সংখ্যালঘু

তানভীর's picture
Submitted by tanveer on Mon, 18/10/2021 - 8:02pm
Categories:

সকাল থেকে চামু রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ফটোকপির দোকানে। একের পর এক কাস্টোমার আসছে কপি করাতে। সবারই তাড়াহুড়া। দোকানদার মামা জানে চামু সবার আগে এসেছে, কিন্তু ছেলেটা এমন বেকুব চুপ করে হাতে খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বলছে না। সবাই পরে এসে মামাকে দিয়ে কপি করিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। হয়ত চামু ভাবছে একটু ফাঁকা হলে তখন কপি করাবে। আরে বাপ, একটু ছায়ায় সরে দাঁড়া, এইভাবে রোদে পুড়লে তো অসুখে পড়বি। হাসান ভাবছিলো চামুকে দেখে। সেও এসেছে মামার দোকানে ফটোকপি করাতে। এখন তার পালা।

চামু তার সাথে একই ক্লাসে পড়ে, সমীর স্যারের ছেলে। কিন্তু কারো সাথে চামুর তেমন আলাপ নেই। সে মোটামুটি অদৃশ্য একটা ছেলে, এখন যেমন।

'কিরে চামু ফটোকপি করাবি নাকি?' চামুর দিকে তাকিয়ে হাসান জিজ্ঞেস করলো।

'তুই করা'। নিচের দিকে তাকিয়ে চামুর ভাবলেশহীন উত্তর। মনে হলো হাসলো একটু স্মিতভাবে, বোঝা যায় না। চামু ছোটবেলা থেকে চোখে কম দেখে, তাই কালো চশমা পরে। চামুর ভালো নাম সৌমেন দাশ। পড়ালেখায় ব্রিলিয়ান্ট, চুপচাপ ছেলে। চোখ দেখতে না পেলে আসলে মনে হয় মনের ভাব বোঝা যায় না। চামুর কোন বন্ধু আছে কিনা জানেনা হাসান। অন্য হিন্দু ছেলেদের সাথে হয়ত থাকতে পারে।

মামা যখন হাসানের ফটোকপি করাচ্ছিলো তখন হন্তদন্ত হয়ে মামুন এলো।
'মামা, হাসানেরটা শেষ হইলে আমারগুলা কপি দিয়েন।' একগাদা খাতাপত্র কাউন্টারের উপর রাখলো মামুন। এখন পরীক্ষার মৌসুম। সামনে মেট্রিক পরীক্ষা, ফটোকপির ধুম লেগেছে।

মামুনও হাসানদের সাথে একই ক্লাসে। চামুকে মনে হয় সে দেখতেই পায় নি। উসকো-খুসকো চুল মামুনের, বোঝাই যাচ্ছে সকালে দাঁত মাজে নি। হলুদ দাঁতে মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।

'কিরে তোকে দেখে মনে হচ্ছে রাতে ঘুমাস নাই?'
'আর বলিস না, গেরামে গেছিলাম, রাতে আসছি। ভোরে ঘুম লেগে আসছিলো। তখন শুরু হলো ড্যাঁডাইয়ার পোলাদের ঢাকের বাড়ি। আর ঘুমাইতে পারলাম না।'

হাসান আড়চোখে চামুকে দেখলো। চামু ভাবলেশহীনভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে যেন শুনতে পায় নি তাদের কথা। চামু মনে হয় এসব শুনে অভ্যস্ত। চট্টগ্রামে হিন্দুদের ডান্ডি, ড্যাঁডা, ডান্ডিপটাশ ইত্যাদি নামে গালি দেয়া হয়। কেন সেটা হাসান জানে না। অনেকে আবার আদর করে ডাকে মালু। মালাউন থেকে মালু। মালাউন মানে নাকি আরবীতে অভিশপ্ত। ক্ষেপে গেলে বলে, মালাউনের বাচ্চা।

