জীববিজ্ঞানীর আঁকাআঁকি আর লিউয়েনহুকের শুক্রাণু

সজীব ওসমান's picture
Submitted by Shajib Osman on Tue, 06/08/2019 - 8:43am
Categories:

বাঁহাতি হওয়াটা নাকি ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানদের জন্য একটা আশির্বাদ। আমি মনে করি, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আশির্বাদটা হলো আঁকাআঁকি জানা। একজন জীববিজ্ঞানী আঁকতে পারলে, বিশেষ করে আগেকার দিনে, সেটা তার অন্যতম অস্ত্র ছিলো। তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রথম দুইটি অস্ত্র বলা চলে। পর্যবেক্ষণকে লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য চিত্রকর্মের মতো শিল্পের দ্বারস্থ হলে এর কোন তুলনাই হয়না। যেমন, একটা নতুন দেখা প্রাণিকে যদি আপনি এনিয়ে অজ্ঞ সাধারণকে বোঝাতে চান তবে ছবি হলো সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এখন তো হাতে হাতে স্মার্টফোন, অতীতে কালি আর কলম ছাড়া কিছুই ছিলোনা। এই দুটি জিনিস ব্যবহারে পটু হওয়াটা সেজন্য জীববিজ্ঞানীদের তুমুল সাহায্য করেছে। জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে সবচেয়ে নামকরা আঁকিয়ে সম্ভবতঃ ছিলেন আর্নেস্ট হেকেল। তাঁর আঁকা দেখলে মনে হতে পারে যে তিনি জীববিজ্ঞানী না হয়ে যদি শুধু একজন চিত্রশিল্পী হতেন তাহলেও বেশ নাম করতে পারতেন। তাঁর এই আঁকাআঁকি পরবর্তিতে তুলনামূলক শারীরতত্ত্ববিদ্যা নামের বিজ্ঞান শাখার গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলো।

আর্নেস্ট হেকেলের অসাধারণ খুঁটিনাটি আঁকার উদাহরণ -

তবে আজকে আরেকটা জিনিস মনে হলো। আণুবীক্ষণিক জীববিজ্ঞানের যিনি গুরু, সেই এন্তনি ভ্যান লিউয়েনহুকও বেশ চমৎকার আঁকতেন। আমি ভাবছি তিনি যদি আঁকতে না পারতেন তবে দিগ্বিজয়ী বিজ্ঞানী হিসেবে নামই করতে পারতেন না। কারনটা বলছি।

ওলন্দাজ লিউয়েনহুকের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলোনা, ডিগ্রিতো ছিলোই না। ভালো ইংরেজি পারতেন না। ওলন্দাজদের শুদ্ধ ভাষাও পারতেন না, বলা চলে আঞ্চলিক ধরনের একটা ভাষা জানতেন আর সেই ভাষাতেই লেখালেখি করতেন। এভাবেই বিখ্যাত দ্য রয়্যাল সোসাইটিতে দুশোরও বেশি গবেষণাপত্র পাঠিয়েছেন। সেগুলোর অনেকগুলি প্রকাশও হয়েছে। তার তৈরি ছোট্ট একটা সরল অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে সাদা চোখে না দেখতে পাওয়া বিশাল ভুবনকে তুলে এনেছেন কথায় এবং ছবিতে। এভাবে আশপাশ আর প্রকৃতি থেকে যা পেতেন তুলে তার লেন্সের নিচে ২৭৫ গুণ বড় করে দেখে ছবিতে তুলে রাখতেন। সেগুলোই পাঠিয়ে দিতেন রয়্যাল সোসাইটিতে। বিস্ময়কর এই জগৎ সম্পর্কে আমরা প্রথমবারের মতো পরিচিত হই কিছু রেখাচিত্রের মাধ্যমে।

লিউয়েনহুক বর্ণনা করছেন একটা কীটের জীবনচক্রের শারীরিক পরিবর্তন এবং অঙ্গের গঠন -

আঁকতে না পারলে লিউয়েনহুককে লোকে চিনতো কিনা সেটা আমি ভাবছি। তবে এখানে রয়্যাল সোসাইটির কৃতিত্ব না বললেই নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকে বিজ্ঞান গবেষণা আর চিন্তাভাবনা তাদেরকে পাঠাতো। তারাও বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন আবিষ্কারের আবদার করতেন। যেমন, লিউয়েনহুক যখন পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন আনবিক্ষণিক জগতের রাজা হিসেবে তখন রয়্যাল সোসাইটিই তাকে বিভিন্ন ধরনের তরল, যেমন মানুষে যেসব পাওয়া যায় তাদের পরীক্ষা করে বর্ণনা পাঠাতে বলতেন, ছবিসহ। সেসম্পর্কে আরেকটা গল্প বলছি, তবে এমন 'মূর্খ' লিউয়েনহুকও রয়্যাল সোসাইটিতে যে লেখা পাঠাতে পারতেন এবং মূল্যায়িত হতেন সেজন্যই আমরা তাকে আজকে চিনি।

