কবি মঈন চৌধুরীর জন্য গল্পঃ সুবোল সখার বিয়ে বৃত্তান্ত অথবা জলপরির জলকথা

কুলদা রায়'s picture
Submitted by porimanob [Guest] on Sat, 29/09/2012 - 1:38am
Categories:

বেলগাছটির অবস্থান ঈশান কোণে। রুয়েছিলেন দীননাথ। সেটা পঞ্চাশ সালের ঘটনা। তখনও আইয়ুব খানের পয়দা হয়নি। চাঁদে আমেরিকা পৌঁছায়নি। চীন আর রাশিয়া নামক দুটি দেশে একই বৃষ্টির ফোঁটা পড়ত। সোহরাওয়ার্দ্দী বড় নেতা। দীননাথ বিয়ে করেছে তার মায়ের অনুরোধে। কৃষ্ণলীলা পালাগান করার ফলে দীননাথের ধারণা ছিল—বিয়ে করার কোনো মানেই হয় না। স্ত্রী হৈমবালাকে বাড়ি আনার পরে একদিন মধ্য রাতে বলেছিল, রাধাকৃষ্ণর প্রেম—নিকষিত হেম। তুমি আমাকে কৃষ্ণজ্ঞানে ধ্যান করিও। তবুও সে বছরই হৈমবালা তাকে বিস্মিত করে গর্ভধারণ করে। একটি পুত্র সন্তানের জননী হয়। তারও বছর দেড়েক পরে আরেকটি পুত্র তার কোলজুড়ে আসে। তাদের নাম রাখে—সুবোল সখা ও সুদামা সখা। এরপরই একদিন দীননাথ গোলারগাতীর বাবুরাম পাগলের আশ্রম থেকে সুফলদায়ী বেলগাছের চারাটি রুয়ে জলদান করল। আর সেদিন ভোররাতেই হৈমবালাকে জাগ্রত করে বলল, তাইলে হৈমবালা আমারে বিদেয় দেও। এ সংসারে থাকার দায় আমার মিটে গেছে।

হৈমবালার দুপাশে দুপুত্র সুবোল সখা আর সুদামা সখা তখনও মাই মুখে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। উঠতে গেলে ডুকরে উঠেছে। ওঠা যাবে না। যেমন করে প্রতি ভোর রাতেই বলে, সে রকম করে বলল, তুমি গেলে আমাগো কী উপোয় হইবে গোসাই?

দীননাথ নিরাসক্ত গলায় বললেন, কৃষ্ণ দেখবেন। কৃষ্ণ সুবোল আর সুদামার বাল্যসখা। তিনিই সহায়। এ কথা জানিবা নিশ্চয়। তারপর গুপ্তকথার মত আজ একটু বেশী বলে গেলেন, এই ব্যাল গাছটার পরথম ব্যাল ধরলি তোমার সুবোলের বিয়া দিও। ঝড়, বৈন্যা, খরা বা অভাব নিয়া ভাইবো না।

হৈমবালা বলল, আইজ কাঁটা বেগুন দিয়া শিং মাছ রান্ধুম। সকাল সকাল ফিরো গো গোসাই। শিশু সুবোল এই সময় পাশ ফিরে শুয়েছে। সুদামা সখা মুখের মধ্যে চুক চুক করছে। দীননাথ এই ভোরের হাওয়ায় নিমাই দাঁড়ারে গানটি গাইতে গাইতে চলে গেছে। কেউ শুনেছে বলে জানা নাই নাই।

হৈমবালা এই কথাটা মনে রেখেছে। দীননাথের এরপরের গতিপ্রকৃতি আর জানতে পারে নাই। এর মধ্যে মূলাদীর নদী লাল হয়ে গেছে। তাড়্গ্রামে কিছু লোককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে সময় একদিন প্রতিবেশী বশার মিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, বৌদি, দীনদাদা মুসলমান হোলি আমরা তার কুলখানি করতাম। আপনে গো ধর্ম মতে যা যা করণ লাগে কইরা ফেলান।

এর বেশী কিছু বলার দরকার ছিল না। সেকালে কালেক্টরেটের গোপন নথিতে লেখা হয়েছিল—‘তাড়্গ্রামে ১৯৫৬ সালে ভয়ংকর রায়ট হইয়াছিল। সে রায়টে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হইয়াছিল।‘ এসব কিছুই হৈমবালার গোচরীভূত ছিল না। যা কিছু জমি সম্পদ ছিল তা বরগা দিয়ে আউশ ধান—আমন ধান যা পেত তা দিয়ে সাংবাৎসরিক আধা খোরাকি জুটত। আর বাড়ি বাড়ি মুড়ি ভেজে, চিড়া কুটে, কাঁথা সেলাই করে, কাসুন্দি বানিয়ে সুবল-সুদামাকে নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। ফলে এর আগে বা পরে তার কখনও সিঁদুর পরার দরকার পড়েনি—ত্যাগ করারও প্রশ্ন ছিল না। কৃষ্ণই তাকে মেলেটারীর হাত থেকে রক্ষা করেছে। কৃষ্ণই তাকে অভাবের দিনে ফ্যান ত্যালানি খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। কৃষ্ণের ইশারায়ই তার বড় ছেলে সুবল সখা মোহন মিয়ার রেশনের দোকানে কাজ পেয়েছে। সেখানে কাজ করে এখন চেকনাই খুলেছে। সুদামার কপালে বৈরাগীর ফোঁটা উঠবে উঠবে করছে। এই রকমই একটি দিনে ঈশান কোণের বেলগাছটিতে বেল পাকলো। সুবোল রাত দশটায় মোহন মিয়ার দোকান থেকে ফিরলে হৈমবালা বলল, আর তো দেরী করনের উপোয় নেই রে বাবা, অক্ষণি তর বিয়ার আয়োজন করণ লাগে।

সুবোল সখা হাম হুম করে কাটা বেগুন আর শিং মাছের ঝোল দিয়ে রেশনের চালের ভাত খাচ্ছিল। সে কিছুই বলল না। তার হাই উঠেছে। ঘুমিয়ে পড়ল নাক ডেকে। এর দুমাস পরে আষাঢ়ী পূর্ণিমার দুদিন আগে দীঘার কুলের রামচন্দর ঘটক রূপোহাটির সম্বন্ধ আনল। সে সময়ে মোহন মিয়ার রেশনের দোকানে এতো বড় ভিড় ছিল যে—সুবোলের অবসর ছিল না। মহাজন মোহন মিয়া শুধু বলে দিলেন, মাইয়া দেখার কিছু নাই। বিয়ার সোমায় একবারেই দেখলেই হবে। মাইয়া দেখনেরই বা কী আছে। মাইয়া তো মাইয়া। দীননাথের বংশের কেবা কবে এ ধরনের মেয়ে দেখেছে? আর এই আকালে বিয়া-তে কেউ রাজী হচ্ছে সেইটাই বড় কথা। বিয়ায় সুবোল সখার মা হৈমবালার কোনো চাহিদা নাই। মানুষের কাছে চেয়ে কী লাভ। জীবনে কারো কাছে কখনও কিছু চেয়েছে বলে মনেও করতে পারে না। যখন দরকার কৃষ্ণই তাকে দিয়েছে–কৃষ্ণই তার সুবোল সখা আর সুদামা সখাকে দেবে। রামচন্দর ঘটক শুনে বললেন, তা কিরে হয় ঠাইরেন? দেয়া-থোয়া ছাড়া বিয়া কী করে হয়? মান সম্মান বলে একটা ব্যাপার আছে না! হৈমবালা তার উত্তরে বলল, যারা বরযাত্রী যাবে তাগো পেট পুইরা চাট্টি দীঘা ধানের ভাত খাতি দিলেই হবে। লগে তাজা মাছের তরকারী হইলে আরো ভালো হয়। রেশনের চাল খাতি খাতি সবার পেটে চর পইড়া গেছে।

ফলে শ্রাবনের মাঝামাঝি বোড়াশী গ্রামের সন্তোষ মিদ্দের ঠাকুর্দার আমলের বাছাড়ি নৌকা ঘাটে এলো। পাড়ার বিশিষ্ট মোহরি শ্রী অনিল মণ্ডলের কলেজ পড়ুয়া শালা নিমাইও বরযাত্রী যাবে বলে নৌকার মাঝখানে একটা ছঁইও তৈরী হল। ভোরবেলা রামচন্দর ঘটক এসে তাড়া দিল বেলা মধ্য গগণে থাকার আগেই রওনা হতে হবে। রূপোহাটি গ্রামটি খুব কাছে নয়। যেতে ঘণ্টা চারেক লাগবে।

সে সময়ে মোহন মিয়ার রেশনের দোকানে নতুন মাল আসবে। চাল, আটা, আর লবণ। সামনে ফুড অফিসার বসে আছেন। কার্গো ঘাটে ভিড়লে রক্ষীবাহিনীর কমান্ডার এসে চেক করবেন । মাল উঠবে পুলিশের সামনে। লাইন ধরে বিতরণ হবে। একটু এদিক ওদিক হলেই মাল লুট হতে পারে। কিছু মাল পাচার হতে পারে। সরকার বলেছে, এক তিল এদিক ওদিক হওয়ার যোগাড় নেই। মোহন মিয়া সুদামাকে বলে দিলেন, তোরা রওনা হইয়া যা। আমি মালামাল সৈর কইরা আরেকটা নৌকায় সুবোলরে নিয়া আইসা পড়ব।

বেলা মাঝ গগণে ওঠার আগেই বাছাড়ি নৌকাটি রওনা হয়ে গেল বিয়ের বর সুবোল সখাকে ছাড়াই। বরযাত্রী যাওয়ার কথা এক কুড়ি, হয়ে গেছে সোয়া দুই কুড়ি। মাঝি বাড়ির মাথার বাই-লাগা গোলোকও উঠেছে। সঙ্গে তার বাবা আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম পাড়ায় রিলিফ আনতে ছুটেছে। গোলোকের মা তাকে একা পাঠাতে রাজী ছিল না। সুদামা বলল, গোলোক নৌকায় আইসা বইছে। অরে নামাইয়া নেবেন ক্যান কাকী। যাক আমাগো লগে। আমরা দেইখা রাখব। চিন্তা করবেন না। ঘটক রামচন্দর সুবলের মাকে নৌকা ছাড়ার সময়ে হেঁকে বললেন, সুবোলরে উঠায় দিয়েন। দেরী করলি লগ্ন চইলা যাইবে। সেটা একটা কেলেঙ্কারি ব্যাপার হইবে। এই কথার মাঝেই বাছাড়িতে হেইয়ো বলে হাঁক পড়ল। ঘাটে হৈমবালা জুকার ধরল। ঠিক সে সময়েই ছৈয়ের মধ্যে আরেকটি জুকার শোনা গেলো। মেয়ে কণ্ঠ। কিন্তু এই যাত্রায় কোনো মেয়ে রাখা হয়নি। সুবোলের মামা শ্যামচরণ আজ বিয়ের গার্জেন। তিনি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন, নৌকার মইদ্যে মাইয়া আইল কৈথিকা?

