আপনভাটি

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Sat, 24/01/2015 - 6:46pm
Categories:

বৃষ্টিমনে খুপরির ফাঁকে উঁকি মেরে সামনের হাওরে ছোঁ ছোঁ দৃষ্টি দেয় আপন ।বছরের হাতেখড়ি বৃষ্টি , কিন্তু এতটা আনাড়ি নয়,-একেবারে আষাঢ় আষাঢ় মুরোদ নিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে।কচুপাতায় টাপুরটুপুর নৃত্য , অযাচিত উপঢৌকনে অসহায় নোয়ানো পাতাগুলো।

এমন দিনে চাল ভাজা খেতে মন চায় আপনের । চাইলেই তো খাওয়া যাবেনা ,শিড়ালির পাথরনিষেধ “চৈত –বৈশাখীর মাঝে গো মা বইনেরা - চাইল, পিঠা -খই ভাজন যাইবনা, এগুলান ভাজলে জমিনে শিল পড়ব” । না , আপনের চাল ভাজা খেয়ে কাজ নেই। শনি- মঙ্গলবারে শিড়ালির কথা মত নদীতে সাবান ও নেয় না সে। কিন্তু তবুও কেন যেন ঘুম ভাঙ্গা শিশুর মতো অকারণ রেগে আছে নদী। নদীর জলজজিহ্বা হাওর পানে ছিবলোচ্ছে! তাতে তাঁর কী ? এক তোলা জমিও করেনি সে। ক্যানভাসার- যদিও ধান্দাবাজি তবুও পেশাটা এই অঞ্চলে তাকে বিশিষ্ট একজন করে তুলেছে।

ফি মঙ্গলবার রাজাপুরের হাঁট ধরে সে। বয়স ত্রিশ ছেড়েছে। নিজেকে আকর্ষণীয় করতে ধনুকগোঁফ সমেত বৃষ্টিস্নাত খড়ের মতো নম্রবিন্যাস দাড়িও রেখেছে সে। মজমার সময় হাজারি তসবিহ, বিচিত্র আধুলিসহ তাকে অনেকটা ঋষি মতন লাগে।

“ আহেন আমার মজমায় ,দেহেন আমার মলম । আমার এই মলম -বিছি পাঁচড়া, ঘা একজিমা , গোটাগাটি ভালো করে। চর্ম রোগ তো দুরের কথা একটা ঘামাছির দাগ পর্যন্ত আপনার গতরে থাকবনা। ভাইজান, বিয়া করছেন বউ বেজার ,টেকা ভাঙছেন হাজার হাজার কিন্তু কাম অইল না , ভাত চাইলে কয় লইয়া খাও পানি চাইলে কয় ঢাইলা খাও, হুদাই করে হাউকাউ – এমন যদি হয় আপনার দশা শুনেন ভাই দেই ভরসা । এই লন সানডার তেল , একটা সপ্তাহ খালি ডাণ্ডায় মাখবেন ভাই, আম্রিকার কামানের লাহান পাওয়ার পাইবেন”।
নিগূঢ় দেহতত্ত্ব,হরিণের মৃগনাভি কস্তুরি কাহিনি, জানা অজানা গল্প ও অদ্ভূত শব্দের ব্যবহারে মজমা জমায় সে। আয় অবশ্য মন্দ না, স্ত্রী মিনুকে নিয়ে চলে যায়। তবে হাওর নিয়ে তাঁর চিন্তা কী? আছে, সেও কি গেরস্থি করেনি ? টানা দুই বছরই ফসল হাওয়া ।কৃষকের বেদনা সে বোঝে। কী করবে সে , ঠকে ঠকে এখন ঠগবাজ । প্রকৃতি তাকে ঠকিয়েছে ভীষণ । বাঁচতে হবে তো। পেশাটা নিয়ে এভাবেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয় ।

