কৃষ্ণকলি

গান্ধর্বী's picture
Submitted by gandharbee [Guest] on Wed, 11/09/2013 - 3:27pm
Categories:

কাক না ডাকা ভোরে কলির ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। নিত্যকার অভ্যাস। পুরো বাড়িতে দুটো মাত্র প্রাণী -কলি আর তার পিসি, গত দশটা বছর ধরে যে মানুষটাকে সে নিয়মিত জ্বালাতন করে আসছে আর তিনি মুখ বুজে তার অত্যাচার সহ্য করছেন। অন্য সবার কাছে কলি একটা একাবোকা, পড়ুয়া, শান্ত, মা-মরা মেয়ে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার অনেক জেদ আর সব জেদ খাটে শুধু ঐ নরুন পেড়ে সাদা কাপড় পরা নিরীহ পিসির কাছে। দুদিন ধরে তার সবচেয়ে কাছের এই মানুষটা তার সাথে কথা বলছে না। কেউই তার সাথে কথা বলছে না, সে মহাভারত কলুষিত করে ফেলেছে। কলির খুব মন খারাপ। রাতে অনেক কান্নাকাটির পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে, ঘুম ভেঙ্গেও মন খারাপের ভাবটা কাটেনি।

খালিপায়ে চুপিচুপি দরজা খুলে ছাদের সিঁড়িতে পা দিতেই বিকট শব্দে ফোনটা বেজে উঠল। কলি দৌড়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে কানের কাছে নিল। কোনো সাড়া নেই। ফোনটা রাখতে যাবে তখনই শুনতে পেল

-কলি, কৃষ্ণকলি কেমন আছিস?

কলি চুপ করে রইল। ছেলেটা তাদের প্রতিবেশী, বড়োলোকের বখাটে ছেলে আর কলির ছেলেবেলার বন্ধুও বটে। কিন্তু এখন যে আর ছেলেবেলা নেই, ছেলেবন্ধুও থাকতে নেই। তাই বাবা আর পিসি মিশতে বারণ করে দিয়েছে। তাছাড়া রাশেদের স্বভাবটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। পাড়া-বেপাড়ায় মেয়ে দেখলেই শিষ বাজাবে, পরীক্ষায় ফেল করবে, কিছু হলেই মারামারি করবে! তাই কলিও ওকে এড়িয়ে চলে, যদিও ছেলেটা এখনো আগের মত মিশতে চায়।

-কলি আমি জানি তোর খুব মন খারাপ। তুই চিন্তা করিস না, আমি সব ঠিক করে দিব।
-আমার মন ভাল। তোকে ফোন করতে নিষেধ করেছিলাম না?
-জানিস, আমি তো ছিলাম না, পরে সব শুনেছি! এতকিছু হয়ে গেছে শুনে মাথা ঠিক রাখতে পারি নি। তুই রাগ করিস না…
-তুই কী শুনেছিস? আর তুই করেছিস কী? দাদাকে তাহলে ওভাবে মেরেছিস তোরাই? ছি ছি
-ছ্যা ছ্যা করিস না তো। ও কেন এমন করল তোর সাথে? আর কীসের দাদা রে? তোকে একা পেয়ে তোর হাত ধরে, তোদের ধর্মে না ভাই-বোনে এসব হয় না!
-তোরা কিচ্ছু জানিস না। তার কোনো দোষ ছিল না। আর তুই আমার কে? তোকে আমার চিন্তা করতে হবে না রাশেদ। শেষবারের মত বলে দিলাম।
-আমি সবই জানি। তোর ওই দাদা খুব বদ, তার নজর খারাপ।
-বাজে কথা কথা বলবি না। সে খারাপ না। আমি খারাপ। আমিই তার হাত ধরেছিলাম, তাকে অনুনয় করে বলেছিলাম আমাকে ভাল না বাসতে পারলেও যেন ঘৃনা না করে।
-তুই মিথ্যা কথা বলছিস। তুই জানিস সে আমাকে কী বলেছে? সে বলেছে আমার মত খারাপ ছেলেই নাকি তোর যোগ্য!
-তুই আমার সাথে আর কক্ষনো কথা বলবি না।
-কলি আমি জানি তুই আমাকে দেখতে পারিস না, আমার মত বখাটে ছেলেকে ছোটবেলার বন্ধু বলেও পরিচয় দিস না কারো কাছে। কিন্তু আমি তোকে এখনো বন্ধু ভাবি, হাওয়াই মিঠাই দেখলেই এখনো তোর জন্য কিনতে ইচ্ছা করে!