কেউ মেয়েদের দেখতে পাচ্ছে না। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এর মধ্যে নৌকার খোলের একটি পাটাতন ঠেলে দুটো মেয়ে জুকার দিতে দিতে মাথা উঁচু করেছে। তাদের দাখে শ্যামাচরণ চমকে উঠলেন। বললেন, বাছাড়ি থামা।
বাছাড়ি থামানো যাবে না। পেছন ফেরা অমঙ্গল। হৈমবালা বললেন, যাউক না, অরা গূড়াগাড়া মাইয়া। একটু হাউস হইছে। তোমারা অগো দেইখা রাইখো গো দাদা। দুর্গা দুর্গা।

বাছাড়ি তখন নিচুপাড়ার খাল ধরে চেচানিকান্দির মুখে পড়েছে। ফকির মুন্সীর মাইজা পোলা রহিম ফকির সুদামার বাল্যসখা। আজ গামছা মাথায় দিয়ে পাগড়ি করেছে। সে বলল, মাইয়া ঝুত না থাকলি বিয়া বিয়া মনে হয় না। ফলে মাইয়া দুটো সুড় সুড় করে ছৈয়ের ভিতরে এসে পড়ল। বড়টির নাম সুলেখা রানী। ছোটটির নাম সুমতি রানী। এরা দুবোন। সুবোল সখার মাইসাতো বোনের ননদ। সুবোল সখার বাড়িতে গেলো বছর খানেক আসা যাওয়া করছে। মাঝে মাঝে পালা কীর্ত্তনের খ্যাপে যায়। সুলেখা রানী সাজে শ্রীরাধা। সুনিতি সাজে সখি বিশাখা। সুলেখা বলল, ভালো মন্দ সগোল তোমরা একারাই খাবা? আমাগো কি খাওয়ার হাউস জাগে না?

পড়শি অনিল মুহুরির শালা শচীন তখন ব্যাগ থেকে বের করেছে ছোট্ট রেডিওটা। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোলকাতার আকাশ বানী ধরার চেষ্টা করছে। সেখানে জল-হাওয়ার খবর হচ্ছে। এর পরেই ঢাকা বেতারে স্থানীয় সংবাদ পাঠ করছেন সরকার কবির উদ্দিন। কৃষি মন্ত্রী আব্দুল মোমেন আশা প্রকাশ করেছেন—এ বছর গেলো বছরের মত ভয়াবহ বন্যা হবে না। ফসল ভালো হবে। বার্মা থেকে সরকার চাল আমদানীর চেষ্টা করছে। সরকার নিয়ন্ত্রিত ন্যায্যমূল্যের দোকানে রক্ষীবাহনীর সহায়তায় মালামাল বিক্রয়ের অগ্রগতি সন্তোষজনক। কোনো প্রকার কালোবাজারী বা কারচুপি সরকার সহ্য করবে না। মন্ত্রী নিজেই সব তদারকী করছেন। ইত্যাদি। সুলেখা বলে উঠল, একটা গান দ্যান। ভাবের গান। কচকচানি ভালো লাগে না।

শচীন তার দিকে তাকাতেই সুলেখা রেডিওটা নিল। নব ঘুরিয়ে একটা গান পেয়েছে। শচীন কর্তা নামের কে একজন একটু চিকন গলায় গাইছেন–
কে যাস রে ভাটি গাঙ্গে বাইয়া
আমার ভাই বইনরে কইয়ো নাইয়র নিত বইলা।

এই গানটা শুনে রহিম ফকিরের কান খাড়া হয়ে গেল। বিকেল এ্কটু পড়ে এসেছে। বিলের মধ্যে শাপলা ফুটেছে। আকাশে চিল উড়ছে। কোনো এক বোন বাপের বাড়ি যেতে পারছে না বহুদিন। নদীর কুলে বসে নৌকাগুলোকে আকুল হয়ে বলছে—তাকে নিতে আসার খবরটি তার ভাইদের কাছে পৌছে দিতে। এইখানে এসে রহিম ফকিরের চোখ থেকে পানি ঝরছে। তার মনে পড়ছে তার মাইজা বোনটিকে গেলো বছর নাইয়োর আনতে যেতে পারেনি। তারা নিজেরাই তখন ফ্যান ত্যালানি খেয়ে বেঁচে আছে—বোনকে এনে কী খেতে দেবে। তার দাদাজান ইন্তেকাল হয়েছেন। দাদিজান ইন্তেকালের পথে আছে। ছোট চাচা ঢাকায় পথে ঘাটে ঘোরে। সেই বোনটিই গানের ভেতর দিয়ে কাঁদছে।

এর মধ্যে রামচন্দর ঘটক সুবোলের মামা শ্যামচরেণের সঙ্গে শলা করতে লাগল, যদি লগ্ন সরে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয় এবং সুবোল সখা আসতে দেরী করে তাহলে কী করা যেতে পারে? শ্যামচরণ এ বিষয়ে চিন্তিত হতে রাজী নন। তিনি বললেন, মোহন মিয়া মহাজনের কথায় কখনও নড়নড় নাই। যে ভাবেই হোক না কেনো লগ্নের মধ্যেই সুবোল সখাকে নিয়ে তিনি এসে পড়বেন। সুবোল হুক্কায় টান দিতে দিতে চোখ বুজে গান শুনবেন। বললেন, কিরে ব্যাডারা, খোলা ঝিমায়ে গেলো কেনো? অভাব কী অখনো শেষ হয় নাই? অখন অব্দি কী সক্কলডির শরীলে জোর ফেরে নাই? জোরে গা।

শুনে রহিম শাহ এবার জোরে গেয়ে উঠল—
শুক বলে আমার কৃষ্ণ মদন মোহন।
সারী বলে, আমার রাধা বামে যতক্ষন
নইলে শুধুই মদন।
বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের।

সামনের বৈঠাদারের যায়গায় বাই-লাগা গোলোককে বসিয়ে দিয়েছে। সবার তালে তাল মিলিয়ে মাঝে মাঝে বৈঠা ফেলছে জলের মধ্যে। আবার মাঝে মাঝে চুপ করে বসে থাকছে। হঠাৎ তার মনে হল তার বৈঠা শক্ত কিছুর উপরে পড়েছে। সেটাকে ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে যাবে তার আগে নৌকাটা এগিয়ে গেছে। বৈঠাটা না মেরে সেদিকে চেয়ে রইল। তার পেছনে হরষিৎ। মুখে সবে বিড়িটা রেখেছে। ইশারা করে গোলোককে শুধালো, সে থেমেছে কেনো? গোলোক কিছু বলল না। পেছনের জোতে হালদারকে ডেকে বলল, দেখতো খুড়ো—কি যেন একটা ঠেকল। জোতে হালদার দেখতে পেয়েছে। জলের নিচে একমাথা কালো চুল। চুলের মধ্যে লাল ফিতা। মুখ দেখা যায় না। মনে মনে বলল, দুগগা, দুগগা। গোলক তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল, ও কিছু না রে গোলোক। কইষা টান দে। বিয়া বাড়ির খাওন ধরতি হবে। গোলোক জলের দিকেই তাকিয়ে আছে। জোতে হালদারের কথা সে বিশ্বাস করেনি।

রামচন্দর ঘটক বিয়ে বাড়ির সম্ভাব্য লোভনীয় খাবারের গল্প করেছেন। তিনি বলছেন, বিলা মাছ, দীঘা ধানের ভাত, সাক্কর কোরা চাইলের পায়েস। দেরী নাই। যাইয়া দেখবা রান্না রেডি। বিয়ার পরে খাসির মাংস। সবাই বলে উঠল—হেইও। আর রহিম ফকির গেয়ে চলেছে—
শুক বলে আমার কৃষ্ণের চুড়া বামে হেলে।
আর সারী বলে, আমার রাধার চরন পাবে বলে,
চুড়া তাইতো হেলে।
বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের। ।

এই গানের ফাঁকে সুনিতি দিদি সুলেখারানীর চুলে বেনী করে দিচ্ছিল। একটা লাল ফিতা দু বেনীতে বাঁধল। সুলেখার কানে কানে বলল, খিদা লাগছে গো দিদি। শচীন কানে রেডিও দিয়ে কৃষি সমাচার শুনছে। অন্য কোথাও তার মন নেই। সুদামা বলল, মাইয়া কি না খাইয়া আইছে? সুনিতি বলল, ভালো মন্দ খাওনের কথা শুইন্যাই তো পাগোল হইয়া আছি। খাইয়া আসি কেমনে!

দেবে না দেবে না করেও তিনটি নোচনার হাড়ি বেঁধে দিয়েছে হৈমবালা। এ গুলো বিয়ে বাড়ীর ভেট। সুলেখারানী একটা হাড়ির বাঁধন অতি সন্তর্পনে খুলে ফেলল। হাত ঢুকিয়ে কিছু মুড়ি আর বাতাসা বের করে আনল। নিজে এক খাবলা মুখে দিল। আর দুকোষ সুনিতির দিকে এগিয়ে দিল। দিতে গিয়ে শচীনের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। শচীন ধড়মড় করে পড়েছে। তার গায়ে সুলেখা রানীকে পড়তে দেখে একটু শিউরে উঠেছে। সুনিতি একটু মুচকি হাসছে। তাই দেখে শচীনের মুখ লাল হয়ে গেছে। সুনিতি একটু ঠেরে ঠারে শচীনকে বলল, পড়ছে তো পড়ছে মাইয়া মানুষ পড়ছে। বাঘ ভাল্লুক তো আর পড়ে নাই।

সুলেখা রানী এ কথায় শচীনের গা একটু ঝেড়ে দিতে গেলো। বলল, ব্যাথা পাইছেন? শচীন ছিটকে ছৈয়ের দিকে সরে গেলো। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। শেষে রেডিওটা একবার বাঁ কানে—আরেকবার ডান কান করতে লাগলো। রহিম ফকির ছৈয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল, আমারেও দুগগা দ্যাও গো দিদি। শ্যামাচরণ গার্জেন হিসেবে এটা পছন্দ করছেন না। এই বাজারে মুড়ি খৈ বাতাসা দানাদার যোগাড় করা চাট্টি খানি কথা নয়। বিয়ে বাড়ি পৌঁছানোর আগে শেষ করাটা ভালো কথা নয়। কঠিন কিছু বলতে যাবেন তার আগে রামচন্দর ঘটক হাত পেতে বসেছেন। বলছেন, মেলাদিন বৌয়ারী ধানের মুড়ি খাই না। ঢ্যাপের খৈ খাতি খাতি বিমুখ হইয়া গেছি।। তিনি এই বলে দুহাত ভরে মুড়ি আর বাতাসা নিলেন। দুটো বাতাসাও চেয়ে নিলেন। সুলেখাকে আশীর্বাদ করে বললেন, আহা লক্ষ্মীমতি মাইয়া, তুমারে এবারের আশ্বিনেই বিয়া দিমু। এই কথায় সুলেখা শচীনের দিকে তাকাল। শচীন চোখ বুজে আছে। সুদামা বৈঠা তুলে অপেক্ষা করছে। তাকে সুলেখা রানী উপেক্ষা করে গেলো। শ্যামচরণ মুড়ির সঙ্গে একটা দানাদারও পেয়েছেন। একটু ভেঙ্গে মুখে দিয়ে বললেন, আহ।

সুদামা তখন সুলেখাকে বলল, আমারে না দেও ক্ষতি নাই—ওই গোলোকরে দেও। ওতো কোনোদিন চাইয়া খায় না। দিলে খায়। সুলেখা বলে উঠল, পোলায় না কান্দলে মায়েও দুধ দেয় না।

শ্যামচরণকে রামচন্দর ঘটক বললেন, আপনের বিয়াতে পাঠগাতীর নারাণ ময়রার দানাদার নিছিলেন। হেইডার স্বাদ অখনো জিবে আছে। শুনে শ্যামচরণ মাথা নাড়লেন। তারও মনে আছে। সেবার ছয়টি নোচনার হাড়ি নেওয়া হয়েছিল। লোকজন খেয়ে ধন্য ধন্য করেছিল। তার নতুন বউ বায়না ধরেছিল, বাপের বাড়ি ফেরার সময়ে পাঠগাতী হয়ে যেতে হবে। নারাণ ময়রার দোকানে বসে দানাদার খাবে। সে সময়ে গরুগুলো ছিল নধরকান্তি। জিন্নার মন্ত্রী যোগেন মণ্ডল তখনো প্রাণ ভয়ে দেশ ছাড়ে নাই। আইয়ুব খানের ইরি ধান আসে নাই। আকাশে মেঘ ডাকলে কৈ মাছ ডাঙ্গায় উঠে আসে। মাছগুলো ঢাকা শহরে যাওয়া শুরু করে নাই। মেনা শেখের জারির পালা শুনে লক্ষণ দাসের হাতি শুয়ে পড়েছিল। শেষে সে হাতি উঠেছিল এক মন দীঘা ধানের ভাত দেখে।

সুদামা শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, হাতি ভাত খায়। শ্যামচরণ জবাব দিল, খাবে না ক্যান? হাতি ভাত খাওয়া শুরু করল বইলাইতো দ্যাশে অভাব নামল। আগে কী এইরকম লক্ষ্মীছাড়া অভাব ছেলো নাকি!

