পণ্ডিত রবি শঙ্করের আত্মজীবনী রাগ-অনুরাগ

তারেক অণু's picture
Submitted by tareqanu on Thu, 13/12/2012 - 8:36am
Categories:

যখন ভাবি এই লেখাগুলোর মধ্যে আমি কতখানি নিজের দোষ স্বীকার করে উঠতে পেরেছি তখন আর আমার আফসোস থাকেনা। হাজার হোক আমি তো দেবতা নই। যারা আমাকে দেবতা জ্ঞান করতেন তারা যদি আজ আমাকে রক্ত-মাংসের মানুষ মনে জেনেও ভালবাসেন তবেই না জীবন সার্থক। উঁচু পিঁড়িতে বসে শ্রদ্ধা পাবার অভিলাষ আমার নেই। যেটুকু গানবাজনা করেছি, মানুষকে যেটুকু আনন্দ আজ অবধি দিয়েছি, তার বিনিময়ে যেটুকু শ্রদ্ধা-ভালবাসা মানুষ আমায় দিতে পারেন তা পেলেই নিজেকে ধন্য মনে করব। কারণ জানব, ওইটুকুই আমার সত্যিকারের পাওনা।

১৯৭৯ সালের ২১ মার্চ দার্জিলিং-এ নিজের আত্মজীবনীগ্রন্থ রাগ-অনুরাগের মুখবন্ধে উপরের কথাগুলো লিখেছিলেন বিশ্বখ্যাত সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শঙ্কর। আবার এক অর্থে এতই আত্মজীবনী নয়ও, ১৯৭৭ সাল থেকে শুরু করে সওয়া দুই বছর রবিশঙ্করের সাথে আলোচনায় বসেছিলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, সেই আলাপগুলো ভরা মজলিসে উপস্থাপনের মত আড্ডার ভঙ্গীতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এসেছে বর্ণিল জীবনের নানা দিক।

ঘরের কোণে একলা বসে রবিশঙ্করের সৃষ্টিতে মজে আছি তুষার ঝরা শীতের রাতে, বাহিরে মনে হচ্ছে তার মহাপ্রয়াণে প্রকৃতিও তুষার, বায়ু, গাছের ছন্দে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন বিশাল হৃদয়ের মানুষটিকে। ভাবলাম কমাস আগেই পড়া রাগ-অনুরাগ নিয়ে একটু আলোচনা করি সবার সাথে---

দেখুন মশাই আমি লেখক নই, গানবাজনার কারবার করি। আর তাতেই তো এখনও অনেক বাকি। লেখার কথা ছেড়ে দিন। তবে হ্যাঁ, অনেক দিন থেকে লোকে বলে এসেছে, একটা কিছু লিখুন। হয়ত ইচ্ছেও ছিল কন-না-কোনদিন লিখব। যদি পরে কোনদিন সময় করে বসতে পারি। কিন্তু করব করব করেও সেটা হয়ে ওঠে না। আর, তা ছাড়া কি লিখতে গিয়ে কি লিখে বসি এই ভাবনাও আসত। বলা তো যায় না। টাই আবার মাঝে মাঝে ভাবতাম লেখার কি দরকার! আমার একটা মত ছিল, যন্ত্র ছেড়ে কথা কেন? এমন কি, একসময় মনে মনে যে বইটার মহড়া দিতাম তার নামটাও ঐ রেখেছিলাম।

এইভাবেই শুরু হয়েছে অসাধারণ বইটির, আগুপিছু করে রবি শঙ্কর স্মরণ করেছেন তার শৈশব, সঙ্গীত সাধনা, বন্ধু, গুরু, বাজনা, ভ্রমণ, প্রেমিকা সবই- ঠিক তার সেতার বাদনের মত, মিহি সুর থেকে উত্তাল তরঙ্গে দুই মলাটে এটে গেছে সমগ্র জীবন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন বাবা কে, তার সেই বাবার নাম ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ- যিনি তার জীবনের আদর্শ, সমস্ত শক্তির উৎস। ১৯৩৪ সালে তার সাথে বালক রবি শঙ্করের প্রথম দেখা হয়, পরে বিলেতযাত্রার সময় জাহাজঘাটায় বিদায় দিতে এসে রবির মা হেমাঙ্গিনী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে বলেছিলেন- দেখবেন এই ছেলেটাকে আমার। ওর বাবা ( পণ্ডিত শ্যামশঙ্কর চৌধুরী) কিছুদিন হল মারা গেছে। আজ থেকে আপনিই ওর বাবা। ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা করে দেবেন। আপনার হাতেই ওকে ছেড়ে দিলাম।

আবেগী মানুষ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন আপনার ছেলে আজ থেকে আমার ছেলে। আমার এক ছেলে তো আছেই, আজ থেকে আমার আর এক ছেলে হল। ও আমার বড় ছেলে হবে এবার।

