গুগলের কর্মীদের সাথে কাজ করতে করতে অল্প দিন পরেই যেটা লক্ষ্য করি, সবাই প্রচন্ড কাজ পাগল। দিনে ৮ ঘন্টা কাজ করার জন্য গুগল পয়সা দেয়। কিন্তু গুগলের কর্মীরা অফিসে থাকে আরও অনেক বেশি সময়। কাজে আসার ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা সময় নেই, যে যার মতো সময়ে আসতে পারে। অফিসে প্রথম দিনেই আমার বসকে প্রশ্ন করেছিলাম, কয়টার সময় আসতে হবে। রিচার্ড (আমার বস) বললো, তোমার যখন ইচ্ছা তখনই আসতে পারো। রিচার্ড আসতো সকাল নয়টার সময়, আর যেতো বিকাল ছয়টায়। আমি অবশ্য নয়টায় আসতামনা প্রতিদিন, যেতাম সাড়ে নয়টা বা দশটায়, আর বেরুতাম অফিস থেকে সাড়ে ছয়টা বা সাতটার দিকে। আমাদের গ্রুপের অন্য সদস্য ব্রায়ান এগারোটার দিকে এসে থাকতো রাত নয়টা সাড়ে নয়টা পর্যন্ত।
কাজে ডুবে থাকার এই সাধারণ প্রবণতাটার পেছনে কারণটা কি, বুঝতে শুরু করলাম কয়েক দিন পর থেকেই। সিলিকন ভ্যালিতে কাজ পাগল মানুষদের কষ্টের ফসল হিসাবে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের মধ্যেও গুগলের কর্মীদের অফিসে পড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টাটা বেশি। আসলে এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অফিসের পরিবেশটাকে অসাধারণ করে রাখা।
শুরুতেই বলা যায় অফিস ও তার আসেপাশের স্থাপনা। আমার অফিসটার পাশে ল্যান্ডস্কেপিং করে ফোয়ারা, জলপ্রপাত, আর মিনি সাইজের লেক বানানো। ফুলের বাগানে গুগলের লোগোতে ব্যবহৃত মৌলিক বর্ণের নানা ফুল সাজানো আছে বিচিত্র নকশায়। প্রথমবার গেলে পার্ক বলে ভ্রম হতে পারে।
অফিসের ভেতরে আবার খাবারের ছড়াছড়ি। আগেই বলেছিলাম একবার, অফিসের প্রতি ১৫০ ফুট পর পর একটা মাইক্রোকিচেন রয়েছে। এর মানে হলো, দুই তিনটা বিশাল ফ্রিজে ভর্তি রয়েছে খাবার থরে থরে - স্যান্ডউইচ, চকলেট, কম করে হলেও ১০-১৫ রকমের ফলের রস, ডাবের পানি, কোক/পেপসির ক্যান, স্পেশাল মিনারেল ওয়াটার, আর এনার্জি ড্রিংক। পাশের টেবিলে বাদাম, চিপস, ফল, বীফ জার্কি (মাংশের শুটকি), এরকম অনেক কিছু। আর কফি তো আছেই। সবই ফ্রি - যার যখন ইচ্ছা এসে খেয়ে যাচ্ছে, বা দু-হাত ভর্তি করে অফিসে নিয়ে যাচ্ছে ভুরি-ভোজনের জন্য।
এতো গেলো কেবল মাইক্রোকিচেনের কথা। প্রতিটা অফিস ভবনেই রয়েছে একটা করে ক্যাফে। পুরো গুগলপ্লেক্স এলাকাতে ভবন ১৬টা, তার মানে বুঝতেই পারছেন, ক্যাফের সংখ্যাও ১৬। আর ক্যাফেগুলো মোটেও গতানুগতিক নয়, একেকটা ক্যাফে একেকটা ধাঁচে সাজানো। যেমন আমার অফিসের ক্যাফের নাম "অফ দা গ্রিড", ওখানে একটু অন্য রকমের বিচিত্র প্রকারের খাবার দিতো। নিজের ইচ্ছে মতো সালাদ বানিয়ে নেয়া, সব্জ্বীর নানা রান্না, আর মাংশের কিছু আইটেম। প্রায় দিনেই অদ্ভুত সব খাবার আসতো, যেমন ক্যাঙ্গারুর বার্গার, হরিণের মাংসের কাবাব, এরকম। সপ্তাহে একদিন বারবিকিউ হতো বাইরে, ঐ যে লেক আর জলপ্রপাতের কথা বলেছি, তার পাশে চাদর বসিয়ে পিকনিকের মতো করে খাওয়া চলতো। আর সকালে প্রতিদিন থাকতো ডিমভাজি সহ নানা রকমের নাস্তা, বিকেল ৩টার সময় আবার বিকালের নাস্তা দিয়ে পেট পুজার ব্যবস্থা থাকতো।
পাশের ভবনেই ফাইভ নামের ক্যাফে, প্রতিটা খাবারে ঠিক ৫টা করে উপাদান দিয়ে তৈরী। আরেকটা ক্যাফে ছিলো ইউরোপীয় খাবারের। আরেকটা (প্যাসিফিক ক্যাফে) হলো চীনা, জাপানি সুশি ও অন্যান্য খাবারের। বিল্ডিং ৪৪এর ক্যাফেটা ছিলো স্লাইস - ওখানে রয়েছে দুর্দান্ত ফলের রস আর স্মুদি (লাসসি টাইপের)।
