বয়স তখন পাঁচ

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Thu, 07/05/2015 - 9:31pm
Categories:

বাবা-মার ভীষণ আদরে বড় হয়েছি আমরা দুই বোন। আমি বড়। বৃহত্তর পরিবারের সব বোনদের মধ্যেও আমি বড়। ছোটবেলায় অসম্ভব চুপচাপ ছিলাম। আমার তিন বছরের ছোট বোন ছিল ঠিক তার উল্টো। মার কাছে আমাকে প্রায় ঘেঁষতেই দিত না। ভীষণ জেদ ছিল ওর। খাওয়া, পড়া কোনো কিছু নিয়েই সে কথা শুনতে চাইতো না। ওর আবদার নিয়ে আমার কর্মজীবি মাকে হয়রান হতে দেখে আমার খারাপ লাগত। তাই ৪-৫ বছর বয়স থেকেই সবসময় চেষ্টা করতাম, যেন আমার কারণে মা-বাবাকে কষ্ট পেতে না হয়। বাড়িতে আত্মীয় স্বজন এসে সবসময় বলত, “কেয়া (মার ছদ্মনাম), তোমার ছোটমেয়ে তোমার বড় মেয়েকে সাতবার কিনে সাতবার বেঁচতে পারবে”। মার কাছে গল্প শুনেছি, আমাকে কোথাও বসিয়ে রেখে গেলে আমি নাকি কেউ এসে না বলা পর্যন্ত উঠতাম না সেখান থেকে। একবার নানাভাইয়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে গোরস্তানে নাকি একটা নতুন খোঁড়া কবরে পড়ে গেছিলাম ছোট্ট আমি। অনেক খোঁজাখুজির পর যখন সবাই আমাকে খুঁজে পেল, তখন দেখে আমি চুপ করে বসে আছি সেই কবরের মধ্যে। একটুও কাঁদছি না। জানি না, এটা কিভাবে কখন শেখা আমার, কিন্তু আমি ভাবতাম চিৎকার করা, শব্দ করে কাঁদা অভদ্রতা। হয়তো আমার ছোট বোনের কান্না চিৎকার দেখেই আপনা আপনি এসব শেখা। চুপ থাকায় সবাই আমার প্রশংসা করত, সেটাও একটা পরোক্ষ কারণ হতে পারে। মা বলে, আমি বকা খেলে বা ব্যথা পেলে নাকি আমার চোখ দিয়ে শুধু পানি পরতো। শব্দ করতাম না।

