সময়ের প্রয়োজনে: এ ক টি অ স মা প্ত পা ন্ডু লি পি

কর্ণজয়'s picture
Submitted by কর্ণজয় on Fri, 16/12/2016 - 2:21pm
Categories:

২০০১ সালের এক রাত। খুব কুয়াশা ছিল সেদিন। আকাশে চাঁদ উঠেছে। কিন্তু দুধ সাদা চাঁদরে তার মুখ পাওয়াই ভার। সমস্ত চরাচর একটা হিম ঠান্ডার ভেতরে ডুবে আছে। হুমায়ূন রোডের বাসার ছাদে দাড়িয়ে আছেন সুমিতা দেবী, অভিনেত্রী- ব্যক্তিগত জীবনে জহির রায়হানের স্ত্রী। কুয়াশার সেই হিম সাদা চাদর ফুড়ে সুমিতা দেবীর কণ্ঠ ভেসে আসে-
: তুমি যদি জহিরের ছবি খেয়াল করে দেখো তাহর্লে দেখবে ওর সমস্ত ফ্রেমে কোথাও একটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে জহির দাড়িয়ে থাকে। ঐ ফাকা জায়গাটা ওর জন্য।
কথাটার মধ্যে একটা সত্যি লুকিয়ে আছে। শুধু তার ছবির মধ্যে নয় - কেউ যদি তার সময়ের প্রয়োজনে গল্পটা ভাল করে পড়ে দেখেন তাহলে তিনিও হটাৎ একটা ফাকা জায়গার সামনে এসে দাড়াবেন।
এই যে বেচে আছি - এই সময়ে - আমাদের কাছে এই সময়ের প্রয়োজনটা কি? মাঝে মধ্যে মনে হয় আমরা সময়টাকে হারিয়ে ফেলেছি, জহির রায়হানের মতোই। তখন আর সময়ের প্রয়োজনটা আর সামনে আসে না - তাই আমরাও আমাদের কাজটাকে ঠিক করে উঠতে পারি না। উপরি একটা দেশপ্রেম নিয়ে কিছু ফাঁকা জায়গায় ঘুরে বেড়াই।
কেন যুদ্ধ করছো বলতে পারো?
বলছিলাম - দেশের জন্য। মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করছি। যুদ্ধ করছি দেশকে মুক্ত করার জন্য।
বাংলাদেশ।
না। পরে মনে হয়েছিল উত্তরটা বোধহয় ঠিক হয় নি। ...
দেশ তো হল ভূগোলের ব্যাপার। হাজার বছরে যার হাজারবার সীমারেখা পাল্টায়। পাল্টেছে। ভবিষ্যতেও পাল্টাবে।
তাহলে কেন যুদ্ধ করছি আমরা?
সময়ের প্রয়োজনে।
(সময়ের প্রয়োজনে, ছোটগল্প)

