লাশকাটা ঘরে

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Sat, 20/04/2013 - 10:54pm
Categories:

অনেক ক্ষণ ধরে আমি এই বিশাল রুমটাতে একলা আছি। মাঝখানে একজন বামুন টাইপ লোক এসে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে গেছে । তীব্র ফিনাইলের গন্ধ পাচ্ছি । কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো কাজ শুরু হয়ে যাবে ।
মাথার উপর একটা বিশাল ফ্যান ঘড় ঘড় শব্দ করতে করতে ঘুরে যাচ্ছে।যতটা না বাতাস পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে শব্দই বেশী হচ্ছে । রুমের দেয়ালে চুনকাম করা। সেখানে এক কোণায় দেখতে পেলাম লাল কালিতে বড় বড় করে লেখা
'' প্রত্যেক প্রানীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে "
-সূরা আল ইমরান
চারপাশে কাচের অনেক বড় বড় জার। সেগুলোতে ফরমাল্ডিহাইডে মানুষের বিভিন্ন অংঙ্গ প্রতঙ্গ সংরক্ষণ করা আছে। সামনে একটা বেদির মত আছে, সম্ভবত এখানেই ব্যবচ্ছেদ করা হবে সাধের এই মানব শরীর।
হ্যা, আমার অবস্থান এখন কোন এক ময়না তদন্তের ঘরে, যেখানে মৃত মানুষকে নিয়ে আসা হয় অপঘাত মৃত্যুর করুন পরিণতি জানার জন্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ আমার অবস্থান এখানে ।
অসাড় এই মস্তিস্কে এক বিখ্যাত কবির কবিতার কিছু এলোমেল লাইন ঘুরপাক খাচ্ছে,

'' শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে
কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ্‌
-------------
-----------
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে- গুমোটে
থ্যাঁতা ইদুরের মত রক্ত মাখা ঠোটে !
-------------------
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিত হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের 'পরে ।।''

জীবনান্দ দাশের কবিতার সাথে এখানের সবকিছু যেন মিলে যাচ্ছে ।

আচ্ছা কারই বা মরিবার সাধ জাগে শুধুশুধু !! এই ইচ্ছাকৃত মৃত্যুবরনের ফলাফল হল এই অটোপ্সি রুমের বদ্ধ প্রকোষ্ঠ যেখানে অপেক্ষা করতে হবে কিছু ধারালো জিনিসের অত্যাচার আর শব ব্যবচ্ছেদ ।
শুনেছি ব্যবচ্ছেদের প্রথম পর্যায়ে দেহটিকে একটি ধারালো সিজার থুতুনি থেকে উরুর শেষভাগ পর্যন্ত চিরে ফেলে ডোম । একে বলে '' I " টাইপ ইনসিসন।এখানে ইংরেজি হরফ ''I'' এর মত কাটা দাগ হয় বলে এরুপ নামকরন করা হয়েছে। এছাড়া আরো দুইরকম আছে, যথাক্রমে '' Y " ও মোডিফাইড Y । দেখা যাক আমার কোনটার অভিজ্ঞতা হয় ।

একটা মাছি ভনভন করে ঘুরপাক খাচ্ছে মুখের চারপাশাটাতে, দূরে দেয়ালে এক পেটমোটা টিকটিকি টিক টিক করে ডাক দিল। আচ্ছা তারা কি একটু হলেও আঁচ করতে পারছে কিছুক্ষণ পর এখানে কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য রোমান্থিত হবে !!বাইরে কিছুটা বিলাপের শব্দের মত শুনতে পেলাম বলে হল। খুব সম্ভবত অন্য মৃতদেহের সাথে আসা স্বজনদের কান্নার আহাজারি ।আমি শুধু দেখে যাচ্ছি। নাহ আমার এখনে কিছুই করার নাই, আমি শুধু একজন অবজারভার !!!

বেচে থাকতে আমরা নিজের জীবন নিয়ে কতটাই বা চিন্তা করি ! কি করছি না করছি তার কতটা হিসেব রাখতে পারি !! ভালো মন্দের জগা খিচূড়ি তে ডুবে থাকি। তখন সর্বময় ক্ষমতা থাকে আমাদের হাতে, নিজের জীবন নিয়ে যা খুশি করব । তখন হয়তো একজন অবজারভার আমাদের দেখেন আর মুচকি হাসেন ।
যাই হোক এই ফিলোসফি কপচিয়ে লাভ নেই, এটা ফিলোসফির ক্লাশ না, মরা কাটার ঘর। এখানে এসব চিন্তা করা অর্থহীন।দরজায় বুটের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কে আসে দেখার জন্য, হয়তো অন্তিমকাল উপস্থিত।
এক স্টুডেন্ট দড়জা দিয়ে উকি দিয়ে আমাকে দেখে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে সাথেসাথে চলে গেল। আমাকে বোধহয় এই অসময়ে সে প্রত্যাশা করেনি।বেলা তিনটার মত বাজে, এইসময় ও যে অটপ্সি হতে পারে সেটা মনে হয় তার অজানা ।।

অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। একজন বেটে মত মাথায় চুল কম ফরেনসিক স্পেশালিস্ট মর্গে ঢুকলেন ডোমের সাথে।এই মেডিকেলের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের প্রধান সে । সুরতহাল রিপোর্টটা একনজরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। এরপর ডোমকে নির্দেশ দিতেই বামুন টাইপ ডোম বেদিতে রাখা ডেড বডিটার উপর লাফ দিয়ে চড়ে বসলেন একটি ধারালো সিজার হাতে। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করলাম । আর সহ্য করা সম্ভব নয় ।

আমি এই মেডিকেলেরই চতুর্থ বর্ষের ছাত্র, সামনে দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষা। পরীক্ষাতে বসার আগে নূণতম ১০ টি অটোপ্সির অভিজ্ঞতা অর্জন করা লাগবে, আইটেম কার্ডের খালি ঘরগুলা পূরণ করা লাগবে, তা ছাড়া কোনভাবেই ক্লিয়ারেন্স দিবে না বলে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রচন্ড ফাকিবাজ হওয়াতে একটাও পূরণ করা হয়নি । তাই মেকআপ করার জন্য আজকে এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অর্জন করতে আসতে হয়েছে এখানে একা। কি আর করব, বন্ধু বান্ধবদের তো খালি ঘরগুলা সব পূর্ন করা আছে !!!

শেষ কথা -

গল্পের সাথে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটা কথা । আমাদের দেশে ফরেনসিক এক্সপার্টের সংখ্যা খুব কম, হাতে গোনা। বড়বড় সরকারী মেডিকেলে প্রয়োজনের তুলনায় ফরেনসিক এক্সপার্ট সবসময়ই কম ছিল , থাকছে এখনো । কয়েকদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম ফরেনসিকে মহিলা ডাক্তারের নাকি খুবই অভাব, সেখানে একজন নির্যাতিত নারী যখন ধর্ষনের পর শরীর পরীক্ষা করাতে আসেন মেডিকেলে, সেখানে পুরুষ এক্সপার্টের কাছে নাকি আবার ধর্ষিত হয় পরীক্ষার সময় । কিন্তু আপনিকি জানেন এম, বি, বি , এস পাশ করার পর যখন একজন ডাক্তার ফরেনসিককে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের সাবজেক্ট হিসেবে বেছে নেয় তখন কতটা অনিশ্চয়তার মাঝে তার ক্যারিয়ার চলে যায়। তারই বন্ধু যখন মেডিসিন সার্জারিতে এফ, সি, পি এস করে একের পর এক রোগী দেখে টাকা কামিয়ে নিতে থাকে, তখন তার অবস্থান হয় মর্গের ঐ বদ্ধ প্রকোষ্ঠে।সে কথা বলে ঐ মৃত মানুষগুলার সাথে। কখনোবা তাকে সমর জারি করে নিয়ে যাওয়া হয় আদালতে সাক্ষী দেয়ার জন্য।এক্ষেত্রে তার কনভেন্স ও হয় নামমাত্র । সুতরাং তাকে পুরোপুরি নির্ভর করা লাগে সরকারী দুই পয়সার বেতনের জন্য । এজন্য অনেকেই আজকাল এই পেশায় আসতে চান না, এইসব জটিলতা দেখে মেয়ে ডাক্তাররা তো আরো আগে মাথা থেকে ফরেনসিক এক্সপার্ট হওয়ার চিন্তা ঝেড়ে ফেলেন। তবুও এখন অনেক নারী এই পেশায় আসছেন, তাদেরকে সাধুবাদ। আর একজন ডাক্তারকে ডাক্তার হিসেবেই মূল্যায়ন করা উচিত, নারী কিংবা পুরুষ না। তাই তাদের ধর্ষক বলার আগে অন্তত একটিবার ভেবে দেখুন !!!

-আয়ন


Comments

অতিথি লেখক's picture

চলুক

সুবোধ অবোধ

আয়ন's picture

ধন্যবাদ হাসি

অপ্রকৃতিস্থ's picture

ভালো লেখা হইছে আয়ন!

আয়ন's picture

ধন্যবাদ হাসি হাসি

অতিথি লেখক's picture

অনেক ভাল লাগলো।

Quote:
সেবাই হোক মানুষের প্রকৃত ধর্ম।

-----------------------------------
মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান

আয়ন's picture

অনেক ধন্যবাদ অতিথি হাসি

ব্যাঙের ছাতা's picture

ভাল লেগেছে।

আয়ন's picture

ধন্যবাদ হাসি

অতিথি লেখক's picture

ভালো লাগল । আপনার লেখনী, গল্পের থিম,বর্ণনা, উপসংহার- সবটাই । চালিয়ে যান ।

তালেব মাষ্টার

আয়ন's picture

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আপনার মন্তব্য পড়ে অনেকটাই অনুপ্রাণিত হলাম। হাসি

বাকা 's picture

খুব ভালো একটা লেখা লিখেছ। প্রাসঙ্গিক।

আয়ন's picture

ধন্যবাদ বাকা , আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.