হাসান মামুনকে চোখে ইঙ্গিত করলো চামুর উপস্থিতির কথা। মামুনের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
'শালা ডান্ডিপটাশদের কত্ত সাহস! কয়দিন আগেই তাদের মন্দির ভাঙা হইলো, এখন কোথায় চুপেচাপে পূজা করবি, তা না ঢাকের বাড়ি দিয়া পাড়াপড়শীদের ঘুম হারাম করে দিতাসে, নামাজ-সালামের অসুবিধা করতেসে।'
'কই নামাজের সময় তো পুজা আর ঢাক বন্ধ থাকে'- হাসান মৃদুভাবে বলার চেষ্টা করলো।
'তরে কইসে, তর হেডা'। এবার মামুনের চামুর দিকে নজর পড়লো।
'আরে চাইম্মা, তুই এখানে ভূতের মতো খাড়ায়ে আছস ক্যান? বাড়িত যা।' চামু অপ্রস্তুত হয়ে কোন কথা না বলে হাঁটা দিলো। বেচারা, এতক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থাকাই সার হলো।

মামুন বলে চললো, 'আর এই চাইম্মা মালাউনের বাচ্চা হইলো আরেক খাটাশ তার বাপের মতো, সবখানে ভূতের মতো ঘাপটি মেরে থাকে'। তারপর গলা নামায়ে বললো, 'ওগোরে ওদের বাপের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছি খুব শিগগীর।'

চামুর বাবা সমীরচন্দ্র দাশ এলাকার স্কুলের সহকারী হেডমাস্টার। হাসানকে বিশেষ স্নেহ করেন। হাসান আগে এলাকার স্কুলেই ছিলো। ক্লাস এইটে উঠার পর তার বাবা তাকে শহরের বড় নামকরা স্কুলে ভর্তি করে দেয়। এই নিয়ে এলাকার স্কুলে বেশ গণ্ডগোল হয়েছিলো। স্কুলের হেডমিস্ট্রেস তাহমিনা ম্যাডাম কিছুতেই হাসানকে টিসি দেবেন না। হাসানের বাবা তখন সমীর স্যারের সাথে গিয়ে দেখা করেন। সমীর স্যার বাবাকে আশ্বস্ত করে টিসির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বাবা সমীর স্যারের সাথে কথা বলে মুগ্ধ। এইরকম স্যার এখনো আছে এই দেশে! হাসানকে বিশেষ করে বলে দিয়েছেন সমীর স্যারকে মান্য করতে। হাসান স্কুল পাল্টালেও সমীর স্যারের কাছে এখনো প্রাইভেট পড়তে যায় অংক আর বিজ্ঞানের জন্য। স্যারের কাছে পড়তে যাওয়া এক বিশাল আকর্ষণীয় ব্যাপার। স্যার শুধু পড়ানই না, কত মজার মজার গল্প বলেন। সেদিন বললেন, তোমরা কি জান পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিস কী? তবে গল্প শোন। যুধিষ্ঠির তৃষ্ণার্ত হয়ে এক জলাশয়ে জলপান করতে গেলো। এক বক এসে বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়া তবে জল খাও। যুধিষ্ঠির বললো, তথাস্তু, কী প্রশ্ন? পৃথিবীতে সবচেয়ে আশ্চর্য জিনিস কী? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলো, প্রতিদিন জীবের মৃত্যু হচ্ছে। তবুও মানুষ চিরদিন বেঁচে থাকতে চায়- এটাই জগতে সবচেয়ে আশ্চর্য!

হাসান মামুনকে জিজ্ঞেস করে, 'বাপেরর বাড়ি পাঠায়ে দিবি মানে?'
'আব্বে, ডান্ডির বাচ্চাদের এক পা তো জন্ম থেকে ইন্ডিয়াতেই দেয়া থাকে। অন্য পা-টাও ইন্ডিয়াতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেছি। ওইজন্যে তো গ্রামে গেছিলাম লোকজন যোগাড় করতে। সামনের হপ্তাতেই ঘরবাড়ি জ্বালায়ে দিমু। তখন আমগো জমি আমগোরে না দিয়া যাবে কই।'

মামুনের বাবা এলাকার বিশাল পলিটিশিয়ান। ওয়ার্ড কমিশনার, পার্টি সেক্রেটারি, মসজিদ কমিটির চেয়ারম্যান আরো কী কী যেন। সমীর স্যারসহ এলাকার হিন্দুদের জমি, ঘরবাড়ি দখল করার জন্য শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইনে মামলা করেছেন। সেই মামলা ঝুলে আছে অনেক বছর যাবত। কিন্তু কোন ইস্যু পেলেই হিন্দুদের ভয় দেখানো হয় যেন তারা নিজে থেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যায়। হাসানের মনে পড়ে কয় বছর আগে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে এখানে হিন্দুরা কীরকম আতংকের মধ্যে ছিলো। এলাকার মন্দিরগুলো ভাঙা হয়েছিলো। হিন্দুরা ঘরবাড়ি ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিলো। চামু অনেকদিন স্কুলে আসে নি। সমীর স্যারও প্রাইভেট পড়ান নি।