পাঁচ বছর হল বিয়ে করেছে সে। কত তুলো তুলো জোছনা রাতে দূর মাঠে সর্ষে ক্ষেতে বিলি কেটেছে সে কিন্তু একটা ফুলও কোঁচড়ে পড়েনি তার । কিছুটা হতাশ সে। তবুও মাসিকের সময় এক বুক উচ্ছ্বাস নিয়ে বউয়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি রাখে । মিনুর কাছে এ দৃষ্টি অর্থময় নিঃশব্দ পাঠ ।তবে হাসি দিয়েই জানায় প্রতি মাসের সেরে যাওয়া অসুখটা এ মাসেও হয়েছে।
আপনের আলতো রসিকতায় অভিযোগ ‘পচা মাইয়া , পত্তি মাসে বাঁধ ভাইঙ্গা যায়”। কিন্তু উচ্ছ্বাসটুকু গোধূলি রঙের মতো শীতল চোখে ফের লীন হয় খুব সন্তপর্ণে,অলক্ষ্যে ।

খুশির খবর হল এ বছরটায় একটা ফুল কোঁচড়ে পরতেও পারে। সাত মাস আগে খুশির খবরটা পেয়েছে সে । খুব মনে আছে দিনটার কথা । হাঁট সেরে জামা ছেড়ে উঠোনে টুলটায় ব্যাঙমোড়া হয়ে বসেছিল । এভাবে বসে থাকলে হ্যাঙ্গারে ঝুলে থাকা ভেজা শার্টের মতো অসহায় লাগে তাকে । সেও মানুষ ঠকাতে পারে মনেই হয়না ।কিছু কোমল আঙুল বেহুদাই চুলগুলো এলো করে দিচ্ছে।উকুন ? না তা হবে না , সন্ধ্যা রাতে উকুন খুঁজবে কেন । এটা মিনুর অভ্যাস ও ভালবাসার প্রকাশ ।হয়তো আজ ভালোমন্দ কিছু রেঁধেছে । আশে পাশে কেউ নেই । আপনকে ফিস ফিস করে মিনু বলল “ এ মাসে বন্ধ হইছে”
তাই বছরটা ভালই যাচ্ছে তার ।

চৈত্রের অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি দেখছে আপন। বৃষ্টি ভালো লাগে তবে অসময়ের এ বৃষ্টি বড় বেখাপ্পা লাগছে। চৈত্রের বৃষ্টি বড়জোর মাটি ভিজবে কি ভিজবেনা । বলা যায় ফেরারি বৃষ্টি ।

দেখতে দেখতে মঙ্গলবার চলে আসল , হাঁটবার আজ। প্রস্তুতি নিচ্ছে আপন । চোরাজ্বরের মতো থেমে থেমে বৃষ্টি আসছে আজও। এদিকে থোর আগত ধানগুচ্ছের মতো গলগলে মিনুর পেট। দু’দিন ধরে পেটে চিকন একটা ব্যাথা অনুভব করছে মিনু । ভার ভার লাগছে। দিন ঘনাতে এখনো অনেক বাকি , অপয়া ব্যাথাটা উঠল কেন ?
ওদিকে বাঁধ উপচে তিরতিরিয়ে পানি গড়াচ্ছে হাওরে ।খবরটা রাতেই পেয়েছিল আপন। বউয়ের বেদনার্ত মুখ দেখে হাঁটে যাওয়ার সাহস করল না আপন ।