কলি দুম করে ফোনটা রেখে দিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। পেঁজা তুলোর মত মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। গেইটের পাশে উঠোন জুড়ে একরাশ শিউলী ঝরে পড়ে আছে। কলি কাঁদছে, ঝাপসা লাগছে সবকিছু…শিউলী গাছ, উঠোন, গেইট সবকিছুই ভেসে যাচ্ছে। এমনই সুন্দর একটা সকালে হাতে ব্যাগ নিয়ে তার এক গেঁয়ো কাকার ছেলে, পার্থ তাদের বাড়িতে এসে ঢুকেছিল। এরপর থেকে সবকটা দিন ছবির মত মনে আছে কলির। গ্রামের ছেলে, মফস্বলের কলেজে পড়তে এসেছে, অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়ের দয়ায় সে বাড়িতে তার ঠাঁই হল। থাকবে, খাবে আর তাদের স্কুল পড়ুয়া মেয়েটাকে অঙ্কটা ইংরেজিটা পড়িয়ে দেবে। পার্থ বয়সে তার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। সে যেন এক উপন্যাসের চরিত্র, কলির নিস্তরঙ্গ জীবনে যে রীতিমত বিপ্লব বয়ে আনলো! ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে কলিকে পড়ায়, কলিও পরীক্ষায় বেশ ভাল করে। আর মাত্র কটা দিন, ম্যাট্রিকের রেজাল্ট হলেই সে শহরের সবচেয়ে ভাল কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে, তার পার্থদার কলেজে। কলির অপেক্ষা করে আছে, দিনগুলো যেন আর কাটতেই চায় না। কিন্তু হঠাৎ করে সব বদলে গেল, কেউ যেন জলরঙে আঁকা ঝকঝকে ছবিটা একেবারে ধুয়ে মুছে দিল!
দুদিন আগে যখন পার্থ নিজের কিছু বই ফেরত নিতে কলির কাছে এল, কলি সযত্নে র‍্যাপিং করা একটা বই তার হাতে তুলে দিল। কলির শত উপরোধ সত্ত্বেও ছেলেটা তখনই খুলে দেখল বইটা। প্রথম পাতা খুলতেই থমথমে হয়ে গেল মুখখানা। কলি নিমেষেই বুঝে নিল সবকিছু। সাথে সাথে পার্থর হাত ধরে ফেলে বলল

-দাদা মাফ করে দাও, রাগ কোরো না। প্লিজ!
-এমন জানলে তোর সাথে কখনো মিশতামই না, ছি ছি কৃষ্ণ !! তুই এত খারাপ? তোকে নিজের বোন বলে ভাবতাম। ছি!
-আমাকে ঘেন্না করবে তাই বলে? এমন কোরো না, আমি খুব একা…আমি জানি না তোমাকে কেন এত ভাল লাগে, মন কেন এমন করে…এরকম তো হয় নি আগে কখনো! একটু বুঝিয়ে বলবে না আমাকে?

বলতে বলতে কলি কেঁদে ফেলল! খেয়ালই করল না কখন পিসি ঘরে এসে ঢুকেছে! পার্থ অপরাধীর মত মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এরপর দুদিন পার হয়ে গেছে, তাকে কলি আর দেখতে পায় নি। চলে গেছে ছেলেটা, তাড়িয়ে দেবার আগেই। শুধু শুনতে পেয়েছিল গলির মুখে কারা যেন ওকে খুব মেরেছে! কলি শুনেও কিছু করতে পারেনি, শুধু কেঁদেছে অসহায়ের মত। আর নিজেকে শাপশাপান্ত করছে দিনরাত। তার জন্যই এমন হয়েছে, সে খুব খারাপ মেয়ে, সে কেন বুঝল না যে তার সমাজে এসব চলে না!
গ্রামের বাড়িতে পুজো হচ্ছে, কলিকে তার পিসীর কাছে রেখে বাড়ির সবাই পুজোতে চলে গেছে। কৃষ্ণকলি এখন অচ্ছুৎ, তাকে নিয়ে কি আর পুজো-পার্বণে যাওয়া চলে?! বাবা যাবার সময় তাকে কিছু না বলেই চলে গেলেন। হয়তো ফিরে এসেও কথা বলবেন না।

পড়ন্ত বাদামি বিকেল। আনমনে ছাদে পায়চারি করছে কলি। মিঠাইওয়ালার হাঁক শুনতে পেয়ে হঠাৎ করে কী যেন হয়ে গেল তার! খুব জেদ চেপে গেল! অস্থির পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে এল সে। তারপর গেট খুলে একেবারে রাস্তায়। ওপাশে রাশেদদের বাড়ি। উদ্ভট হলুদ রঙের বাড়িটা কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, এতদিন পর তার চোখে পড়ল! মিঠাইওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে কলি রাস্তা থেকেই রাশেদের নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠলো! মিঠাইওয়ালাও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। রাশেদ গেট থেকে উঁকি দিতেই কলি বলে উঠলো-

-কি রে হাওয়াইমিঠাই খাওয়াবি না? কতদিন খাই না খেয়াল আছে?

