গুহাচিত্র

হিমু's picture
Submitted by himu on Mon, 18/02/2008 - 5:44am
Categories:

প্রচুর কাজ জমে থাকার পরও রবিবারকে ছুটির দিন ধরে নিয়ে অসংখ্য ব্যক্তিগত ভ্যাজালকে নতুন সপ্তাহের দিকে ঠেলে দিয়ে বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে। দুপুরে মোটামুটি ভুরিভোজের পর সিদ্ধান্ত নিলাম, বহুদিন হলো টেবিল টেনিস খেলি না, আজ তাহলে তা-ই করি। আমার ভোনহাইমে টেবিল টেনিস খেলার কোন সরঞ্জাম নেই, খেলতে গেলে যেতে হবে শহরের আরেক দিকে হের রেহমানের ছাত্রাবাসে, ফোন করে জানলাম খেলা যেতে পারে আজকে।

কিন্তু মিনিট পনেরো পিটাপিটি করেও চতুর্থ ব্যক্তির অনুপস্থিতি বেশি পীড়াদায়ক হয়ে ওঠায় টেবিল টেনিসে ইতি টেনে মোনোপোলি খেলার সিদ্ধান্ত হলো। সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিয়ে ভুনা মুরগি দিয়ে ঠেসে ভাত খেয়ে যখন আমি আর হের চৌধুরী আবার পথে নামলাম দুইজন যথার্থ মাতালের মতো, তখন তাপমাত্রা সেলসিয়াসে শূন্যের আশেপাশে। কনকনে বাতাসও চালিয়েছে, শেষ বাসটা চলে গেছে আমাদের পথে ফেলে রেখে, ভরসা এখন মিনিট পনেরো হাঁটার পর সামনের কোন হাল্টেষ্টেলেতে ট্রামের অপেক্ষায়। হের চৌধুরীও আমার মতোই একজন লোক খারাপ, তাই কিছু খারাপ কথাবার্তার পর কী এক প্রসঙ্গে প্রুশিয় সম্রাট দ্বিতীয় ভিলহেল্ম নিয়ে কিছু কথাবার্তা হলো। চৌধুরী জানালেন, বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান অর্থনীতির বারোটা বাজলেও তখন সাহিত্যের স্বর্ণযুগ, নানা রাজনৈতিক উপাদান আর শৈলী যোগ হচ্ছে তখন জার্মান সাহিত্যে।

স্বীকার করি, কথাটাকে বাজে একটা দিকে ঠেলে নিয়ে গেলাম আমিই। প্রশ্নটা ঠেলে উঠলো ভেতরে, খালি পেটে কি মানুষের হাত খোলে ভালো? সঙ্কটের সময়ই কি মানুষের ভেতরে শিল্পবোধ আরো সূক্ষ্ম হয়?

চৌধুরীর মত হচ্ছে, শুধু সম্পদের সঙ্কট থাকলেই হবে না, মানুষের মধ্যেও লড়াইয়ের প্রবণতা থাকতে হবে। উদাহরণ দিলেন পাকিস্তানের, পাকিস্তানে সম্পদের বন্টন নিয়ে সঙ্কট আছে, কিন্তু পাকিদের মধ্যে লড়াই নেই, তাই তাদের সমসাময়িক সাহিত্য সমৃদ্ধ হচ্ছে না। লড়াইয়ের ধাত বজায় থাকলে মানুষের বিশ্লেষণপ্রবণতা আরো সুবেদী হয়ে ওঠে, কাসেলের বুলেটজমানো ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে চৌধুরীর এমনই মত।

