নৈরঞ্জনা(১)

তুলিরেখা's picture
Submitted by tuli1 on Thu, 10/05/2018 - 5:52am
Categories:

১। ম্যাপের উপরে একটা আঁকাবাঁকা রেখার উপরে তর্জনী রেখে কাশ্মীরা বললো, "এই যে আবীর, এইখানে একটা নদী থাকার কথা। উপগ্রহ-চিত্রেও নদী দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই নদীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুশকিল হলো জায়গাটা খুব দুর্গম। রুক্ষ পাহাড় আর মরুভূমির ভিতর দিয়ে শয়ে শয়ে মাইল রাস্তা পার হয়ে যেসব অভিযানকারী গিয়েছে, কেউই নদীটাকে খুঁজে পায় নি। ফিরে এসে তাই বলেছে। মোট পাঁচটা অভিযাত্রীদল গিয়েছিল, তার মধ্যে দু'টো দল হারিয়ে গিয়েছে, দলের কেউ ফিরে আসে নি। "

অবাক হয়ে শুনছিলাম। এইখানে এসে থাকতে না পেরে বললাম ,"ফিরে আসে নি মানে? দলের সবাই কি কোনো দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে?"

কাশ্মীরা মাথা নাড়ে, বলে, "না, তা নয়। তাহলে তো অন্তত মৃতদেহগুলো পাওয়া যেত। কিংবা ওদের জিনিসপত্র, তাঁবু টাবু ইত্যাদি। কিন্তু কিচ্ছু পাওয়া যায় নি । ওরা স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে নিজেদের সমস্ত কিছু সমেত। শেষ যেখান পর্যন্ত ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, সেই ল্যাটিচুড লঙ্গিচুডে উদ্ধারকারী দল গিয়ে কোনো চিহ্ন পায় নি, না তাঁবু, না জিনিসপত্র, না অন্য
কোনো কিছু। ঐ জায়গার আগের গ্রামগুলোতে জিজ্ঞাসা করেছে, গ্রামের লোকেরা ঐ দলের কথা বলতে পেরেছে। তার মানে ওরা ঐ পয়েন্ট পর্যন্ত গিয়েছিল ঠিকই, তারপরে স্রেফ হাওয়া।"

আমি ভুরু কুঁচকে বসে থাকি ম্যাপের দিকে চেয়ে। তারপরে আস্তে আস্তে বলি, "এ যেন ডাঙার উপরে বার্মুডা ট্রাঙ্গেলের মতন ব্যাপার। লোকজন স্রেফ উবে যায়। "

কাশ্মীরা বলে, "একদম তাই যেন। অবিশ্বাস্য। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই অসাধারণ উন্নতির দিনে এরকম একটা ব্যাপার যেন ভাবা যায় না। "

আরো কয়েকটা ইমেজ বার করে পেন্সিল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে কাশ্মীরা বলে চলে, "এই যে এটা দশ বছর আগের ইমেজ, এটা আট বছর আগের, এটা পাঁচ বছর আগের আর এটা একদম সাম্প্রতিক। সব ক'টাতেই নদী স্পষ্ট, কোনো ভুল নেই তাতে। এই নদীর শুরু এই পাহাড়ে, সেখান থেকে এই পথ ধরে নদী এগিয়েছে। এই নদী সমুদ্রে পড়েনি, শেষ হয়েছে একটা লেকে। সেই লেকও স্পষ্ট। অথচ লোকেরা গিয়ে নদী খুঁজে পায় নি, ফিরে এসে বর্ণনা দিয়েছে শুকনো বালি-বালি ভূমির, মরু অঞ্চলের গাছপালার। কোনো নদীর চিহ্ন নেই। পাহাড় আর হ্রদ কিন্তু ঠিকঠাক আছে, শুধু মাঝের নদীটা উধাও। নদীটা গেল কোথায়? শুধু সেটাই একমাত্র রহস্য নয়, কয়েকটা অভিযানকারী দল একেবারে উবে গেছে, দলের কেউ ফিরে আসেনি। পরেও কোনো খবর
পাওয়া যায় নি তাদের। এখন বিরাট প্রশ্ন হল, কী হল ওদের?”

