রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি এবং জমিদারের রবীন্দ্রগিরি : ত্রয়স্ত্রিংশ পর্ব

কুলদা রায়'s picture
Submitted by porimanob [Guest] on Thu, 29/03/2012 - 11:10pm
Categories:

কুলদা রায়
এমএমআর জালাল

মুসলমান খণ্ড—৫

সুফিয়া কামাল রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের বৈশাখে। কবি তখন আলমোড়ায়। কবি সুফিয়া কামালকে কয়েকটি লাইন লিখে পাঠালেন—
বিদায়-বেলার রবির সনে
বনশ্রী তার অর্ঘ্য আনে
অশোক ফুলের বরুণ অঞ্জলি।
আভাস তারই রঙিন মেঘে
শেষ নিমিষে রইল লেগে
রবি যখন অস্তে যাবে চলি।

কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের স্ফুলিঙ্গ কাব্যের ২৬৭ সংখ্যক কবিতাংশে সংকলিত হয়েছে। কবিতাটি পাঠিয়ে কবি সুফিয়া কামালকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। সুফিয়া কামালের বাড়ি বরিশালে জেনে কৌতুক করে বলেছিলেন-তুমি আমার বেয়াইয়ের দেশের মানুষ। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মধুর-মিষ্টি তুমি। কবির মেজো মেয়েটির বিয়ে দিয়েছিলেন বরিশালে।

সুফিয়া কামাল লিখেছেন, তিনি (রবীন্দ্রনাথ) সুরসিক সুন্দর মনের মানুষ। কতবার তাঁর বাড়িতে গিয়েছি। তাঁর নিজের করা নাটক দেখতে আমাকে ডেকেছেন। নিজ হাতে নাম লিখে তাঁর গোরা বইখানা আমাকে উপহার দিয়েছেন। লিখেছেন-- শ্রীমতি কল্যাণীয়া সুফিয়া খাতুনকে স্নেহ উপহার দিলাম
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭ আশ্বিন ১৩৩৬।

সুফিয়া কামাল প্রথম দিন জোড়াসাঁকোতে গিয়েছিলেন বোরকা পরে। সঙ্গে তাঁর স্বামী নেহাল হোসেন। মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাও গিয়েছিলেন কবির কাছে বোরকা ছাড়াই। পায়ে হাত দিয়ে কবিকে সালাম করছেন। তিনি লিখেছেন, আমি সেলাম করে উঠলে দুহাত উর্দ্ধ তুলে চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ ধরে কি প্রার্থনা করলেন। আমি অবাক হয়ে দেখেছি তাঁর সর্বদেহ থেকে আলোক বিচ্ছুরিত হতে লাগলো। তারপরে তিনি পাশে বসিয়ে গল্প করতে আরম্ভ করলেন—তোমরা যে পর্দ্দা থেকে বাইরে এসেছ এই আমি আশ্চর্য হয়েছি। দ্যাখো সূর্যের কিরণ না পেলে যেমন গাছপালা বড় হয় না ফলমুল ভালো দেয় না, মানুষও তেমনি বাইরের আলোবাতাস ছাড়া পূর্ণ হতে পারে না। পদ্ম পঙ্ক থেকে উর্দ্ধে উঠেই সূর্যের কিরণ লাভ করে, না হলে সে লাভ করতে পারত না। আর এখানেই তার সার্থকতা।

রাহাত আরা বেগম রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটক উর্দুতে অনুবাদ করেছিলেন। ১৯২৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি স্বামীর সঙ্গে জোড়াসাঁকোর বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, খুবই ভদ্রতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি (রবীন্দ্রনাথ) আমাদের সঙ্গে মিশলেন। অনেক কথা বললেন। ...আমাদের দুজনকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে কিছুদিন থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সওগাত পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বের হওয়ার পরে জোড়াসাঁকোতে কবির সঙ্গে দেখা করলেন। কবিকে সালাম জানালেন। শান্তস্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি সালাম গ্রহণ করে বসতে বললেন। সওগাত পত্রিকা থেকে দুটো কবিতা পড়লেন। সওগাত নামটির প্রশংসাও করলেন। নাসিরউদ্দিন সওগাত পত্রিকার জন্য কবির কাছে কবিতা চাইলেন।

