যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে...

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture
Submitted by silent_watcher [Guest] on Wed, 04/03/2015 - 2:34am
Categories:

গত কয়েকদিন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি অত্যন্ত ভীতু মানুষ। ভয়ের চোটে গত কয়েকদিন খবর-পত্রিকা-অন্তর্জাল সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থেকেছি। কি হবে খবর জেনে? এমনকি ফারাবী’র পুনঃগ্রেপ্তারের খবরটাও জেনেছি প্রায় ২৪ ঘন্টা পরে। জেনেই বা কি হবে, লুচ্চাটার বড়জোর ফাঁসি হবে, কিংবা তাও হবেনা। ফারাবীদের ফাঁসি-টাসি হয়না। ঘুরেফিরে অভিজিৎ রায়েরাই কোপ খেয়ে হারিয়ে যান কোন অজানার দেশে।

হুমায়ুন আজাদ যখন আহত হন, আমরা তখন সুরক্ষিত একটি প্রতিষ্ঠান ছাত্রাবাসের বেষ্টনীতে নিরাপদে দিন কাটাচ্ছি। সেখানে খবর খুব সহজপ্রাপ্য ছিল না। প্রথম খবর পেয়েছিলাম আমাদের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক রেজা স্যারের কাছে। (ভদ্রলোক পরে মাস্টারি ছেড়ে দিয়েছিলেন। রেজা এলিয়েন নামে বিজ্ঞানের চমৎকার কিছু বইও লিখেছিলেন।) আমি তখনও ‘কত নদী সরোবর’ কিংবা ‘লাল নীল দীপাবলী’ পড়ে মুগ্ধ হইনি, ‘মহাবিশ্ব’ পড়ে হতভম্ব হইনি। হুমায়ুন আজাদ মানে আমার কাছে পেছনে ফেলে আসা ক্লাস এইটের বাংলা বইয়ের একটা অধ্যায় মাত্র।

এর অনেক অনেক পরের কথা। আমি তখন কার্জন হলে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। সারাদিন বুভুক্ষের মত টাকার পেছনে ছুটে বেড়াই। নানান মাপের, নানা কিসিমের ছাত্র-ছাত্রী পড়াই। কোচিং সেন্টার দু চোখে দেখতে না পারলেও সেটা চেপে রেখে দুটো টাকার আশায় সেখানে ক্লাস নিই। মাস শেষে কখনও ছাত্রের বাবা-মা’র সাথে যুদ্ধ করে টাকা আদায় করতে হয়, কেউবা না চাইতেই একটা ‘বড় নোট’ বেশি ধরিয়ে দেন। পড়াশুনা শিকেয় তুলে এভাবেই চলছিল দিন। একদিন হলে কে যেন নতুন চাকরির খোঁজ দিল “প্রুফরিডিং”। কাজ সাথে নিয়ে আসার সুযোগ থাকায় আমার তো পোয়াবারো। জামাতী জেনেও নাচার হয়ে ‘পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের’ প্রুফও দেখে দিয়েছি এসময়। আর, এমন সময় দুম করে একদিন জানতে পারলাম বন্ধুপ্রতীম রায়হান আবীর, (যে কিনা আমাদের বয়সী হয়েও বেশ একটা ভারিক্কি ভাব নিয়ে পিএইচডি না কি জানি করে- সে) আস্ত একটা বই লিখে ফেলেছে। আমি প্রুফ দেখি শুনে সে একদিন ব্রাউন পেপারের খামে একতাড়া অফসেট কাগজ ধরিয়ে দিল- প্রুফ দেখতে হবে। বইয়ের নামটা অদ্ভুত- ‘অবিশ্বাসের দর্শন’। আমি বই পেলেই গিলি, সেই বইয়ের প্রুফকপিও ভুল ধরা ভুলে গিলে ফেললাম। তখনও আমি ব্লগ কি জানিনা, আবীরের সহলেখক অভিজিৎ রায়কেও চিনিনা।