রহিম ফকির গান শেষে বলে উঠল, মারো টান হেইও–পেট পুইরা খাইও। এইভাবে গোধুলী লগ্নের একটু আগ দিয়ে বাছাড়ি নৌকাটি রূপোহাটি গ্রামের সীমানায় ঢুকে পড়ল।

গ্রামের চারিদিকে জল থৈ থৈ করে। মাঠের মধ্যে আটদশটি বাড়ি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাওয়ার বাহন নৌকা। পঞ্চম বাড়িটির ঘাটে কিছু লোকজন দেখা গেল। ঘাটে নৌকা ভিড়তেই কয়েক মেয়ে জুকার দিয়ে উঠল। বর এসেছে বলে কটি ছেলেমেয়ে দৌড়ে বাড়ির মধ্যে ছুটে গেল।

নৌকা থেকে সবাই নামছে। কিন্তু গোলোক ঘোর লাগা চোখে জলের দিকে চেয়ে আছে। তার নামার লক্ষ্মণ নেই। সুদামা হালে দাঁড়িয়ে নৌকাটা ঘাটকুলে সোজা করে ধরেছে। এ করণে কষে মালকাছাও দিয়েছে। সুমতি নেমে গেছে। সুলেখাকে নামতে না দেখে সুধাল, তুমি যাবা না দিদি? সুলেখা তাকে নেমে যেতে বলল। সে একটু দেরী করে নামবে। বলে সুলেখা জলে পা দুবিয়ে দিল। তার আলতা ধুয়ে যেতে লাগল।

তখন বাই-লাগা গোলোক দেখতে পেল, সুদামার পাশ থেকে এক মাথা চুল উকি দিয়েছে। একটু একটু নৌকায় উঠে আসছে। জল থেকে উঠে এসেছে বলে তার গা থেকে জল ঝরছে। পাটাতন ভিজে যাচ্ছে। তার মাথায় লাল ফিতে একটু সরে গেছে। সেটা চেপে ধরে গোলোকের দিকে চেয়ে একটু হাসছে। বলল, আমারে চেনো না? আমি জলে থাকি। আমার নাম জল পরী। আমার মা-ও জলে ছিল। তার নাম—মা-জলপরী। আমার আজিমাকে জীবন ভর পিঠে ডানা বেঁধে গান গাইতে হয়েছে। বুইড়া কালে আজিমা তেমন নড়ন চড়ন করতে পারত না। শীতে কাঁপত। বলত, আমারে আর জলে রাখিস না, একটু ডাঙায় তোল। মা জবাবে বলত, ডাঙায় উইঠা কী করবা? যতক্ষণ জলে আছ– ততক্ষন খাইতে পারতিছ। জলপরি গো্লোককে বলে, আমার আজিমা খুন খুন করে হাসে। বলে, জলে বাস কইরা কিবা খাই গো মা। মলা, ঢেলা, ডানকানা মাছ, কাজলি শ্যাওলা, শাপলা শালুক, শালুক গুল্লি—এ ছাড়া কী আর খাই! এই সগল খাইয়া নিজেরে আর অখন মানুষ বইলা মনে লাগে না।

গোলোক হা করে করে জলপরির গল্প শুনছে। নিজে কিছু বলছে না। বলবে কি—তার মনে কিছু ধন্ধ জেগেছে। এটা কি সত্যি জলপরি, না, বাইয়ের ঘোরের কুহক খেলা?

জলপরির কাছে কোনো কুহক নাই। তার গল্প বলা চলছে—বোজলা গোলোক দাদা, মা-জলপরী তার মা আমার আজিমাকে কয়, তোমার মানুষ থাকনের হাউস ক্যান? মানুষ হইলেই ভাত খাওনের হাউস জাগবে। আজিমা হাহাকার করে ওঠে, এ জেবনে কী আর দুগগা ভাত খাওনের সুযোগ ঘটবে না? আজিমা কাঁপতে থাকে। মা-জলপরী তাকে নিয়ে আরো জলের গভীরে নেমে যায়।

জলপরি কথা বলতে বলতে জলের দিকে চেয়ে থাকে। জলে তখন কোনো মা-জলপরি আর মা আজিমা-জলপরির কোনো চিহ্ন নেই। জলের উপরে একা জলপরি বসে আছে। তার শুকনো মুখ। গোলোকের প্রাণ কেঁদ ওঠে। সত্যি সত্যি তার কেঁদে ফেলার আগেই জিলপরির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। গোলোককে বলে, আইজ তোমাগো লগে বিয়া বাড়িতে ভাত খামু। লগে পুটি মাছ, আর জালী কুমড়ার ঘ্যাট। তখন গোলোকের খিদে বোধ হয়। তাকে কেউ গুড়-মুড়ি দিয়েছে কিনা মনে করতে পারছে না।

এই কথা বলতে বলতে জলপরী গোলোকের গায়ে হাত রাখে। খুব শীতল সেই হাত। আর সবুজ। গোলোক বুঝতে পারে এই শ্যাওলার নাম কাজলি শ্যাওলা। কাঁটা আছে। গায়ে লাগলে আঁচড় লাগতে পারে। রক্তপাত হতে পারে। গোলোকের ভয় করে। ভয়ে আরও জড় সড় হয়ে যায়। জলপরী নোচনার হাড়ি থেকে মুড়ি আর বাতাসা এনে দিল। গোলোক খাবে কিনা বুঝতে পারছে না। সে হা করে তাকিয়ে রইল। জলপরি তার দিকে মুড়ি আর বাতাসা এগিয়ে দিল। বলল, খাও, একটু পরে বিয়া বাড়ির খাওন খাবা। গোলোক খাওয়ারওয়ার সময়ে বুঝতে পারছে—মুড়ির রঙ সাদা নয়—সবুজ। খেতে ঘাস-ঘাস লাগে। জলপরি বলল, ভয় পাইও না গো গোলোক দাদা। আসো, তুমারে নিয়ে ঘাটে নামি। নামার সময়ে গোলোক জলপরির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখটিকে চেনা মনে হয়। তবু চিনতে পারছে না। তার মাথাটা ভার হয়ে আসে। কিছু বলে না। জলপরী তাকে খুব সাবধানে নৌকা থেকে নামিয়ে নিয়ে এল। বলল, তোমার পাশে বইসা আইজ দুগগা ভাত খামু। আর জলে নামব না।

নৌকা থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে বিয়া বাড়ির লোকজন বাড়িতে ওঠার পথটি আগলে ধরেছে। যেতে দেবে না। শ্যামচরণ হেকে বললেন, আমাগো যাইতে দ্যাও। শুনে একটি মেয়ে তাকে বলল, আগে শুলোক সন্ধান দেন—তারপর যাইবেন। শুলোকটি হল—
তিন অক্ষরের নাম যার
জলে বাস করে।
মইদ্যের অক্ষর বাদ দিলে
আকাশে উড়ে চলে।।

সুনিতি জোরে হেসে উঠল। বলল, এতো সোজা শুলোক। চিতল। চিতল মাছ জলে বাস করে। ট অক্ষরটি বাদ দিলে চিল হইয়া আকাশে ওড়ে।

শুলোক বলা মেয়েটি মাটিতে ভুট হয়ে প্রণাম করে সরে গেল। এরপর একজন আধ-বয়েসী লোক এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো। যুক্ত করে বলে গেলো—যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির ভবতি ভারত। এটা শেষ হওয়ার আগেই সবাই হর্ষদ্ধনি করে উঠল। এবারে বরপক্ষ স্তব্ধ হয়ে গেলো। তাদের মধ্যে সংস্কৃত বলতে পারে এমন কেউ নেই। ফলে তারা একটু দমে গেল। কণেপক্ষ হই চই করে বলছে—এবার কী কইবেন কন। কইয়া আমাগো ডিফিট দিয়া বাড়িতে উঠবেন। তার আগে নয়। ঘটক রামচন্দর বলে উঠলেন, শহর থিকা আইসা কি বেইজ্জতি হইব নাকি শ্যামাচরণ দাদা? শ্যামচরণ উত্তর দিলেন, আপনে তো আছেন আমাগো লাইনে। আপনে হিন্দু ধর্মের কিছু একটা কইইয়া দেন।

ঘটক হেসে বললেন, আমরা কি কিছু কইছি কোনোদিন। আমরা নামে হিন্দু। আমরা মন্ত্র তন্ত্র জানিনে। জানলে বাওনে জানতে পারে। অং বং কইরা কি কয় সেই জানে।

এই কথা সবার পছন্দ হয়েছে। সবাই হেসে উঠেছে। গোলোক হাসবে কি গম্ভীর হয়ে থাকবে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। জলপরি তখন তাকে পরম মমতায় ধরে আছে। বলছে, গোলোক দাদা আপনি কিছু কইতে চান? গোলোকের ঘুম পাচ্ছিল। সে কিছু বলবে না। তবু বলল, শুলোকের এইডা চিতল মাছ না–জলপরী। জলে মাথা জাগাইয়া যে জলপরি ভাসে। আবার লাগলে ডানা মেইলা ওড়ে। কিন্তু বিড় বিড় করে কী বলল তা কেউ বুঝতে পারল না। তার মাথা ঝুলে পড়েছে। এই ফাঁকে সুলেখা রানী শচীনের পিঠে গোত্তা মেরে বলল, আপনে না কলেজে পড়েন। আপনে কিছু কন।

শচীন লাজুকভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, আমি তো এখন সংস্কৃত পড়ি না। স্কুলে যা পড়ছিলাম তা পরীক্ষা পাশের লাইগা পড়ছিলাম। সব ভুইলা গেছি। এখন পড়ি –এ জার্নি বাই বোট। ইংরেজি।

শ্যামচরণ উৎসাহিত হয়ে বললেন, তাইলে ওইটাই কও বাপধন। আমাগো বাঁচাও। ওগো বেম্মো অস্তর মাইরা দেও।

শচীনের দুপাশে সুলেখা রানী আর সুনিতি দাঁড়িয়ে দুহাত ধরে আছে। আর মাঝে মাঝে চিমটি কাটছে। রহিম ফকির তার পিছনে এসে বলল, আল্লার নাম কইরা এইবেলা কও গো বেয়াই মশাই। ফলে শচীন এক ঘোরে পড়ে গড় গড় করে এ জার্নি বাই বোট এছেটা পুরো ইংরেজীতে বলে দিল। পরীক্ষার জন্য জান পরাণ দিয়ে মুখস্ত করেছিল। কোথাও ভুল হয় নাই। শেষে একটু বড় করার জন্য দি কাউ এছেটার কনক্লুশনটাও এর সঙ্গে ঝেড়ে দিল। শুনে সবার তাক লেগে গেল। এত বড় ইংরেজী এছে এলাকার কেউ কখনো শোনে নাই। কণেপক্ষ আর পথ আগলানোর পথ খুঁজে পেল না। তারা সরে দাঁড়াল। হই হই করে সবাই বিয়ে বাড়ি প্রবেশ করল। উঠোনে এসে মাতম শুরু করল। মাতম শেষে যখন সবাই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছে—তখন এ বাড়ির দুটো মেয়ে এলো বরকে বরণ করতে। কিন্তু বরকে পাওয়া গেল না। তারা কাকে বরণ করবে বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