তবে সব কিচ্ছুকে ছাড়িয়ে যায় গুগলপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলের "চার্লিজ ক্যাফে"। গুগলের প্রথম শেফ ছিলো চার্লি, তবে বেতনের বদলে শুরুতে গুগলের শেয়ার পেতো বলে চার্লি এখন মিলিয়নিয়ার হয়ে রিটায়ার করেছে, তার নামেই এখন রয়ে গেছে ক্যাফেটা। বিশাল ফুটবল মাঠের সাইজের ঐ ক্যাফেতে ৫টা সাবক্যাফে ছিলো - নমস্তে হলো ভারতীয় খাবারের, পাশেরটা জাপানী খাবার আর ইতালীয় খাবারের ক্যাফে, তার সামনেরটা "ইস্ট মীটস ওয়েস্ট" অর্থাৎ ফিউশন ধাঁচের। এছাড়াও ছিলো মেক্সিকান খাবার আর গতানুগতিক মার্কিন/ইউরোপীয় খাবারের দুটো সাব ক্যাফে। এগুলোতে প্রতিদিন দুপুর আর সন্ধ্যাতে ভীড় হতো প্রচন্ড। পুরোটা অবশ্য প্রচন্ড সুশৃংখল, সবাই ট্রে নিয়ে লাইন বেঁধে খাবার নিয়ে টেবিলে, অথবা বাইরের মাঠে বসানো পিকনিক টেবিলে চলে যায়। প্রতিদিন কম করে হলেও হাজার চারেক কর্মী এখানে খেয়ে থাকে। ভারতীয় বা চীনারাতো মনে হয় বিকেল বেলাতে পুরো পরিবারের বাপ, মা, বাচ্চা কাচ্চা সহ গোটা দশেক লোক সাথে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য, প্রত্যেকেই অতিথি নিয়ে আসতে পারে, কোনো বাঁধা নেই। আর খাওয়া যে ফ্রি, তা তো আগেই বলেছি।
গুগলের এই খাওয়ার অঢেল ব্যবস্থার কারণে নতুন আসা গুগল কর্মীরা হাপুস হুপুস করে খেতে থাকে, নিজের চোখে দেখা। "গুগল ফিফটিন" বলে কথা চালু আছে, গুগলে ঢোকার প্রথম দুই সপ্তাহে নাকি কর্মীদের ওজন বাড়ে ১৫ পাউন্ড অন্তত।
শুধু কি খাওয়াই মূল আকর্ষণ? মনে হয় না, কারণ গুগলের অন্যান্য ব্যবস্থাও চমৎকার। চুল কাটা দরকার? কোন সমস্যা নেই, গুগলের চুল কাটার মিনিবাস আছে একটা, সারা দিন অফিসে অফিসে ঘুরতে থাকে, জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলেই নেমে গিয়ে চুল কেটে ফেলা যায়। গাড়ির অয়েল চেইঞ্জেরও ব্যবস্থা আছে। আর ঐ রাজভোগ খেয়ে ওজন বাড়লে ভুড়ি কমানোর জন্য রয়েছে জিম। বাচ্চাদের রাখার জন্য নার্সারি। ডাক্তার, ডেন্টিস্ট। আর কাজ করতে করতে অবসন্ন বোধ করলে ম্যাসেজ করার জন্য অটোম্যাটিক চেয়ার ম্যাসাজ, বা এক ঘন্টার টেবিল ম্যাসাজের ব্যবস্থাও রয়েছে। আর যাতায়াতের জন্যও অনেক ব্যবস্থা -- নিজের গাড়ি না থাকলে বা প্রতিদিন ড্রাইভ করতে ইচ্ছা না হলে গুগলের শাটল গিয়ে নিয়ে আসবে, এমনকি ৪০ মাইল দূরের সান ফ্রান্সিস্কো থেকেও অনেকে গুগলের বাসে করে আসে। আর গুগলের ইলেকট্রিক গাড়িও অনেক কর্মীকে দেয়া হয়, চালাবার জন্য।
আর সব সময় কাজ করা? তা নয় মোটেও, বরং খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে বিস্তর। ক্যাফের পাশেই ভলিবল কোর্ট, আর টেনিস খেলা, সাঁতার কাটা, কৃত্রিম স্রোতে সার্ফিং এর ব্যবস্থা, এসব তো রয়েছেই। কিন্তু তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং হলো ভিডিও গেইমের কালেকশান, বাংলাদেশে আমরা যেমন খেলতাম কয়েন অপারেটেড মেশিন, সেরকম মেশিন সাজানো আছে। আমার অফিসের এক কোনাতে একটা বড় স্ক্রিন পেয়ে তো একজন দেখি রীতিমত ভিডিও গেইম কর্নার বানিয়ে ফেলেছিলো, উইই, পিএসপি, আর অন্য সব মেশিন দিয়ে।