পরে জেনেছিলাম অভিজিৎ রায় আমাদেরই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ‘অজয় রায়’ স্যারের ছেলে। অজয় স্যারকে আমরা বিলক্ষণ চিনতাম। এমন নিপাট ভদ্রলোক ক্যাম্পাসে খুব কম দেখা যায়। এই নিরীহদর্শন ভদ্রলোকটিই আবার ঘন্টার পর ঘন্টা ইতিহাস কিংবা দর্শনের ওপর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিতে পারতেন নরম অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে। অজয় স্যারের কোনও এক বক্তৃতাতেই আমরা প্রথম ‘মানুষ’ সত্যেন বোসের গল্প শুনি। পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেনবাবুর গল্প আগেই জানা ছিল। কিন্তু, তাঁর ভেতরের মানুষটাকে এত সুন্দর করে আর কেউ উপস্থাপন করেন নি। তখনও আমি জানতাম না এই বৃদ্ধ মানুষটি বছর সাতেক পরে টিএসসিতে হন্যে হয়ে একটা যানবাহন খুঁজে বেড়াবেন নিজের আহত ছেলেকে হাসপাতালে নেবার জন্য। আমি জানতাম না, নিজ সন্তানের ক্ষতবিক্ষত লাশ তিনি সন্তানের ইচ্ছা মোতাবেক পরম মমতায় তুলে দেবেন জ্ঞানের অন্বেষকদের হাতে।

অভি’দা যখন হামলার শিকার হলেন, সেইসময় আমরা কয়েকবন্ধু আড্ডা দিচ্ছি বাংলা একাডেমির মুল ফটকের ঠিক সামনে। পুলিশের একটা পাজেরো গাড়ি প্রায় আমাদের চাপা দিয়েই হুশ করে চলে গেল দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসির দিকে। আমরা মেজাজ খারাপ করে ক’টা গাল দিলাম। তখন চারিদিকে নীড়ে ফেরার তাড়া, সবকিছুই স্বাভাবিক। একটা হৈচৈ পর্যন্ত কেউ টের পাইনি। অথচ সেসময় বড়জোর ১০০ মিটার দূরে খুন হয়ে যাচ্ছিলেন অভি’দা। সেদিন পুরো সময় মেলায় ছিলাম, শুদ্ধস্বরের সামনে ভিড় দেখে দূর দিয়ে হেঁটেছি। তখনও জানিনা ভিড়ের উপলক্ষই ছিলেন অভি’দা। শেষদিকে ভিড় কমলে আলতো করে ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে আবার রেখে দিয়েছি- পরেরদিন কিনব ভেবে। তখনও টের পাইনি লেখকের জীবনের আর মাত্র ১৫ মিনিট সময় অবশিষ্ট আছে।

বিদায় অভিজিৎ রায়। আপনার মৃত্যুতে হয়তো সর্বব্যাপী ঈশ্বরের সশস্ত্র চেলা-চামুন্ডারা একটু স্বস্তি পাবেন। চেলারা কখনই বুঝবে না ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হয়ে থাকলে তার কাজটা এগিয়ে দিতে হয় না, আর তার কাজটা নিজে করে দিতে হলে তার সর্বশক্তিমানত্বের দাবিকেই অপমান করা হয়। তাই তারা ক্রমাগত কুপিয়েই যাবে, কোপাতে কোপাতে একদিন নিশ্চয় আপনার মত বেয়াদব লোকেদের কলম থেকে কালি বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর মহাপ্রলয়। কে বলেছে শিঙ্গা বাজাতেই হবে? হতাশার কথা হয়ে গেল বোধহয়। হলে কি আর করা? হতাশার সময় হতাশ হতে হয়। ভয় পাবার সময় ভয় পেতে হয়। দিনশেষে আমরা সবাই ভীতু।

