[আজকে শুধুই সিরিজটির ভূমিকা]
মূল প্রসঙ্গে আসার আগে একজন মানুষকে নিয়ে একটু বলে নেই। ১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি, সার্ভিকাল ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলা ভর্তি হন আমেরিকার জনস হপকিন্স হাসপাতালে, নাম হেনরিয়েটা ল্যাক্স (Henrietta Lacks)। চিকিৎসক হাওয়ার্ড জোনস হেনরিয়েটাকে পরীক্ষা করে তাঁর সারভিক্সে একধরনের বর্ধিত অংশ বা টিউমার খুঁজে পান। তিনি এই টিউমারটির কিছু অংশ কেটে নেন এবং একটি প্যাথোলজি গবেষণাগারে পাঠিয়ে দেন পরীক্ষার জন্য। অল্প পরেই হেনরিয়েটা জেনে যান যে তাঁর একধরনের ম্যালিগনেন্ট ক্যান্সার হয়েছে। চিকিৎসার পরেও হেনরিয়েটা বাঁচেন নি। একই বছর অক্টোবরের ৪ তারিখ তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু চিকিৎসাকালে পরীক্ষকগণ তাঁর টিউমার থেকে কিছু অংশ কেটে নেন অনুমতি ছাড়াই (অনুমতির ব্যাপার নিয়ে এক অন্য কাহিনী, আজকে বলছিনা)।
ছবি: হেনরিয়েটা ল্যাক্স
ড: জর্জ অটো গে নামক একজন চিকিৎসক এই টিউমারের কোষগুলি গ্রহণ করেন এবং সেইসময় থেকে থেকে এখন পর্যন্ত কোষগুলি জীববৈজ্ঞানিক এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নাম HeLa কোষ- Henrietta Lacks নামটির আদ্যাক্ষর গুলি (He এবং La) থেকে দেয়া হয়েছে HeLa নামটি। এরপর বছরের পর বছর ধরে পৃথিবীর হাজার হাজার গবেষণাগারে এই কোষকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, বিভাজন করে পরীক্ষা করা হয়েছে। Henrietta Lacks বেঁচে আছেন তার কোষে। কোন ক্যান্সার কোষের বৈশিষ্ট্য, তার উপর ঔষধের প্রভাব, টীকা তৈরি এবং অন্যান্য বহু গবেষণায় ব্যবহৃত হয় এই কোষগুলি। আমরা এধরনের কোষকে সাধারনত 'সেল লাইন' বলে থাকি।
ছবি: হেলা কোষ, যার মরণ নাই
এখন উপরের গল্পটি উল্লেখের কারনটাতে আসি। দেখতেই পাচ্ছেন হেনরিয়েটা মারা গেলেও তাঁর কোষগুলি জীবিত আছে। অর্থাৎ মানুষ বা অন্যকোন জীব মরে গেলেও কোষগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। মানুষের বহুধরনের কোষকেই দেহের বাইরে এনে এভাবে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব, খাবার দিয়ে বংশবৃদ্ধিও করানো সম্ভব। এর জন্য আপনাকে মেরে ফেলারও প্রয়োজন নাই। আপনার হাতের কিছু ত্বক তুলে নিয়ে টেষ্টটিউবে ছেড়ে দিলেই হল। আপনারই কোষ। আপনি হয়তো বেঁচে নাও থাকতে পারেন, কিন্তু কোষগুলি ঠিক বেঁচে থাকে, বিভাজিত হয়। তবে নিয়ন্ত্রিতভাবে এদেরকে পর্যায়ক্রমে বংশবৃদ্ধি করতে দিতে হয়, নাহলে কয়েকদিন পরে মারা যায়।
আমরা জানি জীবের একটা পূর্ণাঙ্গ জীব-স্বত্ত্বা আছে, যেগুলি তার কার্যকলাপে প্রস্ফুটিত হয়। আর বহুকোষী জীবের বিভিন্ন কোষ সম্মিলিতভাবে কাজ করে এই পূর্নাঙ্গ জীব স্বত্ত্বাকে গড়ে তুলে। তখন আমরা বলি, 'জীবটি জীবিত'। অন্যদিকে যখন কোন একটি কোষকে জীবটির দেহ থেকে আলাদা করে নেয়া হচ্ছে তখন আর কোষগুলির মধ্যে সেই জীব-স্বত্ত্বাটির কোন ছোঁয়া পাওয়া যায়না। কিন্তু কোষগুলিও তো জীবিত। সেও বংশবৃদ্ধি করছে, পুষ্টিগ্রহণ করছে। অদ্ভুত, তাইনা? তেমনি, মানুষের শুক্রাণু জীবিত, কিন্তু তাকে জীব বলব না। আবার উদ্ভিদের বীজের কোষগুলি জীবিত, কিন্তু বীজটিকে তো জীব বলব না। অন্যদিকে এককোষী জীব, যেমন ব্যাকটেরিয়া, জীবিত এবং আসলেই একক জীব। কেমন প্যাঁচালো লাগছে!
