বাংলার তরু লতা গুল্ম-৪৫ : কালোকেশি

আব্দুল গাফফার রনি's picture
Submitted by ronygaffar [Guest] on Thu, 09/07/2015 - 2:41pm
Categories:

DSC00444
ঘাসফুল নিয়ে মানুষের মাতামাতি কম। তবে কিছু কিছু ফুল সত্যিই দেখার মতো। আর কিছু ফুল মানুষের দৃষ্টিই কাড়তে পারে না। তবে কিছু ঘাসফুল আবার একেবারেই আলাদা। চেহারা দিয়ে নয়, গুণ দিয়ে মানুষের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়। কেশড়ের ফুলের আলাদা সৌন্দর্য নেই। আবার একেবারে অবহেলিত সে নয়। সব মানুষ তাকে চেনে তার গুণের জন্য। অবশ্য সেই গুণ এখন আর তেমন কাজে লাগায় না। ছোটবেলায় রোদে ঘোরাঘুরি করতাম খুব। চুল লাল হয়ে যেত রোদে পুড়ে। সবাই বলে, চুলকটা হয়ে গেছে। শুধু আমার নয়, বন্ধুদেরও একই অবস্থা।আমার ছেলেবেলায় বন্ধু তালিকাটা বেশ বড়। তাতে শুধুই বন্ধু যেমন আছে, আপনজনও কম ছিল না। আমার নানা বাড়িতে একটা বন্ধু ছিল। খাতিরের চেয়ে মারামারিই বেশি হত ওর সাথে। আবার মিলও কম ছিল না। ও আমার ছোটখালা। বয়সে আমার এক বছরের বড়। কিন্তু গায়ে গতরে আমিই বড়সড় ছিলাম। মারামারিতে আমার সাথে পেরে উঠত না। তাই সন্ধি প্রস্তাব আসত ওর কাছ থেকে। আম কুড়ানো, মাঠে আখ খেতে যাওয়া, কাঁচা ছোলার ফল আনা, শাক তোলা--সবকিছুতে আমার সঙ্গি ওই ছোটখালা। যতদিন নানা বাড়িতে থাকতাম ততদিন। একদিন বলল, ‘তোর চুল তো সব কাটা হয়ে গেছে রে!’
জবাবে আমি ও বললাম, ‘তোরও তো একই অবস্থা! কলপ করবি নাকি?’
‘না,’ জবাবে বলল আমার ছোটখালা। ‘চল মাঠে যাই। কেশড়ে গাছ তুলে আনি। রস করে মাথায় দিলে চুল কালো হয়ে যাবে।’
কেশড়ে তুললাম, রস করে মাথায় দিলাম। কিন্তু চুল কালো হয়নি। তবে শুনেছি কেশড়ের রস মাথায় দিলে চুলের গোড়া মজবুত হয়। কথাটা সত্যি কি মিথ্যে জানি না। কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানি কালোকেশি তেল নামে বাজারে বিকিকিনি করছে। সত্যি-মিথ্যে জানি না। যাচাই করেও দেখিনি। আমি গাছপালা নিয়ে লিখি গাছপালাকে ভালোবেসে। ওর ওষধি গুণ নিয়ে ভাবিনে।
DSC00443
ওষধি গুণ মানেই সেটা কাজে লাগাতে হলে গাছের অঙ্গহানী করতে হয়। ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। ওষধি গুণ বুনো উদ্ভিদ বিলুপ্তির অন্যতম কারণ বলে মনে করি। কারণ আমাদের সব মানুষই কমবেশি চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার চেষ্টা করি। এই চেষ্টার কোপটা পড়ে ওষুধি গুণের উদ্ভিদের ওপর। চিকিৎসার জন্য উদ্ভিদের পাতা, কাণ্ড, ফুল, মূল পর্যন্ত সাবাড় করি। অনেকে বলেন, ওষধি উদ্ভিদের বাগান করে এদেরকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো যায়।
কিন্তু তাতে বুনো উদ্ভিদের বন্যতা কোথায় যাবে! কথায় আছে ‘বন্যরা বনে সুন্দর’-- বুনো উদ্ভিদ বাগানে লাগিয়ে বন্য-সৌন্দর্য নষ্ট করার মানেই হয় না।