অভি’দা শরীরটা কেটেকুটে হয়তো বৃহৎ কোনও গবেষণা হবে। নাহয় ক’জন ডাক্তারের প্র্যাকটিসই হবে, তারপর সেই ডাক্তারেরা হাজারো মানুষের চিকিৎসা করে বেড়াবেন। অভিদা’র শরীর কেটে হাতপাকানো ডাক্তারেরাই হয়তো একদিন মানুষের পাশাপাশি একইরকম দেখেতে অন্ধকারের কোনও কীটের চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলবে। সেই কীটেরা হয়ত জানবেও না যাঁকে ধ্বংস করার এত প্রচেষ্টা, তাঁর অমলিন ভালবাসার ছোঁয়া নিয়েই তাদের কলুষিত বেঁচে থাকা। অভিজিৎ রায় জিতে যাবেন ঠিক এইখানটাতেই। আমরা হারতে হারতে চুপচাপ কবরে সেঁধিয়ে যাব, তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করব শিঙ্গা বেজে ওঠার। একজন অভিজিৎ একাই আলো হাতে নিয়ে আঁধারের যাত্রীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলবেন নিরন্তর।

অভি’দা একটা কাজই করে গেছেন- বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি। আমি স্বপ্ন দেখি শত অভিজিৎ তাঁর রেখে যাওয়া আলোটা হাতে নেবে, ছড়িয়ে দেবে, নিরন্তর পথ দেখাবে আঁধারের যাত্রীদের। স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই, তাই না? মোতাহের হোসেন চৌধুরী খুব চমৎকার একটা কথা বলেছিলেন- “অন্ধকারের ওপর লাঠিপেটা করে লাভ নেই, আলোক জ্বালিলেই অন্ধকার দূরীভূত হইবে।” তবে আর কি? Let There Be Light!

০৩.০৩.২০১৫


Comments

শিশিরকণা's picture

আলো আসবেই।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

আয়নামতি's picture

Quote:
বিদায় অভিজিৎ রায়। আপনার মৃত্যুতে হয়তো সর্বব্যাপী ঈশ্বরের সশস্ত্র চেলা-চামুন্ডারা একটু স্বস্তি পাবেন। চেলারা কখনই বুঝবে না ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হয়ে থাকলে তার কাজটা এগিয়ে দিতে হয় না, আর তার কাজটা নিজে করে দিতে হলে তার সর্বশক্তিমানত্বের দাবিকেই অপমান করা হয়। তাই তারা ক্রমাগত কুপিয়েই যাবে, কোপাতে কোপাতে একদিন নিশ্চয় আপনার মত বেয়াদব লোকেদের কলম থেকে কালি বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর মহাপ্রলয়। কে বলেছে শিঙ্গা বাজাতেই হবে? হতাশার কথা হয়ে গেল বোধহয়। হলে কি আর করা? হতাশার সময় হতাশ হতে হয়। ভয় পাবার সময় ভয় পেতে হয়। দিনশেষে আমরা সবাই ভীতু। অভি’দা শরীরটা কেটেকুটে হয়তো বৃহৎ কোনও গবেষণা হবে। নাহয় ক’জন ডাক্তারের প্র্যাকটিসই হবে, তারপর সেই ডাক্তারেরা হাজারো মানুষের চিকিৎসা করে বেড়াবেন। অভিদা’র শরীর কেটে হাতপাকানো ডাক্তারেরাই হয়তো একদিন মানুষের পাশাপাশি একইরকম দেখেতে অন্ধকারের কোনও কীটের চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলবে। সেই কীটেরা হয়ত জানবেও না যাঁকে ধ্বংস করার এত প্রচেষ্টা, তাঁর অমলিন ভালবাসার ছোঁয়া নিয়েই তাদের কলুষিত বেঁচে থাকা। অভিজিৎ রায় জিতে যাবেন ঠিক এইখানটাতেই। আমরা হারতে হারতে চুপচাপ কবরে সেঁধিয়ে যাব, তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করব শিঙ্গা বেজে ওঠার। একজন অভিজিৎ একাই আলো হাতে নিয়ে আঁধারের যাত্রীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলবেন নিরন্তর।

...Let There Be Light!

