মানুষ সংস্কারা: অস্তিত্বের সন্ধানে- আমি কে?

কর্ণজয়'s picture
Submitted by কর্ণজয় on Sun, 25/09/2022 - 8:48pm
Categories:

আমরা কি নিজের চোখে
নিজের মুখটা দেখেছি কখনও?
দেখিনি। আমরা আমাদের দেখি আয়নায়।
চোখ মেললে তুমি দেখবে আমাকে; আমি তোমাকে।
তাহলে; আমি আমাকে কীভাবে দেখবো?
তুমি তোমাকে?
তিনি বললেন।।

পূর্বকথা
২৫০০ বছর আগে, এজিয়ন সাগরের পশ্চিমে গ্রীস দেশের এথেন্স নগরে সমবেত হয়েছি; আমাদের আদি শিক্ষক সক্রেটিসের কথা শ্রবণ করতে। তার জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্য অপেক্ষমান মানুষের ভিড়ে আমরাও যোগ দেই। অপেক্ষা করি; তিনি কী বলবেন। তিনি আসলেন; প্রতীক্ষারত আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রদান করলেন জীবনের অভিজ্ঞান-
‘নিজেকে জানো।
তোমাকে জানতে হবে
তুমি যা করছো, তা আসলে কী করছো
আর যা করছো কেনই বা করছো;
কী তোমার জীবনের উদ্দেশ্য?
আর তখন মানুষ হিসেবে
তোমার জীবন অস্তিত্বময় হবে।
মানুষের জীবনতো জীবের মতো
জৈবিক আমি’র যে প্রয়োজন
আহার, নিদ্রা, মৈথুন আর বিহার
শুধু তার মধ্যে নয়-
এর বাইরেও আমি’র বিস্তার আছে।
এই আমি’কে জানো;
এই আমি’কে আবিষ্কার করো।

সক্রেটিসের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিল আমাদের নিজেকে। আমরাতো আমাদের নিজেকেই খুঁজেই চলেছি, মানুষের ইতিহাসের শুরু থেকে। আমরা আমাদের দেখি; সেই ৫০,০০০ বছর আগে- আমরা তখনও সভ্য হই নি, পাথরের হাতিয়ার হাতে নিয়ে বনে জঙ্গলে অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি শিকারের খোঁজে। জীব-জন্তু-পশু, যা পাওয়া যায়- শিকার করে খাবার জোগাড় করে ফিরে যাবো পাহাড়ের গুহায়, নিরাপদ আশ্রয়ে। সেখানে খাবার নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছে আপনজনেরা। যেমন অপেক্ষা করে সিংহ শাবকেরা, মা-বাবা তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবে বলে। যেমন অপেক্ষা করে, পাখির ছানারা- মা-বাবার জন্য। আমরা কাঁধে শিকার বয়ে নিয়ে ফিরি; শুরু হয়ে যায় আনন্দ উৎসব। শিকারের শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত। সেই রক্তে হাত ভিজিয়ে, গুহার দেয়ালে এঁকে দেই। দেয়ালের গায়ে লাল টকটকে রর্ক্ত মাখা হাতের ছাপের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। টকটকে লাল একটা হাতের ছাপ। আমার হাতের ছাপ।
এই ছাপটার মধ্যে কি- আমি আছি?
ভেবে উঠি-

সেদিনই কি প্রথম নিজেকে খোঁজার শুরু?
হয়তো না। এই অনুসন্ধানের হয়তো জন্ম তারও আগে…
ইতিহাসেরও আগে থেকে। নিজেকে জানার পথে এভাবেই আমরা হেঁটে চলেছি। ভূগোল থেকে ভূগোলে। কাল থেকে কালান্তরে।।

‘থামো।’
আমরা থমকে দাঁড়ালাম। কালের হিসেবে সময়টা ষোড়শ শতাব্দীর শেষদিকে; এখন থেকে ৪০০ বছরেরও বেশি আগে । ইংল্যান্ডের জ্ঞান সাধক ফ্রান্সিস বেকন আমাদের জানিয়ে রাখলেন, ‘মনে রাখবে, নিজেকে জানা হলো জ্ঞানের অর্ধেক। নিজেকে জানতে হবে, অন্যকে জানার জন্য। শুধু নিজের মধ্যে আটকে থাকলে, এই জ্ঞান বৃথা।’ এভাবেই আমরা নিজেদের আবিষ্কার করতে করতে আমরা চলতে থাকি।

