একের মধ্যে দুই,আমার ভেতর তুই?

নীড় সন্ধানী's picture
Submitted by hrrh69 on Fri, 01/07/2022 - 2:48pm
Categories:

ঘটনাকে শিকার করতে গিয়ে ঘটনার শিকারে পরিণত হবার অভিজ্ঞতা আপনার আছে? ব্যাপারটা শুনতে হাস্যকর মনে হলেও আমার জন্য মর্মান্তিক ছিল। কারণ সেরকম একটা ঘটনার শিকার হয়ে আমি এখন ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলার অপেক্ষায় নির্জন কারাকক্ষে বসে আছি।

ঘটনাটি বলা যাক।

ধরা যাক আমার নাম মারফি। যে অস্বাভাবিক ঘটনাটি আমাকে এখানে এনে ফেলেছে সেটার সাথে আরো একজন জড়িত। তার নাম কেলি। আমরা দুজনই ছিলাম ট্যাক্সিডার্মিস্ট। ‘ট্যাক্সিডার্মিস্ট’ শব্দটা আপনার কাছে অচেনা হলে আমাকে একটু ব্যাখ্যা করতে হবে। তবে ট্যাক্সিডার্মি কী সেটা বোঝানোর জন্য আমি দীর্ঘ প্রবন্ধ ফাঁদবো না। শুধু বলি শব্দটা যেমন বিশ্রী, তেমনি অসম্পূর্ণ। সাধারণভাবে বলতে গেলে ট্যাক্সিডার্মিস্ট হলেন এমন একজন বিশেষজ্ঞ যিনি একাধারে প্রাণীবিদ, প্রকৃতিবিদ, রসায়নবিদ, ভাস্কর, চিত্রকর এবং কাঠমিস্ত্রী। যে লোক একসাথে এতগুলো কাজের সাথে জড়িয়ে থাকে তার মেজাজ একটু তিরিক্ষি হতেই পারে, তাই না?

যাই হোক, এবার ট্যাক্সিডার্মির খানিক ইতিবৃত্ত বলা যাক। ট্যাক্সিডার্মি হলো এক ধরণের স্টাফিং যাতে প্রাণীদেহের বাইরের আবরণকে অক্ষত রেখে তার শরীরের হুবহু প্রতিকৃতি তৈরী করা। আধুনিক বিশ্বে প্রাণী দেহকে স্টাফিং করার চল নেই বললে চলে। পঞ্চম শতকে স্পেনের কার্তাজে গরিলাদের দেহ স্টাফিং করা হতো। ষোড়শ শতকে অস্ট্রিয়ান প্রিন্স সিগমুন্ড হার্বার্টস্টেইন তাঁর প্রাসাদে একটা বাইসনকে স্টাফিং করে রেখেছিলেন। তখন থেকে প্রাণী দেহকে বিশেষ ধরণের রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে সংরক্ষণের রীতি চালু হয়। আজকাল নানা ধরণের আধুনিক পদ্ধতি চালু আছে - যার একটি হলো টেক্সিডার্মি। তবে টেক্সিডার্মি করার সময় বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যেমন সাপের দেহ নিয়ে কাজ করা সহজ নয়। কারণ সাপের চামড়া খুব পাতলা এবং স্বচ্ছ। এটার জন্য বিশেষ কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। সমস্ত আধুনিক পদ্ধতির মূল ভিত্তি হলো আপনাকে চামড়াটা এমনভাবে ছিলে ফেলতে হবে যেন কোথাও কোন দাগ না লাগে। তারপর আপনি চামড়া ছাড়ানো সেই শরীরটাকে প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে মুড়িয়ে দেবেন। প্লাস্টার শক্ত হয়ে গেলে ওটাকে সাবধানে দুই ভাগ করে খুলে নেবেন। যেটা একটা খোলস মাত্র। সেই খোলসের মাপ অনুযায়ী আপনাকে প্রাণীটার শরীরের দুটো অংশ তৈরী করতে হবে হালকা কোন উপাদান দিয়ে। এর পরের কাজটা সবচেয়ে জটিল যেখানে আপনাকে অতি ধৈর্য সহকারে সর্বোচ্চ দক্ষতা প্রয়োগ করতে হবে। দেহের দুটো অংশের মাপে তৈরী মডিউল দুটো জোড়া দিয়ে এমনভাবে একত্রিত করতে হবে যেন কোথাও বিন্দুমাত্র ফাঁক না থাকে। তারপর সেই সম্পূর্ণ দেহমূর্তির ওপর ছিলে নেয়া চামড়াটা নিখুঁতভাবে সেঁটে দিতে হবে। সংক্ষেপে এটাই হলো ট্যাক্সিডার্মির কাজ। আশা করি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না আপনার।