কবির সব লেখাই তখন বিশ্বভারতীর কাছে প্রদান করেছেন। কবির লেখা পেতে হলে বিশ্বভারতীকে টাকা দিতে হয়। এই লেখা থেকে প্রাপ্ত টাকা বিশ্বভারতীর পরিচালনার কাজে ব্যয় হয়।

নাসিরউদ্দিন সেকথা শুনে ফিরে গেলেন। টাকা দিয়ে লেখা নেওয়ার সঙ্গতি তাঁর নেই। কদিন পরেই ডাকে কবির একটি চিঠি তিনি পেলেন। সঙ্গে একটি কবিতা। কবি তাঁকে লিখেছেন-- বিশ্বভারতীকে টাকা দিয়ে আমার লেখা নেয়া তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না বলে সেদিন জানিয়েছিলে। আমি লক্ষ্য করেছি তুমি খুব নিরাশ হয়ে চলে গেলে। একটা কবিতা পাঠালাম। আশা করি তোমার ভাল লাগবে। এর জন্য তোমাকে টাকা দিতে হবে না। এরপর মাঝে মাঝেই কবি নিজের উদ্যোগেই সওগাত পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছেন। সওগাতের দ্বিতীয় সংখ্যায় একটি কথিকা পাঠিয়েছিলেন। নাম ছিল—সওগাত।

কবি জসীমউদ্দিনের নকশী কাঁথার মাঠ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করে লিখেছিলেন—জসীমউদ্দিনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত কবির কদর এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমন খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।

একরামউদ্দীন (১৮৮০—১৯৩৫) ‘রবীন্দ্রপ্রতিভা’ সমালোচনাগ্রন্থ লিখেছিলেন। বইটিকে তিনি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। কবি চিঠিতে লিখেছিলেন-- আপনি যে সরস বাংলা ভাষায় আমার রচনার সমালোচনা করিয়াছেন তা পাঠ করিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি।

ইমাম গাজ্জালীর ইয়াহিয়া-উল-উলমুদ্দিনের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ কিমিয়া সাআদাত অনুবাদ করেছিলেন মীর্জা মোহাম্মদ ইউসফ। বইটির নাম রেখেছিলেন সৌভাগ্য স্পর্শমণি। রবীন্দ্রনাথ বইটি পড়ে পরম তৃপ্তি লাভ করেছেন। গ্রন্থটির মধ্যে ভাবের মহত্ত্ব দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন।

সারা তৈফুর (১৮৮৮-১৯৭১) হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রথম বাঙালি মুসলমান মহিলাজীবনীকার। তিনি এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নি ও ইতিহাসবিদ-পুরাতত্ত্ববিদ সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরের স্ত্রী। তাঁর স্বর্গের জ্যোতিঃ পুস্তিকা রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন। বইটির একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল মৌলবী মুজিবর রহমান সম্পাদিত দি মুসলমান পত্রিকা। সেখানে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির উদ্ধৃতি ছিল—আপনার স্বর্গের জ্যোতি: গ্রন্থখানি পাঠ করিয়া আনন্দিত হইলাম, ইহার ভাষা ও রচনা সুন্দর হইয়াছে। বাংলা ভাষায় এরূপ গ্রন্থের অভাব ছিল, আপনি তাহা দূর করিয়াছেন।

মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী (১৮৮০—১৯৪০) হযরত মোহাম্মদের কিশোর জীবনী লিখেছেন নূরনবী নামে। রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠির বইটির পুনর্মুদ্রিত সংস্করণে চিঠিটির অংশ বিশেষ ছাপা হয়েছিল। সেখানে নূরনবীর বইটির প্রশংসা করেছেন। বইটির বিষয় ও রচনাপ্রণালী শিশু পাঠকদের পক্ষে মনোরম বলে প্রশংসা করেছেন।