পৃথিবীর ইতিহাসে লিউয়েনহুকই প্রথম ব্যক্তি যিনি শুক্রাণু দেখতে পান। এই আবিষ্কার তিনি জানাতে গেলে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার কথা, মানে তখনকার দিনে। কিন্তু, যে শুক্রাণু তিনি দেখেছেন সেটা তার নিজের। কিভাবে এই শুক্রাণু পেয়েছেন সেটাও জানা যায়। তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন যে নিজে নিজে এই জিনিস বের করেন নি। বরং স্ত্রীর সাথে সঙ্গম শেষে তাড়াতাড়ি তার কাছ থেকেই সংগ্রহ করে অণুবীক্ষণের নিচে নিয়ে বসলেন। সূর্যের আলোতে ধরে প্রথম যা দেখলেন তাতে তার "৬টি হৃদস্পন্দন কিভাবে গেলো টের পেলেন না"।

লিউয়েনহুক প্রথমবারের মতো শুক্রাণু দেখছেন -

১৬৭৭ সালে রয়্যাল সোসাইটিকে লেখা “de Natis e semine genital Animalculis” চিঠিতে লিখছেন যে বীর্য ভর্তি ছিলো একধরনের ভোঁতা মাথার লেজসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র 'এনিম্যালকিউল' বা বাংলায় বলা চলে 'অণুজন্তু'। তারা ঘোরাঘুরি করছিলো, "এমনভাবে নড়ছিলো যেন তারা পানিতে সাঁতরে চলা কোন সাপ বা ইল মাছ।"

ঝামেলা হলো এই আবিষ্কার থেকে পরবর্তিতে একটা অদ্ভুত ধারণার জন্ম নেয়, একে বলে 'স্পার্মিজম' বা 'শুক্রবাদ'। স্বল্পজ্ঞান ভয়ঙ্করীর একটা উদাহরণ ধরতে পারেন একে। এন্তনি ভ্যান লিউয়েনহুক এবং তার শিষ্যরা, বিশেষ করে হার্টসোকার ভাবতে বসলেন যে এই শুক্রাণু মুন্ডুটাতে আসলে সম্পূর্ণ একটা মানুষ বসবাস করে। শুক্রাণু মায়ের গর্ভে গিয়ে সেখানে পুষ্টি পেয়ে বেড়ে ওঠে। মানে নারীপুরুষের মিলনে শুধু একটা 'প্রাণ' দানকারী বস্তু থাকে, শুক্রাণু। (ডিম্বাণুর কথা আমরা অনেক পরে জেনেছি।) ১৮০০ সালের আগেও (সাধারণ মানুষ বাদ দিলাম,) বহু বিজ্ঞানী ভাবতেন সন্তানের বৈশিষ্ট্য নির্ধারনে নারীর কোন ভূমিকাই নাই। পুরুষের বীর্যে ছবির মতো এইরকম ক্ষুদ্রাকায় মানুষ বসত করে। এই শুক্রাণুগুলোকে সেই অনুসারে নামকরণও করা হয়েছিলো - হোমুনকিউলাস বা অণুমানব।

অণুমানবের ছবি এঁকেছেন হার্টসোকার, ১৬৯৫ সালে -

এই ছোট মানুষ একটা মানুষ থেকে আরেকটা হয় নারীর দেহের ভেতর দিয়ে, নারী এখানে ইনকিউবেটর মাত্র। রুশ পুতুলে যেমন একটার ভেতরে আরেকটা ছোট পুতুল থাকে, তার ভেতরে আরেকটা থাকে, তেমনি ছোট ছোট শুক্রাণুর মধ্যে ছোট মানুষের ভেতরে শুক্রাণুর মধ্যে আরেকটা ছোট মানুষ, এরকম করে বাবা আদম পর্যন্ত পেছনে চলে যাওয়া যায়। সবাই যে আদমসন্তান সেটাতো এখান থেকেই বুঝতে পারছেন!