কিছুক্ষণ চুপ করে ইমেজগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম, মনে মনে জায়গাটা কল্পনা করার চেষ্টা করছিলাম। দিগন্তবিস্তৃত নির্জন মরুভূমি আর রুক্ষ রুক্ষ পাহাড়। একদল মানুষ পাহাড়ের পাশ দিয়ে চলেছে।

জোর করে মন থেকে ঐ ভাবনা সরিয়ে দিয়ে মুখ তুলে কাশ্মীরার দিকে চেয়ে বললাম, " মীরা, তুমি কি নিজেই অভিযানে যেতে চাও? "

কাশ্মীরা কী নিয়ে যেন চিন্তা করছিল, আমার প্রশ্নে চমকে বাস্তবে ফিরে এলো। অল্প হেসে বললো, "আমি চাই তো যেতে, কিন্তু ব্যবস্থা করা সোজা না। শুধু আর্থিক দিকটা ভাবলেই তো দমে যেতে হয়। ইনস্টিটিউট থেকে হয়তো কিছু সাহায্য পাওয়া সম্ভব কিন্তু তার জন্য হাজার রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, তারপরে বসবে হ্যান কমিটি ত্যান কমিটি, হাজারো হ্যাপা। ব্যবস্থা করা খুব কঠিন আবীর। এইসব ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব, যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে স্পনসর করতে পারেন। সেরকম কারুকে মনে মনে খুঁজছিলাম।"

ভুরু কুঁচকে মেঝের দিকে চেয়ে থাকি, মনে মনে খুঁজছি আমিও। তারপরে হঠাৎ মনের মধ্যে আলো জ্বলে ওঠে যেন। উদ্ভাসিত মুখে কাশ্মীরার দিকে চেয়ে বলি, "মীরা, ডক্টর অরুণাংশু আদিত্য? "

কাশ্মীরার মুখও সঙ্গে সঙ্গে আলো আলো হয়ে ওঠে, সে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ায়। তারপরে বলে, "আবীর, তুমি জানো ডক্টর আদিত্য এখন কোথায়?"

আস্তে আস্তে বলি, "জানি। স্বেচ্ছাবসর নিয়ে উনি যখন আমাদের ইনস্টিটিউট থেকে চলে গেলেন, তখন আমি ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম চিঠিপত্রে। দেখাও করতে গিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে।"

কাশ্মীরা চুপ করে চেয়ে থাকে, ওর চোখে বেদনা ছায়া ফেলেছে ঘনিয়ে আসা মেঘের মতন। আট বছর আগে ডক্টর আদিত্য যখন বিদায় নেন, তখনকার সময়ের কথা হয়তো মনে পড়ছে ওর। একদিকে বিশালসংখ্যক বিরোধীগোষ্ঠীর লোক, আর আরেকদিকে ডক্টর আদিত্য প্রায় একা, শুধুমাত্র কয়েকজন গুণগ্রাহী তাঁর পক্ষে। ঐ অবস্থায়, আমরা আর আমাদের বন্ধুরা, সবাই তখনও ছাত্রাবস্থায়, আমাদেরই বা কী করার ছিল? জানি কাশ্মীরা খুব আঘাত পেয়েছিল, অনেকদিন লেগেছিল ওর ঐ শক কাটিয়ে উঠতে।

আমি অবশ্য ডক্টর আদিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলাম। কাশ্মীরা বা অন্য বন্ধুদের কারুকে জানাই নি। আমার নিজের দায়িত্বে যা করেছি তার মধ্যে ওদের জড়াতে চাই নি। এখন মনে হলো কাশ্মীরাকে হয়তো বলা যেত।

(চলন্ত)


Comments

অতিথি লেখক's picture

অনেকদিন পর সচলে একটা উপন্যাস শুরু হয়েছে দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু পড়তে অতোটা ভালো লাগছে না। এক একজন পাঠক এক এক রকম। সমস্যা হয়তো আমারই। প্রথম প্যারাগ্রাফটা পড়তে পড়তেই অনুভব করলাম বাক্যগুলো কেমন যেন সম্পর্কহীন। আমার আসলে অভ্যাস গল্প শোনা, পড়তে পড়তেই। আমি চোখ বুলিয়ে যাই, আর আমার মাথার ভেতর শব্দ করে পড়েন তিনি, যিনি লিখেছেন।