কাজী আবদুল ওদুদের নদীবক্ষে উপন্যাসটি পড়ে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ১৫ বৈশাখ কবি লিখেছেন-- আপনার লিখিত নদীবক্ষে উপন্যাসখানিতে মুসলমান চাষীগৃহস্থের যে সরল জীবনের ছবিখানি নিপুণভাবে পাঠকদের কাছে খুলিয়া দিয়াছেন তাহার স্বাভাবিকতা, সরসতা ও নূতনত্বে আমি বিশেষভাবে আনন্দলাভ করিয়াছি—এই কারণে আমার কৃতজ্ঞতা জানিবেন।

কাজী আবদুল ওদুদের প্রথম প্রবন্ধ সংকলনে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন—রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভা এবং রবীন্দ্রনাথ ও প্রতিভাবর প্রথম বিকাশ। তিনটি প্রবন্ধ শুরুতে ১৩৩২ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশি হয়েছিল। কবি বইটি পড়ে লিখেছেন—এতে মনের জোর, বুদ্ধির জোর, কলমের জোর একসঙ্গে মিশেছে।...গোঁড়ামীর নিবিড় বিভীষিকার ভিতর দিয়ে কুঠার হাতে তুমি পথ কাটতে বেরিয়েছ, তুমি ধন্য।
১৬ অক্টোবর ১৯৩৪ সালে কাজী আবদুল ওদুদকে শান্তিনিকেতন থেকে চিঠিতে কবি তাঁর নিজের গান বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বলেছেন, আমার গান সম্বন্ধে আপনার প্রবন্ধ পূর্ব্বেই পড়ে আমি বিশেষভাবে খুশি হয়েছিলাম। তার কারণ আমার পাঠকেরা আমার গানকে কাব্যের সম্পূর্ণতা থেকে স্বতন্ত্র করে দেখে। সুরের একান্ত আশ্রিত সে রকম কবিতাও আমার আছে—সুর থেকে বিচ্ছিন্নতার বৈধব্য দশায় সে শ্রীহীন এবং প্রায় নিরর্থক। কিন্তু আমার বিস্তর গান আছে তা কাব্য, বাইরে থেকে সুর যোজনা না করলেও সুর আছে তার অন্তর্নিহিত। আমার নিজের বিশ্বাস কাব্য হিসাবে আমার অধিকাংশ কবিতার চেয়ে সেগুলো শ্রেষ্ঠ। বঙ্গসাহিত্যে জাতীয়তার আদর্শ বিষয়ে তিনি ওদুদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এ বিষয়ে তিনি ওদুদকে লেখেন--সাহিত্যের প্রধান ধর্ম্মই এই সকল আদর্শ তার মধ্যে প্রধানত পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায় প্রত্যক্ষভাবে নয়, এই কারণেই সে আদর্শ সর্ব্বজাতীয় হয়ে ওঠে—উপস্থিত কালের মধ্যেই তার ফল ফলে না দীর্ঘকালে তার সফলতা।

কাজী ইমদাদুল হকের (১৮৮২—১৯২৬) আবদুল্লাহ (১৯৩৩) উপন্যাস পড়ে কবি ওদুদকে লিখেছিলেন, আব্দুল্লাহ বইখানি পড়ে আমি খুশি হয়েছি। বিশেষ কারণ এই বই থেকে মুসলমানদের ঘরের খবর জানা গেল। এ দেশের সামাজিক আবহাওয়াঘটিত একটা কথা এই বই আমাকে ভাবিয়েছে। দেখলুম যে ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্থ করেছে সেই অন্ধতাই ধুতি চাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। একি মাটির গুণ? এই রোগ বিষে ভরা বর্ব্বরতার হাওয়া এ দেশে আর কতদিন বইবে। আমরা দুই পক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলে চলব।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ভাষা ও সাহিত্য ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩১ সালে। বইটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ শহীদুল্লাহকে ১৯৩২ সালের ২৯ জুলাই চিঠি লিখে জানান, বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের আহবান করে আপনি যে প্রবন্ধ কয়টি লিখেছেন, তা হিন্দুদেরও বিচার্য্য। বাংলার ভাষাতত্ত্ববিচার সম্বন্ধে আপনার যোগ্যতার প্রশংসা অনাবশ্যক। এ প্রসঙ্গে আপনি আমাকে সাধুবাদ দিয়েছেন তাতে আমি সংকোচ বোধ করি। যে সময়ে আমি এই অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেম তখন এ পথে আমি ছিলাম একা। তাছাড়া বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে আমি সম্পূর্ণ আনাড়ি। অন্ধকারে আমার প্রদীপ ছিল না, হাতড়িয়ে বেড়িয়েছি। যখন থেকে আপনাদের হাতে আলো জ্বলল, তখন থেকেই এই অধ্যবসায় ত্যাগ করেছি।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ইরানী কবি হাফেজের কবিতার পদ্যে অনুবাদ করেছিলেন। সেগুলো পড়ে কবি এই চিঠিতে অনুবাদ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন কবি—বাংলা ভাষায় আরবী ও পারসী সাহিত্যের অনুবাদ অবশ্য কর্তব্য আমার তাতে সন্দেহ নেই। যদি বিশ্বিভারতীর এ অর্থদৈণ্য কখনো দূর হয় তবে এ কাজে নিশ্চয়ই প্রবৃত্ত হব।

