ভাল সিরিজ খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম দেখার জন্য। বন্ধু মেহেদি পরামর্শ দিল Babylon Berlin দেখার জন্য। ইউটিউবে ট্রেইলারে দেখলাম জার্মান ভাষায় তৈরি এটা। জার্মান টিভির তেমন ভক্ত না হলেও দেখতে বসলাম।
তো সবসময় যেটা করি সেরকম পড়ালেখা করে দেখলাম এই সিরিজটা ইংরেজি ভাষার বাইরে বানানো সবচাইতে খরুচে টিভি সিরিজ। সিরিজটা ফলকার কুৎস্যারের একটা বইয়ের উপরে ভিত্তি করে বানানো। ঘটনার সময়কাল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৪।
এই সময়টাতে জার্মানির ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই ট্রিটির ফলে অসন্তোষ, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, রাশান বিপ্লবের ঢেউ এবং সেই সাথে হিটলারের নাৎসি পার্টির উত্থানের সময় এটা। একটা সাধারণ টিভি সিরিজে অনেক সময় থাকলেও সমাজের এতো কিছু আনা মুশকিল। এতোসব জটিলতা এই সিরিজে খুব সফলভাবে এসেছে।
এই সিরিজটা আরও কিছু কারণে অন্য সিরিজ থেকে আলাদা মনে হয়েছে আমার কাছে। একটু খেয়াল করে দেখলে এই বৈশিষ্ট্যগুলো চোখে পড়বে যে কারও।
সিরিজটা কীভাবে তৎকালের সমাজ তুলে এনেছে সেটার দুটো দৃশ্যে আলোচনার মাধ্যমে তুলে আনা যায়।
এই দৃশ্য রিটার নামে এক ভদ্রমহিলা ডাক্তারের কাছে গিয়েছে দেখা যায়। ডাক্তার নিজের পেশার পাশাপাশি প্রগতিশীল রাজনীতি করেন। সাধারণভাবে প্রগতিশীল কারো চরিত্র বানানোর সময় চরিত্রের সবকিছু ইতিবাচক দেখাবার একটা প্রবণতা থাকে। এই সিরিজে সেটা করা হয়নি। ডাক্তার রিটারের ফরাসি রোগ হয়েছে বলে জানায়। রিটার ফরাসি রোগ কী সেটা না বোঝায় ডাক্তার তাকে বুঝিয়ে বলে ফরাসি রোগের আরেকটা নাম সিফিলিস। মধ্যযুগে এক জনগোষ্ঠী অন্য কোন জনগোষ্ঠী দ্বারা কোন রোগে আক্রান্ত হলে এই ধরণের নামকরণ করতো।
রেডিটে একটা ম্যাপ পেলাম সিফিলিসের বিভিন্ন নাম বিষয়ে। শুধু জার্মানরাই না, সুইস, ইটালিয়ানরাও এই রোগকে ফরাসি রোগ বলতো। ফরাসিরা এই রোগের দায় ইটালিয়ানদের উপর চাপাতো। আমাদের উপমহাদেশেও এটার জন্য ফরাসিদের (ফিরিঙ্গি) দায়ী করা হতো।
বলাবাহুল্য এসব নামকরণের পেছনে বর্ণবাদ/সাম্প্রদায়িকতাও কাজ করতো। ২০এর দশকের শেষে একজন প্রগতিশীল মানুষ এরকম বর্ণবাদি মন্তব্য করছে এটা দেখে দুটি সম্ভাবনা জাগে মাথায়। প্রথম সম্ভাবনা, যে সময়টা নিয়ে কাহিনী সেই সময়টাতে একটা রোগের নামের সাথে একটা দেশ/জাতিকে যুক্ত করা বর্ণবাদ এরকমটা কেউ মনে করতো না। অথবা, ডাক্তার একজন মানুষ বিধায় সে দোষ ত্রুটি গুন মিলিয়েই একটা অস্তিত্ব এরকমটা প্রতিষ্ঠা করা। দুটো সম্ভাবনাই এই সিরিজটাকে বিশেষায়ন করতে সাহায্য করে।
ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে ফ্রাউ রিটার বাসায় ফেরে। ফেরার পথে প্রতিবেশীর সাথে একটা সংলাপও বিনিময় হয়। সে বাসায় ফিরে ঘরে ঢোকা পর্যন্ত ব্যাকগ্রাউন্ডে তার আর ডাক্তারের কথোপকথন চলতে থাকে। এভাবে একটা দৃশ্যের সাথে আরেকটা দৃশ্য সংলাপ দিয়ে বেঁধে ফেলা সময় সাশ্রয়ী। বেশ ভালো কাজ মনে হয়েছে এটাকে।
বাসায় ঢুকে ফ্রাউ রিটার তার সিফিলিস হয়েছে এটা গোপন করে। সংলাপের এক পর্যায়ে বাসায় যে কিশোরী মেয়েটা থাকে সে কাজ করতে পারবে বলে জানায়। মেয়েটা সম্ভবত স্কুলেও যায় না। এটা তৎকালের অর্থনৈতিক দুরবস্থারও ইঙ্গিত দেয়।