---মোখলেস হোসেন

তুলিরেখা's picture

পোস্ট পড়ার জন্য আর মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। মন খুলে সত্যিকার সমালোচনা করেছেন বলে আরো বেশি ধন্যবাদ। এই লেখাটার গঠনশৈলী নিয়ে আমার মনেও অনেক প্রশ্ন আছে, এমনকি এর আখ্যানভাগ নিয়েও প্রশ্ন আছে, সেইজন্যেই সচলে দিচ্ছি আস্তে আস্তে, দেখা যাক পাঠ প্রতিক্রিয়া কীরকম আসে। সেই থেকে কিছু হদিশ যদি পাই লেখাটাকে পাঠকপ্রিয় করার, তাহলে সেইমতন পরিবর্তন করব।
আবারও ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি's picture

অতটা পাড় না হলেও মোটামুটি ফেসবুকে যাওয়া আসা করছি প্রায় বছর তিন হবে। সচলে একরকম আসাই হয়না এখন আর। ফেসবুক একটা ভুলভুইয়ার নাম। নেশাটা কাটাতে চাই আস্তে ধীরে। কথা অবশ্য সেটা না। কথা হচ্ছে, এই যে মোখলেস ভাই তুলি'দির লেখা নিয়ে সপাটে বললেন আর তুলি'দি সেটা সোনামুখ করে শুনলেন, এমনটা ফেসবুকে সম্ভব! প্রশ্নই আসে না। আপনাদের দু'জনকেই সেলাম বাপ! এ কারণেই সচল, সচলই। তেল ঘি দিচ্ছি না। দিয়েই বা ফায়দা কী? পটাং করে সচল হয়া যাবো? মরলেও না, সচল মডুরা রাম পাষাণ। যাইহোক, কথা হইল এই পর্ব নিয়ে মোখলেস ভাই আর সোহেল ভাই কিছু সমস্যার কথা বলেছেন। আমি সেরকম কিছু দেখলাম কেন জানি ইয়ে, মানে...

তুলিরেখা's picture

হুঁ, সেইজন্যেই তো ব্লগে দিচ্ছি। এই লেখাটা নিয়ে আমার নিজেরও অনেক প্রশ্ন। তোমার কোথায় কোথায় খটকা লাগছে বা কাহিনির মসৃণ ধারা আটকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে সেইগুলো বিস্তারিত বোলো।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সোহেল ইমাম's picture

লেখার শুরুর (১।)টা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা, এটা কেন? এটাকি প্রথম অধ্যায় বা পরিচ্ছেদ বোঝাতে? লেখাটা মনে হচ্ছে আকর্ষণীয় একটা কাহিনি হয়ে উঠবে। প্রথম কিস্তিতে আরো একটু বেশি দিলে মনে হয় ভালো হতো, প্রায়ই দেখা যায় পরের কিস্তি আর আসেনা। সচলায়তনে অসমাপ্ত রচনা গুলোকে একত্র করলে একটা পাহাড় হয়ে যাবে। আসা করবো আপনি লিখতেই থাকবেন। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা's picture

হ্যাঁ, ১ দিয়ে প্রথম পরিচ্ছেদ বোঝানো। হ্যাঁ, আর একটু বেশি দেওয়া যেত। কিন্তু কেন যেন দ্বিধা হল। মনে হল কাহিনিটা স্লিম করা দরকার। তাই মূল লেখা থেকে কেটেছেঁটে এমন অংশ তুলে দিচ্ছি যেখানে দীর্ঘসূত্রিতা বা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার কম। দরকার পড়লে হয়তো কোথাও কোথাও কিছু সংযোজনও করতে হবে।
আগেই বলেছি, এই লেখা নিয়ে আমার অনেক সংশয় আছে, তাই পাঠ প্রতিক্রিয়াগুলোকে খুবই মূল্য দিচ্ছি। পড়ার জন্য আর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.