আমার মাথায় জটার ওপরে টুপি ছিলো, চৌধুরীর মাথায় শুধুই জটা, তাই আমার এত উত্তেজিত হবার কোন কারণ ছিলো না। আমি তাই ব্যাপারটিকে আবারও টেনে নিয়ে যাই ঘ্যানানোর দিকে। টেনে আনি সেই পেল্লায় উল্লম্ফন বা গ্রেট লীপ ফরওয়ার্ডের কথা, সেই চল্লিশ হাজার বছর আগে, আজকের ফ্রান্সে এক গুহায় আঁকা সেই বিস্ময়কর সব গুহাচিত্রের কথা। আমি প্রস্তাব করলাম, ঐ সময়ে নিশ্চয়ই বড়সড় কোন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে শিকারের অভাব প্রবল হয়ে উঠেছিলো, তাই গুহাবাসী "আধুনিক" মানুষ বসে বসে গুহার দেয়ালে এঁকেছে প্রবল মাংসল সব বাইসনের ছবি, যেভাবে রোগা রিকশাওয়ালার জন্যে সিনেমা হলের পোস্টারে চর্বিমাংসে একাকার ঢাকাই নায়িকার স্তনের উত্তরগোলার্ধ আঁকা হয়। যেভাবে আমরা গোলাভরা ধান আর পুকুরভরা মাছের প্রসঙ্গ টানি, জীবনে যদিও চোখে দেখিনি এসব। আমি কঠোর হই এসব বলতে বলতে, বলি, ঐ গুহাবাসী শিল্পীরাও হয়তো নিজের চোখে এসব দ্যাখেনি, সে শুনেছে তার পূর্বসূরীদের কাছে, তারপর সেই স্মৃতি, আবছা পর্যবেক্ষণ আর নিজের কল্পনা মিশিয়ে ইচ্ছামতো এঁকে গ্যাছে ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ করে, যাকে বলে অর্ধেক বাইসন তুমি অর্ধেক কল্পনা। নিশ্চয়ই সেই সময় আবহাওয়ার বড় কোন পরিবর্তন ঘটেছিলো, যার ফলে বাইসন আর ম্যামথের আকাল পড়েছিলো রীতিমতো। শিকারের অভাবে হাভাইত্যা গুহাবাসী তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্যেই বসে বসে এ কাজ করেছে। তাছাড়া ছবি আঁকা অ্যাতো সহজ নয়, সুজন চৌধুরীও একটা কার্টুন আঁকার জন্যে ঘন্টা তিনেক সময় নিয়ে থাকেন, আর সেই প্রাচীন শিল্পী যখন দেয়াল জুড়ে একটা বাইসনের ছবি আঁকতো, তখন নিশ্চয়ই আরো বেশি সময় লাগতো। ধারণা করা হয়, প্রাগচাষাবাদ যুগে শ্রমের বন্টন অনেক সুষম ছিলো, আর পেশার ভাগ তখনো শুরু হয়নি, অর্থাৎ প্রত্যেককেই যার যার খোরাক তার নিজেরই জোটাতে হতো, দিনের এতো সময় ধরে ছবি আঁকলে খাবার যোগাড় হতো কখন? এর উত্তর একটাই হতে পারে, এত সময় যখন তার হাতে ছিলো, তার আর অন্য কিছু করার ছিলো না। অর্থাৎ, শিকারের উপায় ছিলো না তার, কিংবা শিকারই ছিলো না। এতে করে আমরা একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করাতে পারি, যে চল্লিশ হাজার বছর আগে ঐ অঞ্চলে বাইসন আর ম্যামথ জনপুঞ্জে একটা উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটেছিলো। পিকাসো যেমন শেষ বয়সে এঁকেছে ভয়ঙ্কর যৌবনবতী সব রমণীর ছবি, তেমনি, ক্ষুধার্ত হাভাইত্যা সেই প্রাচীন শিল্পী বসে বসে এঁকেছে প্রচুর মাংসের ছবি, জীবন্ত সেইসব মাংস শিকারের ছবি। আমার অনুসিদ্ধান্ত, সেই সময়ের মানুষ যদি নিরামিষাশী হতো, তাহলে বাইসন আর ম্যামথের ছবির বদলে আমরা প্রকান্ড সব ফুলকপি আর শালগমের ছবি দেখতাম দেয়ালে। এই হাইপোথিসিস প্রমাণ করে, রিসোর্সের অভাব ঘটলে মানুষের পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ আর সৃজনশীলতা সূক্ষ্মতর হয়। এখন যেটা করতে হবে, আশ্রয় নিতে হবে ডেনড্রোমিটিওরোলজির, সেই সময়ের কাঠ যোগাড় করে দেখতে হবে, আবহাওয়ার কী অবস্থা ছিলো। যদি আবহাওয়ার কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না ঘটে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে, অতিশিকারের কবলে পড়ে বাইসন আর ম্যামথ হ্রাস পায় সেই অঞ্চলে। অতিশিকার তখনই হয় যখন জনসংখ্যা হঠাৎ বৃদ্ধি পায়। কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে শিকারী-সংগ্রাহক সমাজে জনসংখ্যা সহজে বৃদ্ধি পায় না, কারণ তারা সবসময় দৌড়ের ওপরে থাকে, এবং নিজেদের জনসংখ্যা সচেতনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখে, যদি না একই সময়ে একাধিক গোষ্ঠী সেই অঞ্চলে সমাপতন না ঘটায়। কিন্তু তার পরিণতিও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ও লোকক্ষয়, এবং শেষমেশ আবারও নিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা। তাহলে কী ঘটেছিলো সেই গুহার আশপাশে? খোঁজ নিতে হবে, ভালো করে খোঁজ নিতে হবে ... প্রয়োজনে এর ওপর ভিত্তি করে লেখা যেতে পারে একটি বিস্তৃত উপন্যাস।

চৌধুরী মন দিয়ে সব শুনে বললেন, কাসেলে আর্জেন্টাইন এক রেস্তোরাঁয় নাকি বাইসনের স্টেক পাওয়া যায়, পনেরো অয়রো দাম।

হাইপোথিসিস মিলে যায় কাঁটায় কাঁটায়। তাই বাড়ি ফিরে মন দিই গুহাচিত্র আঁকায়।


Comments

সংসারে এক সন্ন্যাসী's picture

গুহাচিত্রটি দেখতে সাধ হচ্ছে বড়ো চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সুজন চৌধুরী's picture

হুমম্
বাইসনের স্টেক আর সৃষ্টির ক্ষুধা সমার্থক না হলেও একে অন্যের পরিপূরক।
____________________________
লাল গানে নীল সুর হাসি হাসি গন্ধ......

ধুসর গোধূলি's picture

- পুরাটা পড়লাম ধৈর্য্য ধরে, মাথা একবার এদিক আরেকবার ঐদিক ঝাঁকালাম, এবং অতঃপর ২টা অনুসিদ্ধান্তে আসলাম,
১. 'তোর মাথাটা দিন দিন খারাপের দিকেই যাইতাছে!'
২. পরে কমু খাড়া।
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

সুমন চৌধুরী's picture

হুম



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

লুৎফুল আরেফীন's picture

অসধারণ লাগলো আপনা(দে)র বিশ্লেষণ!
ভাবনার খোরাক পেলাম।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

হিমু's picture

অসংখ্য ধন্যবাদ। একটা বড়সড় লেখায় হাত দেবো ঠিক করেছি এই গুহাচিত্রকে ঘিরে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অমিত আহমেদ's picture

সেরম... হিমু ভাই অন রোল!

অতিথি লেখক's picture

বিশ্বাসযোগ্য হাইপোথিসিস। আপনার গুহাচিত্র দেখার ইচ্ছা আমারও। খুব ভালো হবে নিশ্চিত।

- শামীম হক

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.