কেলির একটা টেক্সিডার্মির ব্যবসা ছিল। আমি ছিলাম তার সহকারী। সে আমার বস ছিল বটে, কিন্তু শুয়োরের বাচ্চাটা ছিল একটা ইতর, অসভ্য, বদের হাড্ডি। কথায় কথায় গালিগালাজ আর দুর্ব্যবহার ছিল তার নিত্য আচরণ। সে একটা স্যাডিস্ট মানসকিতার লোক ছিল। আমাকে সে প্রচণ্ড ঘৃণা করতো এবং সেই ঘৃণাটা নানাভাবে আমার উপর প্রয়োগ করে মজা লুটতো। এটা তার এক ধরণের কুৎসিত খেলা ছিল।

সে জানতো আমি কাজপাগল মানুষ- নতুন নতুন কাজের অভিজ্ঞতা নিতে পছন্দ করি। সে কারণে সে ইচ্ছে করে আমাকে নতুন কাজের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতো। আমাকে এমন সব কাজ করতে দিত যেগুলো একেবারে ফালতু। যেমন কোন বুড়ির প্রিয় টেরিয়ার কুত্তা, কিংবা কারো বেড়াল, শেয়াল, ঘোড়া কিংবা সাদা খরগোশ ইত্যাদির কাজ। অতি তুচ্ছ অর্ডারগুলো আমাকে দিয়ে করাতো যা আমি আমি চোখ বন্ধ করেই করে ফেলতে পারি।

যদি বিশেষ ধরণের গুরুত্ববাহী কোন কাজ আসে -যেমন কুমীর কিংবা বোর্নিওর মাকড়সা অথবা জিরাফ, তাহলে সেগুলো কেলি নিজের জন্য রেখে দেবে। আমাকে সেদিকে ঘেঁষতেও দেবে না। তার উপর আমি যখন বিরক্তিকর কাজগুলো দাঁত চেপে করে যেতাম, তখন আমার প্রতি তার কটুক্তি আর বিশ্রী গালিগালাজগুলো চালাতে থাকতো।

সেদিন আমাদের ওয়ার্কশপের পরিবেশটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী তেতে ছিল। কেলিও তার মেজাজের চরমে। আমি তখন দুপুর পর্যন্ত খেটে একটা বেড়ালের কাজ শেষ করেছি। তারপর ওটাকে একটা শেলফের ওপর রাখলাম যেখানে আমরা সদ্য সমাপ্ত কাজগুলো রাখি।

জিনিসটা রাখতে না রাখতেই কেলির তেরছা সুরের মন্তব্য ছুটে এলো - ‘ঐ হালা, বিড়ালের লেজ গেল কই?’

আমি ঠান্ডা সুরে বললাম, ‘এটা ম্যানক্স জাতের বিড়াল, এই বিড়ালের লেজ থাকে না।’

সে ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘হালার পো হালা,এটা যে ম্যানক্স বিড়াল সেটা কোথায় লেখা আছে? এটা যে ট্রাকের তলায় লেজ খোয়ানো বেড়াল না সেটা কে বলবে?’

কথা শুনে আমার মেজাজ এত খারাপ হয়ে গেল যে তখনি হারামীটার গলা টিপে ধরতে ইচ্ছা করলো। তবু মাথা ঠাণ্ডা রেখে বেড়াল জাতি কত প্রকার ও কী কী ইত্যাদি নিয়ে একটা বিরাট লেকচার দিলাম। নানান তথ্য এবং উদাহরণ দিয়ে বোঝালাম কেন এবং কিভাবে ম্যানক্স বিড়াল অন্যদের চেয়ে আলাদা।

আমার বিড়াল বৃত্তান্তের এত ব্যাখ্যা শোনার পরও ইতরটা মুখের ওপর বলে বসলো - ‘তুই একটা খানকির ছাওয়াল, অশিক্ষিত বাঞ্চোত মাথামোটা হদ্দ বেকুব, গাধার বাচ্চা গাধা….. আমারে তুই বিলাই চিনাস নাটকির বাচ্চা?’

