কৃষ্ণচূড়া

রণদীপম বসু's picture
Submitted by Ranadipam Basu on Sat, 20/12/2014 - 10:54pm
Categories:

ঘর থেকে বেরুলেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ--
সরকারি জায়গায়।
রোজ ইস্কুলে যেতে-আসতে গাছটাকে দেখতাম,
গাছটাও আমাকে দেখতো--
কোন কথা হতো না আমাদের।

প্রথম শীতের দুষ্টু দুষ্টু পাতাগুলো যখন
ঝালরের মতো ঝিরঝির করে কাঁপতো--
একটা নরোম আদর
খুব মিষ্টি করে ছড়িয়ে যেতো আমার শরীরে।
মফস্বল শহরে তখনো কোন বন্ধু হয়নি আমার,
যেখানেই যেতাম, মনে হতো
একটা শ্যামলা-সবুজ গাছ সারাক্ষণ আমার পাশেপাশে
হাঁটছে, আমাকে আগলে রাখছে।
ফাগুন এলে টুকটুকে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠতো গাছটা।
কিন্তু আমার তা একদম ভালো লাগতো না,
সবুজের প্রতিই ছিলো পক্ষপাত আমার--
উড়ন্ত স্বপ্নেও সে ছিলো আমার কাছে এক সবুজ সকাল।

দূরের পাহাড়টার বেজার করা মুখটাকে আলো করে
সূর্যটা যখন উঁকি দিতো জানলায়
তখুনি ইচ্ছের মতো সেই কাকটা এসে
কা-কা করে ডাকতো আমাকে, প্রতিদিন।
খাবার থেকে সরিয়ে রাখা রুটির টুকরোগুলো নিয়ে
আমিও বেরিয়ে যেতাম দ্রুত। আমাকে দেখেই কা-কা করে
বলতো-- ‘সুপ্রভাত’। আমি তার ভাষা ঠিকই বুঝতাম।
রুটির টুকরোগুলো একে একে ছুঁড়ে দিতাম,
মাটিতে পড়ার আগেই কী অদ্ভুত সুন্দর কায়দায়
লুফে নিতো সে লম্বা-কালো-ঠোঁটে! তারপর
কা-কা করে ‘আসি’ বলে চলে যেতো।

আবার কখনো কখনো ক-তো নীরব কথা-যে হতো--
আমার গলাটা কি কর্কশ ? ভাষা কি খুব খারাপ ?
আমি বলতাম-- কক্ষনো না।
ওটা তো তোমারই কণ্ঠ, ওটাই তোমার ভাষা।
আক্ষেপ ঝরতো তখন--
কিন্তু সাড়া পেলে ওরা যে ঢিল মারে শুধু!
এই দ্যাখো না, পা’-টা কেমন থেতলে দিয়েছে!
জলের মতো তার স্বচ্ছ চোখের দিকে তাকালে
ভারি কষ্ট হতো আমার। মনে হতো বুকের ভেতরে
কোথায় যেন কী একটা খাঁ-খাঁ করছে।

গাছটার সঙ্গে খুব ভাব ছিলো তার।
বসন্ত এলেই যখন ফের লাল হয়ে ওঠতো,
কাকটাও ভীষণ চঞ্চল হতো--
এ’ডাল-ও’ডাল করে তীক্ষ্ণ ঠোঁটের আদরে-
ফুলগুলোকে আরো লাল করে দিতো!

একদিন কেন জানি সে কাকটা আর এলো না,
কখনোই এলো না।
রুটির টুকরোগুলো নিয়ে গাছকে বললাম তার কথা--
কিন্তু সে কিছুই বললো না। দেখি--
সবুজ প্রিয় গাছটা একটু একটু করে
কী ভয়ঙ্কর লাল হতে লাগলো!

সেই গাছও আজ নেই--
কোত্থেকে কারা যেন এসে কেটে নিয়ে গেছে।
তারপর থেকে আমার স্বপ্নের ভেতরে
মাঝে-মধ্যেই দু’টো গাছ এসে হানা দেয় ;
একটা সবুজ, আরেকটা কটকটে লাল--
কৃষ্ণচূড়া !
সবাই বলে, এটাই নাকি ‘স্বাধীনতা’ !
আমার তখন সেই কাকটার কথাই মনে পড়ে যায়,
যার চোখ দুটো ছিলো ঠিক আমার মায়ের চোখের মতোই--
স্বচ্ছতোয়া !
মা নাকি একদিন সত্যিই ফিরে আসবে--
আমার জন্য স্বাধীনতা নিয়ে !
০৬/১২/২০০৭


Comments

তিথীডোর's picture

কৃষ্ণচূঁড়া নয়, কৃষ্ণচূড়া।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