গোলোক এ সময়ে মাথা উচু না করেই বলল, জলপরি।, আমারে শোওয়াইয়া দেও। আমার ঘুম লাগে।
খড়ের পালানের কাছে খড় বিছিয়ে দিল জলপরি। সেখানে বাই-লাগা গোলোক শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে যেতে বলল, ভাত হইলে ডাক দিও। পেট পুইরা চাডডা খাইয়া আবার ঘুমাব।

রামচন্দর ঘটক সুবোল সখার ভাই সুদামাকে হাক ডাক করে খুঁজতে শুরু করেছে। সুদামা উঠোনে ছিল না। ও তখন মালকোছা মেরেই বাছাড়ি নৌকার লগি গাড়তে ব্যস্ত। ওর খালি গা। সুদামাকে দেখে দুটো মেয়ের মধ্যে যেটি বড় সে বলে উঠল, উনি বর হইবে কেমনে? উনি তো নাওয়ের মাঝি। এক বাক্যে শ্যামচরণ তো তো করতে লাগলেন। কী বলবেন বুঝতে পারছে না। শুধু পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, সুবোলদের নৌকাটি দেখা যায় কিনা। কিন্তু বিল ফাঁকা। সুবোলদের নৌকার কোনো চিহ্ন নাই। তিনি একটু তফাতে দাঁড়ালেন।

এই সময় এ বাড়ির গইয়া গাছটার নিচে শচীন পকেট চিরুনি দিয়ে চুল আচড়াচ্ছিল। পরণে প্যান্ট-শার্ট। তাকে দেখিয়ে সুলেখা রানী বলল, ঐ যে বর। শুনে মেয়ে দুটি শচীনের পায়ের কাছে জল ভরা ঘটি রেখে প্রণাম করল। এই বরকে তাদের পছন্দ হয়েছে। বরকে বরণ করার জন্য এয়োস্ত্রীরা সমস্বরে জুকাড় দিয়ে উঠল। চারজন যুবক ছেলে তাকে চ্যাং দোলা করে তুলে নিয়ে একটি পিঁড়িতে বসিয়ে দিল। ধান দুর্বা দিয়ে কণের দিদিমা আশীর্বাদ করে বলল, আহা, শিব ঠাকুরের মত ছেইলা। আমাগো নাতনি টুনিলতার দেখছি রাজকপাল।

পাশ থেকে দ্বিতীয় মেয়েটি দিদিমার কানে মুখ রেখে বলল, টুনি দিদি নয় গো দিদিমা—পুনিলতা।

দিদিমা একটু অবাক হয়ে বলল, আজতো টুনির বিয়ার কথা শুইন্যা আসলাম। মাইয়া পালটে গেলো কিভাবে? মেয়েটি ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল। দিদিমা কিছুক্ষণ আগে এসেছে। তাই টুনি না পুনির বিয়া তার দিশা করতে পারছে না। তার শুধু মনে আছে তার মাইয়া সুধালতার বড় মাইয়া আষাঢ় মাসে হয়েছিল। তার ঘরের হাইতনার পাশে একটা বেগুন গাছে একটা টুনি পাখি চুপ করে বসেছিলে। সে কারণে সেই বড় মেয়ের নাম রাখা হয়েছিল টুনিলতা। তার দেড় বছর পরে আশ্বিনে যে মাইয়া হল তার নাম টুনির সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল পুনিলতা। এটা দিদিমার মনে আছে। বেশ বয়স হয়ে যাচ্ছে বলে দিদিমার কিছু ভুলভাল হয়ে যায় সত্যি। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, তাইলে কি টুনিলতার বিয়া হইয়া গেছে?

মেয়েটা বলল, হয় নাই। তবে তার কী হয়েছে সেটা না বলে দিদিমাকে বলল, দেরী হইয়া যাইতাছে গো দিদিমা। তুমি জামাইরে ফোঁটা দেওন সাইরা ফালাও। কাকিমা জেঠিমারা এখন ধান-দুব্বা দেবে। দিদিমা মুখ ভার করে সরে গেল। ঘরের দিকে এগোতে লাগল। তার মনে হচ্ছে—এটার মধ্যে কিছু রহস্য আছে। তার মাইয়া সুধালতাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে। বিয়ের মধ্যে কোনো তঞ্চকতা থাকা ঠিক নয়।

শচীন কিছু বলতে চেষ্টা করছিল। তার আগে এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর হরেন ব্যাপারী এগিয়ে এলেন। বরের নামধাম শুধালেন। বললেন, বাবা-ধনের কী করা হয়?
শচীনের আগে সুলেখা রানী জবাব দিল, কলেজে পড়ে। ছাত্তর।

শুনে হরেণ মেম্বর চমকে উঠেছেন। তিনি এতক্ষণ এ বাড়ির সব কিছু দেখভাল করছিলেন। এই কাজে তার বেশ নামধাম আছে। তার পিছনে মেয়ের বাবাচ অনন্ত মিস্ত্রী ঘুরছে। অনন্ত মিস্ত্রীর দিকে ঘুরে মেম্বর জিজ্ঞেস করল, তুমি যে শিক্ষিত জামাই যোগাড় করছ–সেই কথা তো কও নাই?
অনন্ত মিস্ত্রী এমনিতে সাদাসিধে মানুষ। নানা সমস্যায় তার জেরবার অবস্থা। তার একটি শীর্ষ তালিকা নিম্নরূপ–

সমস্যা এক.
কাল থেকে তার বড় মেয়েটিকে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ তার বিয়ে। বাবা হিসেবে অনন্ত মিস্ত্রীর উপর দিয়ে ঝড় যাচ্ছে। সারারাত আর সারাদিন ধরে জলে জলে কেটেছে। এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়েছে। সুযোগ থাকলে বিয়ে বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু তার স্ত্রী সুধালতা বলেছে—মাইঝা মাইয়াওতো ডাঙ্গোর হইছে। কাক পক্ষীর জানার আগে অরে আজ বিয়ার পিড়াতে বসাইয়া দেও।
তার নিজের কাছে বড় মেয়ের বদলে মেজো মেয়েকে বিয়ের পিড়িতে বসানোটা পাপকর্ম মনে হয়। কিন্তু এ সংসারে তার স্ত্রীর উপরে আর কোনো কথা নেই। এই পাপকর্মের জন্য তার মন খচ খচ করছে।

সমস্যা দুই.
টুনিলতার দুই মামা নৌকা নিয়ে খালে বিলে টুনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তারে পাওয়া গেলে ফিরে আসবে। বেলা গেল–সন্ধ্যে হয়ে আসছে। তাদের ফেরার নাম নাই।

সমস্যা তিন.
গেলবার বন্যায় ধান হয়নি। তাই জিয়োনিগিরি করে সংসার চালিয়েছে। কিন্তু এই অভাবের দিনে দেশের মানুষের মাছ কেনার মত পয়সা নাই বলে জিয়োনিগিরি করে আর চালাতে পারছে না। রিলিফের উপর ভরসা করে আছে। ঘরে সামান্য কিছু দীঘার বীজ ধান আছে। তা দিয়ে খুব বেশী হলে এক কুড়ি লোককে খাওয়ানো সম্ভব। কিন্তু বীজ ধান খেয়ে ফেললে চাষের সময় কী করবে?

সমস্যা চার.
এই বিয়ের চাল মেম্বর দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। এখনো চাল তার বাড়িতে পৌছায়নি। চাল পাওয়ার জন্য মেম্বরের পিছনে কদিন ধরে ঘুর ঘুর করছে। মেম্বর বলেছে চাল আসছে। মেম্বর একটু রগচটা হলেও কাউকে বিপদে ফেলেন না। চাল এলে রান্না চড়ানো হবে। কিন্তু মেম্বর নিজে এসেছে বটে–কিন্তু চাল আসেনি। এদিকে বরযাত্রী এসে পড়েছে। তাদের কী খেতে দেবে?

সমস্যা পাঁচ.
বরযাত্রীর সংখ্যা সোয়া দুই কুড়ি। টেনে টুনে এক কুড়ির খাওনের আয়োজন হতে পারে। এর বেশি চাল মেম্বর দেবে বলে মনে হয় না। বাকীটা চাল কিভাবে যোগাড় হবে বুঝতে পারছে না। তবে সে চাল দীঘা ধানের হবে না–রিলিফের চালই হবে।এই ধরনের তঞ্চকতা তার বাপ-ঠাকুরদারা কোনোদিন করেনি।

সমস্যা ছয়.
গ্রামের লোকদের নেমতন্ন করা হয় নাই। তারা খবর পেলে সবাই এসে পড়তে পারে। তখন কীভাবে তাদের সামলাবে এটা তার মাথায় আসছে না।

অনন্ত মিস্ত্রী এই রকম সমস্যাপীড়িত হয়ে হরেণ মেম্বরের দিকে জোড় হতে বললেন, দাদা আমি কী কইরা কই। এই অভাবের দিনে খাতি পাইনা তো মাইয়ার বিয়া দেইয়ার চিন্তা করাই অন্যায়। কিন্তু ছাওয়াল থাকে শহরে। তাগো কোনো চাহিদা নাই। মাইয়াও দেখবার চাইল না। ঘটক কইল–এই রকম বিয়ার সুবিধা কোনো কালেই পাবা না। তোমার মাইয়া কপাল নিয়া আইছে। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেইল না। আমরা ছাওয়ালও দেখনের নাম করিনাই। ছাওয়াল শিক্ষিত না অশিক্ষিত সেইডা কী আমিই জানি? মাইয়া পেড ভইরা চাড্ডি খাবার পাবে—হেইডাই বড় কথা।

হরেণ মেম্বর এইসব কথার ধার ধারে না। তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। রামচন্দর ঘটকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাইলে তোমারই কাম। শিক্ষিত জামাই করার মত মাইয়া আমার ঘরে নাই? আমারে বাদ দিয়া তুমি জীয়নীর ঘরে বিয়ার সম্বন্ধ দিলা? আমাগো ইজ্জতটা থাকলো কোথায়?
রামচন্দর ঘটক বলে উঠল, আপনে ভুল করতেছেন মেম্বর বাবু। আমাগো ছাওয়াল কলেজের ছাত্তর না। ফাইভ পাশ।

এই কথা শুনে মেম্বর আরো খেপে গেলেন। বললেন, এখন আমারে ছল্লি বল্লি বুঝাইতেছ? চেহারা দেখলিই বোঝোন যায় কেডা শিক্ষিত আর কেডা অশিক্ষিত। শিক্ষিত ছাওয়ালের লগে জীয়নীর মাইয়ার বিয়া হইতে পারে না। হরেন মেম্বর বাইচা থাকতে এই বিয়া হইতে দেবে না। গ্রামের ইজ্জত নষ্ট হইতে দেবে না। খাড়াও, আমি লোক লইয়া আসতেছি।

হরেণ মেম্বর ফাল দিয়ে নৌকায় উঠে গেল। তার গ্রাম রূপোহাটির পাশের গ্রাম ছিলনা। সেদিকে রওনা হতেই অনন্ত মিস্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। করুণ গলায় বললেন, আমরা জীয়োনী না। চাষা। অভাবে পইড়া জীয়নী হইছি—চোরতো আর হই নাই!