এটা নতুন কিছু না। সে এমন গালি প্রায়ই দিয়ে থাকে। কিন্তু সেদিনের বাতাসে কী যেন ছিল। তার শেষ কথাটা আমার মাথার রগ ধরে যেন টান দিল। শুয়োরটা তখন গালিগালাজ শেষ করে আমার দিকে পেছন ফিরে তার সাইকেলের ক্লিপ লাগাচ্ছিল। আমার হাতটা যেখানে রাখা ছিল সেখানে একটা স্টীলের লম্বা রড ছিল, যেটা দিয়ে আমরা প্লাস্টারের কাজ করি।

আমি কোন কথা ছাড়াই রডটা তুলে নিয়ে তার মাথার পেছনে ধুমসে একটা বাড়ি লাগালাম। সে একটা আর্তনাদ করে সামনের দিকে পড়ে গেল। উঠতে গেলে আমি আবার বাড়ি মারলাম। আবারো, আবারো। মারতে মারতে তাকে পুরোপুরি লুটিয়ে দিয়ে রডটা ছুড়ে ফেলে দিলাম।

মেজাজ চরম খারাপ হয়ে ছিল। আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। চারদিকে তাকালাম। শক্ত মার দেবার পর মেজাজটা একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। তখন হঠাৎ মনে পড়লো তার হৃদযন্ত্রে একটা সমস্যা ছিল। ব্যাটা মরেটরে যায়নি তো? ওয়ার্কশপের সামনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার একটা ড্রাম ছিল, সেটাই আমাদের সুপেয় পানির একমাত্র উৎস। আমি সেটাকে নেড়েচেড়ে ঠিক করে বসালাম। শীতের মধ্যেও রীতিমত ঘামছিলাম। কিন্তু আমার ভেতরটা ছিল একেবারে শান্ত। আমি আবারো ওয়ার্কশপে ফিরে গেলাম।

দেখলাম কেলি ঠিক সে অবস্থাতেই আছে যেভাবে আমি ওকে মেরে রেখে গিয়েছিলাম। কোন নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে না। শ্বাসও পড়ছে না। তখন পালস চেক করে বুঝলাম সে আর নেই। আমি তাকে ঠেলে চিত করলাম এবং তার চোখ পরীক্ষা করলাম। অন্য লোকদের চেয়ে আমি বহুগুন বেশী মৃত চোখ দেখেছি। দেখেই বুঝতে পারি প্রাণ আছে কিনা।

কেলি মরে গেছে। আমি ওকে খুন করেছি। আমি একজন খুনী। আর কিছু না ভেবে আমি কোটটা গায়ে চড়িয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। পথে পথে কিছুক্ষণ এলোমেলো হাঁটলাম, ভয় কাটানোর চেষ্টা করলাম, যুক্তি দিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম। তারপর একটা পানশালায় ঢুকে পড়লাম। প্রচুর হুইস্কি খেলাম তারপর বাড়ি গেলাম।

পরদিন সকালে জেগে উঠে আমি খুব অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম। অতিরিক্ত মদ্যপান এবং দুশ্চিন্তা দুটোই আমাকে কাবু করে রেখেছে। আমি আবারো ভাবতে চেষ্টা করলাম, কেলির ব্যাপারটা কী সত্যি, নাকি আমার মাতাল স্বপ্ন। সত্যি কী ওরকম কিছু ঘটেছে?
নাহ, আমি কোন ধরণের সান্ত্বনা বা আশার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম না। কেলি সত্যি সত্যি মারা গেছে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুশ্চিন্তা, ভয়, ভাবনার মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে একের পর এক সিগারেট খেতে খেতে মাথায় একটা পাগলামি চিন্তা ভর করলো হঠাৎ। এমন ভয়ানক, অকল্পনীয়, ঘৃণিত চিন্তা কারো মাথায় আসতে পারে সেটাই আশ্চর্য ব্যাপার। আমি ঠিক করলাম অন্যন্য মৃত প্রাণীদের নিয়ে আমি যা করি কেলির শরীরটাকে তাই করবো। ট্যাক্সিডার্মি।