DSC00037
কেশড়ে মেঠো উদ্ভিদ। পতিত বাঁছড়া জমিতে যেমন দেখা যায়। ফসল ক্ষেতও কেশড়ের ভীষণ পছন্দ। আর পছন্দ ক্ষেতের আল। আলের দুর্বাঘাসের জটলার ভেতর কেশড়ে গাছের দেখা মিলবেই।
কেশড়ে গাছকে অনেকে ঘাস মনে করে। কিন্তু কেশড়ে তৃণ শ্রেণির গাছের মধ্যে পড়ে না। কেশড়ে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশের সব এলাকায় সব মাঠে কেশড়ে গাছ দেখা যায়। কেশড়ে গাছের গড় উচ্চতা ১ ফুট। কিছু কিছু গাছ তিন ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়। সাধারণত কেশড়ে গাছের কিছুটা হেলেপড়া ভাব আছে। তবে যেগুলো খুব বড় হয় সেগুলোর অবশ্য হেলেপড়া ভাব থাকে না। কেশড়ের কাণ্ড ও ডাল রসালো। কাণ্ড নরম, গোল। কাণ্ডের বেড় আধা সেন্টিমিটার। মসৃণ নয় খসখসে। কাণ্ডের গায়ে শাদা শুঁঙ্গ আছে। কাণ্ডে খুব বেশি ডালপালা বের হয় না। তিন চারটা ডাল বেরোয় মাত্র।

DSC00041
কেশড়ের পাতা লম্বাটে। খসখসে। পাতার দৈর্ঘ্য ২-২.৫ ইঞ্চি। প্রস্থ আধা ইঞ্চি। পাতার রং সবুজ, রসালো। পাতার কিনারগুলো আঁকাবাঁকা।

DSC00599
আগার দিকে প্রতিটা পাতার গোড়ায় একটা করে মঞ্জুরি বের হয়। তবে ডালের আগায় দু-তিনটি মঞ্জুরি বের হয়। গাছ ও ফুলের তুলনায় মঞ্জরি বেশ বড়ই। মঞ্জুরি দেড় ইঞ্চি লম্বা হয়।

DSC01281
মঞ্জুরি সরল। একপুষ্পক। কিন্তু ফুল একক নয়। আসলে কেশড়ে দেখতে অনেকটা সূর্যমুখি ফুলের মতো। এধরনের ফুল একক নয়। অনেক ফুলের সমন্বয়ে গুচ্ছ ফুল। ফুল গোলাকার। সূর্যমুখির মতো ফুলের কিনার গোলকরে ছোট ছোট সাদা পাপড়ি দিয়ে সাজানো।

DSC00176
পাপড়ি শুকিয়ে ঝরে গেলে ফুলটাই ফলে পরিণত হয়। ফুলের মাঝখানেই ছোট ছোট ত্রিকোণাকার বীজ দিয়ে সাজানো থাকে। কাঁচা ফল ও বীজ সবুজ রংয়ের।

DSC01279
পাকলে বীজের রং হয় কালো। অনেকটা কালোজিরার মতো দেখতে। বীজ দ্বিবীজপত্রি। কেশড়ে বারোমাসি উদ্ভিদ। তাই সারা বছর এদের দেখা যায়।

DSC00592
স্থানীয় নাম : কালোকেশি, কেশড়ে, কালোকশি, কেশরাজ, কেশঠি, কোশুতি, খেতুয়া, মইরচর, ভৃঙ্গরাজ, কালাহুনা।
ইংরেজি নাম : False daisy.
বৈজ্ঞানিক নাম : Eclipta Prostrata.
বাংলার তরু লতা গুল্ম ৪৪ : পটপটি


Comments

স্পর্শ's picture

মনে পড়ল, খেলার সময় ফুলকপি বানাতাম এর ফল দিয়ে।

এই পর্বটা বেশ গোছানো লাগলো! আপনার বানান প্রমাদও অনেকটা বাগে এসে গেছে মনে হচ্ছে। হাসি

অনেক দিন ধরে এই সিরিজটা চালাচ্ছেন। কাজটা নিঃসন্দেহে প্রসংশার যোগ্য। এমন লেগে থাকার ধৈর্য্য আমাদের মাঝে বিরল। চলুক


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আব্দুল গাফফার রনি's picture

ধন্যবাদ, সিরিজটা ১ হাজার পর‌্যন্ত টানার ইচ্ছে আছে। জানি অনেকদিন লাগবে। তবুও চলবে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মন মাঝি's picture

কালোকেশি "ভৃঙ্গ্‌রাজ" (হিন্দী?) নামে ভারতে চুল পড়া বন্ধের জন্য ব্যবহৃত অত্যন্ত জনপ্রিয় ভেষজ। চুল পড়া বন্ধ, নতুন চুল গজানো, চুলের গোড়া শক্ত, চুল কালো, ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথিত গুনাগুনের জন্য এটার তেল বা অন্য তেলের উপাদান হিসাবে এর নির্যাস ব্যবহৃত হয় প্রচুর। একসময় ঢাকার বিখ্যাত আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্তুতকারক শক্তি কিম্বা সাধণা ঔষধালয়ের (কোনটা মনে নেই) "মহাভৃঙ্গরাজ" চুলের তেল অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এখন পাওয়া যায় 'নবরত্ন' (ভারতীয়) আর 'প্যারাস্যুট' (বাংলাদেশি) তেলের অন্যতম উপাদান হিসেবে।