যেই ঘটনা বলার জন্য এত কথা বলা তাতে আসি এবার। আমার বয়স তখন পাঁচ। ছোট বোনের বয়স দুই। আমরা একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। বাবা-মা রাতদিন এক করে খাটা খাটনি করতেন, আমাদের জন্য একটু আনন্দ কিনে আনবে বলে। মা পেশায় চিকিৎসক। তাই অসুখ বিসুখ নিয়ে খুব চিন্তিত হতে কখনো দেখিনি তাকে। একটু আধটু জ্বর হলেও বলতেন ওষুধ খাওয়ার দরকার নেই। বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে হ্যাঁ, কখনো খেলতে গিয়ে হাত পা কেটে গেলে নিস্তার ছিল না। সাথে সাথে টিটেনাস ইঞ্জেকশন পরত হাতে। আমার দাদী থাকতেন সবসময় আমাদের সাথে। বিকেলবেলা বাড়ির সামনে পাড়ার গলিতে আমরা বাচ্চারা খেলতাম, সবার বয়স ৩ থেকে ১০ এর মধ্যে। খেলাধূলার মধ্যেও কখনো আমরা বাবা-মা বা দাদীর চোখের আড়াল হতাম বলে মনে পড়ে না। বিকেলে সব বাড়ির বারান্দায় চাচীরা/খালারা দাঁড়িয়ে গল্প করতেন আর নজর রাখতেন। আমাদের পরিষ্কার বলা ছিল, কোনো অচেনা লোক দেখলেই যেন সরে আসি ওখান থেকে। সেই প্রথম গল্প শুনলাম ছেলেধরার। আমার কেন যেন ছেলেধরাকে ভাল মনে হত। গল্প শুনে শুধু মনে হত, একদিন যদি একটা ছেলেধরার দেখা পাই! আমাদের বাচ্চাদের সূত্রেই কিনা জানিনা, সব বাসার মানুষজন সবাইকেই চিনতো। শবেবরাত এ হালুয়া নিয়ে যেতাম আমরা বাড়ি বাড়ি। আমাদের বিল্ডিঙ্গের চারটা বাড়ির সব বাড়িতেই ছিল মেয়ে বাচ্চা। তাই আমরা খেলতামও একসাথে। আমরা থাকতাম চার তলায়। সামনের বাড়ির চারতলার গৃহকর্ত্রীকে মা খুব পছন্দ করত। উনি ভীষণ আদর করতেন আমাদের। কিছু রান্না করলেই বারান্দা থেকে ডাক দিতেন। পাঠিয়ে দিতেন কাউকে দিয়ে। উনার দুই ছেলে ছিল। একজন সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, আরেকজন উচ্চমাধ্যমিক। ধরি তাদের নাম আকাশ আর বাতাস। আমরা মামা বলে ডাকতাম দুইজনকেই, কারণ তারা বাবা-মা কে ভাই-আপা ডাকতো। দুইজনই ভীষণ মিশুক ছিলেন। আমি তখন নতুন বই পড়া শিখছি। বইমেলা থেকে আমার জন্য ছোটদের বই নিয়ে আসতেন উনারা। আমার চেয়ে বেশি তারা গল্প করতেন আমার পিচ্চি বোনটার সাথে। উনাদের বারান্দা থেকেই ওকে ওর চুল, ঝুটি, দাঁত এসব নিয়ে খ্যাপাতেন। আর পিচ্চি বোন যেত রেগে। উনাদের মা, যাকে আমরা ডাকতাম নানু, সবসময় বাসায় যেতে বলতেন। আমিও প্রায়ই আমার দাদুর রাঁধা এটা সেটা খাবার দিতে যেতাম। আমি গেলেই আকাশ মামা, বাতাস মামা দুইজনের নানারকম মজার গল্প বলত। তাদের ছোটোবেলার খেলনা বের করে দিত নানু। উনি মনে হয় ছেলেদের শৈশব মিস করতেন।

এরকমই একদিন গেছি উনাদের বাড়ি। স্কুল ছুটি ছিল। বাড়ি গিয়ে দেখি ছোট ভাই বাতাস মামা বাড়িতে নেই। নানু আছে কিনা মনে পড়ছে না এখন। আকাশ মামা যথারিতী আমাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে নানান গল্প করছেন। তারপর আমার ঠিক মনে পরছে না, আমিই যেতে চাইলাম নাকি উনিই আমাকে কিছু একটা দেখাতে বাথ্রুমে নিয়ে গেলেন। এরপরের স্মৃতিগুলো আমার কাছে ঝাপসা। হঠাত হঠাত কিছু ছবি অথবা দৃশ্য মনে পরে। উনি আমাকে কমোডের উপর বসিয়ে আমার প্যান্ট খুললেন। তারপর উনার মুখ এবং জিহবা দিয়ে আমার যৌনাঙ্গে দিলেন। আমি জানি না আমি কেন কোনো প্রতিবাদ করলাম না। একটা কারণ হতে পারে, আমি কোনো ব্যথা পাচ্ছিলাম না। অথবা আমি একেবারে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এরপর উনি নিজের প্যান্ট খুলে উনার লিংগ দিয়ে একই জায়গায় কিছুক্ষন ঘষলেন। আমি অবাক হয়ে উনার সেই অদ্ভূত অঙ্গটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আমি ভাবতেও পারি নি ছেলেদের প্যান্টের ভিতর এমন কিছু থাকতে পারে! আমার মনে পড়ে না এটা কতক্ষণের ঘটনা ছিল। পঁচিশ বছর পর এসে ওই সময়টা মনে করতে গিয়ে মনে হচ্ছে হয়তো এক মিনিটও ছিল না। কারণ, উনি বারবার বাইরে তাকাচ্ছিলেন। নিশ্চয় উনার মা বা বোন কেউ বাড়িতে ছিল। আমার এও মনে পড়ে না উনি বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে আদৌ আমাকে কিছু বলেছিলেন কিনা। কাউকে বলতে মানাও করেছিলেন কিনা।

