলা আছে কি না- সেটি যাচাই করে দেখা। নইলে এমন মুড়ি-মুড়কির দরে গোল্ড মেডাল বিলিয়ে গেলে, অচিরেই দুষ্ট লোকে বিশ্ববিদ্যালয়টির মান নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে বসতে পারে।

এই ফেসবুক প্রতিমন্তব্যে বিদ্যুৎ কুমার রায় দাবী করেছেন যে, বিনামূল্যে দেশব্যাপী বিতরনের জন্য NCTB কর্তৃক প্রকাশিত এবং NCTB'র ছাপ্পামারা বইতে নাকি খোদ NCTB'র সংশ্লিষ্টতাই নেই। এই ভয়ানক ফেসবুকীয় অভিযোগের ব্যাপারে একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে NCTB কর্তৃপক্ষের মতামত জানা জরুরী। এবং, দাবী অসত্য প্রমাণিত হলে দ্রুততম সময়ে NCTB কর্তৃপক্ষের আইনী ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। NCTB'র বই সারাদেশে বাচ্চাদের হাতে পৌঁছে, এটি হেলাফেলা করার বিষয় নয়। কিংবা, ফেসবুকে রিচ বাড়ানোর তালে থাকা কোনও ছ্যাঁচ্চোড়ের আহ্লাদের বিষয়ও নয়। (বিদ্রঃ বিদ্যুৎ কুমার রায়ের ছিঁচকে সময়জ্ঞান দুর্দান্ত। তিনি ঘড়ি ধরে এমন সময়ে ভাইরাল হয়েছেন, যখন টানা ৫ দিন ঈদ উপলক্ষে দায়িত্বশীল বিভিন্ন দপ্তর ছুটি থাকবে। এবং, ছুটি শেষে দাপ্তরিক প্রতিবাদলিপি আসার আগেই উনি ভাইরাল হয়ে মোক্ষলাভ করবেন। একেবারে ফাঁকা মাঠে গোল যাকে বলে!) এই ছবিতে থাকা দ্বিতীয় প্রতিমন্তব্যটি আরও মজার। এখানে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে তিনি সরাসরিই ‘সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে’ বলে ফেলেছেন। সম্ভবতঃ উনার নাস্তার রুটি পুড়ে গেলে কিংবা দুপুরের ডালে লবন না হলে সেই দোষও একান্তভাবে জাফর ইকবালেরই ঘাড়েই যাবে। উল্লেখ্য যে, প্রচলিত চাকুরি বিধি মোতাবেক, কর্মরত কর্মচারীর 'গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রদান' কিংবা 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার' সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট আইন আছে। তিনি সেই আইন আদৌ মেনেছেন কি না, সেটিও খতিয়ে দেখা জরুরী। একই সঙ্গে দায়িত্বশীল পদে থাকা অবস্থায় তিনি এমন ডাহা মিথ্যাচার করতে পারেন কিনা সেটিও দ্রুততম সময়ে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। নইলে এমন ভাইরালাকাঙ্ক্ষী কর্মচারী দ্বারা পরিচালিত হলে শিক্ষা ব্যবস্থার তেরোটা বাজতে বাধ্য। বাচ্চাদের শিক্ষাটা যদি অন্তত ঠিকঠাক থাকে, তবে দু-এক প্রজন্ম পরে হলেও রুচির দুর্ভিক্ষ হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু, শিক্ষায় একবার দুর্ভিক্ষ এলে আর বাঁচার উপায় নেই। অনাগত শিক্ষা-দুর্ভিক্ষের এমন সম্ভাব্য কুশীলবদের প্রতিহত করা প্রয়োজন- এবং এখনই! আসন্ন বই দিবসে পাঠ্য (ও অপাঠ্য) বইসমুহ এমন জোচ্চোরদের কবল থেকে মুক্তি পাক, এটুকুই প্রত্যাশা।

২২/০৪/২০২৩


Comments

ওডিন's picture

দুর্দান্ত অনুসন্ধানী একটা লেখা হয়েছে!