কেউ যখন প্রবল আতঙ্কের জগতে প্রবেশ করে তখন তার হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে যায়, ভালো এবং মন্দের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায় না। সেই সন্ধ্যায় আমি ওয়ার্কশপে ঢুকে আমার কাজ শুরু করলাম। আমি ধীরস্থিরভাবে কাজ করছি। দিনরাত টানা কাজ। কিভাবে কী করলাম সেসবের কুৎসিত বিবরণ দিতে যাচ্ছি না। শুধু এটুকুই বলি একটি গরিলাকে নিয়ে যে পদ্ধতিতে কাজ করতাম, এখানেও তাই করলাম।

কাজটা শেষ করতে চার দিন লেগে গেল। তারপর আমি কেলির মুখমণ্ডলসমতে নিখুঁত একটা চামড়া পেলাম। সম্পূর্ণ দেহের প্লাস্টারের কাজ শেষ হবার পর শরীরের বাকী অংশগুলো গনগনে চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম। আমার পরিকল্পনা ছিল কেলি একটা চেয়ারের ওপর ঘুমিয়ে আছে- তেমন একটা দৃশ্য তৈরী করা। সেই দৃশ্য তৈরী হয়েছে। কেউ যদি তাকে ডাকতে আসে তখন ওভাবে দেখতে পাবে। আমি কাজটা করে সন্তুষ্ট। দেখেশুনে মনে হলো কাজটা নিখুঁত হয়েছে। তবু আমি জিনিসটা ঠিক হয়েছে কিনা সেটা পরখ করে দেখলাম বারবার।

তারপরই ভয়ংকর চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এটা এত বেশী অবাস্তব অযৌক্তিক যে আমি নিজেও কেঁপে উঠলাম ভাবতে গিয়ে। ভাবনাটা শুরু থেকেই একটু একটু গজিয়ে উঠছিল। দিনের পর দিন আমি চামড়াটাকে প্রিজারভেটিভ দিয়ে তার সেলুলোজ এবং অন্যন্য জৈব উপাদানগুলো অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম। সেই ভাবনার ক্ষুদে ফুলকিটা আজ যেন মাথার ভেতরে বজ্রপাত ঘটালো।

আমি যদি কেলির মূর্তির গায়ে পরানো চামড়াটা খুলে নিজের গায়ে লাগিয়ে প্রয়োজনমত কেলি হয়ে যাই, তাহলে কেমন হয়? তার শরীর আর আমার শরীর প্রায় একই আকৃতির। তার জামাকাপড় সব বরাবর আমার মাপে। তার চামড়াও সেরকম মাপমতই হবার কথা। চেষ্টা করতে দোষ কী?

ভাবনাটা বাস্তবায়নে কাজে নেমে গেলাম। আরো একদিন গেল নানারকমের টুকটাক মেরামতি কাজকর্ম করতে গিয়ে। তারপর চামড়াটা নিজের গায়ে লাগিয়ে জামার মতো পরে ফেললাম। সবটা ফিটিংস হয়ে গেলে আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম হুবহু কেলিকে দেখা যাচ্ছে ওখানে। শুধু দাঁত আর চোখ বাদে আমার বাকী সবটাই কেলী। দাঁত আর চোখের মধ্যে যে সামান্য পার্থক্য সেটা অত কেউ খুঁটিয়ে দেখবে না। কেউ বুঝতেই পারবে না কেলির চামড়া পরে আমি বসে আছি।

এবার আমি কেলির জামাকাপড়গুলো পরে নিলাম। কন্ঠস্বর এবং আচার আচরণকে তার মতো বিশ্রী করে বদলে নিতে তেমন কষ্ট হলো না। দ্বিতীয় দিনে আমি কেলির আবরণ গায়ে পরে হাঁটতে বের হলাম। পথে পথে কেলির চেনা লোকজনের সম্ভাষণও গ্রহন করলাম।