মামুন চামুকে কম জ্বালায় নি। একবার ঈদের সময় জোর করে গরুর মাংস খাইয়ে দিয়েছিলো। মামুন একই ক্লাসে পড়লেও বছরের পর বছর ফেল করার কারণে বয়সে ও গায়ে-গতরে বড়। এখন বাপের ক্যাডার দলের মেম্বার।

হাসান এবার ভীত হয়। 'ঘরবাড়ি জ্বালায়ে দিবি মানে? ওইখানে সমীর স্যার আছে না?'
'তর হেডা। আব্বে ঐ মালাউনের বাড়িই তো আগে জ্বালামু। সমীরের দাদা গেছে গা ইন্ডিয়ায়, তার নামেই তো সব ঘরবাড়ি। ঐটা তো আসলে শত্রু সম্পত্তি। আব্বায় মামলা দিছে তাও ছাড়তেসে না। এদিকে মাইয়া বিয়া দিছে ইন্ডিয়ায়। শুধু এক পা না, তিন ঠ্যাং দিয়া রাখছে তার বাপের বাড়ি। তাও জায়গা ছাড়ে না। এইবার আর ছাড়াছাড়ি নাই'।

হাসান তাড়াতাড়ি বাসায় আসে। বাবাকে বলতে হবে সমীর স্যারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য, কোন ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। বাবা বললো অফিস থেকে ফেরার পথে স্কুলে সমীর স্যারের সাথে দেখা করে আসবে। হাসানের সারাদিন কোন পড়ালেখা হয় না। সন্ধ্যায় বাবা এসে বলে, তাড়াতাড়ি তোমার স্যারের বাসায় যাও। উনি স্কুল থেকে পদত্যাগ করেছেন, সপরিবারে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছেন।'

হাসান দৌড়ে যায় চামুদের বাসায়। স্যার একটা অন্ধকার ঘরে চেয়ারে বসে আছেন। হাসানও বসে থাকে চুপচাপ।
'হাসান, নতুন স্কুল কেমন লাগছে?' স্যারই নীরবতা ভাঙেন।
'ভালো লাগছে না স্যার।'
'আমি জানি। আমার সাথে ঐ স্কুলের হেডমাস্টারের সাথে একদিন দেখা হয়েছিলো। আমাকে বললো, 'আপনাদের স্কুল থেকে এক পোলায় আইছে। আমরা হেরে বাজায়-বুজায় দেখলাম। আহামরি কিছু মনে হয় নি। আমি বললাম, বাজায়-বুজায় দেখলে তো হবে না। হাসান হলো ছাই ছাপা আগুন। ছাই সরায়ে না দেখলে তো কিছু দেখতে পাবেন না।'
হাসানের মাথা আরও হেঁট হয়ে গেলো। কী বলবে, কথা খুঁজে পায় না।
'এখন তবে আসি স্যার।'
'ওপারে ভালো থাকবেন।' বলতে গিয়েও থেমে গেলো। সাধারণত কারও মৃত্যু হলে শোকবার্তায় লেখা থাকে ওপারে ভালো থাকবেন। আর এখন জ্যান্ত মানুষকে এ কথা বলতে হচ্ছে! সক্রেটিসকে ভিন্নমত প্রচার করায় তার দেশের মানুষ মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো। সে বহু বছর, বহু সভ্যতা আগের কথা। আর আজ এত এত সভ্য হওয়ার পরে এই দেশের লোক ভিন্নধর্মালম্বীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বলছে, তোমরা এই দেশে থাকতে পারবে না অন্য ধর্ম পালন করার জন্যে। মালাউন মানে নাকি অভিশপ্ত। এই দেশ, এই দেশের মানুষের চেয়ে বড় অভিশপ্ত আর কে হতে পারে! এর থেকে দূরে থাকাই তো শান্তি। স্যার আসলে শান্তিতেই থাকবেন। সমীর স্যারকে সালাম দিয়ে বের হয়ে পড়ে হাসান। বাইরে তখন এশার আযান দিচ্ছে- 'হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ, আলাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লালাহ'।


Comments

Unknown's picture

মন খারাপ মন খারাপ

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.