ধারণা করতে পারেন, এমন আবিষ্কার নারীকে কোথায় ঠেলে দিতে পারে? অর্থাৎ, মনে হতে পারে যে মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্য নারীর অবদান সামান্যই। পুরুষই প্রাণের ধারক, নারী শুধু প্রাণকে বহন করে কিছুদিন। সে সন্তান উৎপাদনের কারখানা। পরবর্তীতে যখন ভ্রুণবিদ্যার জ্ঞানচর্চা আর গবেষণা শুরু হয় তখন ধীরে ধীরে আমাদের ধারণার পরিবর্তন হতে থাকে। এই অদ্ভুত ধারণাটা আর টিকে থাকতে পারেনাই।

যাই হোক, এমন ভুলের পরও লিউয়েনহুককে তো আর বাদ দেয়া যায়না। ৪০ বছর বয়সের পরে তিনি গবেষণা শুরু করেন যা চলে প্রায় ৫০ বছরব্যাপী। এই বিস্তীর্ণ সময়ে বহু আণুবীক্ষনিক জগৎকে তুলে এনেছেন রেখায়। এতো বছর ধরে চলা নিবিড় পর্যবেক্ষণের চর্চা আমাদের জন্য বেশ অণুকরণীয় বলা যায়।


Comments

অবনীল's picture

দারুন লাগলো লিউয়েনহুকের জীবন ও কাজ নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত বিবরণী। অন্যান্য বিশ্ববরেণ্য জীববিজ্ঞানীদের নিয়ে এরকম লিখা লিখবেন আশা করি।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সজীব ওসমান's picture

থ্যাংকু। এই আঁকাআঁকি নিয়ে আরও লেখার ইচ্ছা আছে। দেখা যাক।

হিমু's picture

হেকেলের আঁকা দেখলে বোঝা যায়, তিনি নামের সম্মান রেখেছেন। জার্মানে এর্ন‌্স্ট অর্থ অলঘু।

সজীব ওসমান's picture

এতো সময় নিয়ে নিখুঁতভাবে উপাত্তের বর্ণনা ছবিতে তৈরি বেশ ধৈর্য্যের ব্যাপারও।

তবে এই হেকেল ব্যাটারও আরেকটা অদ্ভুত ধারণা ছিলো। সে মনে করতো মায়ের গর্ভে বা ডিমে প্রাণীর পুরো বিবর্তনের ইতিহাসটা একবার পুনারবৃত্তি ঘটে! বুঝতেই পারছেন, কত বড় ভুল। হাসি

হিমু's picture

এই ভুলের সমস্যাটা মনে হয় হেকেলের না। মানে, তিনি তাঁর সময়ের প্রযুক্তি আর দর্শন দিয়ে পর্যবেক্ষণ থেকে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। সমস্যাটা তাঁর ছাত্রদের, যারা হাতে নতুন প্রযুক্তি আর নতুন দর্শন থাকার পরও এই সিদ্ধান্ত থেকে সরেননি। এখনও অনেক লোক আছে যারা ফ্রয়েডের বই হাতে আলগে (এরা পড়েও না) একটা ছদ্ম-মনোবিদ ভাব মারাতে থাকে। চিকিৎসা শাস্ত্রে রসচতুষ্টয়-ভিত্তিক ধারণার মতোই মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েডের দর্শন যে এখন তামাদি হয়ে গেছে, এরা খোঁজও রাখে না। বিজ্ঞানীদের "পেশাগত" ঝুঁকিই সম্ভবত এটা: একদিন আংশিক বা পুরো বাতিল হয়ে যাওয়া।

তারেক অণু's picture

লেখা ভালো লাগলো, আর হেকেলের আঁকা দেখে তব্দা খেয়ে গেলাম!

সজীব ওসমান's picture

পুরাই অন্য লেভেলের আঁকা। কিছু রঙিন ছবিও পাওয়া যায়, তবে আমি নিশ্চিত না সেগুলা পরবর্তীতে রঙ করা কিনা। খুঁজে দেখবো!

তারেক অণু's picture

দেখেন দেখেন

সোহেল ইমাম's picture

মজার বিষয়, পড়ে ভালো লাগলো। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

লিউয়েনহুক নিজের বীর্যের মধ্যে অকল্পনীয়ভাবে ভয়ঙ্কর দর্শন কিছু প্রানীকে কিলবিল করতে দেখে পাগল হয়ে যান নি কেন বুঝতে পারছি না। আমি ভাবছি সে যুগের কোন মোল্লা হুজুর এই দৃশ্য দেখলে কী ঘটতো। এক ফোঁটা নাপাক তরলের মধ্যে কিলবিল করতে থাকা পোকামাকড় দেখে তাদের কী মনোভাব হত তা জানতে ইচ্ছা করছে।

অবনীল's picture

মোল্লারা মনে হয় দাতের পোকার মত বীর্যের পোকা হিসেবে বের করি টাইপের ব্যবসা ফেদে ফেলতো।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

কর্ণজয়'s picture

খুব ভালো লাগলো। স্পার্মিজম, অণুমানব নিয়ে আগে জানা ছিল না-

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.