চলতে হঠাৎ নৈঃশব্দের আবহ আমাদের ঘিরে ধরে। এই নিরবতা যেন কিছু বলছে। তেরশ শতাব্দী তখন… পারস্যভূমিতে দাঁড়িয়ে আমরা কান পাতি।
সুফি সাধক মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী তার মৌনতার ভেতর ডুবে আছেন। সেই মৌনতার ভেতর থেকে নৈঃশব্দময় শব্দ আমাদের ভেতর বেজে ওঠে, ‘তুমি আর এই জগত আলাদা নও।
তুমি নিজেকে জানলে মানে, জগতকে জানলে।’

সেই নৈঃশব্দের অভিজ্ঞান গায়ে মেখে আমরা চলতে থাকি।

এভাবেইতো মহাকালের ধ্বনি আমাদের শুনতে পাই। ঐ ধ্বনিতে- এই জগতের বিশালত্বকে নিজের মধ্যে উপলব্ধির আনন্দ রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে বেজে ওঠে-
‘সীমার মাঝে, অসীম তুমি- বাজাও আপন সুর,
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর…’

বর্তমানের পথ ধরে আদি থেকে ভবিষ্যত- ত্রিকাল জুড়ে মানুষের নিজেকে খুঁজে যাওয়ার এ এক পরম্পরার পথযাত্রা। সেই পথযাত্রায় আমরা প্রত্যেকে- সবার মাঝে নিজেকে খুঁজে নেয়ার পথে হেঁটে চলেছি। আমরা চলছি, চারপাশের রূপ-রস-শব্দ-স্বাদ-গন্ধ নিতে নিতে; বুঝতে পারছি, জগত আর নিজেকে নিয়ে যা জানি, তা সম্পূর্ণ নয়। আমাদের সম্পূর্ণ হওয়ার, পূর্ণ হওয়ার এই পথেই- নতুন জ্ঞানের জন্ম। এটাই জ্ঞানের পথ। জ্ঞান দিয়ে পুরোনোকে ঝেড়ে, নিজেকে সংস্কার করে ফেলে আমরা নিজেদের নতুন করে গড়ে তুলি। সক্রেটিস, এরিস্টেটল, গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, যিশুখ্রিস্ট, মুহাম্মদ, ফ্রান্সিস বেকন, গ্যালিলিও, ভলতেয়ার, স্পিনোজা, দ্যা ভিঞ্চি, রুমি, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, হেমিংওয়ে, আইনস্টাইন, স্টিফেন হকিংস... যত মনীষী যুগে যুগে এসেছেন; কালে কালে, দেশে দেশে গোটা পৃথিবী জুড়ে যত দর্শন, যত সাহিত্য, যত চিন্তা রচিত হয়েছে, যত বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে- সবকিছুর লক্ষ্য ছিল একটাই-

এই বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে মানুষ হিসেবে নিজেদের নানানভাবে আবিষ্কার করা।
নতুন জ্ঞানের আলোকে পুরনো নিজেকে সংস্কার করে নতুন করে গড়া।
মানুই এটা পারে, তাই মানুষের আরেক নাম মানুষ সংস্কারা।