এ বাড়ির লোকজনও কম নয়। তারাও হুংকার দিয়ে উঠল। বলল, অখনই বিয়া হবে। দেখি কেডা ঠেকায়। হরেণ মেম্বর আইলে লাশ পইড়া যাবে। ফলে এই হুমকি-পাল্টা হুমকীর মধ্যে কাড়া-নাকাড়া বেজে উঠল। লগি বৈঠা বের করে সবাই লাফিয়ে দাপিয়ে উঠল।

দেখে শুনে শ্যামচরণের মাথা খারাপের দশা। তার ইচ্ছে ছিল বিয়া বাড়িতে পাড়া দিয়েই খাওন দাওনের তত্ত্ব–তাল্লাশ নেবেন। বলবে্ন—অক্ষুণি সবাইরে প্রথম বৈঠকে বসাইয়া দেও। বিয়ার পরে আরেক বৈঠক দিলেই চলবে। তা না এখন কোথায় কী? খাওনের এক বৈঠকেরই খবর নাই। রণ হুংকার শুরু হয়েছে। রামচন্দর ঘটককে খুঁজতে গিয়ে শ্যামচরণ দেখতে পেলেন, ঘটক নাই। চেঁচিয়ে বললেন, ও ঘটক, এ কোথায় তুমি আমাগো আনলা? পরাণডা কী আজ বেঘোরে যাবে?

হুংকার শুনে গোলোকের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে জলপরিকে খুঁজলো। জলপরি তার মাথার কাছেই চুপ করে বসে আছে। গোলোককে জাগতে দেখে ফিসফিসিয়ে বলল, ভয় পাইও না। গাঁও গেরামে এইরকম হয়। আমার মাইজা বোনের যে বার বিয়া লাগল—সেবার তিন গ্রামের লোক ভাঙ্গানী দিছিল। পাঁচজনের মাথা ফাডছে। তার মদ্যেই বোনের বিয়া হইছে। তারে নিয়া যাওনের সময় জামাই কয়—এই অলক্ষ্মী মাইয়ার জন্যিই এই সব অঘটন হইছে। বাড়ি নিয়া হ্যার শোধ লমু। বাড়ি যাওনের আগেই মাইজা বোন জলে নাইমা গেছে। অখন বাজুনিয়ার খালের মুখে খাড়ানো বইন্যা গাছটায় তারে মাঝে মইদ্যে দেখন যায়। শুনে গোলোক জলপরির দিকে তাকিয়ে থাকে। জলপরি তার সবুজ আঙ্গুল দিয়ে তার চোখে ঘুম এনে দিল।

রামচন্দর ঘটক তখন এ বাড়ির বইন্যা গাছের আগায় উঠে বসে আছে। বিলের পশ্চিম দিকে তাকিয়ে সুবলদের নৌকা আসছে কিনা দেখার চেষ্টা করছে। নৌকার কোনো নাম নিশানা নাই। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। জল খলবল করছে। রামচন্দর ঘটক কেঁপে উঠেছে। হাহাকার করে বলল—ওরে সুবোল সখা, বাপ আমার—তুই আইসা পড়। দেরী করিস না। আমাগো সক্কলডির জান-পরাণডা বাঁচা রে সুবোল্যা।

রামচন্দরের এই প্রার্থনার মধ্যে পশ্চিম দিক থেকে এক ঝাঁক বক পাখি উড়ে এলো। তারা বিলের উপর দিয়ে বইন্যা গাছে হাহাকার রত রমচন্দর ঘটককে গ্রাহ্য করল না। বিয়ে বাড়ির কাড়া নাকাড়ার দিকেও তাদের মন নাই। বাড়িটাকে পিছনে ফেলে বক পাখির ঝাঁক পুব দিকের বিলের উপর ছায়া ফেলে উড়ে গেল।
এরই মধ্যে বিয়ে বাড়ির উঠোনে দুটো হারিকেন জ্বলে উঠল। বাড়ির জোয়ান লোকগুলো শচীনকে ঘিরে ধরেছে। মাইয়ার কাকা হারাধন চেঁচিয়ে বলল, বাওন মশাইরে ডাক দে। বিয়া আগেই হইয়া যাবে। বর-কন্যারে বয়ার পিড়িতে বসা। তারপর অন্যকথা।

এইবার শচীন কেঁদে উঠল। ভগ্নিপতি অনিল মোহরির কথায় বরযাত্রী হয়ে খুব বিপদে পড়ে গেছে। উদ্ধার পাবে কিনা বুঝতে পারছে না। হাতজোড় করে শচীন বলল, আমি বর না। শচীনের কথা কানে নেওয়ার মত কারো মন নাই। কণের দিদিমা তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, কান্দে না সোনা। বিয়ার দিন মাইয়া মাইনসে কান্দে। বেটা মাইনসের কান্দনের নিয়ম নাই।

শচীন ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল। বাওন মশাই খড়ের পালার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার মাথার টিকিতে বাঁধা জবা ফুলটা লেপ্টে গেছে। হাই তুলে বলল, একি আপদ রে বাপু। মেলাদিন পর দুইটা ভালোমন্দ খাইতে পারমু বইলা সকাল সকাল এই বাড়ি আইসা পড়ছি। খাওন দাওনের নাম গন্ধ নাই। এদিকে রাম-রাবনের যুদ্ধ শুরু হইছে।

এই কথায় টুনিলতার কাকা হারাধন কাকে যেনো হুকুম করল, আর তারা গোটা চারেক বিলের ধাপে জন্মানো বড় বড় কুমড়া আর শোল মাছ ঘাট থেকে এনে উঠোন দিয়ে সবার চোখের সামনে দিয়ে ঘরের পিছনে নিয়ে গেল। বলল, বাওন মশাই—এই দেখেন আপনার খাবার। বাওন মশাই বলে উঠল, কিন্তু চাল কই? দীঘা ধানের চাল? সেইটা দেখাও। হারাধন হেসে উত্তর দল। আছে, আছে। সময় মত পাতে দীঘা ধানের ভাত পাবা। আগে বিয়ার মন্ত্র পড়াও। মনে হল বাওন মশাই এ কথা বিশ্বাস করেনি। গজ গজ করতে লাগল। বিড় বিড় করে বলতে লাগল, ভাত ছাড়া খাওইন হয় কী কইরা?

সুবোলের মামা শ্যামচরণ কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। একবার উঠনে বসছেন। আরেকবার উঠছেন। তার মাথারবিরল প্রায় কেশ খাড়া হয়ে গেছে। সুদামা এসে তাকে বলল, মামা, চলেন নৌকায় যাই। আমাগো বিয়ার কাম নাই।
এ বাড়ির হারাধন এটা শুনে রক্ত চক্ষু লাল করে বলল, আইজ বিয়া না কইরা যাওন টাওন নাই। পথ বন্ধ।

এই কথা শুনে শ্যামচরণ সুদামার কাঁধ খামছে ধরেছে। বলল, ভাইগ্না, তখন তুই যদি নৌকার না থাইকা আমাগো লগে থাকতি তাইলে কী অনিল মোহরির শালারে এই বাড়ির লোকজন বর মনে করতে পারত? তুইই এই আনাঠার জন্যি দায়ী। তরে দুটো চড় মারতি পারলে আরাম হত।

সুদামা কী উত্তর দেবে তা বোঝার আগেই ঘাটকুলে কান চারেক ছিপ নৌকা রে রে করে ছুটে এসেছে। একটার মাঝখানে হরেণ মেম্বর মাঝায় হাত দিয়ে ফুঁসছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে তারা নৌকা নিয়ে তেড়ে আসবে—এটা একটু রহস্যজনক মনে হল শ্যামচরণের কাছে। তারা কী তবে আশেপাশে কোথাও নৌকা রেডি হয়েছিল কাইজা করার জন্য? ঘাট থেকে লোকজন ফাল দিয়ে নামতে শুরু করেছে। আর তার মধ্যে হরেণ মেম্বরের গোলা শোনা গেল, জীয়োনীর পো, এইবার কলেজপড়া জামাইরে আমাগো না দিয়া যাবি কোথায়?

এর উত্তরে এই বাড়ির লোকজন চেঁচিয়ে উঠল, আইজ কা তোগো ফিইরা যাতি দেব না। ফলে দুদলে দুদিক থেকে কাড়ানাকাড়া বাজাতে লাগল। আর গোপালগঞ্জ থেকে আসা সুবোলের বিয়ের বরযাত্রীরা চিড়ে চিপ্টে হয়ে কে কোথায় পালাবে বুঝতে না ছুটোছুটি করতে লাগল। এর মধ্যে বাই-লাগা গোলোক নাক ডাকছে। তার শিয়র থেকে সুলেখা রানী উঠে কণের ঘরের দিকে গেল। কুপির আলোয় তখন কণে সাজানো হচ্ছে। পুনিলতা গাইগুই করছে। একটু বিরক্ত হয়ে বলছে, আমারে ক্যান, দিদিরে ডাক। দিদিরই তো বিয়া। মেয়ের মা সুধালতা তখন পুনিলতাকে ঝামটি মেরে বলছে, সে হারামজাদী এখন কোথায় তার কী হদিশ জানি আমরা? আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু সুলেখা রানীকে দেখে থেমে গেলো। সুলেখা রানী কণের কাছ থেকে লক্ষ্মীমতি সিঁদুর কৌটাটি নিয়ে বাইরে চলে এলো। তাকে উদ্দেশ্য করে পুনিলতা বলল, বাইরে যাইও না দিদি। ঘরে থাক। কাইজা থামলি যাইও। সুধালতা পুনিলতাকে ঠোনা দিয়ে বলল, কথা কইস না। সাজোন গোজন শেষ কর। সময় নাই। বাওন মশাই বইসা আছে।

নৌকা থেকে হরেণ মেম্বরের সবচেয়ে তুখোড় লাঠিবাজ নরোত্তম মণ্ডল ওরফে নরা মণ্ডল নেমে পড়ল। মাথার উপরে বেশ কায়দা করে লাঠি ঘুরাচ্ছে। কণে পক্ষের আরেক এলেমদার বিলেসচন্দ্র ওরফে বিলে লাঠির বদলে বৈঠা ঘুরাতে ঘুরাতে এল। সামনে আসার আগেই নরা মণ্ডল তাকে থামাল। দুজনে মুখোমুখি বসেছে। ট্যাক থেকে দু টুকরো সুপারী মুখে দিল। কাল রাত্রে নরার ঘুম হয়নি। ঘাঘর নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিল। তার চোখে অবসাদ। বেশ খিদে বোধ আছে। কাইজার আগে খেয়ে নিতে পারলে ভাল হত। এ কারণে গায়ে তাগদ পাচ্ছে না। হরেণ মেম্বরের ডাকে না এসে উপায় নেই। তার কল্যাণেই কিছু রিলিফ পায়। দুটো পেটে পড়ে। মেম্বর বলেছেন কাইজা শেষে বিয়ার খাওন পাবে।

মুখটা নামিয়ে বিলেসচন্দ্রকে নরা মণ্ডল শুধাল, কী কী পদ রান্না হইবে রে বিলেস কাগু? বিলেস আরেকটু খাটো করে বলল, কুমড়ার ঘ্যাট আর শোলমাছ। খেসারীর ডাইল হইতেও পারে।
শুনে নরা মণ্ডল বলল, ভাত?