সিলিকন ভ্যালির অন্যত্র অবশ্য এতোটা সুযোগ সুবিধা নেই। আমার বন্ধু কেউ কেউ ইন্টেলে কাজ করেছে, ওদের ক্যাফেতে নাকি পানিটাও কিনে খেতে হতো। গুগলের কর্মীরা থাকে রাজার হালে। অবশ্য এর পেছনে গুগলের লাভটাও অনেক। কর্মীদের এভাবে রাজার হালে রেখে রেখে অফিসে ধরে রাখাটা খুব সহজ হয়, সকাল থেকে এসে সবাই রাত করে ফিরে, মাঝের সময়টাতে পাগলের মতো কাজ করে চলে। আর মনে ফুর্তি আনার মতো সব ব্যবস্থা আছে বলে সারাদিন চরম উৎসাহে, আগ্রহে তৈরী করে চলে অসাধারণ সব সফটওয়ার।
(ছবি, আমার অফিসের বাইরের অংশ, চার্লিজ ক্যাফের বাইরের বসার পিকনিক টেবিল, আর শেষে মাইক্রোকিচেনের কিয়দংশ)।
Comments
অফিস বা কর্মস্থল বললে যে চিত্রটা মনে ভেসে ওঠে, তার সাথে আপনার বর্ণনার আদৌ কোনও মিল নেই। ভারি বিস্মিত আর মুগ্ধ হলাম।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু?
ব্যাপারটা সেরকমই বটে। এমন বিস্তর স্বাধীনতা ও তোয়াজ-তোষামোদ পেলে চক্ষুলজ্জার খাতিরে (অথবা নেমকহারাম না হওয়ার জন্যে) হলেও কিছু কাজ করা তো জরুরি।
একদা পিপলসফট (এখন অরাকল যেটি গিলে ফেলেছে) অফিসে এরকম খানিকটা দেখেছি, তবে এতোটা অবশ্যই নয়।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
লেখা পড়ে খুব সহজেই বোঝা যায় কেন গুগল #১ প্রতিষ্ঠাণ।
অসাধারণ জায়গা !
ভালো কথা তড়িৎ প্রকৌশলীদের জন্য গুগলে চাকরি নেই কোন ?
------------------------------------------------------
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
আহাহা... গুগলে কি সমাজবিজ্ঞানীর চাকরি নাই?
..............................................................
শুশুকের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সাঁতরে এসেছি কুমীরে-ভরা নদী!
এই এপিসোডটা জব্বর লাগছে। কম্পানীরা ১০০-১৫০ বছর পরেও বুঝলো না যে কর্মীদের স্যাটিস্ফ্যাকশনটা কত জরুরী। এতে শেষ বিচারে কম্পানীরই লাভ হয়। গুগল বুঝলো, এবং তার ফায়দাও লুটবে অনেকদিন। চার্লির কাহিনী পড়ে হেভি মজা পাইলাম। জীবনে আসলে টাইমিং-ই সবচেয়ে বড় গুণ! আর ভারতীয়দের নেটওয়ার্কিং সম্পর্কে খাস কথা বলছেন। বাঙ্গালীরা একে অপরকে ঐভাবে কেন তুলতে পারে না, বুঝি না।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর
একটা ল্যান্ডমার্ক সিরিজ হয়েছে ।বহু জিনিষ জানতে পারলাম ।
গুগুলে সবই আছে , শুধু বিছানাটা থাকলে আর বাইরে আসার দরকার কী ?
বিছানার ব্যবস্থা মানে দুপুরে সিয়েস্তা নেয়ার একটা সুযোগ আছে বলেই পড়েছিলাম। রাগিব নিশ্চিত করতে পারবেন।
টাইমস প্রচ্ছদ কাহিনী করেছিলো গুগল নিয়ে। গত বছর বোধ হয়। কিছু ছবি আমি দিয়েছিলাম ব্লগে।
গুগল আসলেই একটা মজার পরিবেশ তৈরি করেছে।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না
আসলেই দারূণ অভিজ্ঞতা !
আজ এক নিঃশ্বাসে সবগুলো পর্ব পড়ে ফেললাম...শেষ পর্বের অপেক্ষায় আছি...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান…
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
আসলেই! গুগল গুগলই
১৬ বছর পরের আপডেট। আগের যুক্তিগুলো যেমন ঠিক ছিল, এখনকার যুক্তিগুলোও ঠিক আছে।
সময়ের সাথে প্রেক্ষিত পালটায়, কোম্পানির প্রায়োরিটি পালটায়, শুধু কর্মী শোষণ অব্যাহত থাকে।
সৈন্যরা বৃথাই বন্দুক ছোঁড়ে,
কৃপাণ নিজেরা লড়াই করে।
ক্রোধ অদৃশ্যই থেকে যায়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
Post new comment