ওই ঘটনা ওই প্রথম ওই শেষ। এরপর আমি আর ওই বাসায়ই হয়তো যাই নি। অথবা গেলেও অন্য অনেকের সাথে গেছি। কিন্তু, আমি ওই ঘটনা কাউকে বলি নি। মাকেও না। বলা যায়, ঘটনাটা আমার মস্তিষ্ক থেকে একরকম মুছেই যায়। অনেক বছর পর, যখন আমি হাইস্কুলে পড়ি, তখন উনার সাথে কোনো একটা বইয়ের দোকানে দেখা। উনি সম্ভবত ভাল ছাত্র ছিলেন। বাবা তাকে বেশ স্নেহ করতো। উনি বাবার সাথে কথা বলতে আসলেন, আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হঠাৎ করে আমার সব স্মৃতি মনে পড়ে গেল। তখন আমি বুঝতে পারলাম, কি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছিলাম আমি। আরেকদিন যদি উনি আমাকে একা পেতেন, কি করতেন ভাবতে পারছিলাম না। পাঁচ বছরের মেয়ে হিসেবে আমি তখন জানিও না একটা ছেলের যৌনাঙ্গ যে আমার চাইতে আলাদা। কখনো কোনো ছবিতেও দেখিনি। বাচ্চাকালের যেকোনো নতুন ঘটনার মত ওটাকেও নতুন কিছু ভেবে চুপচাপ বসে ছিলাম হয়তো। তবে আমি আমার ছোটোবেলার অন্য কিছু আচরনের ব্যাখ্যা এখন দিতে পারি। আমি ওই সময়ের পর বেশ কয়েক বছর আমার মার পাশে কোনো পুরুষকে সহ্য করতে পারতাম না। এমনকি আমার বাবাকেও না। যদি দেখতাম মা বাবার পাশে বসে আছে, ভীষণ রাগ হত। একবার আমি আমার এক দুরসম্পর্কের মামা আর মার সাথে কোথাও থেকে ফিরছি। অল্প পথ, তাই রিকশা নিতে হবে। কিন্তু আমি কিছুতে রিকশায় উঠতে রাজি হইনি। আমার সেই মামা মার চাইতে অনেক ছোট বয়সে। কিন্তু, রিকশায় তারা এত কাছাকাছি বসবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। এদিকে এটা বলতেও পারছিলাম না। কারণ বললে তো মা বুঝবে না, বকা দিবে। অতঃপর মা বাধ্য হয়েছিল বেবিট্যাক্সি নিয়ে আসতে। আমি সেখানে মাঝখানে বসেছিলাম যেন মার শরীরে কোনো ছেলের স্পর্শ না লাগে। আমার ধারণা, ওই ঘটনা আমাকে আমার আশে পাশের মেয়েদের ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল করে দেয়।