ভূমিকম্প, সয়াবিন তেলের দাম বাড়া থেকে শুরু করে সোলার ফ্লেয়ার- মোটামুটিভাবে সকল সমস্যার মুলেই যে মুহম্মদ জাফর ইকবাল, এইটা তো এখন প্রমাণিতই। :/

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ভদ্রলোক প্রতিদিনই নতুন নতুন ভাইরাল ভিড্যু পয়দা করতে গিয়ে আগের দিনের কথার সাথে পরের দিনের কথায় প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলছেন। বারবার 'সমস্যাডা শুধুই জাফর ইকবালে' ছাড়া বাদবাকি স্ক্রিপ্টিং খুবই দূর্বল, কিন্তু তাতে কি আসে যায়? রায় বাহাদুরের মুরীদদের কাছে ওই একটি জাদুবাক্যই যথেষ্ট। তাঁরা বিপুল বিক্রমে জ্যামিতিক হারে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছেন।

এই লেখাটা ছড়িয়ে দেয়া দরকার ছিল! কিন্তু ভাইরাসই ছড়ায়, ভ্যাক্সিন নয়। (রচনাঃ প্রমথ চৌধুরী, সম্পাদনাঃ সাক্ষী সত্যানন্দ)

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

এনসিটিবি'র কোনো বই কোনো একক লেখকের লেখা নয়, কোনো একক সম্পাদকের সম্পাদনা নয়। যে কোনো আমলের এনসিটিবি'র যে কোনো বই হাতে নিলে এটা প্রমাণিত হবে। একক কৃতিত্ব দাবি করা, বা সেটা কেউ চুরি করা ইত্যাদি বলা বা ঝোপঝাড় পেটানো নিতান্তই বালখিল্য আচরণ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

বালখিল্য "ভাইরালজীবি" আর তাঁর বালখিল্য "মুরীদবাহিনী" কেউই তো মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে আসেন নি। এত কথা উনারা জানবেন কিভাবে? আর ভাইরাল হতে এত পড়াশুনা লাগেও না, এটা একটা ব্যপার।

একক কৃতিত্বের দাবিটা সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং, একক তো পরের কথা, ভাইরাল হওয়া ভদ্রলোক (!) আদৌ লেখকই নন। আমার আশংকা, এতদিন বিভিন্ন জায়গায় বড় গলায় বলে বেড়িয়েছেন "এই বই আমি একাই লিখেছি", তারপর ছাত্ররা যখন প্রথম পাতায় লেখক তালিকা দেখে উসখুস করতে শুরু করেছে, তখন বেলুন ফুটুস হওয়ার আশংকায় এই আগাম আক্রমণ। উনার ফেসবুক আইডি থেকে বোঝা যায়, তিনি "প্রশ্নের মুখোমুখি হতে বড়ই অপছন্দ করেন", এই দর্শনের একজন মানুষ শিক্ষকতা করেছেন- এটি বড় দুর্ভাগ্যজনক!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

স্পর্শ's picture

আরেহ! এত কিছু কখন হয়ে গেল! দারুণ লেখা গুরু গুরু

আমি যেটা বুঝতেছি না, এসব করার পিছনে এই লোকের মোটিভেশনটা কী?


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

মোটিভেশনজনিত প্রশ্নটা আমারও। (বিদ্যুৎ রায় সম্ভবতঃ বৃহত্তর কোনও গং এর পাপেট মাত্র)

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নীড় সন্ধানী's picture

বিশাল কাণ্ড। এই লোক তো দেখি পুরাই হিটখোর ধান্ধাবাজ। প্রোফাইলে লেখা ওএসডি। কোন পূন্যের কারণে ওএসডি হলো কে জানে। জাফর ইকবালকে গালি দিয়ে যদি কপাল ফেরে সেই চেষ্টা করছে হয়তো।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

ইয়ে, "ওএসডি মানেই শাস্তিপ্রাপ্ত" এই গণ-ধারণা অশিক্ষিত সাংবাদিকদের বহুল চর্চিত বাক-ওয়াজের ফলাফল। শিক্ষা-ছুটি চলাকালীন কিংবা পদোন্নতির অব্যবহিত পরে পদায়নের উপযুক্ত পদ ফাঁকা না থাকাকালীন- ইত্যাদি নানান কারনেই "ওএসডি" নামের এই জমকালো পদভার অর্জিত হতে পারে। বাস্তবে শাস্তিমূলক ওএসডি পদধারীর সংখ্যা অতি নগন্য।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

সোহেল ইমাম's picture

চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

Quote:
মিথ্যা ধুয়ে যাক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

কল্যাণ's picture

চমৎকার লিখেছেন। বেশ কিছুদিন আগে এই লোক "বুঝে পড়ার কোন দরকার নেই, শুধু মুখস্ত করতে হবে, মুখস্ত করেই আমি সোনার মেডেল পেয়েছি" টাইপের কথা বলছিলেন, মনে পড়ছে।

প্রথম প্যারায় মৃদুল দা' 'রহমান' হয়ে গেছেন।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- হ্যাঁ উনিই, ঠিক চিনেছেন!

ঠিক করে দিলাম! (ঠিকমত মুখস্থ না করলে যা হয়...) লইজ্জা লাগে

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.