বিলেসচন্দ্র একটু হতাশ সুরে বলল, এইটা বলা যাতিছে না। অখনো চাল পাওয়া যায় নাই। হরেণ মেম্বর দেবে কইছে। কিন্তু অখন তো কাইজা পাতাইছে। এদের দুজনের শলা দেখে হরেণ মেম্বর নৌকা থেকে গর্জে উঠলেন, অরে নরা শালা, তরে কী গপসপ করার জন্যি আনছি?

এই কথায় নরা মণ্ডল ফাল দিয়ে উঠল। ফাল দিয়েই বুঝতে পারল, তার কোমরে অত জোর নাই। ফলে কোমরের বদলে মুখে জোর এনে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে রে রে করে উঠল। বিলেসচন্দ্র পালটা ফাল দিয়ে একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করছে। তারও আগের মত গুর্দায় তেজ নাই। পা দুটো কাঁপছে। সুবোলের মামা শ্যামচরণ চোখ বন্ধ করলেন। এবার ঠাস করে শব্দ তার কানে আসবে। কানে আঙ্গুল চাপা দিতে গেলেন।

বাই লাগা গোলোক এ সময় ঘুমের মধ্যে একবার জলপরির নাম ধরে ডেকে উঠল। সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। আবার যুদ্ধ লেগেছে। অনেককেই আবার জলে নেমে যেতে হচ্ছে। এই যুদ্ধে তার পিঠাপিঠি বোন সুরোবালার সঙ্গে সে জলের মধ্যে ভেসে যাচ্ছে। তাকে তার বাবা ধরতে পারছে না। সুরোবালা ভেসে যাওয়ার কালে কান্নার মত চিৎকার করছে, দাদারে। বোনকে সে বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু নিজেও মরে গেছে এই চিৎকারের মধ্যে দিয়ে—কান্নার মধ্যে দিয়ে। সেই কান্নাটা গোলোক শুনতে পারছে। এটা শুনে তার কান্না পেতে লাগল। বলতে লাগল, জলপরি, তুমি কোথায় গেলা? জলপরি তার সবুজ ঠোঁট গোলোকের কানে চেপে ধরে বলল, ভয় নাই। আমি আছি—তোমার লগে। ঘুমাও। গোলোক সুরবালার মিলিয়ে যাওয়া কান্নার মনে করে আবার ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল। দেখতে পারল, তার বোন সুরবালা নেই। হারিয়ে গেছে। জেগে উঠলে আবার সুরবালা আবার ফিরে আসবে। সে জন্য ঘুমিয়ে থাকাই ভালো।

এরপর জলের মধ্যে একটা আলোড়ন উঠল। তার মধ্যে থেকে এক অপরূপ সুন্দরী সবুজ নারীমুর্তি উঠে এল। পরণে চেলি শাড়ি পরা। চোখে বিলোল কটাক্ষ। কাখে সোনার কলসি। ঘাট থেকে সেই নারীমূর্তি দাঁড়াল যুযুধান দুদলের মাঝখানে। কোমর দুলিয়ে গান ধরল—
আমি রূপ নগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি।
ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দ্বারে এসেছি।।

এই গানের সঙ্গে বেঞ্জু বেজে উঠল। মাথায় গামছাটা বেঁধে রহিম ফকির তার সঙ্গে তাল দিতে লাগল। সবাই লাঠি খেলা রেখে এই নাচ গান হা করে দেখতে লাগল। পুরো পালাগান শুরু হয়ে গেছে। কলস থেকে মোহিনী নারী মিঠাই মণ্ডা ছুড়তে লাগল। সেটা পাওয়ার জন্য সবাই হুড়হুড়ি লাগিয়ে দিল। যারা পেল তারা মুখে পুরে চুষতে লাগল। আর যারা পায়নি তারা আশায় থাকল। আবার সুন্দরী বাতাসা ছুড়বে।

এই মোহিনী নারীকে দেখে হরেণ মন্ডল নৌকা থেকে নেমে এলেন। কাছে এসে বললেন, কেগো তুমি মাইয়া?
মোহিনী নারী অপাঙ্গে ভ্রু ভঙ্গী করে বলল, আমার নাম রূপভান। নিবাস চুনখোলা।

হরেণ মণ্ডল খুশি হলেন। বললেন, চুনখোলার পাশে পাখিমারা গ্রামে আমার মাসি বাড়ি। পিসার নাম স্বর্গীয় শ্রীমন্ত কবিরাজ। তোমার কী বিয়া হইছে রূপভান?
এইকথা শুনে রহিম ফকির রূপভানের পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, আমি ওর স্বামী–রহিম বাদশা।

স্বামী রহিম বাদশা এই ফাঁকে মুরগীর একটা লাল পালক মাথার গামছায় গুঁজে নিয়েছে। রূপভান আঁচলের খুঁট থেকে লক্ষ্মী-সিন্দুরের কৌটা বের করে সিঁথিতে সিঁদুর টেনে নিল। দেখে হরেণ মণ্ডল একটু বিষম খেলেন। বললেন, রূপভান আর রহিম বাদশা তো মুসলমান লাগে। তাইলে সিন্দুর মাখলো ক্যান মাইয়া?
এই প্রশ্নে রহিম বাদশা একটা দেহতত্ত্বের গান ধরতে যাবে তার আগে রূপভান শচীনচন্দ্রের গায়ে আছড়ে পড়ল। বলল, রহিম বাদশা নয়, আমার স্বামী এই শচীনচন্দ্র। আমি তার অগ্নি সাক্ষী করা বউ। শুনে রাহিম বাদশা চেঁচিয়ে উঠল, মিছা কথা। রূপভান আমার নিকে করা বউ। সে হিন্দু হয় কেমনে?

ফলে রূপহাটির মিস্ত্রী বাড়ির এই উঠোনে আরেকটি পালা শুরু হয়েছে। রূপভান শচীনকে জড়িয়ে ধরে আছে। শচীন ঘেমে উঠেছে। সে চেতনা রহিত। ওদিকে রহিম বাদশা পাগলপারা। রূপভানের জন্যে হাহাকার করছে। বলছে রূপভানের লেগে সে জীবন ত্যাগিবে। জলে নেমে যাবে।
হরেণ মেম্বর কণের বাবা অনন্ত মিস্ত্রীকে ডেকে বললেন, অ অনন্ত, কী জামাই আনছ? এর দেখি বউ আছে। আবার সেই বউয়ের গণ্ডা গণ্ডা স্বামী! গঞ্জ থিকা কি ছেলে খেলা করতি এরা আইছে? গ্রাম বলে কি আমাগো কোনো দাম নাই?

এই প্রশ্নে কণের বাবা অনন্ত মিস্ত্রী বললেন, হেইডা জানে ঐ রামচন্দর ঘটক। ঘটক তখন গলা জলে দাঁড়িয়ে হোগলা ঝোপের আড়াল নিয়েছিল। নরা মণ্ডল আর বিলেসচন্দ্র তাকে জল থেকে টেনে নিয়ে এলো। ঘটক জোড় হাতে বলে উঠল, আমারে তো আপনেরা কইতেই দিলেন না। আজকের বর এই শচীনচন্দ্র নয়। শচীনচন্দ্র গোপালগঞ্জের বিশিষ্ট মোহরী অনিল মণ্ডলের শালা। বিয়ার বরযাত্রী হইয়া আমাগো লগে আইছে। শালার কিছু হইলে মহরী বাবু কেস কইরা দেবে। এই কেসের ঠেলা আছে!

অনন্ত মিস্ত্রী কেসের কথায় ভয় পেয়ে গেছেন। আর কিছু হোক না কেনো কেসে পড়া যাবে না। যমে আর কেস শেষ না করে ছাড়ে না। তিনি শুধালেন, তাইলে বর কেডা?

ঘটক সুদামাকে দেখিয়ে দিলেন। সুদামা এই হই হট্টগোলের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করছিল। খড়ের পালার ডান পাশে একটু কাত হয়ে শুয়েছিল। নানা কারণে সেখানে নাক ডাকছিল। তাকে তুলে মামা শ্যামচরণ বললেন, ঘটক মশাইয়ের কথা সত্য। এই যে আপনাগো জামাই। নাম সুদামা সখা। শচীনচন্দ্ররে ছাইড়া দেন। তার পত্নীর নাম সুলেখা রানী। সুলেখা রানী এখন রূপভান সাইজা আছে।

গোলোক পাশ ফিরে দেখতে পেল, জল পরিটি মাথা নিচু করে আছে। মৃদু করে হাসছে। তাকে ঠিক সুলেখা রানীর মতন- লাগছে। গোলোক বিস্ময়ে বলল, জলপরি, তুমি কী সুলেখা রানী? জলপরি আরও রহস্য করে বলল, হতি পারি। আবার নাও হতি পারি। তুমি ঘুমাও। উইঠো না। ভাত এখনো হয় নাই। গোলোক কিছু বুঝতে পারছে না। সে ঘুমাবে কী—তার বিস্ময় বেড়ে গেছে। একই মানুষ কী করে একই সঙ্গে জলপরি এবং সুলেখা রানী দু জন হতে পারে? তখন জলপরি বিশদ করে বলল, এই দুনিয়ায় যে মেয়েই কোনো না কোনো ভাবে সুলেখা রানী। আবার কোনো না কোনো ভাবে জলপরী। যে-ই রাধা সে-ই বিশাখা। যে-দ্রৌপদি—সে-ই জনম দুঃখিনী সীতা। শুনে গোলোকের মাথা ভারী হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে আর কোনো স্বর বের হল না। জলপরি তখনো বলে চলেছে, আমি কখনো সুলেখা, কখনো সুনিতি। কখন এই বাড়ির টুনিলতা। তার যে বোন পুনিলতা –সেও আমি। ঐ যে রহিম ফকির—তার যে বোনডা গাছে ঝুইল্যা পড়ছে—মাঝে মইদ্যে মনে হয়—সেই বোনডাও আমি। তুমি ঘুমাও চান। এসব তোমার বোঝনের দরকার নাই। জলপরির শেষ কথাগুলি শোনার আগেই গোলোক আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। জলপরি বড় করে শ্বাস ফেলল।

আর তখনি সুদামা চোখ ডলতে ডলতে উঠেছে। মামার দিকে তাকিয়ে বলল, বিয়া হইয়া গেছে?
রামচন্দর ঘটক এবার হেসে বলল, হয় নাই। তুমি পিড়ায় বইসা পড়লিই হবে।
শ্যামচরণের মন খুঁত খুঁত করছিল। কারণগুলি নিম্নরূপ–

প্রথমত. তিনি জীবনে কখনো মিথ্যে কথা বলেননি। আজ বলতে হয়েছে—সুলেখা রানী শচীনচন্দ্রের স্ত্রী। এটা অধর্ম। তবে ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ। বোঝা ভার।

দ্বিতীয়ত, আজকের প্রকৃত বর সুবোল সখা। গা বাঁচাতে তার বদলে সুদামার নাম বলছে। এটাও মিথ্যে। মিথ্যে কথা বলা মহা পাপ। কিন্তু এতো গুলো লোকের জীবন-মান বাঁচাতে এই মহা পাপ করার বিকল্প ছিল না।

তৃতীয়ত, সুদামা সংসারী না—বৈরাগী মতে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এটাতো ভগবানে ফেরার পথ। তাকে সংসারী করা ঠিক নয়।

চতুর্থত, আসল বর সুবলকে হেলা করতে তার মন সায় দিচ্ছে না। তার ইচ্ছে সুবলের জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যায়। মোহন মিয়া মহাজন নিশ্চয়ই আসবেন। কিন্তু বিয়ে বাড়িতে যেভাবে ঘোট পাকিয়ে যাচ্ছে একের পর এক তাতে তার ভরসা হচ্ছে না।