অতিথি লেখক's picture

পাঞ্জেরী জামাতি না, মালিক নিজেই হুমায়ূন আজাদ স্যারের শিষ্য। চাইলে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি- মাসরুফ

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

আপনি নিশ্চিত? মাস্ফু'দা?
কে জানে, আমিই ভুল জানতাম হয়তো।
জামাতীগো "বেনিফিট অব ডাউট" দিতেও চাই না আরকি।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক's picture

খুব ভালো লেগেছে লেখাটা- মাসরুফ

অতিথি লেখক's picture

"আলোকের পথে, প্রভু, দাও দ্বার খুলে
আলোক পিয়াসি যারা আছে আখি তুলে"

অভিদার মৃত্যুতে জাগরিত হবে মহাকাল আর মহাবিশ্ব এই আশায় জাগরুক হোক।
-----------
রাধাকান্ত

এক লহমা's picture

"শত অভিজিৎ তাঁর রেখে যাওয়া আলোটা হাতে নেবে, ছড়িয়ে দেবে, নিরন্তর পথ দেখাবে আঁধারের যাত্রীদের।"

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক's picture

"নি:শেষে প্রান যে করিবে দান" , অভিজিত , হুমায়ুন আজাদরাই উদয়ের পথে হাতে হাত ধরে অপেক্ষা করছে । এটাই আমাদের মনে রাখতে হবে।
----------
রাধাকান্ত

গান্ধর্বী's picture

Let There Be Light!

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক's picture

Quote:

সেই কীটেরা হয়ত জানবেও না যাঁকে ধ্বংস করার এত প্রচেষ্টা, তাঁর অমলিন ভালবাসার ছোঁয়া নিয়েই তাদের কলুষিত বেঁচে থাকা। অভিজিৎ রায় জিতে যাবেন ঠিক এইখানটাতেই। আমরা হারতে হারতে চুপচাপ কবরে সেঁধিয়ে যাব, তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করব শিঙ্গা বেজে ওঠার। একজন অভিজিৎ একাই আলো হাতে নিয়ে আঁধারের যাত্রীদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলবেন নিরন্তর।

দেবদ্যুতি

অতিথি লেখক's picture

সুন্দর একটি ধর্মকে পুরো পৃথিবীর কাছে অসুন্দর রূপে প্রকাশ করার অধিকার ফা**'দের (নামটা বানান করে লিখতেও ঘেন্না হোলো) কে দিয়েছে জানি না তবে নাস্তিক / বিধর্মী'র তকমা দিয়ে যদি তোমরা কাওকে শাস্তি দেবার (আল্লাহ'র) দায়িত্বটা নিজেদের হাতে তুলে নাও তবে জেনে রেখ, তোমরা; হ্যাঁ তোমরাই সবচে জঘন্য বিধর্মী! কারন, পৃথিবীর কোনও ধর্মের কোনও প্রভু ধর্ম শেখাবার জন্য ধারালো অস্ত্রে কাওকে ক্ষতবিক্ষত করতে বলেন নি। তোমরা Photoshop-এ edit করা ছবির মাঝে ইসলামের মহত্ত্ব খোঁজো। হায় আফসোস! যদি সত্যিই ইসলামের চেতনা তোমাদের থাকতো! মানুষ তোমাদের আচরনে কতই না মুগ্ধ হত।

তোমরা কে ধর্ম শেখাবার? নিজেরা জানো? নিজেরা বোঝ, ধর্ম কি? গায়ে আতর মেখে পাঁচবার মাথা ঠুকলেই কিংবা ধুপধুনো জ্বালিয়ে মা'এর সামনে হাতজোড় করলেই ধর্ম হয়ে যায়? এতই সোজা!

- ভোরের বৃশ্চিক।

অতিথি লেখক's picture

মঙ্গলের পথে থেকো নিরন্তর,
মহত্বের 'পরে রাখিও নির্ভর--- (রবীন্দ্র)

---------------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক's picture

আজকাল কেন জানি আর কষ্ট পাই না কিছুতেই।

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক's picture

Let There Be Light!

রানা মেহের's picture

আপনার লেখাটা ভাল লাগলো

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.