সেই ছোট্ট আমির সাথে এই এত বছর পরের আমির আচরণে কোনো মিলই নেই। এখন আমি অনেক গলা উঁচু করে কথা বলতে পারি। কোথাও যদি কোনো মেয়ের উপর কোনো অন্যায় হচ্ছে দেখি, আমি কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে মেয়েটার পক্ষ নেই। কারণ আমি জানি, আমাদের সমাজে মেয়েরা শুধুমাত্র দোষী হয়ে যাওয়ার ভয়ে মুখ খোলে না। তাদের ভয় হয় যে তারা কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করলে তাদেরকে সেটা প্রমাণও করতে হবে। প্রমাণ করাটা তো এত সহজ না। এই ভয়টার পিছনে আছে হীনমণ্যতা। আমার বাবা-মা অসম্ভব মুক্তমনের মানুষ। কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা দুইবোন কখনো বুঝতেও পারিনি আমাদের দেশের মেয়েরা যে এত স্বাধীনতা নিয়ে বড় হয় না। ধর্ম, বিয়ে, সংসার – এগুলো যে মেয়েদের পালন করার কথা সেটা আমি আমার বন্ধুদের কাছে শুনেছি। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পড়ালেখার বাইরের বিভিন্ন কাজে আমাদের উতসাহ দিতেন মা-বাবা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার আগ পর্যন্ত মেয়ে বলে যে সাজসজ্জার দিকে আলাদা যত্ন নিতে হবে অথবা ঢেকেঢুকে পোশাক পরতে হবে সেটা জানাই ছিল না। মা দুই বোনের জন্যই একিরকম জামার কাপড় কিনে বানিয়ে দিতেন। ফ্রকের চেয়ে প্যান্ট-টপ্সই বেশি পরা হত আমার। পোশাকেও যে ছেলেদের চাইতে আলাদা কিছু পড়তে হবে সেটা কখনো মনে হয়নি আমাদের। মেয়েদের সাজগোজ অথবা পর্দা – এই দুই ব্যাপারেই আমার জ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর। ততদিনে আমি এগুলো যে ব্যাক্তিগত পছন্দের ব্যাপার- সেই ধারণাটুকু লাভ করে ফেলেছি। ধর্ম নিয়েও বাবা-মা খুব স্বাধীন চিন্তার ছিলেন। মাকে রোজার মাসে নামাজ পড়তে দেখতাম। বাবাকে ঈদের দিন । আমাদের কখনো কিছু শেখাননি। স্কুলে যখন সূরা মুখস্থ করতে দিত তখন ঠিকই মা আমাকে সেগুলো মুখস্থ করাতো। এক পর্যায়ে আমার নিজেরি মনে হল, ধার্মিক হলে নিয়মিত নামাজ পড়া উচিত। মার কাছেই শিখলাম নামাজ পড়া। মা শেখাতে না করেনি। আমার ছোটোটার ওসবে আগ্রহ ছিল না। তাই সে কখনো নামাজ পড়া শেখেইনি। স্কুলে বন্ধুদের কাছে শুনতাম সবার বাড়িতে হুজুর আসেন কোরান শরীফ পড়াতে। আমি দেখলাম শুধু আমরা দুইবোনই আরবি পড়তে পারি না। মনে হল, আমরা তো পিছিয়ে পরছি। মার কাছে আমিই ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলাম। হুজুরের বাবস্থা হল অবশেষে। আমি দুই বছরের মধ্যেই দুইবার কোরান খতম দিলাম। এসব কিছুর পাশাপাশি আমাদের ঘরের বইয়ের তাকে রাখা আরজ আলী মাতুব্বর, কার্ল মার্ক্স, তসলিমা নাসরিন, বার্ট্রার্ড রাসেলও কিন্তু পড়া হচ্ছিল আমার। বাবা-মা সব কিছু পড়ার সুযোগই করে দিয়েছে আমাকে। যেন আমি নিজের থেকে বুঝতে শিখি। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর যখন দর্শন-যুক্তিবাদ নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ হয় আমি নিজেই ধর্মচর্চা থেকে দূরে সরে আসি। কারণ আমার কাছে না বুঝে কোরান পড়াকে অর্থহীন মনে হতে লাগল।