তিনি সুদামাকে এগিয়ে দিতে গিয়েও পশ্চিম দিকে চোখ রাখলেন। সুবোলদের নৌকার নিশানা দেখা যায় কিনা দেখার চেষ্টা করলেন। কোনো নৌকার আগা মাথা কিছুই দেখতে না পেয়ে সুদামাকে বললেন, বাবা সুদামা, আর কথা কইস না সোনা। বিয়ার পিড়ায় উইঠা বয়। আমরা নেল্লা হইয়া বাড়ি ফিরি।

হরেণ মেম্বরের মনে ফুর্তি এসেছে। মেয়ের বাবা-কাকাকে আর দেরী না করে বিয়ের যোগাড়-যন্ত্র করতে হুকুম দিলেন। শচীনচন্দ্র কানে রেডিওটা চেপে ধরে নৌকায় গিয়ে বসল। হরেণ মেম্বর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছেন, আমার নাম হরেণ চন্দ্র ঘরামী। রূপোহাটি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর। দুইটা পয়সা আছে বলে লোকে খাতির করে। বোঝেনইতো রিলিফের মালামাল বিলি ব্যাবস্থা করি। এতে নানান ফ্যাসাদ আছে। আপনার জামাই বাবুর লগে সময় কইরা গোপালগঞ্জ শহরে যাইয়া দেখা কইরা আসব। মোহরী বাবুর সঙ্গে পরিচয় থাকায় লাভ আছে।

অনন্ত মিস্ত্রী সমবেত লোকজনের দিকে তাকিয়ে বললে, তাইলে লগ্ন আইসা পড়ছে। বাওন মশাই এইবার মন্ত্র পড়া শুরু করুক।

বাওন মশাই ঘন ঘন তার পৈতাটা ঘন ঘন নাড়ছে। সোজা বলে দিল, আমার রান্নার সামগ্রী দেন। আগে রান্না কইরা খাইয়া লই। তারপর বিয়ার মন্ত্র কবো।
অনন্ত মিস্ত্রী বললেন, তাহলে লগ্নের কী হইবে? লগ্ল গেলি তো আমার মাইয়ার আর বিয়া হবে না। বাওন মশাই উত্তরে জানাল, লগ্ন আমার হাতের মুঠোয়। আমার কথায় ওঠে বসে। আমি যখনই কবো তখনই লগ্ন হইবে।

রান্নার কথা শুনেই নরা মণ্ডল বলল, আমরাও সবাই নেমত্তন্নে আছি। রান্না চড়াইতে কন। এই কথাটা বিলেসচন্দ্রেরও পছন্দ হয়েছে। সে এসে নরার কাঁধে হাত রেখেছে। হরেণ মণ্ডলের লোকজন এই ফাঁকে সবাই নৌকা ছেড়ে উঠনে জায়গা নিয়েছে। তারা বিয়ে দেখতে এসেছে। বিয়ে দেখে খেয়ে দেয়ে যাবে। এখানে তাদের কারো সঙ্গে বিবাদ নাই।

তাদের বসতে দেখে অনন্ত মিস্ত্রী বললেন, এতো মাইনসের খাবার পাব কই? যা যোগাড় করছি তা দিয়া বরযাত্রীর আধাআধিও খাওয়াতি পারব না। অখন কী করি মেম্বর দাদা?

হরেণ মন্ডল তাকে নিয়ে রান্নার দিকে এগিয়ে গেলেন। চাল-ডাল নিতান্ত কম। বিলের কটা কুমড়া আছে। কিছু মান কচু আছে। অনন্ত মিস্ত্রী বললেন, চাইয়া চিন্তা এই গুলান যোগাড় করতে পারছি। আর তো পারি নাই। আপনার দিকে চাইয়া আছি।

হরেণ মণ্ডল এই সবই জানে। অনন্ত মিস্ত্রী তাকে বলেছেন আগেই। তার কাছে রেশনের চাল পাওয়ার জন্য ধর্ণা দিয়েছিলেন। মেম্বর দেবেন কথাও দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও দিতে পারেন নাই। কাল রিলিফের চাল এসেছিল। কোটালী পাড়ায় পাট মন্ত্রী আকস্মিক সফরে আসবেন বলে রূপোহাটির রিলিফের চালও সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান খবর পাঠিয়েছেন মন্ত্রী চলে যাওয়ার পরে কিছু চাল আসতে পারে। কিন্তু কখন যে আসবে তার ঠিক নাই। এলে মেম্বর দেওয়ার চেষ্টা করবেন। অনন্তএর কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঘাবড়াইও না অনন্ত। ভগবানের দিকে চাও তিনিই মুশকিল আসান করবেন। আমরা তো চেষ্টা তদবির কম করছি না তোমার লাইগা। আমাগোতো কোনো খ্যামতা নাই।

এর মধ্যে সেই দু্টো মেয়ে শচীনকে বর ভেবে ভুল করেছিল, তারা দুজনে আবার সুদামার সামনে এসে ঘটি ভরে জল রেখে প্রণাম করল। তার পায়ে জল ঢেলে মাজন করে দিল। কণের বুড়ি দিদিমা এসে বরকে আশীর্বাদ করল। ছন্ন চেহারার গ্রামের পাচু নাপিত একখানি ধুতি নিয়ে এসে সুদামাকে বলল, পইরা ফেলাও। সুদামা পরবে কি পরবে না এইরূপ দোনামোনা করতেই রামচন্দর ঘটক বলে উঠল, দেরী কইরো না বাপ। যা হয় মঙ্গলের জন্যি হয়। কানের কাছে মুখটা এনে গভীর কোনো গুপ্ত কথার মতো বলল, এই বউ তোমার যদি পছন্দ না হয় পরে তোমারে আরেকটা বিয়া দেব। মাইয়ার অভাব হইবে না।

পাচু নাপিত অপেক্ষা করছে সুদামা নতুন বস্ত্রটি পরলে তার পরণের পুরনো বস্ত্রটি সে নেবে। কিন্তু নতুন বস্ত্রটি মামা শ্যামচরণের পছন্দ হয়নি। তিনি বললেন, অ মাইয়ার বাপ, একখান নতুন ধুতিও কিনবার পার নাই। এইটা কি তোমাগো ঠাকুরদার বিয়ার ধুতি?

কণের বাবা অনন্ত মিস্ত্রী সেখানে ছিল না। বুড়ি দিদিমা উত্তর দিল, ওর ঠাকুরদার হইবে ক্যান। ওইটা রিলিফের থান। খাবার জোটাইতে পারে না—কেমনে গণ্ডায় গণ্ডায় বস্তর কেনে? তোমাগো পছন্দ না হইলে বিয়ার পরে আমারে দিয়া যাইয়ো। আমার পরণের কাপড় তেনা তেনা হইছে। আমি পরতি পারব।

এর মধ্যে উঠোনে দুটি পিঁড়ি পাতা হয়েছে। পিঁড়িতে লতাপাতা খাড়া। একটিতে বর বসবে। আরেকটিতে কণে। আরো দুটি পিড়ি এসেছে সেগুলো বর্ণহীন। একটাকে কণের বাবা—আরেকটিতে বাওন মশাই বসবেন। যে আধা বয়েসী লোকটি সংস্কৃত মন্ত্র বলেছিলেন, তিনি এবার একটা কাগজ বের করেছেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এবার বিবাহ-মঙ্গল কাব্য পড়া হবে। তিনি সিতাইকুণ্ড গ্রামের হরিপদ। এ গ্রামে পাঠশালার শিক্ষক। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কাব্য রচনা করেন। চোখের সামনে কাগজটি ধরে তিনি ত্রিপদী ছন্দে পড়তে শুরু করলেন,
রূপোহাটির বিলে আমরা সবাই মিলে
দিচ্ছি টুনির বিয়া।
গোপালগঞ্জের বর গড়বে সুখের ঘর
কইছি আশা নিয়া।।

এর মধ্যে রাত বাড়ে। পুবাল বাতাসও গতি পায়। আর জল বাড়ে। সেই জলে আদ্যিকালের চন্দন ঘষে সেই দুটো মেয়ে সুদামার কপালে ফোঁটা কাটতে গেল—তখন সুলেখা মাটিয়ে গড়িয়ে পড়ল। আছাড়ি-বিছাড়ি করে কেঁদে বলল, আমার কৃষ্ণ ঠাকুর চইলা যায়—এ প্রাণ রাখি কেমনে?

সবাই আবার রগড় মনে করে সুলেখাকে ঘিরে এলো। কে একজন ছাদনাতলার নিচ থেকে ধুকতে থাকা হারিকেনটা এনে দেখতে পেল, সুলেখার মধ্যে এবার কোনো ভান নেই—সে সত্য সত্যি কাঁদছে। মাটিতে মাথা ঠোকার কারণে ফুলতে শুরু করেছে। রক্তপাত হতে পারে। তাই দেখে তার ছোট বোন সুনিতি পাথর হয়ে যাচ্ছে।

শ্যামচরণ তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞেস কর্লেন, ওগো মা, তোমার কৃষ্ণ কেডা?

গোলোক ভেবেছিল জলপরি তার নাম বলবে। এই ভেবে সে নড়েচড়ে উঠল। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, জলপরি, এই যে আমি তোমার কৃষ্ণ। কিন্তু জলপরির সাড়া নেই। গোলোক বিভ্রান্ত বোধ করছে। তার খিদে পেয়েছিল। সে আবার শুয়ে পড়ার আগে দেখতে পেল, সুলেখা রানী মুর্ছা গিয়েছে। সুনিতি তার মাথাটি কোলে নিয়েছে। ডান হাত দিয়ে সুদামার দিকে ইঙ্গিত করে তার দিদির কৃষ্ণ ঠাকুরকে দেখিয়ে দিল। সুদামার চক্ষে তখন জলধারা নেমেছে। মুখের চন্দন ফোঁটা গলে পড়তে শুরু করছে। আকাশের আধা জ্যোৎস্না আধা অন্ধকারের দিকে চোখ তুলে বলল, রাধা। আমার রাধা। কথাটি এতো আস্তে বলল যে, কেউ শুনতে পারল না। শুধু তার বাল্য সখা রহিম ফকির বুঝতে পেরেছে। ফকিরের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠেছে। বুঝতে পেরেছে এ জীবনে রাধা আর কৃষ্ণ ছাড়া গীত নাই। কোনো না কোনোভাবে তাদের ভিন্ন কোনো সত্বা নাই। তারা এক। বহুর ধারণা একটা বিভ্রম মাত্র।

ফলে এইখানে এসে রূপোহাটির রূপের বৃত্তান্ত নতুন একটি পর্বে পতিত হয়। রাধারূপী সুলেখারানী কৃষ্ণরূপী সুদামাপদে দেহ-মন-প্রাণ সঁপে দিয়ে পড়ে আছে। নৌকা থেকে পিলপিল করে হাড্ডিসার মানুষ ধীরে ধীরে ঘাটকূলে—উঠোনে আসতে শুরু করেছে। সারি দিয়ে নিঃশব্দে উঠোন জুড়ে বসছে। তাদের হাতে নানা প্রকার বাসন-কোসন। হরেণ মেম্বরের চাল আসার খবর এখনও হয় নাই। হরেণ মেম্বর নরা মণ্ডলকে হেকে বলছেন, এই মানুষগুলোরে সামলা রে নরা। নরা মণ্ডলের সাড়া নাই। তার এখন বেশ খিদে লেগেছে। সে ঘরের পিছনে চলে গেছে। তার ইচ্ছে—আজ দুটো গরম গরম বাড়তি ভাত খাবে। বিলেসচন্দ্র তার দিকে বড় মুখ করে চেয়ে আছে। তাদের সামনে কাটা শৈল মাছ পড়ে আছে। কমড়ো ধয়া হয়েছে। চুলর উপরে ভাতের ডেকচিতে জল ফুটছে। কিন্তু চাল দেওয়া হয়নি। হিরোণ গ্রামের নামী রাঁধুনী পদ্মঝিয়রীকে দেখা যাচ্ছে না। তার পানের পিক এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে।