আকাশে মেঘগুলো যেন যুক্তি করে একটু জায়গা করে দিল, তাতে ঝলমল করে উঠল একঝাক তারা। আকাশের তারা আর অবিশ্রান্ত ঝিঝির ডাকের ফাকে দুই একটা ব্যাঙ চিৎকার করে জানান দেয় - সে আছে। তারাদের মধ্যে চেনাতারাগুলো খুজতে খুজতে ভাবি প্রকৃত ভালবাসা কি? আমি কাকে কাকেই বা প্রকৃত ভালবাসি? প্রকৃতভাবে ভালবাসা ছাড়া কি কোন কিছু দেখতে পাওয়া যায়?
যদিও সকালবেলায় আমরা ঘুম ভেঙে উঠে দেখি- চারপাশটা একইরকম আছে। একটা বিশাল বাড়ি রাস্তায় ছায়া ফেলেছে। হাউজিং কোম্পানি অধ্যূষিত ব্যস্ত শহর পেরিয়ে সেই নদী, আকাশ জুড়ে মেঘেদের আনাগোনা, গাছগুলোর সবুজ দেহ বাতাসে দুলছে, একটা পাখি উড়ে গেল দূরে কোথায়। কিন্তু মাথার ভেতর কোন কিছু ঢুকছে না। মগজের জায়গাটা শূন্য মনে হয়। খুব অসহায় মনে হয়। তখন আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। অপেক্ষার আলো বর্ষার ফলার মত, চোখের ভেতরে ঝলকে ওঠে। চারপাশটা ছবি হয়ে যায়। কিন্তু এই ছবিটাকেও ঠিকমতো আকতে পারি না। এখন কত চলচ্চিত্র হয়- সহস্র নাটক অভিনীত হয়। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে একটা কড়া মেকআপের গন্ধ। মেকআপের আড়ালে চামড়ার রঙটাই হারিয়ে গেছে। শিল্প যে জীবন থেকে - জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসে -এটা আমরা ভুলে গেছি। উপন্যাস যেমন জীবনের এবং সমাজের প্রতিচ্ছবি, চলচ্চিত্রটাও তাই।
জীবন থেকে নেয়া- একটি পরিবারের গল্প। পুরো পরিবারের স্বপ্ন- ভালবাসা একজনের কর্তৃত্বের শেকলে বন্দী । বাড়ির ছাবির গোছা, যেটা সেই পরিবারের কর্তৃত্বের প্রতীক। সেই চাবির গোছার মালিকানা জোর করে দখলে রাখতে চান বাড়ির বড় কন্যা। এই কন্যা আসলে আসলে পাকিস্তানী স্বৈরাচারের একটা প্রতীক। জহির রায়হানÑ এই ছবিতে যে চাবির গোছা দেখিয়েছিলেন - সেই গোছাতে ছিল ছয়টি চাবি। এই চাবিও ছিল আসলে একটি প্রতীক। যখন জহির রায়হান জীবন থেকে নেয়া ছবিটি নির্মাণ করছেন তখন বাঙালী তার আত্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে লড়াই করতে আন্দোলনে নেমেছে। জীবন থেকে নেয়া’র চারি গোছার গোছার প্রত্যেকটি চাবি ছিল এক একটি দফার প্রতীক। ছয়টি চাবি - ছয়দফা। যার মধ্যে বাঙালীর মুক্তি লুকিয়ে আছে। পুরো পরিবারটি হয়ে ওঠে বাঙালী জাতির একটি রূপক। এই ছিল ছবির বিষয় উপস্থাপনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭০’এর নির্বাচন ছিল স্বাধীনতার সূচকের মতন। বাঙালী জাতি সেদিন ৬ দফার পক্ষে তার রায় প্রদান করেছিল। জীবন থেকে নেয়া ছবিটি - ৭০ এর নির্বাচনে বাঙ্গালীর তার ঐতিহাসিক মুক্তির আকাঙ্খাকে জমাট বাধতে সাহায্য করেছিল।

সাথে লড়াই করতে আন্দোলনে নেমেছে। জীবন থেকে নেয়া’র চারি গোছার গোছার প্রত্যেকটি চাবি ছিল এক একটি দফার প্রতীক। ছয়টি চাবি - ছয়দফা। যার তার মধ্যেই বাঙালীর মুক্তি লুকিয়ে আছে। এই ছিল ছবির বিষয় উপস্থাপনা। ৭০’এর নির্বাচন ছিল এর পরেই। জীবন থেকে নেয়ার- ৭০ এর নির্বাচনে বাঙ্গালীর তার ঐতিহাসিক মুক্তির আকাঙ্খাকে জমাট বাধতে সাহায্য করেছিল।
আসলে সসব মহৎ শিল্পই এমন। এখন আমরা গল্প ফাদি - আমরা গল্প নেই না। আমরা যদি জীবনকে দেখতে পারতাম তাহলে জীবন থেকেও নিতে পারতাম - সেই ধ্র“পদী বাণীর সারকথা - জীবনটাতো নাটকের চেয়ে অনেক নাটুকে, সিনেমার চেয়ে সিনেমাটিক।

ইচ্ছে করে আমার পাশের বাড়ির ছোটবউটিকে নিয়ে একটা ছবি বানাই। ছোটবউটি, যার স্বামী আজ দশবছর ধরে জেলখানায় পচে মরছে। কী অপরাধ তার, কেউ জানে না।

