বিপন্ন বনের বিপন্ন মানুষদের উষ্ণতায় (চতুর্থ কিস্তি)

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Tue, 06/11/2007 - 9:55am
Categories:

জুয়েল বিন জহির

২৭ অক্টোবর বেলা এগারটার দিকে বিজন্তীদির দেয়া এক গ্লাস চুবিচ্চি টেনে চুনিয়া থেকে দোখলার দিকে যাচ্ছি, সেখান থেকে পরে পীরগাছায় যাব। দোখলা রেস্ট হাউজের সামনে দেখা হলো প্রীতিদার সাথে (আচ্চুর ছেলে), লাঠি হাতে মনের সুখে শীস বাজাচ্ছেন আর বাইদের ধান ক্ষেত পাহারা দিচ্ছেন। বানরেরা দল বেঁধে বেঁধে এসে পাকা ধানের এক্কেবারে বারোটা বাজিয়ে যায়। তাই এই সময়টা একটু খেয়াল রাখতে হয়। বানরেরই বা দোষ দিয়ে কী লাভ। বনে গাছ থাকলেতো তারা সেখান থেকে খাদ্যের চাহিদা মেটাবে। সব বানরতো আর লহড়িয়া বিট কাম পশুকেন্দ্রের বানরদের মত ভাগ্য নিয়ে জন্মায় না, যে পিকনিক পার্টি বা বড় বড় অফিসাররা আসলে বনবিভাগের লোকজনের কাছ থেকে কপালে দুই-চারটা কলা জুটবে, আর তার বিনিময়ে দুই-চাইরটা ডিগবাজি আর ভেংচি কেটে মনোরঞ্জনের খোরাক যোগাবে! যাই হোক, ইকোপার্ক প্রকল্পের অংশ হিসেবে তৈরি করা ওয়াচ টাওয়ারের কাছাকাছি এলে দেখা হলো বিষ্ণু চাম্বুগং এর সাথে। কী এক কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাই কুশল বিনিময়ের পরপরই বিদায় নিলেন। শালবনের ভেতরের একটা গ্রাম পেগামারিতে তার বাড়ি। এখানকার সবাই তাকে কাঙ্খু নামেই ডাকে। কাঙ্খু শব্দটার মানে কী তা জানা হয়নি। অনেকের দেখাদেখি আমিও কাঙ্খুদা বলেই ডাকি। এই কাঙ্খুর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে মূলত গত বছরের অক্টোবরের দিকে। সোহেল মৃ'দের বাড়িতে এক চু এর আসর থেকে। চু এর টানে সেদিন কাঙ্খু শুনিয়েছিলেন তার জীবনের কিছু কথা। পরে মনে হয়েছিল কথাগুলো আসলে কাঙ্খুর একার না, শালবনের মান্দিদের সকলের। কয়েকবছর ধরেই কাঙ্খু দোখলা বিটের লেবার হিসেবে কাজ করছেন। বনবিভাগের কাছ থেকে বর্তমান মাসিক বেতন হিসেবে পাচ্ছেন ১৫০০ টাকা করে। লেবার হিসেবে বনবিভাগের কাছ থেকে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেয়েছেন উপটৌকন পেয়ে আসছেন নিয়মিত, হিসেব করলে প্রায় ৪৫ টা মিথ্যা মামলা। অনেকগুলা মামলার ওয়ারেন্ট ঝুলছে মাথার উপর। মামলাগুলো হয়েছে গাছ চুরি, বনবিভাগের জমি দখল করে আনারস বাগান করা ইত্যাদি নানান কিসিমের অভিযোগে। বনবিভাগে কাঙ্খু কাজ নিয়েছিলেন একটা বিশেষ কারণে। বনবিভাগ তার নামে প্রথমে মিথ্যা মামলা করেছিল বনের জমি দখলের। তার ধারণা ছিল বনবিভাগে লেবারের চাকরি নিলে হয়ত কর্মকর্তারা সদয় হয়ে তার নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলাটা তুলে নিবেন। কিন্তু না, একটা মামলার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে এখন সে প্রায় অর্ধশত মামলার আসামী। হ্যাঁ, গাছ চুরির সময় কাঙ্খু ছিলেন অনেক স্পটে। তবে সে চুরির দায়ভার কেন তার কাঁধে বর্তায় তা জানে না সে। বন এলাকায় এক অদ্ভূত সিস্টেম চালু করে রেখেছে বনবিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা; সিস্টেমটার নাম হল লাইন দেওয়া। লাইন দেওয়া হল বনবিভাগের কর্মকর্তাদের অসাধু উপায়ে বাঙালি ব্যবসায়ীদের কাছে কিছু গাছ বিক্রির অনুমতি দেয়া। বাঙালি ব্যবসায়ীটি হয়ত রেঞ্জারের কাছ থেকে লাইন পাস করালেন ১০ টা গাছের, বিট অফিসার বা দায়িত্বপ্রাপ্তরা এসে স্পট দেখিয়ে দিয়ে গেলেন কোন গাছগুলো কাটা হবে। রাতের বেলা তখন এই লেবাররা ১০ গাছ কাটার জন্য বনে আসেন। কিন্ত একের পর এক গাছ মাটিতে পড়ে ট্রাকে উঠতে থাকলেও ১০ টা গাছ কাটা আর শেষ হয় না। শালবনে রাতের আঁধার কেটে আকাশটা পরিষ্কার হতে থাকলেও না। ১০ টা গাছের জন্য আসে ৩/৪টা বা কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি ট্রাক। ট্রাক চলে যায় একে একে। সর্বশেষ ট্রাকটা যখন ইঞ্জিনে স্টার্ট নেয় তখন কাঙ্খুরা বুঝতে পারে হ্যাঁ ১০টা গাছ কাটা এবার শেষ হয়েছে। গাছ কিন্তু কাটা হয়েছে ১০ হিসেব করেই। রেঞ্জারের দেয়া ১০টা, বিট অফিসারের দেয়া ১০টা, গার্ডদের একেক জনের তরফ থেকে হয়ত আরো ১০ টা....এভাবেই প্রটোকল মেনে মেনে ১০ টার গুনিতক হতে হতে ৩/৪/৫ বা আরো বেশি ট্রাক ভর্তি হয়ে যায় সারারাতে। রাতের বেলায় কাঙ্খুদের অফিসিয়াল কোন ডিউটি না থাকলেও এই নাইট ডিউটি না দিলে তার চাকরি থাকবে না, উপরন্তু একের পর এক বাড়তে থাকবে মামলার সংখ্যা। সকালবেলা এসে একে একে সব গাছের মোথা তুলতে থাকে কাঙ্খুরা। মোথা তোলা শেষে সেখানে মাটিচাপা ও লতাপাতা দিয়ে ভালমত ঢেকে দেওয়া হয়, যাতে বুঝা না যায় এখান থেকে গাছ চুরি করা হয়েছে। বনবিভাগ এভাবে বুঝতে না দেওয়ার খেলা খেলতে খেলতে সাইন্যামারি, সাধুপাড়া, জয়নাগাছা, টেলকি, পীরগাছা, ভুটিয়া, জলছত্র, চাঁনপুর, বিজয়পুর, সাতারিয়া গ্রামের বেশিরভাগ এলাকার প্রাকৃতিক বনের চিহ্নটুকুও মুছে ফেলেছে। মাঝে একবার কাঙ্খু বনবিভাগে চাকরিটা ছেড়েই দিয়েছিল রাগে- দু:খে। কিন্তু ছাড়ার পরপরই আরো কয়েকটি নতুন মামলা দেয় বনবিভাগ। বিট অফিসে পুলিশেরর আনাগোনা দেখে ভয় পেয়ে যায় ওয়ারেন্টের আসামী কাঙ্খু। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনেরা খবর দেয় আবার কাজে যোগ দিলে তার কিছু হবে না, পুলিশ-মামলা সব সামলাবে অফিসাররা। আবার কাজে যোগ দেয় কাঙ্খু কিন্তু মামলার স্রোত আর থামে না। বনমামলা করতে নাকি বনবিভাগের কোন কিছুর দরকার হয় না, কেবল একজন মান্দি পুরুষের নাম ও তার বাবার নাম জানলেই হলো- গতবছর এক আলাপচারিতায় এমনটাই বলেছিলেন শালবনের টেলকি গ্রামের হতভাগা সিরিন নকরেক। বনবিভাগের মিথ্যা মামলায় সিরিন নকরেককে জেলে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, গাছ চুরির দায়ে সিরিন নকরেক যখন জেল খাটছিলেন তখনো তার নামে নতুন নতুন মামলা দায়ের করা হয়েছিল বনবিভাগের পক্ষ থেকে। যেন রাতের বেলায় জেল থেকে পালিয়ে সিরিন বনের গাছ চুরি করে সকালে আবার জেলে ডুকে গেছেন সবার অজ্ঞাতে। কী অদ্ভূত! কী হাস্যকর! কী নির্মম!