বিদেশী ভাষার উচ্চ শ্রেণীর কাব্যগুলিকে পদ্যে অনুবাদ করার চেষ্টা বর্জ্জনীয় বলে আমি মনে করি। কবিতায় এক দিকে ভাবার্থ, আর এক দিকে ধ্বনির ইন্দ্রজাল। ভাষার্থকে ভাষান্তরিত করা চলে কিন্তু ধ্বনির মোহকে এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় কোনোমতেই চালান করা যায় না। চেষ্টা করতে গেলে ভাবার্থের প্রতিও জুলুম করতে হয়। এই কারণেই পদ্যে আপনার হাফেজ অনুবাদ চেষ্টার আমি অনুমোদন করতে পারলেম না।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বাঙ্গালা ব্যাকরণ ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। কবি সেটি পড়ে কবি সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে চিঠিতে জানিয়েছেন। ব্যাকরণখানি সকল দিক থেকেই সম্পূর্ণ হয়েছে—এতে ছাত্রদের উপকার হবে বলেও লিখেছেন। বইটি শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ছাত্রদের ব্যবহারের জন্য।
ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে একমাত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথের বিয়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে ১২ মে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়র ম্যানেজিং কমিটির (সিন্ডিকেট) সদস্যরূপে বরণ করে চিঠি লিখেছিলেন মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। শহীদুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সমস্যার কারণে তিনি বিশ্বভারতীর প্রথম সংসদের সদস্যপদ লাভের দুর্লভ সম্মান গ্রহণে দ্বিধাবোধ করেছিলেন। তবে সংসদের সদস্যদের তালিকায় শহীদুল্লাহর নাম মুদ্রিত হয়েছিল। অধ্যাপক ভুঁইয়া ইকবাল লিখেছেন--সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী শহীল্লাহর নিযুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ এই শাস্ত্রীই ১১ মাস আগে শহীদুল্লাহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার সময়ে তাঁর নিযুক্তির সমর্থন করেছিলেন। আমাদের ধারণা, ওই পরিস্থিতিতে শহীদুল্লাহ হয়তো রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে উপযুক্ত সাড়া দেওয়া নিরাপদ বিবেচনা করেন নি।

নবীন কবিযশোপ্রার্থী আজিজুল হাকিম কবির বাণী চেয়েছিলেন। কবি ১৯২৯ সালের ১০ অক্টোবর তাঁকে লিখেছিলেন, আমার বাণী আমার কাজের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। যখন আমার কাজের সঙ্গে পরিচয় হবে তখন আমার বাণী শুনতে পাবে। আমাদের দেশে আমরা কেবল কথা বলচি এবং কথা বলচি এবং কতকগুলি বাধা-কথার বন্ধনে বদ্ধ হয়ে পড়েচি। বড়ো কথা মাত্রই অত্যন্ত পুরোনো, কাজের মধ্যে দিয়েই জীবনে তাদের নূতন করে আবিষ্কার করি। যতক্ষণ না করি ততক্ষণ সে কথাগুলো বস্তার ভিতরকার বীজের মতো, যে বীজ উপযুক্ত মাটির মধ্যেই সক্রিয়, সার্থক হয়। অন্যত্র কেবল মাত্র বোঝা হয়ে থাকে।