ইচ্ছে করে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে ছবি তৈরী করতে।
সেই বন্ধু।
বহুদিন আগে যাকে প্রথমে আরমানিটোলায় পরে পল্টনে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দিতে দেখেছিলাম। দেখেছিলাম সহস্র জনতার মিছিলের মাঝখানে। সেই একুশের ভোরে যে আমার কানে কানে বলেছিল - বন্ধু, যদি আজ মরে যাই তাহলে আমার মাকে কাঁদতে নিষেধ করে দিও। তাকে বলো - সময়ের ডাকে আমি মরলাম।
সময় পাল্টে গেছে হয়তো। তাই আজ সেই বন্ধু আমার, আমলাদের ঘরে ঘরে যুবতী মেয়েদের ভেট পাঠায় দুটো পারমিটের লোভে! আহা, তাকে নিয়ে যদি একটা ছবি বানাতে পারতাম।

আমার ছোট বোনটি সেও ছায়াছবির একটা বিষয়বস্তু হতে পারতো।
তার বড় আশা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। দু-দুবার কঠিন রোগে ভোগার পর ডাক্তার তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিল।
... মাঝে মাঝে ভাবি কতকগুলো অসংস্কৃত লোককে নিয়ে একটা ছবি বানাবো।
যারা দিনরাত সংস্কৃতির কথা বলে। কালচারের কথা বলে। ঐতিহ্যেও কথা বলে। বলে আর বলে।...
ইচ্ছে করে সেলুলয়েডে কয়েকটি মানুষের ছবি আকি। যাদের মুখগুলো শূকর- শূকরীর মতো।
যাদের জিহ্বা সাপের ফণার মতো। যাদেও হাতগুলো বাঘের হাতের থাবার মতো। ..
আর যাদের মন মানুষের মনের মতো সহস্র জটিলতার গিটে বাধা। যারা শুধু কলহ করে আর অহরহ মিথ্যে কথা বলে।
যারা শুধু দিনরাতের ভাতের কথা বলে। অভাবের কথা বলে। মাংসের ঝোলের কথা বলে। আর মরে।
গিরগিটির মতো। সাপ-ব্যাঙ কেঁচোর মতো। মরেও মরে না।
গন্ডায় গন্ডায় বাচ্চা বিইয়ে বংশ বৃদ্ধি করে রেখে যায়।
আহা, আমি যদি সেই তরুণকে নিয়ে একটা ছবি বানাতে পারতাম। যার জীবন সহস্র দেয়ালের চাপে রুদ্ধশ্বাস।
আইনের দেয়াল। সমাজের দেয়াল। ধর্মের দেয়াল। রাজনীতির দেয়াল।দারিদ্র্যের দেয়াল।
সারাদিন সে ওই দেয়ালগুলোতে মাথা ঠুকছে আর বলছে - আমাকে মুক্তি দাও। ...
সারাদিন সে ছুটছে, ভাবছে- আবার ছুটছে।
এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে।
ঈর্ষার দেয়াল। ঘৃণার দেয়াল। মিথ্যার দেয়াল। সংকীর্ণতার দেয়াল।
কত দেয়াল ভাঙবে সে?
... তবু সে ছুটছে আর ভাঙছে। যদিও সে জানে মানুষের আয়ু অত্যন্ত সীমিত।

(ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি, ছোটগল্প)
বাক্যগুলো চোখের ভেতরে অন্ধকার নামায়, মাথার মধ্যে আলো। সময়ের চিত্রটাকি পাল্টলো খুব? মাঝে মধ্যে কোথাও তাকাতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয় চোখ বন্ধ করে বসে থাকি। মানুষের অভিজ্ঞতা আসলে বাড়ে না। নইলে পুরনো সমস্যাটার কথা নতুন করে ভাবতে হয় কেন? কিংবা এইজন্যই হয়তো নতুন করে ভাবতে হয়।
ভাবনার আকাশে সূর্যাস্তের রঙ মাখানো উৎসবে কালি মেখে দিয়েছে মেঘ। তবু তার ফাক গলে আবির রঙে আর সোনা রঙে আকাশটার তন্বী শরীরটা যে কেমন মাখামাখি তা বেশ বোঝা যায়। নৌকার একটানা ভটভট শব্দে চারদিকটা আরো চেপে এসেছে। বৌদ্ধ সূত্র পাঠের শব্দ এখনও শোনা যায়। আমি সামনে তাকাই। নলখাগড়ার মাথাগুলো অনেক উচুতে, আন্ধার নামা রাত্রির গায়ে আরো নিকষ কালো হয়ে দাড়িে য়আছে, ভুল করে নারি সারি সৈন্যের উদ্ধত বর্ষার ফলার মত মনে হয়। তার পায়ের কাছে বিজেতা নদীটা আনত হয়ে আলুলোয়ায়িত বেশে পড়ে আছে।
এই যে এত আয়োজন , কেন বলতে পারেন। এখন তথ্য দিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে, বিদ্যা দিয়ে লড়াই হচ্ছে, আবিস্কার দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব আনছে- এই সেকেলে যুদ্ধের আয়োজন এখনও কেন বলতে পারেন -
পুরোনো খবরের কাগজের আড়ালে বাবার মুখ।। বাবার উঠোন মানেই খবরের কাগজ আর খবরের কাগজ। খবরের কাগজে কি সব ছাইপাশ চারধার গরম হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাউনি ফেলেছে মিলিটারীরা - ছাত্রদের উপর গুলি করেছে.. খেলার মাঠে একটা সেপাই গিয়ে ছাত্রদের উপর চড়াও হয়েছে তাই নিয়ে এই গন্ডগোল। শিক্ষকের হাতকড়া পরা ছবি। এসব কিছুই মাথায় ঢুকে না, হাতে একটা গরম ভাপা পিঠে নিয়ে আমি ঘুরঘুর করি। কেন এমন হয়। শূন্য কামরাঙা গাছটায় একটা অজানা পাখি এসে বসেছে। নীল রঙের একটা ঝুটি পাখিটার মাথার উপর। হুশ করে উঠতেই পাখিটা উড়ে গিয়ে হারিয়ে যায়। আমি খানিকক্ষন খুজে তাকে ভুলে যাই। ছাদ ঝুলতে থাকে চোখের উপর। আমিও আর মনে করতে পারি না ঠিক শূন্য সাদার দিকে আমি কিসের জন্য চেয়ে আছি।
শুনেছি মানুষ স্মৃতির মধ্যেই বাচে।
দেশ? তার বোধহয় স্মৃতির দরকার হয় না। তাই আমরা ভুলে গেছি -
দেখলাম
মেঝেতে পুডিং এর মতো জমাট রক্ত - বুটের দাগ- অনেকগুলো খালি পায়ের ছাপ। ছোট পা। বড় পা। কচি পা।
কতগুলো মেয়ের আঙুল। একটা আঙটি। চাপচাপ রক্ত। কালো রক্ত। লাল রক্ত। মানুষের হাত। পা। গোড়ালী। পুডিং এর মতো রক্ত। খুলির একটা টুকরো অংশ। এক খাবলা মগজ। রক্তের উপর পিছলে যাওয়া পায়ের ছাপ। অনেকগুলো ছোট বড় ধারা। রক্তের ধারা। একটা চিঠি। মানিব্যাগ। গামছা। একপাটি চটি। কয়েকটা বিস্কুট। জমে থাকা রক্ত। একটা নাকের নোলক।একটা চিরুনি।.. ... বুটের দাগ। লাল হয়ে যাওয়া একটা সাদা ফিতে। চুলের কাটা। দেয়াশলাইয়ের কাঠি। একটা মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ছাপ। রক্তের মাঝখানে এখানে ওখানে অনেকগুলো ছড়ানো। পাশের নর্দমাটা বন্ধ। রক্তের স্রোত লাভার মতোন জমে গেছে সেখানে। দেখে ঊর্র্দ্ধশ্বাসে পালিয়েছিলাম। সেখান থেকে।
আমি একা নই । অসংখ্য মানুষ।
(সময়ের প্রয়োজনে, ছোটগল্প)