পরেরদিন আমি একটু বাড়াবাড়ি সাহস দেখিয়ে কেলির বাড়িতে চলে গেলাম। সেখানে বাড়িওয়ালী আমাকে(কেলিকে) দেখে তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এতদিন কোথায় গায়েব ছিলে তুমি?’ তিনি বিন্দুমাত্র টের পেলেন না।

আমি বললাম, ‘মাথামোটা মারফিকে বলেছিলাম আমি কদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি- সেটা যেন আপনাকে বলে। অপদার্থটা আপনাকে কিছু বলেনি, তাই না?’

সে রাতে আমি কেলির বিছানায় শুতে গেলাম। আমি একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম ভেবে আমার(মারফির) আসল বাড়িওয়ালী আমাকে বাড়ি ফিরতে না দেখে কী ভাবছে? কেলির বিছানায় শোবার যাবার আগে আমি তার আবরণটা খুলে রাখলাম না। আমার পরিকল্পনা যেন আরো নিখুঁত থাকে সে জন্য ওটা পরেই শুয়ে পড়লাম। ঘুমানোর আগে আমি আরেকটা সিদ্ধান্ত নিলাম। কেলি তার চেনাজানা সবাইকে জানিয়ে দেবে সে এখানকার ব্যবসাপাতি মারফির কাছে বিক্রি করে কানাডা চলে যাবে। তারপর আমি চামড়াটা পুড়িয়ে তার ব্যবসার পুরো মালিক হয়ে বসবো। ভাবনাটা আমার মধ্যে এমন পুলক জাগালো যে মনে মনে আমি নিজেকে বাহবা দিলাম এমন একটা অপরাধকে নিখুঁতভাবে ধামাচাপা দিতে পেরে।

তবু আরেকবার ভাবলাম, আমি কোথাও কোন ভুল করছি না তো? মনে হচ্ছে না। এখনো পর্যন্ত সবকিছুই ত্রুটিমুক্ত আছে। কেলির চামড়াকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য আমি যেসব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, চামড়াটাকে নিজের শরীরে পরার উপযোগী করার জন্য যা যা করা দরকার ছিল সবই ঠিক আছে। যে কোন সাধারণ ট্যাক্সিডার্মির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ঠিক আছে।

কিন্তু আমার মাথায় আসেনি যে একটি উষ্ণ বিছানায় জীবন্ত শরীরের সাথে চামড়াটা ভিন্ন আচরণ করতে পারে। বিপদটা টের পেলাম যখন পরদিন ওয়ার্কশপে গিয়ে চামড়াটা গা থেকে খুলতে চাইলাম। ওটা খুলছে না। আমার শরীরের সাথে সেঁটে আছে। আমি শত চেষ্টা করেও কিছুতে গা থেকে চামড়াটা ছাড়াতে পারলাম না। দুদিন এভাবে থাকার পর টের পেলাম চামড়ার ভেতরে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। কেলির চামড়াটা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। আমার শরীরটা কেলির চামড়ার ভেতরে বন্দী হয়ে গেল। চামড়াটা এত অবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যে এমনকি সেই চামড়া দিয়ে ঘামও ঝরছে, শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে।

কয়েকদিন ভয়াবহ টেনশানে কাটলো। তারপর আরো বিপদ দেখা দিল যখন আমার নিজের বাড়িওয়ালী এসে জানতে চাইলেন মারফি কোথায়। আমি তাকে বললাম, আমিও সে কথা তাকে জিজ্ঞেস করার জন্য যাচ্ছিলাম। মারফি হতচ্ছাড়াটা কোথায় গেল?

বাড়িওয়ালী খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ মারফি তো এরকম নিরুদ্দেশ থাকার বান্দা নয়। নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা হয়েছে। তিনি বললেন তাঁর উচিত পুলিশকে বিষয়টা জানানো। আমি তাঁকে নিরুৎসাহিত করলাম না। কারণ এভাবেই মারফির নিখোঁজ হয়ে যাবার ব্যাপারটা সবাই একদিন মেনে নেবে। সেই সাথে আমি স্থায়ীভাবে কেলি হয়ে যাবো। ব্যাপারটা ভয়ানক, কিন্তু এছাড়া উপায় কী?