আমার বাবা-মা কেউই কিন্তু নাস্তিক নন, আবার খুব ধার্মিকও নন। কিন্তু তারা আমার উপর কোনো বিশ্বাস বা অবিশ্বাসই চাপিয়ে দেননি। আমি আমার বাবা-মা কাউকেই ভয় পেয়ে বড় হইনি। এত কিছুর পরও এত বড় একটা ঘটনা আমি পারিনি তাদের বলতে। কারণ কি? কিসের এই লজ্জা? আমাদের সিনেমা নাটকে সবসময় নারীদের এত পবিত্ররূপ দেখি বলে কি সেটাই মাথায় গেঁথে গেছিল? একটা বাজে লোকের কাপুরুষ আচরণের জন্য জীবনের একটা বড় সময় পুরুষ জাতটাকেই খারাপ ভাবতাম। আমার ধারণা যদি ওই লোকটা আরো খারাপ কিছু করতো আমি তাও কাউকে কিছু বলতাম না। অথচ আমি জানি, আমার মা যেমন শক্ত মহিলা, সে জানা মাত্র হয়তো সেই লোককে ভাল একটা শিক্ষা দিত, অথবা তার সাথে সব রকম সম্পর্ক নষ্ট করতো। কিন্তু, আসলেই কি করতো? এই ভরসাটা যদি আমার থাকতো তাইলে আমি কি তখনই বলতাম না তাদের? অথবা ব্যাপারটা যে অন্যায় হচ্ছে সেটাই কি আমি বুঝেছিলাম তখন?

সচলায়তনে গত কয়েকদিন ধরে নানান লেখায় নানান রকম সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। যা যা বলা হয়েছে তার সব গুলোই আমার পরিবার থেকে পেয়েছি আমি। তারপরও দুর্ঘটনা এড়ানো যায় নি। আমার ধারণা, বাবা-মার প্রথম কাজ উচিত নিজের সন্তানের বিশ্বাস অর্জন করা। ছোটবেলা থেকে তারা যেন কোনোরকম হীনমণ্যতায় না ভোগে। সন্তান যদি সবসময় ভয় পায় যে সে বাবা-মার আশানুরূপ আদর্শ সন্তান হতে পারছে না, তাহলে সে তার সাথে হওয়া যেকোনো অন্যায়ের কথাও বলতে ঘাবড়াবে। আমার ধারণা আমার ক্ষেত্রে লোকটা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল, আমি এত চুপচাপ, ভদ্র এবং ভীতু যে কাউকে কিছুই বলব না। আমি যদি আমার ছোটো বোনের মত দস্যি হতাম, হয়তো সে এতটা সাহস করতো না। এই ধরনের যৌন সন্ত্রাসীরা বেশ বুঝে শুনেই তাদের শিকার বাছে। ঠিক যেমন পহেলা বৈশাখের ঘটনাটাও অনেক উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া একটা ঘটনা মনে হয় আমার কাছে। বাবা-মা অনেক লিবারেল এবং দূরদর্শী হওয়া সত্ত্বেও ছেলে-মেয়েরা লাজুক ভীতু হতে পারে। এরজন্য দরকার স্কুলে একদম ছোটোবেলা থেকেই এই ব্যাপারে বাচ্চাদের সচেতন করা। বাচ্চারা যখন বাইরে যাওয়া শুরু করে তখন থেকেই তাদের সাথে নিজের শরীর নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা। তার শরীর সম্পর্কে সে যেন হীনমন্যতায় না ভোগে, অথবা পাপবোধে না ভোগে। কেউ যদি তার শরীরে হাত দেয় সেটা যে হাত দিয়েছে তার দোষ। আর সন্তানদের চুপ করে থাকাকে উৎসাহ না দেয়াও হয়তো এর সমাধান হতে পারে। বাচ্চাকে ছোটোবেলা থেকে ডাইরি লিখতে অভ্যাস করানো যেতে পারে। স্বভাবগত কারণে অনেক বাচ্চাই খুব চুপচাপ থাকে। সেক্ষেত্রে বাবা-মার হয়তো উচিত বছরে একবার হলেও কোনো ভাল কাউন্সিলর বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে বাচ্চাকে কথা বলানো। তারা জানেন কিভাবে বাচ্চার কাছ থেকে কথা বের করে আনতে হয়। তাহলে হয়তো শিশুটাকে সারাজীবন কোনো খারাপ স্মৃতির ভার বহন করে চলতে হবে না।

