পরিচয়

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Wed, 25/12/2013 - 10:25pm
Categories:

বিজয় দিবসের সন্ধ্যা। বন্ধু দম্পতির পরিবারে প্রথম সন্তানের আগমনের সংবাদে তাদের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য সস্ত্রীক রওনা হই। রাস্তায় রিক্সার উদ্দেশ্যে হাঁক দেই,

-যাবেন?
-কৈ যাইবেন?
-মুসলিম বাজার।
-যামু, ২৫ ট্যাকা ভাড়া লাগবো।
-কেন? ভাড়াতো ২০ টাকা।
-হেইটা ঠিক। তয় আইজ বিজয় দিবস, হের লাইগা ৫ ট্যাকা বেশি দিবেন।
-কেন? আজ বিজয় দিবস বলে আপনি ৫ টাকা বেশি নিবেন কেন? যা ন্যায্য তাই নেবেন।
-আইচ্ছা, ২০ ট্যাকা দিয়া আপনে খুশি থাকলে কতা নাই, উডেন।

রিক্সা চলছে আমরা দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছি। মুঠোফোনে বন্ধুকে বললাম, “আমরা আসছি, বাসায় থাকিস”। হঠাৎ রিক্সাচালক হঠাৎ

হঠাৎ রিক্সাচালক বলে ওঠেন,

-আইজ তো আমরা রেকর্ড করলাম ভাই।
-কীসের রেকর্ড?
-ক্যান জানেননা! আইজকা ২৭,১১৭ জন ইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রী লইয়া জাতীয় পতাকা বানাইসে। অহন দুইন্যাত আমরাই সব থেইকা বেশি মানুষ লইয়া সব থেইকা বড় পতাকা বানানি দেশ।
-আপনি তো ভালো খবর রাখেন! (তখনও জানতাম না যে আমার আরও বিস্মিত হওয়া বাকি)
-কি যে কন, এমুন খবর আবার রাখুমনা, দেশের হগ্‌গলে জানে। ক্যান আইজ তো লাখ লাখ মানুষ লইয়া জাতীয় সঙ্গীতও গাইলাম।
-ভালো লাগল আপনার কথায়, কিন্তু আপনি এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন কেন? এটাতো ঘুরপথ আপনার সময় বেশি লাগবে আবার কষ্টও বেশি হবে।
-আরে সোজা রাস্তাত অনেক জাম। আহনের সময় দুই ঘন্টা লাগসে ছুট্টা আইতে।
- এই রাস্তায় এত জ্যাম কেন?
-ভাইজান দেহি কোন খোঁজখবরই রাখেননা, আইজ বিজয় দিবস বইলা সব গাড়ি ফ্লাইওভার দিয়া যাইতাসে। বহুত মাইনসে ঘুরতে বাইর হইসে, হের লাইগা এতজাম। কী করব কন, বিএনপি আর জামাতিগো জ্বালায়তো মাইনসে এতদিন ঘর থেইকা বাইর অইতে পারে নাই। মাইনসে আর কত সইয্য করবো! অতিস্ট অইয়া আইজ সবতে বাইর অইসে।

রিক্সা চলতে থাকে, আবার হঠাৎ করে তাঁর প্রশ্ন,

-আপনের কী মনে অয়, ৫ তারিখে নির্বাচনের পর বিএনপি আর কিছু করতে পারব?
- কী বলেন, সব্বাই না আসলে এই নির্বাচন কি গ্রহনযোগ্য হবে? আবার ৯৬ সালের মত হবে না? আর জামাতে ইসলাম কি মানবে? দেখেছেন দেশের কী অবস্থা?
-কী কন ভাই! দেশের এই হাল কি আপনে-আমি বানাইসি? বানাইসে বিরোধীদল। আর জামাতের কথা থোন। তবে এইটা সত্য কোন খেলাই একলা খেইল্যা মজা নাই।
-আপনি মনে হয় সরকার পার্টি?
-ক্যান ভাই, এইটা কইলেন ক্যান? বিএনপি আর জামাতের বিরুদ্ধে কথা কইলেই কি মাইনসে আওয়ামী লীগ অয়? কই আপনেরে আমিত বিএনপি বা জামাতি কই নাই!
-আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি আরে আপনি রাগ করছেন নাকি, ও’কথা আমি কিছু ভেবে বলি নাই।
-এই সমস্যা, খালি পাবলিক কইয়া আর কিছু নাই। অইলে আওয়ামী লীগ, নাইলে বিএনপি-জামাত। আরে আমিত কোন পার্টি করি না। যেইটা নেইয্য হেইটা কমু না!
-এটা আপনি ঠিক বলেছেন। আসলে এটাই সমস্যা। দেখেন না এখনো স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছে সেটা নিয়ে কিছু লোক অযথা বিতর্ক তৈরি করে।
- কাইজ্জা তো লাগাইবই। আমরা পড়ালেখা করি নাই, আমাগো মনে কোন প্যাছঘোছ নাই। আর আপনেরা শিক্ষিত মাইনসেরা সোজা জিনিসরে প্যাছায়া জিলাফি বানান। এইডাতো পানির লাহান পরিষ্কার, শ্যাখ সা’বে স্বাধীনের ডাক দিসে আর জিয়ায় রেডিওত হেইটা পইড়া শোনাইছে।
-ব্যাপারটা আপনি যত সহজে বললেন আসলে বাস্তবে কি এত সহজে বলা যায়?
- ক্যান যাইব না! যেইটা সইত্য সইত্য অইসে হেইটাই বইখাতাত ল্যাখেন। বানায়া মিছা কতা না ল্যাখলেই অয়।

কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর তিনি আবার শুরু করেন,

- হোনেন, আমার ব’স অহন অ্যাকষট্টি বচ্ছর। মুক্তিযুদ্ধের সোময় আছিলাম উন্নিশ বচ্ছরের। সরাসরি অস্ত্র লইয়া যুদ্ধ করি নাই। তয় মুক্তিবাহিনীগো কাছে পাকিস্তানী ক্যাম্পের আর রাজাকারগো খবর দিতাম। উনাগো নৌকা বাইয়া পার করসি। গেরামের বাড়ি বাড়ি থেইকা চিড়া-মুড়ি, ভাত-ডাইল যোগাড় কইরা মুক্তিবাহিনীরা যেই জাগাত পলায়া থাকতো হেই জাগাত নিয়া দিয়া আইছি। একবার মুক্তিবাহিনীর একজন পায়ে গুল্লি খাইলে হ্যারে খাটিয়া কইরা আমি আর আমার তিন মামাতো-খালাতো ভাই মিল্যা কান্ধ কইরা তিন মাইল দূরে এক ডাক্তারের কাছে লইয়া গেছিলাম। আমি নিজেরে মুক্তিযোদ্ধা কইনা। কিন্তু হেই সময় যারা ইন্ডিয়া বইয়া আছিলো বা রাজাকার আছিলো হেগো অনেকতেই অহনে সার্টিফিকেটওয়ালা মুক্তিযোদ্ধা অইছে। এইরহম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাগো কাছে গেলে হেগো থেইকা মিছা কিচ্ছা ছাড়া সইত্যটা আর কী জানবেন! আপনের ব’স তো কম, মনেতো অয় যুদ্ধ দেখেন নাই। মুক্তিযুদ্ধের কথা কি বই পইড়া জানসেন?

-হ্যাঁ মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। বড়দের কাছে শুনে আর বই পড়েই তো জানতে হবে। কিন্তু এ’কথা বললেন কেন?
-কারণ যুদ্ধ হইসে মোটে বিয়াল্লিশ বচ্ছর। অহনতরি অনেক মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন। হেগো কাছ থেইকা আসল কতাটা হোনেন। ক্যান আপনেগো এলাকাত কোন মুক্তিযোদ্ধা নাই? হের কাছ থেইকা হোনেন। তাইলে আসল সইত্য জানবেন। আর এই সইত্য কতাগিলি বইয়ে ল্যাখেন। যদ্দিন এইগুলান না ল্যাখবেন আর ভুয়া লোকের লেখা পড়বেন তদ্দিন এই সমস্যার কোন সমাধান অইবনা। আর অহনে না করলে ভবিষ্যতের আপনেগো পোলাপাইনরা তো আরও উলটাপালটা জানব।
-অনেক দামী কথা বলেছেন । সে কারনেই আজ অনেকে বলে এই কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক মানুষ না। আবার অনেক পণ্ডিত বলে মুক্তিযুদ্ধে নাকি ৩০লাখ লোক মারা যায় নাই। বড় জোড় ৩ লাখ মারা গেছে। আরও কত কী!
বলতে বলতে আমার গন্তব্যে পৌছে যাই।

তিনি আবারও বলে,

-রেডিওত একটা গান হুনছিলাম। ঐসব জ্ঞানী মাইনসেরা এইসব কইলে হেগো হেই গানটার কতা হোনায়া দিবেন
“ আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়” ।

ভাড়া নিয়ে রিক্সাওয়ালা চলে গেলেন। আমি বেশ কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাড়িয়ে থাকি। আসলেই তো সত্যটা কত সহজ। শুধু সেটা বলার সৎসাহস থাকা চাই। এই যা! উনার নামটাতো জানা হলনা।
আমার স্বগতোক্তি শুনে আমার স্ত্রী বলেন,
- কেন উনার নাম তো উনি বলেছেন। শোননি, উনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আর একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার এর চেয়ে বড় পরিচয় আর কি হতে পারে!