রোমেল চৌধুরী's picture

কাবুলিওয়ালা রহমত যাই বলুক না কেন, খুকি, খোঁকি নয়। খাইছে

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

রণদীপম বসু's picture

কী আশ্চর্য ! আপনারা কবিকূলকে একটু স্বাধীনতাও দেবেন না ! হা হা হা !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রণদীপম বসু's picture

ধন্যবাদ তিথীডোর, বানানটা ঠিক করে নিলাম।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

নীড়পাতায় পোস্টের শিরোনামের নিচে একটা ছবি দেখায়। কিন্তু পোস্টে ক্লিক করলে ছবি উধাও। কায়দাটা কী?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রণদীপম বসু's picture

আমার প্রায় সব পোস্টেই কিন্তু এই কায়দাটা ব্যবহার করা হয়েছে পাণ্ডব দা। ফটোগ্রাফি আর সাহিত্য দুটোই একসাথে করা হয়ে যায় ! কিন্তু একটা আরেকটাকে বিরক্ত করে না !
পোস্ট তৈরি করার সময় ‌'কার্সর পর্যন্ত দেখাও' জাতীয় অপশনটার 'মূল পোস্টে 'সারসংক্ষেপ দেখাও' অফ করে দিয়ে দিই। নিশ্চয়ই এ কৃতিত্ব সচল সিস্টেমের ! তার পরও কি তার অবদান অস্বীকার করবে ! হা হা হা !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

কবিতা ভাল লেগেছে, নীড়পাতায় দৃশ্যমান (কিন্তু সবিস্তারে উধাও) ছবিটাও!

রণদীপম বসু's picture

ধন্যবাদ। বিষয়টা উপরের মন্তব্যের উত্তরে উল্লেখ করেছি। তাই পুনরুল্লেখ করলাম না।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

প্রৌঢ় ভাবনা's picture

আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় সিটি কর্পোরেশনের জায়গায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। মাঝেমধ্যেই এটার ডালপালা ছেটে একেবারে মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রূপ দেওয়া হয়। হ্যাঁ, তবে ফাগুনে ঠিকই আগুন জ্বলে!
কবিতা ভাল লেগেছে। আপনার স্মৃতিকথাও। হাসি

রণদীপম বসু's picture

কবিতাকে কিন্তু স্মৃতিকথা নয়, কবিতার দৃষ্টিতেই দেখতে হবে, নইলে কাব্য-উপলব্ধিটা বাধাগ্রস্ত হয়। সুযোগে একটু বয়ান করে দিলাম ! হা হা হা !
অনেক ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রোমেল চৌধুরী's picture

এলানো ঢঙয়ে বলে যাওয়া কাব্যগন্ধী কথাগুলো শেষটায় এসে বক্তব্যের চাবুকে পীড়িত হয়েছে বলে মনে হলো। সবটুকু ভালো লেগেছে, এই অংশটুকু ছাড়া,

Quote:
সবাই বলে, এটাই নাকি ‘স্বাধীনতা’ !
আমার তখন সেই কাকটার কথাই মনে পড়ে যায়,
যার চোখ দুটো ছিলো ঠিক আমার মায়ের চোখের মতোই--
স্বচ্ছতোয়া !
মা নাকি একদিন সত্যিই ফিরে আসবে--
আমার জন্য স্বাধীনতা নিয়ে !

উদ্ধৃত অংশটুকু ছাড়া কবির যা কিছু বলবার ছিল তার কি কিছু হেরফের হয়? বোধকরি না।
আমিও একটু বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম। ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন। হা হা হা।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

রণদীপম বসু's picture

আপনার যথার্থ বক্তব্যে সহমত। কেননা, কবিতার নিচে যে তারিখটা দেখতে পারছেন ওই তারিখে কবিতাটার ততটুকুই লেখা হয়েছিলো এবং তা বলবৎ ছিলো এটা সচলে পোস্ট দেবার আগের দিন পর্যন্ত! এবং কবিতা ওইটুকুই। বাকিটা আরোপিত এবং পরীক্ষামূলক। কারণ কেউ একজন এটার প্রতীকী অর্থটুকু ধরতে না পেরে কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের কিশোর কবিতা মানতে রাজি হননি। সেটা বোঝার জন্যই সচলে দিয়েছিলাম কোন গুরুত্বপূর্ণ মতামতের আশায়। এবং সেই মতামতটা আপনিই দিলেন। অসংখ্য কৃতজ্ঞতা। পরবর্তীকালে গ্রন্থবদ্ধ হলে এই আরোপিত অংশটুকু বাদ যাবে নিশ্চিতভাবেই।