মসজিদের মাইকে কোদাল ঝুড়ি নিয়ে বাধে যাওয়ার ঘোষণা হচ্ছে। মিনুর ব্যাথাটা বাড়ছে । ঘরের এক কোণে কোদাল দেখা যাচ্ছে। গফুর গোয়ালা দৌড়াচ্ছে আর চিল্লাচ্ছে “তাড়াতাড়ি বান্ধে যাও মিয়ারা , হাওর তল হইয়া যাইতাছে , কোদাল –পাইছা লইয়া বান্ধে যাও, বান্ধে মাটি দেওন লাগব”।
উত্তেজনায় মৃদু কাঁপতে থাকে আপন । “ খাড়াইয়া রইছ কেন , বান্ধে যাও , মালাবুবু আছে চিন্তা কইরনা” বলে কোদালটা আপনের দিকে এগিয়ে দেয় মিনু। আপন দৌড় দেয় বাঁধের দিকে ।
সবাই যাচ্ছে, ব্যাথাটা না থাকলে মিনুও যেতো । বাঁধের কাছে পৌঁছে উত্তেজনা বেড়ে যায় আপনের।
মাটি , বাঁশ , বস্তা , টিন দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চলছে। সব শক্তি ঢেলে মাতিতে কোপ বসায় সে, কিন্তু ঝুড়ি নেই। পেতে দেরি হলনা। জোয়ান ইমাম সাহেব ঝুড়ি বাড়িয়ে বলে “ মিয়াসাব আমার মাথায় দেন ”। আপন ঝুড়ি ভরে দেয় ইমাম সাহেব তা বাঁধে ফেলে,সঙ্গে শব্দ করে দোয়া পড়ে যাচ্ছেন।
আধকাঁচা হলুদাভ রং হাওরে । এক বিহান চেষ্টা করেও পানির সাথে সন্ধি করা গেলনা । বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে! আহাজারি , হাউমাউ কান্না! ইমাম সাহেব দূর জেলার লোক , সেও কাঁদছে । কাস্তে নিয়ে হাওরে নেমে পড়ছে সবাই। বউ-ঝিরাও নেমেছে আধকাঁচা ধান কাটতে । ধান কাটবে কি? কান্নাই থামাতে পারছে না তারা । এখন হাওরে কোন আল নেই, যে যা কাটতে পারে। কৃষক শুধু দুই নয়নে চেয়ে দেখে তার সর্বনাশ । তাই এই আল ছাড়া ডুবতে যাওয়া অবস্থাকে বলে ‘নয়নভাগা’ ।
বাড়ি ফিরছে আপন , কাঁধের কোদালটা খুব ভারি লাগছে তার। বাড়ি পৌঁছে দেখে মিনু মৃত একটি ছেলে সন্তান জন্ম দিল । আশ্চর্য ! আপনের একটুও কষ্ট লাগছে না যেন। শুধু ফসল ডুবে যাওয়া কৃষকের কাঁচা ধান কাটার নিরর্থক চেষ্টার মতো মৃত সন্তানটিকে ছুঁয়ে দিল। জড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে মিনু।সেও খুব কেঁদেছে বলে মনে হয়না। ক্যানভাসার আপন ও মিনুর প্রথম সন্তানের শোক ম্লান হয়ে গেছে হাওর ডুবিতে, অথচ হাওরে তাঁদের একতোলা জমিও নেই।

আষাঢ়ের শেষ দিকে । কিন্তু বৃষ্টি নেই। ছেবে-ছেঁকে হাওর থেকে ধান তুলছে কৃষকরা । দুপুরখেকো রোদে শুকোচ্ছে সেগুলো। কম অবস্থাপন্ন কৃষকরা সারা বছরের খোরাক তুলে ফেলেছে।সারা রাত জেগে আঁচড়া দিয়ে ধান তুলে তারা। বন্ধুর কাছে কেমন করে পত্র লিখা যায়- এমন কথার গানও ভেসে আসে। তখন আপন ও মিনু নির্জনতম আদিম চাষী, বীজ বপনে একনিষ্ঠ অন্ধকারিক সুখ সুখ চাষবেলা। ভাটির সকলের মতো তাঁদের চোখেও সুপ্রসন্ন বৈশাখীর স্বপ্ন । আপনভাটিতে ফসল ও সন্তান একাকার !