এই পুরো দৃশ্যটা মূল কাহিনীর সাথে তেমন সম্পর্কিত না। অর্থাৎ, এই দৃশ্য বাদ দিলেও মূল কাহিনী কোন এদিক ওদিক হয় না। তবুও এরকম ছোট ছোট দৃশ্য তৈরি করা হয়েছে সিরিজে যেটা দেখে তখনকার সমাজ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় দৃশ্যে অন্যতম প্রধান চরিত্র শারলোটের সাথে ছেলেবেলার বান্ধবী গ্রেটার রাস্তায় দেখা হওয়া দেখানো হয়। গ্রেটা ব্যরলিনে এসেছে কাজ খুঁজতে। রাতে থাকার জায়গা নেই। খাবার পয়সাও নেই। শারলোট গ্রেটাকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। রেস্টুরেন্ট দৃশ্য শুরু হয় লং শট দিয়ে। একটু খেয়াল করলে উপরে রেস্টুরেন্টের নাম আশিঙ্গার (Aschinger) দেখা যায়।
এই শটের পরেই ফ্রেমে দেখা যায় গ্রেটা খাবার শেষ করছে। প্লেটের কোনায় একটা লোগো। গুগল করে দেখলাম সেটা আশিঙ্গারের লোগো।
আশিঙ্গার নামে ব্যরলিনে একটা রেস্টুরেন্ট ছিল বটে। সেটা ১৯৭৬ সালে বন্ধও হয়ে যায়। পরিচালক কষ্ট করে একটা পুরনো রেস্টুরেন্ট বানিয়েছেন, সেটার প্লেটেও যত্ন করে লোগো বসিয়েছেন। প্লেট চামচ গ্লাস সবই অরিজিনাল আশিঙ্গারের এটা হবারও একটা জোর সম্ভাবনা আছে। এই রেস্টুরেন্ট দৃশ্য যেকোন একটা রেস্টুরেন্ট সেট বানিয়ে করলেও হতো। রেস্টুরেন্টের কোন ভূমিকাই নেই কাহিনী। এ সত্ত্বেও এই অতিরিক্ত কষ্টটা করেছেন পরিচালক।
রেস্টুরেন্টে শারলোট আর গ্রেটা যেভাবে আলাপ করে সেটা দেখে জার্মান সংস্কৃতি যারা জানেন তারা একটু ধাক্কা খাবেন। জার্মানরা ভান পছন্দ করে না। অথচ এই দৃশ্যে দেখা যায় গ্রেটা এবং শারলোট দুইজনেই নিজেদের খোঁজ খবর দেবার সময় নিজেদের বিষয়ে অনেকটা বাড়িয়ে বলছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জার্মানিকে বদলে দিয়েছে আগাপাশতলা। এটা হতে পারে যুদ্ধের আগে নিজেকে/নিজেদের নিয়ে গল্প করার প্রচলন ছিল যেটা এখন নেই।
খাবার শেষে দুইজনের ৬ পেনি বিল আসে। গ্রেটা ১০ পেনি দেবার পর যে ৪ ফেরত আসে সেটা সে গ্রেটার জন্য টেবিলে রেখে যায়। পশ্চিমা পর্দায় এসব দারিদ্রের চেহারা দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের বেশি হয় না। এটা আমাদের দেশে যে খুব হয় তাও না। একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র টাকা বাঁচানোর জন্য বিকালে নাস্তা করে না বা হালের ফ্যাশন সম্মত রেস্টুরেন্টে আড্ডা মারতে যায় না বিল দিতে পারবে না বলে বা সেই মেয়েটা যে একটা ভালো শাড়ী নেই বলে বিয়ের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে -- এসব আমাদের চারিদিকের বাস্তবতা। এসব আমরা সিনেমা নাটক গল্প উপন্যাসে আনতে পারিনি সেভাবে। ব্যবিলন ব্যরলিন এটা পেরেছে।
Comments
দেখবো। আএ্যারডে'র সাথে স্কাই মিলে বানিয়েছে এই সিরিজ। স্কাই না থাকলে বৈধভাবে দেখার রাস্তা নাই।
অজ্ঞাতবাস
নেটফ্লিক্সে পাওয়া যাবার কথা।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ক্যানাডা নেটফ্লিক্সে নাই দেখলাম
..................................................................
#Banshibir.
এই একটা ঝামেলা। ইওরোপিয়ান নেটফ্লিক্স এমনিতে ভালো না। আপনারা বহু কিছু দেখতে পান যেগুলো আমরা দেখতে পাই না বা দেখার জন্য ৬ মাস বসে থাকা লাগে। ততোদিনে লোকজনের মুখে স্পয়লার শুনতে শুনতে আর মজা থাকে না।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
ক্যানাডা নেটফ্লিক্সে আসছে এখন।
..................................................................
#Banshibir.
সময় পেলে দেখে ফেলব সিরিজটা।
বার্লিন'কে ব্যরলিন লিখলেন কেন?
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
উচ্চারণের কাছাকাছি লিখলাম। মারকেল যেমন ম্যরকেল।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
Post new comment