মহান সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ জীবনের নানা দিক উঠে আসে রবির বর্ণনায়, বাংলাদেশের মানুষ তিনি, কোলকাতার ভাষায় কথা বলতেন না, আজীবন নিজের বুলিই বলেছেন সারা বিশ্বে, তার সাধনা, তার হিমালয়সম জ্ঞান, মানবিকতা নিয়ে বলে গেছেন পাতার পর পাতা।

এসেছে তার সঙ্গীত জীবনের সবসময়ের সঙ্গী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর কথা, যার সঙ্গীতচর্চায় অলসতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এক সময় গাছের সাথে বেঁধে সারা দিন পিটিয়েছিলেন, সেই মানুষটিই পরিচিতি পেলেন বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাজিয়ে হিসেবে। উনাকে সবসময়ই রবি শঙ্কর ভাই আলী আকবর বলে সম্বোধন করেছেন।

মুচকি হাসি নিয়ে স্মরণ করেছেন জীবনের শুরুর দিকের দিনগুলোর কথা যখন মানুষের ধারণা ছিল মসুলমান শিল্পী না হলে কিংবা নামের পিছনে খাঁ না থাকলে, পেয়াজ-রসুনের গন্ধ না আসলে নাকি শিল্পী হওয়া যাবে না! রাগে দুঃখে রবি শঙ্কর ভেবেছিলেন নাম পরিবর্তন করে রব্বন খাঁ করে ফেলবেন।

আরও একজনের কথা বার বার এসেছে রবি জীবনকথায়, তার আপন বড় ভাই বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর, যার সমান খ্যাতি আজ পর্যন্ত উপমহাদেশের কোন নৃত্যশিল্পীর কপালে জোটে নি।

এসেছে বিলায়েত খাঁর সাথে তার বন্ধুত্ব এবং বাজনা নিয়ে অদ্ভুত দন্ধের কথা, যদিও বোঝা যায় রবি সেরা না বিলায়েত সেরা এমন কথা তুলে তাদের বাজনার লড়াইটা উসকে দিতে খবরের কাগজের লোকেরা। সেই সাথে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে, তপন সিংহের চলচ্চিত্রে সুরারোপণের অভিজ্ঞতা বলেছেন চটুল ভঙ্গীতে।

বইটির আরেক বিশাল সম্পদ এর আলোকচিত্রের সংগ্রহ, কত বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ আর মনিষীর ছবি আর কাহিনীযে স্থান পেয়েছে অতি অল্পের মাঝেও বিশেষ করে ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওয়াজির খাঁ, আমির খাঁ, নিশার হুসেন খাঁ, ভীমসেন যোশী, আশিস খাঁ, গুলাম আলী খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, ওংকারনাথ ঠাকুর, কেশরবাঈ, হীরাবাঈ, মল্লিকার্জুন মনসুর, আখতারীবাঈ, আহমেদজান থিরকুয়া সাহেব, কিষেণ মহারাজ, কেরামত খাঁ, দেবব্রত বিশ্বাস, শম্ভু মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, সলীল চৌধুরী, ফরাসী দার্শনিক রোম্যা রলা, ইহুদি মেনুহিন, পাবলো কাসাল, লতা মুঙ্গেসকর, শচীন দেব বর্মণ, কানন দেবী, আমজাদ আলী খাঁ, ওস্তাদ আল্লারাখা প্রমুখের কথা।

সেই সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টি নিয়ে তার একান্ত উপলব্ধি।

একাধিকবার কথা প্রসঙ্গে এসেছে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এবং ইন্দিরা গান্ধীর কথা, নেহেরু যে তাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন সে কথা রবি বলেছেন নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে করতে। সেই সাথে অবশ্যই জর্জ হ্যারিসন এবং বিটলস! জর্জ হ্যারিসন যখন রবিশঙ্করকে গুরু হিসেবে মেনে নিলেন তখন বিশ্বব্যপী কোটি কোটি তরুণের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন রবি, কিন্তু এর ঋণাত্নক দিকও ছিল, অনেকেরই ধারণা হয়েছিল হিপি আর ড্রাগ কালচারে জড়িয়ে যেয়ে রবি শঙ্কর তার সৃষ্টির বারোটা বাজাচ্ছেন।