তাই আমরাও এখন পালাচ্ছি। জহির রায়হানের মতন আমরা কেউ আর দেখিনা -

জনতার সমুদ্র।
সমুদ্রের চেয়েও গভীর।
সাগরের চেয়েও উত্তাল।

মনে হচ্ছিল সে অনেক অনেক কথা, তোমার জন্য।
কিন্তু নীরবতা এসে বলছে - মৌনতার চাষ করো, অনুভূতিগুলো বেড়ে উঠবে। আমরাতো দেখেছিই - আমাদের বলে ওঠা কথাগুলো ছিন্ন কোন মালা থেকে ঝরে পড়া পুতির মত গড়িয়ে গেছে, আমরাও তাকে পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছি আরো অনেকটা দুর। এখন যে জায়গায় দাড়িয়ে পৃথিবীকে আমরা দেখছি - সেখানে পৃথিবী যে নীল - সেটা চারভাগের তিনভাগের জলের জন্যই। আকাশের মেঘগুলো আমরা জানি জলের কণা পরিপূর্ণ এক বাস্পখন্ড মাত্র, যক্ষের মনোবেদনার মর্ম যে বাণী- সে আমাদের সৃষ্টিশীল মনের মনছবি , সেও জেনেছি বোধহয় - অনেকদিন হলো।
পাথুৃরে কর্কশ জমিতে হাটতে হাটতে মানুষ এভাবেই বড় হয়ে যায় - আমরাও বড় হয়ে উঠেছি - দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে - এটুকু বুঝে নিয়ে আর কি বলার কথা থাকতে পারে, যা নতুন করে বলা যায়?
সম্ভবত আমরা কেউই আমাদের ফেলে যেতে পারি না। অতীত শুধু অতীত নয়। তার আপন নিয়মে সে বর্তমানের মতই সোচ্চার। এই পৃথিবীতে কোথাও সে আমার জন্য দাড়িয়ে আছে, ভেবে ছিলাম ফেলে এসেছি কিন্তু এখন বুঝতে শিখেছি -আমরা ফেলে আসতে পারি না কিছুই। সবকিছুই থেকে যায়: স্বপ্ন, পাপ, ভ্রম, প্রেম, বেদনা এবং অপেক্ষা- মনের কোন এক সংগোপিত অলিন্দে। অন্তর্ধান থেকে জহির রায়হান মগজের কোষে ফিরে আসেন। আমি ভাবতে চেষ্টা করি - এই চোখ- জহির রায়হানের চোখ। আমি টের পাই তিনি লজ্জ্বা পাচ্ছেন।

রবার্ট ক্লাইভ- এ খলনায়কও আত্মলজ্জ্বায় আত্মহত্যা করেছিলেন।
কিন্তু আত্মসন্মানহীন আমাদের নায়কেরা...

সময়ে নাকি সব পাল্টে যায়। চষধংঃরপরঃু ড়ভ ঃরসব.
সময়ের পরিবর্তনের মধ্যে অনেক কিছুই হয়তো চাপা পড়ে গেছে। আমরা ঠিক এখন তার মত স্বপ্ন দেখতে পারি না।