তাহলে জীবনের সংজ্ঞা কি? একটা কোষের বেঁচে থাকা নাকি একটা পূর্ণাঙ্গ জৈবিক স্বত্ত্বা হিসেবে নিজেকে অনুভব করা? এককোষী জীবেরা যেহেতু একক জীব সেহেতু সেখান থেকে শুরু করাই ভাল। মজার একটি প্রশ্ন মাথায় আসতে পারে- একটি জীবন তৈরির জন্য নুন্যতম কি কি জিনিস প্রয়োজন? আসলে জীবনকে বুঝতে গেলে এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবের বিবর্তনের গুঢ় সম্পর্কটা বোঝার ব্যাপার রয়েছে। সেইসঙ্গে আসে সেই চিরাচরিত প্রশ্ন- কিভাবে প্রাণের উদ্ভব হল। এই সিরিজের পরের পর্বগুলিতে ব্যাপারগুলির শুলুকসন্ধানের চেষ্টা করবো।
ছবি: এককোষী জীবথেকে বহুকোষী জীব তৈরির একটি তত্ত্ব। নাম কলোনিয়াল থিওরি, প্রবক্তা বিখ্যাত দার্শনিক এবং জীববিজ্ঞানী আর্নষ্ট হেকেল (Ernst Haeckel)। যেখানে দেখানো হচ্ছে কিছু এককোষী কোষ প্রথমে একসাথে কলোনী তৈরি করে পরে কয়েকটি কোষ নির্দিষ্ট কাজের জন্য অভিযোজিত হয়ে একটি বহুকোষী জীব তৈরি করেছে।
তবে প্রশ্ন হল- জীবনের সংজ্ঞা কি আসলেই দেয়া যায়? দেখা যাক।
পরবর্তী পর্বগুলি -
১। জীবনের সংজ্ঞা
২। আত্মাহীন রসায়ন
৩। বিশ্বভরা প্রাণ!
৪। আরএনএ পৃথিবীর আড়ালে
৫। শ্রোডিঙ্গারের প্রাণ!
৬। প্রথম স্বানুলিপিকারকের খোঁজে
৭। প্রাণের আধ্যাত্মিক সংজ্ঞার পরিসর দিন দিন ছোট হয়ে আসছে
৮। ত্বকের কোষ থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করবেন
৯। গবেষণাগারে কিভাবে প্রাণ তৈরি করছেন বিজ্ঞানীরা
১০। সম্পূর্ণ সংশ্লেষিত জেনোম দিয়ে প্রথমবারের মতো ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি: এ কি কৃত্রিম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হলো?
ছবিসূত্র:
লেখার অনুক্রমে
১। Life Magazine, February 2, 1922
২। উইকিপিডিয়া
৩। http://www.smithsonianmag.com
৪। উইকিপিডিয়া
Comments
আরে বাহ, হেলা কোষ আর হেনরিয়েটা লাক্সের খালি নামই শুনছিলাম...
কিন্তুক, এমন জায়গায়, এমনে কষা ব্রেক মারলেন মিয়া
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
হেহে। পরের পর্ব দ্রুত দেয়ার চেষ্টা করব
জীব বিজ্ঞান ব্যাপারটাই ভুই পাইতাম । আপনার মত কেউ গল্পে গল্পে বলেনি তো !
রাজর্ষি
আমার তো অংক দেখলেই ভয় লাগে
চলুক চলুক
............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্ চিনে।
হুমম.... দেখা যাক চলতে চলতে কই যায়
।
আপনি কি অণুজীব বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন? নাকি জীব বিজ্ঞানের অন্য কোন বিষয়?