এবার আপনার আরেকটা মতামত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করছি। আরোপিত অংশটা ছাড়া কবিতাটা কি মুক্তিযুদ্ধ বা এ-জাতীয় কোন প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রকাশ করতে সক্ষম একজন নতুন পাঠকের জন্য ? কেননা, যাঁরা এই অংশসহ কবিতাটা পড়ে ফেলেছেন তাঁরা তো অনায়াসেই বুঝে ফেলেছেন। কিন্তু নতুন কোন কিশোর পাঠকের জন্য তা কি একই ব্যঞ্জনা বহন করবে ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রোমেল চৌধুরী's picture

রণদীপম দাদা,
আপনার প্রশ্নের জবাবটা একটু ঘুরিয়ে দিই।

আপনার রচনার ট্যাগ চারটি। ‘কবিতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘কিশোর কবিতা্‌’, ও ‘সববয়সী’। শ্রেণিভুক্ত করবার উদ্দেশ্যে যদি আপনি ট্যাগ করতেন তবে ‘কবিতা’ ও ‘সববয়সী’ এই দুটি ট্যাগ করলেই চলতো। ‘কবিতা’ ট্যাগের কারণে রচনার ক্যাটেগরি হিসেবে সচলায়তনে এটি অন্যান্য কবিতাগুলোর ক্রমে সংরক্ষিত হতো। আর ‘সববয়সী’ ট্যাগের কারণে বোঝা যেত যে, এটি সবার পড়বার জন্য উন্মুক্ত। এই দুটি ট্যাগ ছাড়াও আপনি যেহেতু রচনাটিকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘কিশোর কবিতা্‌’ হিসেবে ট্যাগ করেছেন, তখন ধরে নিচ্ছি যে আপনি শুরুতেই পাঠকের দৃষ্টিকে একটি বিশেষ বিষয়ে আবদ্ধ করতে চাইছেন। তাই আলোচ্যমান অংশটুকুর এমনিতেই প্রয়োজন ফুরোয়।

এবারে একটু অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাই। গ্রন্থভুক্ত হবার বিষয়টি খতিয়ে দেখলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায়? এখানে যে উদ্দেশ্যে ‘কিশোর কবিতা্‌’ হিসেবে ট্যাগ করেছেন কিশোর সাহিত্যের গ্রন্থে ভুক্ত হলে সেই উদ্দেশ্যের সাধন হয়। বাকি রইল ‘মুক্তিযুদ্ধ‌’। আর নিয়েই আপনার দুটি প্রশ্ন। আমি প্রশ্ন দুটি আবার উল্লেখ করি,

Quote:
আরোপিত অংশটা ছাড়া কবিতাটা কি মুক্তিযুদ্ধ বা এ-জাতীয় কোন প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রকাশ করতে সক্ষম একজন নতুন পাঠকের জন্য ?

কিন্তু নতুন কোন কিশোর পাঠকের জন্য তা কি একই ব্যঞ্জনা বহন করবে ?

আলোচ্য অংশটুকু বাদ দিলে একজন নতুন পাঠক কিম্বা নতুন কোন কিশোর পাঠকের জন্য রচনাটি মুক্তিযুদ্ধ বা এ-জাতীয় কোন প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রকাশ করতে পারবে কি না সে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। আপনার যদি মনে হয় এতে কোন খামতি থেকে যাচ্ছে, তবে ছেঁটে ফেলা অবয়বের ভেতরেই আরো নিখুঁত শলমা-জরির কারুকাজ করুন। মনে করুন সেই বিখ্যাত চতুর্দশশব্দীর কথা,

The apparition of these faces in the crowd;
Petals on a wet, black bough.
[Ezra Pound, 'In a Station of Metro', 1917]

কি অসাধারণ কবিতা! বাহুল্যবর্জিত ও স্ফটিক স্বচ্ছ। একটিও ক্রিয়াপদ নেই। এটি ছিল কবির পাতাল মেট্রো স্টেশনের অভিজ্ঞতাকে আঁকার প্রয়াস। সেখানের মানুষগুলোর প্রেতায়িত প্রতিচ্ছবিকে আঁকতে কবি বর্ণনা নয় বরং সমীকরণকেই উপযুক্ত মনে করেছিলেন। তাইতো বর্ণনার ছটা নেই। প্রথমটায় লেখা হয়েছিলো তিরিশ পঙক্তিতে, পরে কাট-ছাঁটে এসে দাঁড়ালো চৌদ্দ শব্দতে। একটি নিখুঁত ছবি।

আপনি সুকারু ভাবনার মানুষ, আশাকরি বুঝে নিতে অসুবিধে হবে না।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.