দোখলা বাজারে চা খেয়ে চলে এলাম পীরগাছায়। বচনদাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। রান্না-বান্না করছেন। ভাত আর বিভিন্ন ঔষধি গাছের পাতা দিয়ে টাকি মাছের ভর্তা। জোর করেই ভাত খাওয়ালেন। মধুপুর আসার ৬/৭ দিন আগে বচনদাকে জানিয়ে ছিলাম, সেই সুযোগে তিন বগনা চু রান্না করে রেখেছেন আমার জন্য। তার থেকে প্রথমে একটা নামানো হল। এরই মধ্যে তিরেশদাও এসে হাজির হলেন, আসলেন পাশের বাড়ির অলিশনদাও। দেখতে দেখতে তিনটাই শেষ করে দিলাম চারজনে। বচনদা হয়ত ভেবেছিলেন একটা রাতের জন্য রেখে দিবেন, বুঝতে পেরে তাকে জানালাম রাতের ব্যবস্থা করা আছে। সকালেই বিজন্তীদি একটা দিখ্যা (চু তৈরির সবচেয়ে বড় মাটির মটকি) নামাতে চেয়েছিলেন। আমি রাজি হয়নি, বলেছিলাম রাতে খাব। জেনে বচনদার হাসি আরেকটু প্রশস্ত হলো। মিশনের সামনে চা-সিগারেট শেষ করে আমরা দু'জনে চলে এলাম তেমাথায়। সুজনদা (সুজন দেব বর্মণ- প্রথমবার মধুপুর এসে আদিবাসীদের মধ্যে এই সুজন বর্মণের সাথেই আমার পয়লা পরিচয় হয়েছিল) বরাবরের ন্যায় চা-সিগারেট-মিষ্টিপানের আতিথেয়তায় ভাসালেন। আমরা কেউই কোনদিন তার কাছ থেকে কখনো খালি মুখে ফিরতে পারিনি। এজন্য আমরা মজা করে আমাদের নতুন কোন বন্ধুকে উনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই এলাকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বলে। এখানে কিছুক্ষণ কাটানোর পর বচনদা তার ভায়রা বাড়ি নিয়ে গেলেন। তেমাথার এই এলাকাটা মূলত সূর্যবংশীয় বর্মণদের পাড়া। বর্মণ পাড়ায় অনেকবার আসা হয়েছে-থাকা হয়েছে আমাদের, সবাই মোটামুটি পরিচিত। বর্মণ পাড়ার কয়েক বাড়ি পর আমরা চলে এলাম তার ভায়রার বাড়ি। এই পাড়ায় মান্দি পরিবার বলতে বচনদার শ্বশুড়র আর দুই ভায়রার পরিবারই। তো আমরা বড় ভায়রার বাড়িতেই বসে পড়লাম। ভায়রা বেচারা ছুটিতে বাড়ি এসেছেন, দুপুর বেলা একটু ঘুমোচ্ছিলেন। ঢাকায় কী একটা কোম্পানীতে ড্রাইভিং এর চাকরি করেন। ফ্রেশ হয়ে বারন্দায় আমাদের সামনে এলেন। নামটা মনে করতে পারছি না, কী ম্রং যেন, রাখী ম্রং এর খালাতো ভাই হন সম্পর্কে। যাক, পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বিশ্বায়ন নিয়ে তার ধারণাগুলো আমাদের দীর্ঘ আড্ডায় ছেদ টানতে চাইছিল না। আলাপচারিতায় আঁচ পেলাম অনেক ক্ষোভ পুষে রেখেছেন তার পোড় খাওয়া বুকটাতে। মিশনারী, বনবিভাগ, রাষ্ট্রের প্রশাসনের প্রতি তার ক্ষোভ যেন অনেকটা প্রকাশ্যই বলা চলে। তেমাথার আশেপাশে বাইরে থেকে আগত কলাবাগানের বাঙালি মালিকদের হাত ধরে বাংলা মদ বিক্রি নাকি শুরু হয়েছে ইদানিং। বিষয়টা উনাকে বেশ ভাবাচ্ছে এবং এটা বন্ধ করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন এমনটাও জোর দিয়ে জানালেন। আমি জানি না উনি ঠিক কতটা সফল হতে পারবেন। (অসমাপ্ত)


Comments

অতিথি লেখক's picture

আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।

কেমিকেল আলী's picture

লিখতে থাক দোস্ত
সুন্দর হচ্ছে

জুয়েল বিন জহির's picture

দুস্ত আর এক কিস্তি লেখনের ইচ্ছা আছে।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.