নিজের জীবনসঙ্গিনী এবং প্রেমিকাদের কথা বলেছেন অকপটে, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা অন্নপূর্ণার সাথে যখন তার বিয়ে হয় তখন বরের বয়স সবে ২১ আর কনের বয়স পনের পেরিয়েছে। উদারপন্থী আলাউদ্দিন খাঁর জেদে হিন্দু মতেই বিয়েটি সম্পন্ন হয়। এর কিছুদিন পরেই তাদের প্রথম সন্তান শুভর জন্ম হয়। এরপর নানা কারণে, রেওয়াজ, বাড়তি উপার্জন, সংসার এবং কমলার সাথে সম্পর্কের কারণে অন্নপূর্ণার সাথে রবির সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, যদিও তারা আইনের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেন নি। কমলাকে বিয়ে না করার ব্যাপারে রবি শঙ্কর স্পষ্ট বলেছেন- কমলাকে যে নিয়ম মেনে বিয়ে থা করিনি তার কতকগুলো কারণ আছে, কি জানি, নিজের বিয়ে দেখে এবং অন্য অনেকের বিয়ে দেখে আমার বিয়ের ওপর থেকে সমস্ত শ্রদ্ধা চলে গেছে। তবে ভালো স্ত্রীরা বা সঙ্গিনীরা যে কোনও পুরুষকে জীবনে অনেক বড় হতে এবং সার্থক হতে অনুপ্রেরণা দেয় এবং সাহায্য করে, সেটাও আমি খুব বিশ্বাস করি। কোনও সন্দেহই নেই সে বিষয়ে। তবে সেটা নিছক বিয়ের জন্য কি না, সেটা তর্কসাপেক্ষ। ঐ সার্থক সম্পর্কও তো আসলে একটা গভীর অন্তরঙ্গতা এবং ভালবাসার ওপরই প্রতিষ্ঠিত। সেখানে মন্ত্র পড়ে কার বিয়ে হল, কার কি হল, সেটা বড় কথা নয়, বিয়ে না হয়েও সেটা হতে পারে। কাজেই বিয়ে বলে যে মন্ত্র পড়াপড়ির একটা অজুহাত, সেটা না দেখালেই কি নয়? আসল কথা ভালবাসা, বোঝাবুঝি, মানিয়ে চলা এবং একে অন্যকে বড় হতে দেওয়ার শুভ প্রচেষ্টা। পরস্পরকে সন্মান দিয়ে, ভালবেসে যারা থাকতে পারে তারাই সুখী, তারাই আদত বিবাহিত। এবং সেটা কমলার সঙ্গে আমার হয়েছে। তাই আমি ওকে পেয়ে সুখী।

অথচ এই কমলার প্রতিও আমি বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করেছি। আনফেথফুল হওয়া বলতে যা বোঝায়। বহুবার। কিন্তু আনফেইথফুল হওয়ার মাঝেও একটা কথা আছে। আইফেইথফুল আমি নিশ্চয়ই হ্যেছি,কিন্তু আমি তার জন্য ওর কাছে মিথ্যার আশ্রয় নিই নি।
[b]
আমাদের জীবন যা হয়, অর্থাৎ অনেক দিন একলা একলা অনেক অনেক ঘুরতে থাকলে কিছু-না-কিছু এক্সপিরিয়েন্স আপনা থেকেই হয়ে পড়ে। এবং সেটা যারা অস্বীকার করেন তাদের আমি বড় মানুষ হিসেবে মানতে বাধ্য। কিন্তু যারা এসব ঘটিয়েও সব অস্বীকার করেন তাদেরকে আমি নিম্নস্তরের মনোবৃত্তির লোক বলেই ধরব। [/b]

এর পর রবি তার এক নাম না জানা প্রিয় বান্ধবীর কথা বলেন যে তার পঞ্চম সে গারা হতে চেয়েছিল, ঐ যে রবি গারার মুখটা বাজান, তারপর কোথায় কোথায় চলে যান, কত অন্য রাগ ধুনে তানে গিয়ে মিশে যেয়ে আবার কিরকম ভাবে মাঝে মাঝে ফিরে আসেন সেই পঞ্চম সে গারায়! সেই রমণীই কি রবি শঙ্করের নিউ ইয়র্কে প্রেমিকা স্যু জোনস, যার কথা রবি বলেছেন গলায় বিশেষ টান নিয়ে ( রবি শঙ্কর এবং স্যু জোনসের কন্য নোরা জোনস বিশ্বখ্যাত গায়িকা)।

এত জগত জোড়া খ্যাতির মাঝে বাঙালি মানুষটি অন্য রকমের ডাক শুনতে পান হৃদয়ের মাঝে, নিজের ভাষাতেই বলেন- করছি কি আমি! আর কতদিন এসব! কি-ই বা দিলাম, কি-ই বা পেলাম! একেবারে বিরক্ত বিস্বাদ! কিছুই ভাল লাগে না! সেই গতানুগতিক প্লেনে চড়ে আজ এখানে, কাল ওখানে। হোটেলে থাকা একঘেয়ে খাওয়া, punctually হলে যাওয়া, বাজনা বাজানো, তারপর হোটেলে ফিরে আসা নিশাচরের মতন মাঝরাত্রে। ভাল লাগে না আর!