বড় হয়ে ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনা তো অনেকে লিখছেই। বাসে ওঠা থেকে শুরু করে গাউসিয়ার ভীড় – সবখানেই ওঁত পেতে থাকে এই যৌন সন্ত্রাসীরা। কিন্তু আমি দেখেছি এরা অনেক ভীতুও হয়। অনেকবারই এমন হয়েছে যে তাদের চোখে চোখ পড়লেই তারা হাত সরিয়ে নেয়। একটু আধটু ধমক দিলে হয়তো আর কখনো তারা সেটা করার সাহসই পাবে না। মেয়েদের হয়তো উচিত নিজেদের নিষ্পাপ-সতী-নাজুক ইমেজ থেকে বেরিয়ে এসে একটু মা কালীর মতন মারমুখী হওয়ার চেষ্টা করা। শরীরের প্রতিবাদী ভাষা (বডি ল্যাঙ্গুয়েজ) এবং মুখের মারমুখী এক্সপ্রেশন ৫০% সন্ত্রাসীকে অনুতসাহিত করতে সক্ষম। আমার নিজের অভিজ্ঞতা তাই বলে।সমস্যাটা ঢাকা শহরে একটু বেশি মাত্রায় আছে বলেই মেয়েরা যদি রাস্তায় নেমে প্রতিরোধ করার উপায় বের না করে তাহলে এর সমাধান পাওয়া খুব কঠিন।


Comments

ধ্রুব আলম's picture

চলুক

আপনি নামটা দিতে ভুলে গেছেন।

৫ বছরের একটা মেয়ের প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা কিভাবে জন্ম নেয়, আমি আগেও বুঝিনি, এখনো বুঝতে পারি না। সে বয়সটাতে ছেলে-মেয়েতে পার্থক্য করা যায় কি? সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়, ছেলে শিশুরাও এদের হাত থেকে শঙ্কামুক্ত নয়। ইয়ে, মানে...

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ। ছেলে শিশুদের ভিক্টিম হবার সম্ভাবনা আরো বেশি। কারণ তারা বাইরে বেরোচ্ছে বেশি। ছোটোবেলা থেকেই বাবা-মার সন্তানদের সাথে খোলামনে কথা বলতে পারতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

জলপদ্ম

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।

সুলতানা সাদিয়া's picture

কিছু বলবার ভাষা নেই। পড়ছি আর আমার মেয়েটাকে ঠিক শিক্ষা আর সাহস দেবার পথ খুঁজছি।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক's picture

ভয় পেলে চলবে না। এখনকার বাবা-মাদের চ্যালেঞ্জটাই সেটা। নিজের ভয়কে জয় করে সন্তানকে সাহসী বানাতে হবে যেন সে বাইরে বেরোতে ভয় না পায়। বাইরে বেরোনোর সাহস ও তখনই পাবে যখন জানবে ও চাইলে যখন খুশি ফিরে আসতে পারে ওর বাবা-মার কাছে। তারা ওকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বিশ্বাস করবে, ওর পক্ষে থাকবে। ওর ছোটো থেকে ছোটো - অদরকারি গল্প শোনার মত ধৈর্য্য থাকতে হবে আমাদের। আপনার মেয়ের জন্য শুভকামনা।

এক লহমা's picture

শিশু অবস্থতেই যৌন সন্ত্রাস-এর শিকার হয়েও আপনি হেরে যাননি। তার জন্য আপনাকে অভিবাদন। হয়ত আপনার মার সাথে মনের ভার ভাগ করে নিতে পারল আপনার কষ্টটা আর একটু কম হত।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

কর্ণজয়'s picture

৫* <
জীবন্ত বর্ণনা । পরিমিতি । সমন্বয় । বক্তব্যের স্পষ্টতা । বিশ্লেষণ ।

তাপস শর্মা's picture

পড়লাম। যথেষ্ট পরিণত একটা লেখা...

রানা মেহের's picture

আপনার লেখাটা ভাল লাগলো।
বাবামাইয়েদের সচেতন হওয়া এবং সচেতন করা যে কী জরুরী, সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝি।
আশা করি এখনকার বাবামায়েরাও বুঝবেন।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.