আমার মদ্যপান বেড়ে গেল। এক রাতে ভরপেট মদ গিলে আমি ক্লাবে গেলাম স্নুকার খেলতে। এই ক্লাবটা কেলির সাথে আমার তিক্ততা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সদস্য হবার সময় আমি জানতাম না কেলিও এই ক্লাবের সদস্য। এটা নিয়ে তার বিরক্তি ছিল সীমাহীন। সে ভাবতো আমি তার উপর নজর রাখছি। কখন কোন মেয়ের সাথে সে কী করছে তার হিসেব রাখছি।

ক্লাবে ঢুকে আমি একটা মারাত্মক ভুল করে ফেললাম। সবাই জানে আমি ভালো স্নুকার খেলি এবং ওই ক্লাবের সেরা খেলোয়াড় আমি। আমি তখন টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে দেখতে আমার পালা আসার অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ মনে পড়লো যে কেলি কখনো স্নুকার খেলতো না। মনে পড়তেই কয়েক মুহুর্তের জন্য পাথর হয়ে গেলাম। অল্পের জন্য ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে কেলির ভ্রু দিয়ে আমার ঘাম বেরিয়ে এলো।

আমি বারে গেলাম। সেখানে এক ফিচেল মহিলার সাথে দেখা যিনি দুই পেগ গেলার পর অবিরাম বকবক করতে পারেন। তিনি আমাকে দেখে বললেন, মারফিকে দেখছে না বেশ কয়েকদিন। স্নুকার রুমটা তাকে খুব মিস করছে। কথা শুনে আমার কান গরম হয়ে উঠল। আমি বিব্রত হয়ে কোনমতে জবাব দিয়ে, বেশি কথা এড়িয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। বলা বাহুল্য, কেলির বাড়ির পথ।

কয়েকদিন পর আসল বিপদটা উদয় হলো। এক বিকেলে দুজন আগন্তুক এসে ওয়ার্কশপে ঢুকলেন। বললেন, তারা আমার সাথে একটু আলাপ করতে চায়। সিগারেট দিয়ে আপ্যায়ন করার পর তারা জানা গেল তারা সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ। কিছু রুটিন চেক আপ করতে এসেছে। বেশ কয়েকজন মারফি নামের লোকটার হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারে রিপোর্ট করেছে। সে কোথায় আছে? কোন খবর নেই? কখন তাকে শেষ দেখেছি? তাকে কী অস্বাভাবিক লাগছিল?

বললাম- আমিও তার অনুপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। তাকে অস্বাভাবিক লাগেনি কখনো। সে তো বরাবরই হৈ হুল্লোড়ে থাকা লোক। তবে আমি তাকে সম্প্রতি একটা কাজের ভুল নিয়ে একটু বকাঝকা করেছিলাম। সে তখন আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছিল চাকরী ছেড়ে ইংল্যাণ্ডে চলে যাবে।

তারা জানতে চাইলেন- আমি নিজে কী কয়েকদিন বাইরে ছিলাম? বললাম- হ্যাঁ, আমি কদিনের জন্য গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম একটা কাজে।

এরকম সাদামাটা প্রশ্ন, সাদামাটা উত্তর। এত সাদাসিদে প্রশ্ন সত্ত্বেও আমি ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন বোধ করলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত তারা আসল সত্যটা সম্পর্কে মোটেও সন্দেহ করছে না। তারা সত্যি সত্যি মারফিকে খুঁজে বের করতে চায়। তবু টের পেলাম আমি একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। বিপদটা ঠিক কোনদিক থেকে আসবে জানি না। বেশি বেশি হুইস্কি খেয়ে নিজেকে কোনমতে চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করলাম।