রাশেদ সেই আগের মতই প্রথমে প্যান্টের পকেট দুটো হাতড়ে নিল, তারপর উস্কো খুস্কো চুলগুলো দ্রুত হাতে ঠিক করে নিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল।

---------------------------------


Comments

অতিথি লেখক's picture

চলুক
ইসরাত

অতিথি লেখক's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

গান্ধর্বী

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ's picture

আচ্ছা, আপন ভাইতো না, কাকাতো ভাই। কাকাতো ভাই-বোনের প্রেম বা বিয়ে কি নিষিদ্ধ?

গল্প কি আরো এগোতো নাকি?

লেখা ভালো হচ্ছে, চালিয়ে যান।

____________________________

মেঘলা মানুষ's picture

যতটা জানি, কাজিনদের মধ্যে বিয়ে হিন্দুধর্মে নিষেধ।
খৃ্ষ্ট ধর্মানুসারেও ফার্স্ট কাজিনদের মাঝে বিয়ে ট্যাবু।

@লেখক, লেখার বর্ণনা ভালোই লাগছিল, আরেকটু সময় ধরে পড়তে পারলে হয়ত ভালোই লাগত।
আরো লিখুন।

অতিথি লেখক's picture

হুম কাকাতো-মামাতো ভাই বোনে প্রেম/বিয়েতে নিষেধ আছে।
ঠিকই বলেছেন, গল্পটা মনে হচ্ছে হঠাৎ করে শেষ করে দিয়েছি! কিন্তু ভাল হচ্ছে জেনে ভাল লাগল, ধন্যবাদ হাসি

গান্ধর্বী

অতিথি লেখক's picture

কাকাতো-মামাতো ভাই বোনে প্রেম/বিয়ে নিষিদ্ধ।
হ্যাঁ, গল্প আরেকটু এগোতে পারতো!
ধন্যবাদ হাসি

গান্ধর্বী

সাক্ষী সত্যানন্দ's picture

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

গান্ধর্বী

সুবোধ অবোধ's picture

চলুক....

অতিথি লেখক's picture

হাসি

গান্ধর্বী

এক লহমা's picture

গল্প ঠিক আছে। তবে, কলির কাছ থেকে চলে গিয়ে রাশেদ-এর হাতে মার খাওয়ার অংশটুকুর আর একটু বিস্তার, পার্থ কি ভাবে রাশেদ-এর সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে এবং মার খাওয়ার আগে পরে তার সংলাপ-প্রতিক্রিয়া, সেটা কি ভাবে কলির কাছে আসে - এই টুকু বুনে দিতে পারলে এ গল্প আরো অনেকটা উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা রাখে। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক's picture

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য হাসি

গান্ধর্বী

অতিথি লেখক's picture

চলুক

রাসিক রেজা নাহিয়েন

অতিথি লেখক's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

গান্ধর্বী

অতিথি লেখক's picture

ভালো লাগলো। কিন্তু এত হুট করে শেষ হয়ে গেলো?

অতিথি লেখক's picture

মন খারাপ
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

গান্ধর্বী

অতিথি লেখক's picture

একটু ছোট হয়ে গেল। তবে ভালো লেগেছে।
চলুক

-ছায়াবৃত্ত

অতিথি লেখক's picture

পরের বার ঠিকঠাক সমাপ্তি টানার চেষ্টা থাকবে হাসি
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

গান্ধর্বী

অতিথি লেখক's picture

ভালো লাগছিলো, কিন্তু হঠাৎ করেই শেষ করে দিলেন। আমি যতদূর জানি, ফার্স্ট কাজিনের মধ্যে বিয়ে হয় না, গল্প পড়ে মনে হলো এরা ফার্স্ট কাজিন নয়।
ভালো থাকুন।

-নিয়াজ

অতিথি লেখক's picture

হুম শেষটা ঠিকঠাক হল না, সবাই বলছেন মন খারাপ যাই হোক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ

গান্ধর্বী

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.