মোট সাতাশজন মানুষ। প্রথম উনিশজন ছিলাম। আটজন মারা গেল মর্টারের গুলিতে। .. একজন পালিয়ে গেল। আর একজন মারা গেল হটাৎ অসুখে। তখন ছিলাম ন’জন। এখন আমরা বেড়ে সাতাশে পৌছেছি।
আমাদের অস্তিত্ব এবং লক্ষ্য দুই-ই এক।
আমরা ভাবতে পারি না- আমরা এভাবে বেড়ে উঠবো। নিঃসঙ্গতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা ঝেড়ে ফেলে অনেক হয়ে উঠবো। হয়তো সময়টাই তাই। নিজেকে বিক্রি করা ছ্ড়াা আর কোন অস্তিত্ব নেই এখন। ভাঙ্গা কাচে দেখা নিজের ভাঙা চেহারাটাকেই আসল ভেবে ঘুরে বেড়াতে হবে।
কিন্তু জহির রায়হান ইতিহাসের মতই আমাদের ফিসফিস করে বলে যান, সময় একরকম থাকে না। সময়ের প্রয়োজন পাল্টায়। মানচিত্রের মত। এই সময় থেকে আর এক সময়ের শুরুর দিকে তাকাই-
মনে মনে ভাবি -আমরা ওদিকেই যাবো। ওখানে মেঘ বৃষ্টি রোদ আছে। ওখানে একটা শিশু বসে আছে। ও সেখানে খেলা করে। ও সেখানে কান্না করে। ও সেখানে হাসি করে।
হাজার বছর ধরে সেখানে বরফ গলা নদী ঝর্ণাধারার মত বইবে। আর সেই ঝর্ণার জল পান করে তৃষ্ণা মেটাবে শেষ বিকেলের মেয়ে। কাচের দেয়ালে আটকা পড়ে থাকবে না কেউ।
জহির রায়হানের মৃত্যু হয় নি। তার মৃত্যুর সুনিশ্চিত কোন তথ্য আমরা জানি না। একটা গল্পের মধ্যে আমাদের রেখে জহির রায়হান চলে গেছেন। তার কাজগুলো আমাদের কাছে রয়ে গেছে - কিন্তু যেন তা তার জীবনের মতই - একটা অসমাপ্ত পান্ডুলিপির মতো। যে পান্ডুলিপিটা এখনও শেষ হয় নি। আমাদের যুদ্ধের মত। আমাদের দেশের ইতিহাসের মত। যেন লিখতে লিখতে উঠে একটু সময়ের জন্য তিনি বাইরে গেছেন, তিনি আবার ফিরে আসবেন যে কোন সময়। আর এই অসমাপ্ত পান্ডুলিপি সম্পূর্ণ করার জন্য তিনি একটু পেছনে ফিরে তাকাবেন - তার মনে পড়বে সেই পুরনো সংলাপগুলো এখনও পুরনো হয়ে যায় নি - ওখান থেকে জন্ম নিতে চলেছে আসন্ন আগামী - সময়ের নতুন প্রয়োজন-
আগুন জ্বালো।
আবার আগুন জ্বালো।
পুরো দেশটায় আগুন জ্বালিয়ে দাও।
পনেরো কোটি লোক আছে।
তার মধ্যে না হয় সাতকোটি মারা যাবে।
বাকি আটকোটি সুখে থাকুক। শান্তিতে থাকুক।
পুরো বছরটাকে শহীদ দিবস পালন করুক ওরা।
(কয়েকটি সংলাপ, ছোট গল্প)
মূল গল্পে পনেরো কোটির জায়গায় সাত কোটি, সাতকোটির জায়গায় তিনকোটি, আর আটকোটির জায়গায় চারকোটি আছে


Comments

অতিথি লেখক's picture

ইচ্ছে করে 'লেট দেয়ার বি লাইট' নিয়ে একটা চলচ্চিত্র বানাই। এক কালে যে ছবির চিত্রায়ণ শুরু হয়েছিল অলিভিয়া গোমেজকে কেন্দ্রীয় এক চরিত্রে কাস্ট করে। যার শুরুটা হয় এই বলে -

"তবু মানুষের এই দীনতার বুঝি শেষ নেই।
শেষ নেই মৃত্যুরও।
তবু মানুষ মানুষকে হত্যা করে।
ধর্মের নামে।
বর্ণের নামে।
জাতীয়তার নামে।
সংস্কৃতির নামে।
এই বর্বরতাই অনাদিকাল ধরে আমাদের এই পৃথিবীর শান্তিকে বিপন্ন করেছে।
হিংসার এই বিষ লক্ষ-কোটি মানব সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
জীবনকে জানবার আগে।
বুঝবার আগে।
উপভোগ করবার আগে।
ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে অসংখ্য প্রাণ।"

অতিথি লেখক's picture

Quote:
ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে অসংখ্য প্রাণ।"
Quote:
হান্টার হান্টার

প্রাচ্য পলাশ's picture

মানুষ সময়ের দাস। সৃষ্টির আদিকাল থেকে জীবনের অনাদিকাল পর্যন্ত তাকে দাসত্ববরণ করেই থাকতে হবে। জীবনের সবকিছুর আধুনিকায় হয়। কিন্তু সময়ের দাসত্বের নবায়ন বা আধুনিকায়ন হয় না।

প্রাচ্য পলাশ

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.