ঠিক তার পরেই বিপদটা আরো কাছাকাছি এসে গেল। কয়েকদিন পর সেই দুই গোয়েন্দা আরো দুজন পোশাকধারী পুলিশ নিয়ে আসলো ওয়ার্কশপে । সাথে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট। বললেন, এটা একটা রুটিন কাজ। যে কোন নিখোঁজ ব্যক্তির ক্ষেত্রে তারা এই নিয়ম পালন করেন। তারা ইতিমধ্যে মারফির আস্তানা সার্চ করে এসেছে, কোন সূত্রই মেলেনি। কিছুক্ষণ সার্চ করে তারা আমার কাজের জায়গা তছনছ করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে চলে গেলেন।

কয়েকদিন পর সাদা পোশাকের সেই ভদ্রলোক পুলিশ নিয়ে এসে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলেন মারফিকে হত্যা করার অপরাধে। তারা আমার অপরাধ প্রমাণ করার জন্য চুল্লির ভেতর পাওয়া পুড়ে যাওয়া মানব অস্থিকে ব্যবহার করলো।

বিচারে আমার ফাঁসি হয়ে গেল। এখন আমি যদি হাজার কসম করেও বলি যে মারফি এখানে বেঁচে আছে কেলির চামড়ার নীচে, সেটা কে বিশ্বাস করবে? আর বিশ্বাস করলেও তো প্রশ্ন আসবে, তাহলে কেলি গেল কোথায়?

গল্প শেষ।

তো বুঝতেই পারছেন কিরকম বেকায়দা অবস্থায় ফেঁসে গেছি। করুণা হচ্ছে আপনার? দয়া করে করুণা করবেন না, কারণ শেষবেলায় একটা বিষয় নিয়ে আমি খুশী। কারণ ফাঁসিটাতো আদতে কেলিরই হচ্ছে। ব্যাটা একটা ইতর, অসভ্য, জানোয়ার। সে যে মারফিকে খুন করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই সাজা তারই পাওনা ছিল।

---------------------------------------------------------------------------------
[আইরিশ গল্পকার Flann O'Brien এর Two in One অবলম্বনে লেখা অনুবাদ গল্পটি সচলায়তনের জন্মদিনে উৎসর্গ করা হলো ]


Comments

নুশান's picture

চমৎকার সাবলীল একটি অনুবাদের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অবাধে উত্সাহের সাথে পড়ে ফেললাম।

নুশান

নীড় সন্ধানী's picture

অনেক ধন্যবাদ নুশান। অনুবাদটি ধন্য হলো আপনার মন্তব্য পেয়ে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

হিমু's picture

অনেক বছর পর যেন সেবা প্রকাশনীর সেই রমরমা আমলের অনুবাদের (ছয় রোমাঞ্চ, সপ্ত আতঙ্ক, স্বর্গসৌরভ...) স্বাদ পেলাম।

ট্যাক্সিডার্মিকে বাংলায় অজিনকলা আর ট্যাক্সিডার্মিস্টকে অজিনকার বলা যায়।

নীড় সন্ধানী's picture

আহা সেবার সেই সুস্বাদু অনুবাদের কোন তুলনা হয় না। পঞ্চরোমাঞ্চ, আর ছয় রোমাঞ্চের গল্পগুলো এখনো সুখস্মৃতি জাগায়।

ট্যাক্সিডার্মি শব্দের বাংলা আছে জানতাম না। মারফি ব্যাটা ঠিকই বলছে, এই শব্দটা বোঝাতে গেলে আস্ত প্রবন্ধই ফাঁদতে হয়। অজিনকলা শব্দটা নোট করে রাখলাম।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নৈ ছৈ's picture

অসাধারণ ঝরঝরা অনুবাদ! চমৎকার লাগলো

নীড় সন্ধানী's picture

অনেক ধন্যবাদ নৈ ছৈ! উৎসাহিত হলাম আপনার মন্তব্যে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তাহসিন রেজা's picture

চমৎকার লাগলো গল্পটা। অনুবাদ বলে মনেই হয়নি!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

নীড় সন্ধানী's picture

জেনে খুব ভালো লাগলো তাহসিন। পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তিথীডোর's picture

অনুবাদ খুব ভাল লাগলো! চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নীড় সন্ধানী's picture

অনুবাদটা ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ তিথী!

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক's picture

ভাল লাগল।

(আসিফ)

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.