মুরশিদাবাদের নবাব বাহাদুরের নেতৃত্ত্বে হিন্দু মোসলেম সম্প্রীতি সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে ১৯৩৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি দন্তচিকিৎসক ডাঃ আর আহমদকে শুভেচ্ছা পত্র লিখেছিলেন। তিনি কবির দাঁতের চিকিৎসা করেছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় সন্তুষ্ট হয়ে কবির সহকর্মী প্রমোদেলাল গাঙ্গুলির দন্তক্ষয়ের চিকিৎসা করার অনুরোধ করেছিলেন।

বন্দে আলী মিয়ার ময়নামতি চর কাব্যগ্রন্থ পড়ে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছেন, তোমার ময়নামতির চর কাব্যখানিতে পদ্মাচরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথাও ফাঁকি নেই। সমস্ত মনের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস ভঙ্গিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক শব্দগুলি যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুণ্ঠিত হওনি তাতে করে কবিতাগুলি আরো সরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাপাড়ের পাড়াগাঁয়ের এমন নিকট স্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না।

পদ্মা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে বড়ো জায়গা আছে। সারা জীবন ধরে যে নদীকে দেখেছেন বা ভেবেছেন বা গড়েছেন সে নদী পদ্মাই। শিলাইদহ থেকে চলে আসার অনেক দিন পরে, যখন তিনি খুব বুড়ো হয়ে গেছেন, বাইরে যাওয়ার আর সামর্থ্যটি নেই—তখন তিনি লিখেছিলেন শান্তি নিকেতনের কোপাই নদীটিকে নিয়ে একটি কবিতা। কোপাই নদীটিকে লিখতে গিয়ে হঠাৎ করে লিখে ফেলেন পদ্মার কথাই।

পদ্মা কোথায় চলেছে দূর আকাশের তলায়,
মনে মনে দেখি তাকে।
এক পারে বালুর চর,
নির্ভীক কেননা নিঃস্ব, নিরাসক্ত—
অন্য পারে বাঁশবন, আমবন,
পুরোনো বট, পোড়ো ভিটে,
অনেক দিনের গুঁড়ি-মোটা কাঁঠালগাছ—
পুকুরের ধারে সর্ষেখেত,
পথের ধারে বেতের জঙ্গল,
দেড়শো বছর আগেকার নীলকুঠির ভাঙা ভিত,
তার বাগানে দীর্ঘ ঝাউগাছে দিনরাত মর্মরধ্বনি।
ওইখানে রাজবংশীদের পাড়া,
ফাটল-ধরা খেতে ওদের ছাগল চরে,
হাটের কাছে টিনের-ছাদ-ওয়ালা গঞ্জ—
সমস্ত গ্রাম নির্মম নদীর ভয়ে কম্পান্বিত।
পুরাণে প্রসিদ্ধ এই নদীর নাম,
মন্দাকিনীর প্রবাহ ওর নাড়ীতে।
ও স্বতন্ত্র। লোকালয়ের পাশ দিয়ে চলে যায়—
তাদের সহ্য করে, স্বীকার করে না।
বিশুদ্ধ তার আভিজাতিক ছন্দে
এক দিকে নির্জন পর্বতের স্মৃতি, আর-এক দিকে নিঃসঙ্গ সমুদ্রের আহ্বান।
একদিন ছিলেম ওরই চরের ঘাটে,
নিভৃতে, সবার হতে বহুদূরে।
ভোরের শুকতারাকে দেখে জেগেছি,
ঘুমিয়েছি রাতে সপ্তর্ষির দৃষ্টির সম্মুখে
নৌকার ছাদের উপর।
আমার একলা দিন-রাতের নানা ভাবনার ধারে ধারে
চলে গেছে ওর উদাসীন ধারা—
পথিক যেমন চলে যায়
গৃহস্থের সুখদুঃখের পাশ দিয়ে, অথচ দূর দিয়ে।