জ্ঞান চর্চার এই পরম্পরায়, ৪০০ বছর আগে বাংলার মাটিতে, মানুষ হিসেবে নিজেকে চেনার মধ্য দিয়ে বিশ্ব প্রকৃতিকে ধারণ এক সহজিয়া দর্শনের জন্ম হয়েছিল। সহস্র বছরের অন্বেষণের পরম্পরায় গড়ে ওঠা এই সহজিয়া দর্শনে প্রাচ্যের বৌদ্ধ, হিন্দু, তাও সংস্কৃতি আর মধ্যপ্রাচ্যের ইসলাম যিশুখ্রিষ্টের ধর্মীয় ভাবধারার সাথে সহজভাবে মিশে গিয়েছে ইউরোপের সক্রেটিসের জ্ঞানতত্ত্ব।
যে বস্তুজগতে আমরা বেঁচে আছি, সেই বস্তুজগত আসলে কী? আমি যা দেখছি, যা ভাবছি- সে কি তাই? না কি অন্য কিছু? কী এর আসল স্বরূপ? ’রূপেতে আছে স্বরূপ গিল্টি করা’, সহজিয়া দর্শনের প্রধান দার্শনিক লালন সাঁই আমাদের মনে করিয়ে দেন।
যা দেখছি, তা আসলে তা নয়। কল্পনার মনের রঙে ঢাকা পড়ে গেছে এই বস্তুজগতের আসল স্বরূপ। এই যে আমি, যাকে আমি মনে করছি- সেও আমি নয়। কামনা আর ইচ্ছে-মায়ার আড়ালে লুকিয়ে আছে সত্যিকারের আমি। কে সে? এই কল্পনা, এই মায়ার বিভ্রম কাটিয়ে এই জগত সংসার আর নিজেকে কীভাবে আমরা চিনতে পারবো;- এটাই সহজিয়া দর্শনের পথ। এই দর্শনে মানুষকে বোঝার যে জ্ঞান- তাই ‘মানুষ তত্ত্ব’।
মানুষতত্ত্ব মানে মানুষকে জানা। মানুষের স্বভাবকে জানা। এই নিখিল জগত সংসারে দেহ’কে কেন্দ্র করে যে আমি; তার স্বরূপকে জানা।
‘আপনারে জানতে পারলে
যাবে অচেনারে চেনা-

এই জগতকে জানতে গেলে প্রথমে জানতে হবে নিজেকেই ‘এটাই আত্মজ্ঞান। সহজিয়া দর্শনে এই আত্মজ্ঞানই পরম জ্ঞান। জগত-সংসারের সাথে কীভাবে জড়িয়ে আছি; তাকে আবিষ্কার করে নিজেকে জানার, বোঝার, চেনার যে চেষ্টা তারই এক পথলিপি- ‘মানুষ তত্ত্ব’।
এই রচনালিপি, মানুষের সঞ্চিত অভিজ্ঞতার একটা ছবির টুকরো টুকরো কিছু অংশ। এই টুকরোগুলো, আমাদের সত্য দেবে না। তবে, আমাদের মধ্যে সত্য জাগিয়ে তুলতে খানিকটা সাহায্য করতে পারে হয়তো; সহজিয়া বাউল সাধুর সান্নিধ্যের মতো। হয়তো- এই কারণে যে, এই রচনার শব্দগুলো উঠে এসেছে সহজিয়া দর্শনের পথে যারা নিজেদের খুঁজতে বেরিয়েছেন, সেই বাউল সাধুর শব্দগুলোকে উপলব্ধির ভেতর থেকে।
সাধুগণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,
তাদের কাছে আমরা সত্য পাই না। কিন্তু, তাদের সংস্পর্শে আমাদের মনের ভেতর সত্য জেগে ওঠে।

তখন আমরা আমাদের দেখতে শুরু করি। তখন আমরা চিন্তা করতে শুরু করি। এই জগত সংসারের স্বরূপ খুঁজতে শুরু করি। আর এর মধ্যে চিনে নেয়ার চেষ্টা করি, আমি’কে। ‘আমি’কে চিনে ওঠার মধ্য দিয়ে ‘আমি হয়ে ওঠার’ শুরু। আমরা নিজের ভেতরের ‘আত্মরূপ’ আমি হয়ে ওঠার পথে নামলেই বুঝতে পারবো, জগত জুড়ে সকল কিছু আমাদের চিনিয়ে দিচ্ছে, ‘আমি কে’। আমরা দেখতে পাবো- সেই রাস্তায় আমাদের সম্ভাসন জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন- পাওলো কোহেলহো।
‘আমরা যখন আমি হয়ে উঠতে চাই,
সেই আমি হয়ে ওঠার জন্য পুরো প্রকৃতি হাত বাড়িয়ে দেয়...’

আমাদের শুভকামনা জানিয়ে তিনি তার পথে চলে যান। তার হয়ে ওঠার পথটা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। আর আমাদের প্রত্যেকের সামনে জীবন হয়ে পড়ে থাকে,
আমাদের নিজের নিজের ‘আমি’- হয়ে ওঠার পথ।


Comments

কে 's picture

এইসব লেখা আরো পড়তে দিয়েন। চোখের জন্য স্বস্তিদায়ক লেখা। পড়া শেষ করে কিছুক্ষণ লেখার দিকে শূন্যদৃষ্টি তে তাকায়ও থাকা যায়।

অনেক ধন্যবাদ!

নৈ ছৈ's picture

বাহ!

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.