মাসুদ সজীব
অনুজীব বিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন, মলিকিউলার জিনেটিক্স
লেখা চলুক এবং এক একটি পর্ব আয়তনে আরেকটু বড় হোক।
ইচ্ছা করেই ছোট করেছি। পরেরগুলো প্রয়োজন হলে বড় করবো, তবে ছোট লেখাই মনে হচ্ছে ভাল, যেহেতু কয়েকটি পর্ব করছি।
ভুমিকাটা পড়েই সিরিজটা পড়ার আগ্রহ বোধ করছি।
- লেখার শুরুতে একটা সূচীপত্র দিলে কেমন হয়? যেমন ধরা যাক আপনি এই বিষয়টা নিয়ে ১০টা পর্ব লিখবেন। সেগুলো একটা ক্রমানুসারে তালিকা।
- দ্বিতীয়ত, ছবির সোর্স দেয়াটা জরুরী।
- রকিবুল ইসলাম কমল
লেখক হয়তো এই লেখায় শুধু ভূমিকাটুকুই দিতে চেয়েছেন। লেখক যেভাবে মনে করবেন সেভাবেই লিখবেন এইরকম একটা মানসিক প্রস্তুতি পাঠকের পক্ষ থেকে থাকা দরকার।
- মডারেটরকে ফেইসবুক কমেন্ট হিসেবে অপ্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপণ এ্যালাউ না করার অনুরোধ করছি।
-
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ধন্যবাদ।
- ছবির সোর্স না দেয়ার দোষে দুষ্ট আমার আগের অনেকগুলা লেখা। দিয়ে দিতে চেষ্টা করব।
- সূচীপত্রের আইডিয়াটা ভাল। তবে আমি প্রথমেই খুব গোছালোভাবে ঠিক করে নেইনা কোন কোন টাইটেল থাকতে পারে। মাঝেমাঝে পরিবর্তনও করতে হয়। যদি গোছাতে পারি তবে দেয়ার চেষ্টা করব।
অনেক ধন্যবাদ মূল্যবান কমেন্টের জন্য।
মাধ্যমিক/উচ্চমাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা সিরিজ লেখা সম্ভব? কন্টেন্ট থাকবে তাদের সিলেবাসের চৌহদ্দির মধ্যে। তবে লেখা গাইড বই টাইপ বা পরীক্ষা টার্গেট করে হবে না। গল্পাকারে হবে। ভেবে দেখবেন দয়া করে। ওটা করতে পারলে পরে একটা ইবুক বানিয়ে ফেলা যায়।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
শিক্ষক.কম এর জন্য স্কুলের জীববিজ্ঞানের ৪টি কোর্সের একটি আউটলাইন তৈরি করেছি। ৪ জন শিক্ষক পড়াবেন। তবে লেখা হয়তো হবেনা বইয়ের মত। তবে লেকচারের টেক্সটগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখা যায়। আলাদাভাবে লেখার আইডিয়াটাও ভাল। ভেবে দেখি।
হাসিব ভাই, ঠিকই বলেছেন। তবে আমি কিন্তু লেখককে ডিকটেট করার জন্য মন্তব্যটি করিনি; সিরিজের অনাগত পর্ব গুলো সম্বন্ধে একজন আগ্রহী পাঠক হিসেবে নিজের `উইশফুল থিঙ্কিং´টা শেয়ার করতে চেয়েছি মাত্র। লেখক অবশ্যই তার নিজের মত করেই লিখবেন।
জীববিজ্ঞানে আগ্রহ পাচ্ছি আপনার লেখায়, পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য
একবার একজন পাঠিকা আমাকে বললেন যে তিনি নাকি ব্যাচেলর কোন বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষায় ভাইভাতে ভাল করেছেন আমার লেখা পড়ে! হাহা।।
আগ্রহ তৈরি করতে পেরেছি বলে ধন্য।
এবার জট খুলবে মনে হচ্ছে! আগেও কিছু লেখা/বই পড়েছি। তবে এটি'র ভুমিকায় অন্যরকম স্বাদ আছে। পরের পোস্টের অপেক্ষায় থাকলাম। ধন্যবাদ লেখককে।
সমুদ্রপুত্র
ভাল লাগল।
পরের পর্বের জন্য সাগ্রহ অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
সিরিজটার প্রতি দারুণ আগ্রহ থাকলো।
সেল লাইন আগে পড়ে গিয়েছি কিন্তু বুঝিনি। এখন বুঝলাম। সেল লাইন কি শুধু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়? আমি পড়েছিলাম ভ্যাক্সিন তৈরিতে সেল লাইনের ব্যাবহার আছে!!
- শেষ প্রশ্ন
ধন্যবাদ।
যেকোন একধরনের কোষের সংগ্রহকে সেল লাইন বলে। কোষের উপর পরীক্ষার জন্য সেটা দিয়ে যেকোন ধরনের কাজই করা যায়।
দারুণ কিছু প্রশ্ন। জীবন কি? জীবন কি শুধুই কেমিক্যাল ইন্টারেকশন? এ সংজ্ঞায় গাড়ি, কম্পিউটার, রোবটকে কি জীবিত ধরা যায়? চলুক।
সন্দেহপ্রবণ
গাড়ি, কম্পিউটার এবং যেকোন রাসায়নিক সিস্টেমের সাথে এসবের সঙ্গে বড় পার্থক্য আছে। স্বনবায়নক্ষম এবং স্বয়ম্ভর হতে হবে। পরের পর্বটায় কিছুটা ব্যাখ্যা করা আছে।
মনমুগ্ধকর লেখা। আপনার সব লেখা পড়া আরম্ভ করলা।
Post new comment