উইকিপিডিয়া কালোকেশি ওরফে ভৃঙ্গ্‌রাজ সম্পর্কে বলছে --

Quote:
It is reported to improve hair growth and color. A study in rats showed that petroleum ether extracts of E. prostrata decreased the amount of time it took for hair to begin regrowing and to fully regrow in shaved albino rats. The result of treatment with E. prostrata was better than the positive control, 2% minoxidil*.
[* মিনোক্সিডিল এ্যলোপ্যাথিতে টাকের চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ঔষধ। বাংলাদেশে সব বড় বড় ঔষধ কোম্পানি অনেক দামে এটা বাজারজাত করে।]

****************************************

আব্দুল গাফফার রনি's picture

হুম, তেলের বিজ্ঞাপনে প্রায়ই দেখি

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক's picture

কালোকেশি খুব চেনা, তথ্যগুলো ঠিক এভাবে জানা ছিল না। আমার যেবার ডান পায়ের পুরো পাতা পুড়ে গেল, মা অনেকদিন ধরে কালোকেশির পাতা বেটে লাগিয়ে দিয়েছিল। আমাদের এলাকায় কারুর হাত, পা, গা পুড়লে সাদা হয়ে যাওয়া ত্বকের রঙ ঠিক করতে কালোকেশির ব্যবহার ছিল নিশ্চিত। তুলনায় চুল কালো করার জন্য এর ব্যবহারের কথা বেশ পরে জেনেছিলাম।

দেবদ্যুতি

আব্দুল গাফফার রনি's picture

পোড়া চিকিৎসার কথা জানা ছিল না

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সো's picture

"অনেকে বলেন, ওষধি উদ্ভিদের বাগান করে এদেরকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো যায়।
কিন্তু তাতে বুনো উদ্ভিদের বন্যতা কোথায় যাবে! কথায় আছে ‘বন্যরা বনে সুন্দর’-- বুনো উদ্ভিদ বাগানে লাগিয়ে বন্য-সৌন্দর্য নষ্ট করার মানেই হয় না।"
বাগান করা আর বনে থাকতে দেয়া কি mutually exclusive?
দুটোই তো পাশাপাশি করা যায়।

আব্দুল গাফফার রনি's picture

পাশাপাশি হতে পারে, কিন্তু বিকল্প হতে পারে না।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক's picture

কালোকেশী চিনতাম না। মাথার চুল কালো করা আর নতুন চুল গজানোর জন্য বহু গাছ গাছড়ার জীবন নাশ করেছি কালোকেশী মনে করে। আজ একে চিনলাম।
Jaraahzabin

আব্দুল গাফফার রনি's picture

চিনতে পারার জন্য ধন্যবাদ

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

ছায়াপথের পথচারী's picture

ভালো লাগলো - চোখের সামনে থেকেও চোখ এড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্য! ঠাকুর মশাইয়ের শিশিরবিন্দু নিয়ে কবিতার কথা মনে পড়ে যায়!

আমার কয়েক বছরের বড় এক খালার (আসলে ভাগ্নি, বড় বলে ডাকতাম খালা) সাথে গ্রামের পথে ঘোরাঘুরির কথা মনে পড়ে গেলো! আমি অবশ্য ভদ্র ছিলাম, মারামারি করতামনা, উলটো আরো কবিতা লিখে দিতাম। হাসি

আব্দুল গাফফার রনি's picture

আমিও খুব শান্ত ছিলাম, আমার খালঅটাই বরং বেশি চঞ্চল ছিল, তাই মারামারিটা লাগত।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আব্দুল গাফফার রনি's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক's picture

আমি এটাকে চিনি "কালাহুনো" নামে।স্থানীয় নাম। মা বেটে বেটে চুলে লাগাতো যেন কালো হয়।বিশেষ করে যখ্ন গরম কালে মাথা ন্যাড়া করতো তখ্ন এর কদর বেশি। থাকত।
এ্যনি মাসুদ

আব্দুল গাফফার রনি's picture

যাক, নতুন একটা নাম জানলাম আপনার কাছ থেকে, স্থানীয় নামের জায়গায় যোগ করে দিলাম। ধন্যবাদ।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক's picture

নাম যোগ করেছেন দেখে ভাল লাগছে ..….…ধন্যবাদ। আমরা অতি অতিমাত্রায় সুন্দর হতে গিয়ে প্রথমে জাল_ভেজাল,রং_তাল করে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সুন্দরের বারোটা বাজিয়ে।পরে হন্যে হয়ে প্রকৃতির দারস্ত হই..……আর এখন তো প্রকৃতির বারোটা বাজাতে ব্যস্ত

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.