১৮৯১ সালের অক্টোবরে (সোমবার ৩ কার্তিক) ইন্দিরাকে লিখেছিলেন কবি, কোজাগার পূর্ণিমার দিন নদীর ধারের আস্তে আস্তে বেড়াচ্ছিলুম—আর মনের মধ্যে স্বগত কথোপকথন চলছিল;ঠিক ‘কথোপকথন’ বলা যায় না, বোধ হয় আমি একলাই বকে যাচ্ছিলুম আর আমার সেই কাল্পনিক সঙ্গীটি অগত্যা চুপচাপ করে শুনে যাচ্ছিল, নিজের হয়ে একটে জবাব দেওয়াও সে বেচারার জো ছিল না—আমি তার মুখে যদি একটা নিতান্ত অসঙ্গত কথাও বসিয়ে দিতুম তা হলেও তার কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী আর বলব। কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না;--ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে আর এ পর্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্না ঝিক ঝিক করছে; একটি লোক নেই, একটি নৌকো নেই, ও পারের নতুন চরে একটি গাছ নেই, একটি তৃণ নেই—মনে হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীর চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূণ্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্প এই পরিত্যাক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে, আজ সেই-সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের ‘তেপান্তের মাঠ’ এবং ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী; ম্লান জ্যোৎস্নায় ধূ ধু করছে। আমি যেন সেই মুমূর্ষু পৃথিবীর একটি মাত্র নাড়ীর মতো আস্তে আস্তে চলছিলুম। আর সকলে ছিল আর-এক পারে, জীবনের পারে...

বাস্তবিক পদ্মাকে আমি বড়ো ভালোবাসি। ইন্দ্রের যেমন ঐরাবত আমরা তেমনি পদ্মা-আমার যথার্থ বাহন; খুব বেশি পোষ-মানা- নয়, কিছু বুনোরকম; কিন্তু ওর পিঠে এবং কাঁধে হাত বুলিয়ে ওকে আমার আদর করতে ইচ্ছে করে। ...আমি যখন শিলাইদহে বোটে থাকি তখন পদ্মা আমার পক্ষে সত্যিকারের একটি স্বতন্ত্র মানুষের ...
(ছিন্নপত্র, ২ মে ১৮৯৩)


Comments

আব্দুর রহমান's picture

দাদা, আমার ঠিক মনে নেই কোথায় পড়েছিলাম, খুব সম্ভবত সৈয়দ মুজতবা আলীর কোনো একটা লেখায়, সেখানে লেখা ছিলো প্রশংসা বিতরণে কবিগুরু উদারহস্ত ছিলেন। একথাটা কতখানি ঠিক? তিনি কি কখনো কারো সমালোচনা করেছেন, খুব কড়া ভাষায়?

------------------------------------------------------------------
এই জীবনে ভুল না করাই সবচেয়ে বড় ভুল

কুলদা রায়'s picture

রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা বিতরণে উদার হস্ত ছিলেন এটা ঠিক। আবার যা প্রশংসার যোগ্য নয়--তাকে কিন্তু প্রশংসা করতেন না। সমালোচনাও করতেন। দেখুন এই লেখাটাতেই তার প্রমাণ আছে। তিনি কাজী আবদুল ওদুদকে খুব উচ্চ মুল্য দিতেন। বঙ্গসাহিত্যে জাতীয়তার আদর্শ বিষয়ে তিনি ওদুদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এ বিষয়ে তিনি ওদুদকে লেখেন--সাহিত্যের প্রধান ধর্ম্মই এই সকল আদর্শ তার মধ্যে প্রধানত পরোক্ষভাবে প্রকাশ পায় প্রত্যক্ষভাবে নয়, এই কারণেই সে আদর্শ সর্ব্বজাতীয় হয়ে ওঠে—উপস্থিত কালের মধ্যেই তার ফল ফলে না দীর্ঘকালে তার সফলতা।
ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর হাফিজের কবিতার পদ্যঅনুবাদকে সমর্থন করেন নি। শব্দ ব্যবহার নিয়ে তাঁর কিছু ভিন্নমত আছে। সেগুলো দীর্ঘ বিতর্কও করেছেন। আমরা সেসব বিষয় নিয়ে একটি পর্বে আলাপ করার ইচ্ছে রাখি।

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.