এর মধ্যে রহিম ফকির বাওন থাকুরের কাছে এসে ধরা গলায় বলল, আমার নাম রহিম ফকির হইলেও আমি আগে মানুষ। যদি আপনাগো সমস্যা না থাকে তাইলে এই মাইয়ার জন্যি আমি বর হতি রাজী আছি। মাই মাইয়ার লগ্ন রক্ষা করতি চাই।

বাওন ঠাকুরের এই সব কথায় কান দেওয়ার সময় নাই। তার মুখ বিরক্তিতে পুর্ণ হয়ে আছে। বহুদিন পরে আজ তার কপালে বিয়ের পুরুতগিরী জুটেছিল। কপালে ফেরে তা খসে জেতে শুরু করেছে। এখন দুটো চাল-কলা পাওয়া যাবে কিনা সে চিন্তায় হাসফাস করছে। রহিম ফকিরকে অগ্রাহ্য করে কণের বাবা অনন্ত মিস্ত্রীকে খুজতে লাগল।

এই ফাঁকে আরও লোকজন ঘাট থেকে উঠে আসছে। সুলেখা রানী সিঁদুর কৌটাটা সুনিতির হাতে দিয়ে বলল, মাইয়ার হাতে দিয়া আয়। সুনিতি এই লোকজনের ভিড় বাঁচিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেল বারান্দায় হারিকেনটা নেই। নিভে গেছে।

অথবা কেউ নিয়ে গেছে। আকাশে চাঁদের আলোতে সে বারান্দায় উঠে এলে। ঘরের দরজাটা খোলা। ঘরের মধ্যে কেউ নেই। ঘরের পেছনের বেড়া খোলা। বেড়া খুলে এ ঘরের লোকজন চলে গেছে। বিয়ের কোণেও নেই। কোনোকালে ছিল বলেও তেমন কোনো চিহ্ণ নেই।

শুধু তুলসি তলায় বুড়ি দিদিমা বসে আছে। তার চোখ বিভ্রান্ত। সুনিতিকে দেখে তার হাত ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, কেউ নাই। অরা চইলা গেছে। যাওনের সময় আমারেও নিতি চাইছিল। আমি যাই নাই। আমি তঞ্চকতা পছন্দ করি না। আমারে সব কইয়া যাতি হবে। এই জন্যি বইসা আছি।
বুড়ি দিদিমা আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। সুনির হাত ধরে বাড়ির পিছনে এলো। সেখানে হোগলা ঝওপের আড়ালে একটা নৌকার আগার অংশ দেখা যাচ্ছে। দিদিমা বলল, অভাবের দিনে টুনিলতার বিয়ার কথা গুপ্ত রাইখাছিল আমার জামাই বাবাজী। কাল যখন মাইয়ারে কইছে—তখন মাইয়া টুনিলতা জলে ঝাপ দিছে। কেউ দেখে নাই।
সুনিতি মুখে আঁচল চাপা দিয়েছে। শিউরে উঠেছে। তা দেখে দিদিমা বলল, ঝাপ না দিয়া করবে কি? ঘরে ভাত নাই। বিয়ার আসরে বসে কেমনে! ছাওয়াল পক্ষ কই ছাইড়া দেবে মাইয়ারে?

একটু চুপ থেকে দিদিমা আবার বলল, সেইডা সমস্যা না। মাইয়া জনম লইছিই জলে ঝাঁপ দেওনের লাইগা। আমার বড় বইনও ঝাঁপ দিছিল। আমার সাইজা মাইয়া দিছিল। আমিও দিছিলাম। তখন আমাগো মাঠে ধান। বাপে কাটতে যাবে। মাইঝা কর্তা কইলেন, ধান কাইটা আর করবি কি। দ্যাশ আর নাই। মাঠে যাইয়া বাপে যাইয়া দেখে দ্যাশ আছে। ফসল নাই। এদিকে আমার বিয়ার বাদ্য বাজতেছে। ধান কেডা নেছে? কর্তা বাবু? না, মোজাম সদ্দার? কেউ কইতে পারে নাই। কর্তা বাবুর খবর নাই। তিনি কৈলকাতা। লোকে কয় কর্তাবাবু ধান সুদ্দা জমি জিরেত মজাম সদ্দারের কাছে বেঁইচা কৈকাতা গেছে। আর আইবে না।

দিদিমা বলল, আইজ আমার জামাই বাবাজি বড় মাইয়ার বদলে মাইজা মাইয়া পুনিলতার লগে বিয়ার যোগাড় কইরা রাখছিল। পুনিরে কই নাই। তোমাগো আসার কথা এক কুড়ি—আইছ সোয়া দুই কুড়ি। মেম্বর শলা কইরা কাইজা পাতাইল। ইচ্ছা–খাওন দাওন ছাড়াই আইজ বিয়া দেওন হইবে। পুনি বালার লগে।

সুনিতি স্তব্ধ হয়ে সুনছে। দিদিমার ঠোঁট কাঁপছে। ঘন ঘন চোখ মুছছে। বলল, শোনো মাইয়া, সেইডাই প্রায় ঘটতে যাইতেছিল। কিন্তু গেরামের না খাওয়া মাইনসে যখন বিয়ার খবর পাইল, তখন তারা খাওনের আসায় পঙ্গপালের লাহান আইসা পড়তেছে। সেগো সামলানোর সাধ্যি কি কারো আছে?

বুড়ি দিদিমা নৌকার আগায় উঠে পড়ল। হাতড়ে একটা বৈঠা পেল। সেটা বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরল। উঠোনে তখন অনেক মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে। দিদিমা সুনিতিকে বলল, সামলানোর সাধ্যি কারো নাই বইলা তারা মাইয়া ঝুত নিয়া পলাইয়া গেছে। তোমরাও যাও। এই বাড়ি থাইকো না। আমাগো ক্ষ্যামা দিও।
দিদিমা তার কাঁপা কাঁপা হাতে বৈঠা জলে ফেলল। নৌকাটি একটু পিছিয়ে দেয়ে এবার সামনে এলো। হোগলা ঝপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। নৌকায় দিদিমার এক ছেলে লগির খোচ মারছে। তার মুখ ভাবলেশহীন। নৌকার পাটাতনে একটা মেয়ে শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। কিছুটা ফুলে উঠেছে। মুখে শ্যাঁওলা জমেছে বলে সবুজ হয়ে আছে। মাথা ভর্তি চুল। চুলের মধ্যে লাল ফিতা। দিদিমা বলল, আমার বড় নাতনি টুনিলতা। অর মামারা টুনিরে একটু আগে খুঁইজা পাইছে সিলনার বিলে। বিলের জলে ভাইসা উডছিলো।

এই টুকু বলতে বলতে ছেলের সঙ্গে বুড়ি নিজেও বৈঠা ধরেছে। কাঁপা হাতে খোঁচ মারতে শুরু করেছে। তরা করে যেতে হবে। পুনিলতাদের নৌকাটি ধরতে হবে। টুনিলতার বাবা-মাকে দেখিয়ে আবার জলে ভাসিয়ে দিতে হবে। আর দেরী করার সময় নাই। নৌকাটি সুনিতির চোখের বাইরে চলে গেলো। চাঁদের উপরে একখণ্ড মেঘ পড়েছিল। সহসা অন্ধকার হয়ে গেল। অসংখ্য মানুষের কোলাহলে নৌকার ছপ ছপ ধ্বনি মুছে গেল। সুনিতির গলা থেকে তখন হেচকি উঠেছে। কাঁদতে পারছে না। বমি পাচ্ছে।

গোলোককে টেনে তুলেছে সুলেখা রানী। তার ঘুমের ঘোরের মধ্যে হএর ধরে অনেক গা বাঁচিয়ে বাছড়িতে উঠতে পেরেছে। বলল, এই নাও তোমার বৈঠা। বাই-লাগা গোলক সে বৈঠাটা হাতে নিয়ে, বাঁকা করে ঘাড়ের আড়ালে দেখলে। জলপরি তাকে রেখে জলে নেমে যাচ্ছে। গুপ্ত কথার মত করে বলছে, প্যাট ভৈরা দীঘা ধানের ভাত খাতি আইছিলাম। জলের মধ্যে তার পা দুখানি ডুবেছে। কোমরটাও ডুবতে ডুবতে জলের মধ্যে গলে যাচ্ছে। সেই গাঢ় সবুজ রঙ জলে ভেসে যাচ্ছে। গোলোক বলল, যাইও না জলপরি। জলপরি ততক্ষণে গলা জলে। বলল, থাইকা কী করব, দ্যাশে ভাত নাই। জলে নাইমা যাই। জলপরি জলে নেমে মিশে গেল। শুধু তার চুল জেগে রইল। সেই চুলের মধ্যে লালফিতা দেখতে দেখতে গোলোক বুঝতে পারল, জলপরি নেই। হরষিৎ তাকে ঠেলা দিয়ে বলল, মারো টান হেইও।

এর মধ্যে সুদামা আবার বাছাড়ি নৌকার হালে দাঁড়িয়েছে। রহিম ফকির মাথা নিছু করে বসে আছে। আজ তার বোনটির কথা মনে পড়েছে। বারবার কানের ভেতরে বলছে, ভাইজানগো, ফ্যান ত্যালানী আর খাতি মন চায় না। আমারে দুইটা ভাত খাইতি নিয়া যাও। শচীন ছইয়ের নিচে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। তার রেডিওটা কানে নিয়ে সুলেখা রানী গান খুঁজতে লেগেছে। শ্যামচরণ হুক্কায় টান দিচ্ছেন। টানে জোর হচ্ছে না। তারা আজ পরান নিয়ে বেছে আসছে ঠিকই। কিন্তু মাইয়া আনতে পারে নাই। বিয়ে করাতে ব্যর্থ হয়েছে। এলাকার লোকের কাছে কী কৈফিয়াত দেবে?

সুনিতি হাতড়ে হাতড়ে নোচনার হাড়িটি বের করেছে। বিয়ে বাড়িতে দেওয়া হয়নি। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে এক কোষ মুড়ি বের করেছে। সুলেখা হাত পেতে নিয়ে মুখে দিয়েছে। চোখে আরাম লাগছে। শচীন চোখ খুলে এই প্রথম বলল, আমারেও দুগগা দেও। মুড়ি চাবাতে চাবাতে সুলেখা ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আর উঠবে না। সুদামা হেকে বলল, সুনিতি বইন, মুড়ি কি আর আছে? খালি পেটে জোর পাতিছি না।

এই সময় বাছাড়ি নৌকাটি রূপোহাটি গ্রাম ছেড়ে শুকতাইল গ্রামের সীমানায় ঢুকে পড়েছে। তখন দেখা গেল—একটি নৌকা তীর বেগে ছুটে আসছে। রাতে আলো আন্ধকারে ভালো করে চেনা কঠিন। সেই নৌকা থেকে কে একজন চেচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, রূপোহাটি গেরাম আর কতদুর?

রামচন্দর ঘটকের মুখে হাসি ফুটেছে। এ গলা সুবলের—সুবোল সখার। সুবোল সখা ছাড়া আর কেউ নয়। ঘটক এবার মামা শ্যামচরণের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, আপনের হুক্কাডা দ্যান। জুত কইরা দুইটা টান মারি


Comments

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.