বাতাসে মুসলিম বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বিশ হাজার বাঙালীর আত্মা সেই সাক্ষ্য দিয়ে যায় — একজন মুক্তিযোদ্ধার ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়ই সবচে’ বড়।

অভিমন্যু
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি


Comments

দীনহিন's picture

রিকশাওয়ালা ভাইকে স্যালুট।
চৌদ্দই ডিসেম্বর থেকেই অনেক রিকশাওয়ালা ভাইকে বিজয় দিবসের ব্যান্ড পরতে দেখেছি। অনেকের রিকশাতেই দেখেছি লাল-সবুজ পতাকা। ব্যাপারটা কিছুই না। তারপরও মনে হয়, যেন এই দিনগুলোতে আমাদের দেশের খেটে-খাওয়া মানুষগুলো কিছুটা হলেও মুক্তির স্বাদ পায়, অন্তত একটি স্বাধীন দেশের জাতীয় পতাকা তো উড়াতে পারে!
অভিজ্ঞতাটুকু আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ, অভিমন্যু!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

Quote:
আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

এক লহমা's picture

চলুক
"কারণ যুদ্ধ হইসে মোটে বিয়াল্লিশ বচ্ছর। অহনতরি অনেক মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন। হেগো কাছ থেইকা আসল কতাটা হোনেন। ক্যান আপনেগো এলাকাত কোন মুক্তিযোদ্ধা নাই? হের কাছ থেইকা হোনেন। তাইলে আসল সইত্য জানবেন। আর এই সইত্য কতাগিলি বইয়ে ল্যাখেন। যদ্দিন এইগুলান না ল্যাখবেন আর ভুয়া লোকের লেখা পড়বেন তদ্দিন এই সমস্যার কোন সমাধান অইবনা। আর অহনে না করলে ভবিষ্যতের আপনেগো পোলাপাইনরা তো আরও উলটাপালটা জানব।"
অত্যন্ত দামী কথা। যত তাড়াতাড়ি, যত বেশী করে এই সত‌্য গুলি সামনে আসবে, লেখা হবে, প্রচার পাবে ততই জোরদার হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক's picture

অভিনন্দন রিকশাওয়ালা কে। এরকম মানুষ খুব বেশি দরকার আমাদের দেশে।
গবেষক

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ's picture

এরকম মানুষ আনাচে কানাচে ছড়িয়েই আছে। খোঁজ করলেই পাবেন। দেশের বেশীরভাগ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষই তাই। টকমারানীদের কথা না শুনে এদের সাথে গল্প করাও অনেক ভালো।

____________________________

দীনহিন's picture

Quote:
দেশের বেশীরভাগ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষই তাই।

শতভাগ একমত! আমার পর্যবেক্ষন একই রকম! সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষগুলো এ দেশকে টিকিয়ে রেখেছে এখনো, তারাই অর্থনৈতিক সৌধের মূল কারিগর, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলো এমনকি তাদের মধ্যেই প্রবল। অন্যদিকে, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষগুলোই সুবিধাবাদী, সব নষ্টের গোঁড়া! জটিল মারপ্যাচ কষতে কষতে এরা এখন একটি কংকালে পরিণত হয়েছে!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

শব্দ পথিক's picture

Quote:
একজন মুক্তিযোদ্ধার ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিচয়ই সবচে’ বড়।

এটাই বড় সত্য।

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ's picture

ধন্যবাদ অভিমন্যু।

____________________________

মেঘলা মানুষ's picture

Quote:
"যেইটা সইত্য অইসে সেইটা বইখাতাত লেখেন"

গুরু গুরু

আনু-আল হক's picture

গুরু গুরু এই মহান মুক্তিযোদ্ধার প্রতি । সহজ কথা যায় যে বলা সহজে , চাইলেই ।

গান্ধর্বী's picture

অশিক্ষিত(?) এই রিকশাওয়ালাকে শ্রদ্ধা জানাই।
যারা দেশের ইতিহাস নিয়ে ভ্রান্ত ধারণায় থাকে তাদের এই ভদ্রলোকের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক's picture

আসলে সত্য সবসময়ই চিরন্তন তা তথাকথিত শিক্ষিত বা অশিক্ষিতের জন্য একেক রকম হয়না, তাই আমরা সবাই যেদিন এই মহান যোদ্ধার ন্যায় সত্যকে সত্য বা সবকিছু না প্যাচিয়ে সহজভাবে চিন্তা বা বলতে পারব সেদিন আমাদের দেশটা সুন্দর হয়ে উঠবে।

সবাইকে ধন্যবাদ ( পড়া ও মন্তব্যের জন্য)।

অভিমন্যু .
________________________
সেই চক্রবুহ্যে আজও বন্দী হয়ে আছি

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.