মজিবুর রহমান


Comments

অতিথি লেখক's picture

খুব সহজে মুগ্ধ হওয়ার মত লেখা...চালিয়ে যান,আপনাকে দিয়ে হবে সাহিত্যের অগ্রগতি....

আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ

মজিবুর রহমান 's picture

এমন মুগ্ধ পাঠক থাকলে লেখকের মন বেড়াভাঙা শেয়ালের মতো সর্ষেক্ষেতে আনন্দে দৌড়ায় ।

ধন্যবাদ, আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ

রংতুলি's picture

ভাষার যাদুকরী-তে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না! হাসি

মজিবুর রহমান 's picture

আপনাকে ধন্যবাদ দেবার ফুসরত আমার নেই ....................... উৎসাহে আনন্দে সানন্দে আছি !!!!!! গড়াগড়ি দিয়া হাসি

সুলতানা সাদিয়া's picture

কিছু টাইপো আছে, সেরে নিলে সব ঠিকঠাক। শুভকামনা।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মজিবুর রহমান 's picture

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ......... আমি কিন্তু অপেক্ষায় আছি ভুলবেন না!!!!!

অতিথি লেখক's picture

কত ছোট লেখা অথচ কী সাবলীল, সুন্দর! লিখতে থাকুন, পড়তে চাই আরও।

মজিবুর রহমান 's picture

নাম না জানা পাঠকের প্রতি কৃতজ্ঞতা !!!!!!

অতিথি লেখক's picture

দারুণ লেখা। ছোট, সুন্দর, সাবলীল। লিখতে থাকুন।

দেবদ্যুতি রায়

মজিবুর রহমান 's picture

ধন্যবাদ দেবদ্যুতি রায়

অতিথি লেখক's picture

আপনার নাম না জানা পাঠকটাও আমিই ছিলাম। নাম লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম

দেবদ্যুতি রায়

অতিথি লেখক's picture

ভালো লাগলো আপনার গল্পটা পড়ে। ভাষাবুনন সুন্দর।
প্রথম লাইনে যদিও ছোঁ ছোঁ দৃষ্টিসহ পুরো বাক্যটা পড়ে আরাম পাইনি। আর ক্রিয়ার পর না বোধক শব্দে স্পেস দিলে ভালো হয়। থাকব না, লাগবে না এমন আর কি। আপনি দুই এক জায়গায় সেটা ফলো করেছেন অবশ্য আর বাকিগুলোতে করেন নি।
তবে সব মিলিয়ে টাইপো বাদ দিলে আপনার লেখা পড়তে ভালো লাগে।
অপর্ণা মিতু

মজিবুর রহমান 's picture

টাইপো থাকা আসলেই লেখকের যত্নের অভাব , প্রিভিওতে বারবার পড়ি কিন্তু নিজের লেখার টাইপো ধরতে পারি না, কারণ হল পুরো লেখাটাই মাথায় গাঁথা । তাই যতই পড়ি শুধু মেমরিটাই পড়া হয় আর মনে হয় ঠিকই তো আছে । সচেতন হবো!

টাইপো মার্জনা করেও যত্নে পড়েছেন , অশেষ কৃতজ্ঞতা !!!

রাফি 's picture

গল্প ভালো লেগেছে , নতুন উপমা এনেছেন তবে লক্ষ্মীট্যারা থাকল টাইপো .........হবে আপনাকে দিয়ে , লিখতে থাকুন।

রাফি

মজিবুর রহমান 's picture

ধন্যবাদ রাফি হাসি

অতিথি লেখক's picture

যার একতোলা জমিও হাওড়ে নেই সেও হাওড়ে বাধ দিতে যায়!আর ফিরে এসে দেখে তার সদ্য জন্ম নেওয়া সন্তানটা মৃত!দারুন দিয়েছেন ভাই। চলুক তাহলে।

-----------
রাধাকান্ত

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ রাধাকান্ত !!!!

এক লহমা's picture

হাততালি
এই লেখক কোথায় গেল?

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.