অবসাদ থেকে খানিকটা মুক্তি পেতে, জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি অর্জনের জন্যই হত রবি শঙ্কর হাত পাতেন স্বামী বিবেকানন্দের বাণীর কাছে, টাট বাবার শিষ্য হন এবং সত্য সাইবাবারও!

রাগ-অনুরাগ এখানেই শেষ, কিন্তু সেটি প্রায় ৪০ বছর আগের ঘটনা। এর মাঝে অনেক কিছু ঘটেছে, রবি শঙ্কর আমাদের দিয়েছেন নব নব সৃষ্টি। ব্রিটিশরাজ তাকে বিশেষ ধরনের নাইটহূড উপাধি দিয়েছিল, যার ফলে তিনি নামের আগে স্যার ব্যবহার করতে পারবেন না ( আগের যুগে রাজার ঘোড়ার লাদি পরিষ্কার করেও অনেকে স্যার উপাধি পেয়েছে, একজন রবিশঙ্করের স্যার উপাধি লাগে না হে মূর্খ ব্রিটিশরাজ), নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার সৃষ্টি আছে, থাকবে যতদিন বিশ্বে মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলো টিকে থাকবে ততদিন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুটি যে নিউইয়র্কে কনসার্ট ফর বাংলাদেশে আয়োজনে কি বিশাল ভূমিকা রেখেছিলেন তা আমাদের সকলেরই জানা।

হে সুরের প্রকৃত সাধক বাঙ্গালী রবি শঙ্কর ( রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী), আপনার দিকে চেয়ে আমাদের বিস্ময়ের শেষ নাই। আপনি অমর আমাদের হৃদয়ে।


Comments

লুৎফর রহমান রিটন's picture

গুডবাই রবি শঙ্কর, পৃথিবীশ্রেষ্ঠ সেতারঈশ্বর

এক লহমায় চকিতে রবি শঙ্করকে দেখার জন্যে লেখাটা ভালো।

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

তারেক অণু's picture
পরী's picture

লেখা -গুড়- হয়েছে
অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় একজনকে নিয়ে লেখার জন্য। তবে আরও অনেক অজানা কথা জানতে চাই তার সম্পর্কে। চলুক

তারেক অণু's picture

খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে, দেখি যদি বড় করে একটা পোস্ট দিতে পারি-

নূপুরকান্তি 's picture

এ লেখাটার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ তারেক অণু।
একজন পরিণত শিল্পী, যাঁর জীবনে রয়েছে অগুণতি অর্জন, চলে গেলেন পরিণত বয়সেই -- ৯২ টি বছর তো কম নয়! তবু, তাঁর মৃত্যু সংবাদ আমাকে কিচুক্ষণের জন্যে স্তব্ধ করে দিয়েছিলো গতকাল।রবিশংকর আরো বেশ কিছুদিন আমাদের মাঝে থাকবেন - স্থির বিশ্বাস ছিলো।

'রাগ-অনুরাগ' বইটিও ক'দিন আগেই হাতে এসেছে, মুগ্ধ হয়ে তাই পড়ছিলাম। গেলো ক'দিন অনবরত শুনে যাচ্ছিলাম ১৯৭১ এর Concert for Bangladesh - এ আলী আকবর খাঁ আর আল্লা রাখার সংগে বাদিত অসামান্য 'বাংলা ধুন'।

রবি শংকরকে অশেষ শ্রদ্ধা।

পুনশ্চ: রবিশংকরের আরো দু'খানা আত্মজীবনী রয়েছে ইংরেজীতে: ১।Raga Mala ২। My music, my life। দু'টি বই-ই অত্যন্ত সুখপাঠ্য, প্রচুর তথ্য ও দুর্লভ ছবি সম্বলিত।

তারেক অণু's picture

ধন্যবাদ।

দেখলাম উনি আরও একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন, সেটাই সম্ভবত শেষ।

নূপুরকান্তি 's picture

সেই আরেকটি আত্মজীবনীর নাম (প্রকাশক সহ) জানাবেন কি অনুগ্রহ করে?

তারেক অণু's picture

Learning Indian Music: A Systematic Approach. এই বইটির কথা বলেছিলাম, কিন্তু মনে হচ্ছে সেটি জীবনী নয়, নিচে দিগন্তের মন্তব্যে একাধিক বইয়ের নাম আছে প্রকাশকসহ।

যুমার's picture

সুর অবিনশ্বর।রবি শঙ্করকে অমেয় শ্রদ্ধা।

তারেক অণু's picture
তাপস শর্মা's picture
তারেক অণু's picture
নির্ঝর অলয় 's picture

অণুদা খুব গোছানো ভাষায় এই মাস্টারপিসটার কথা মনে করিয়ে দিলেন, সেই সাথে কলেজ জীবনের নস্ট্যালজিয়া। শঙ্করলাল ভট্টাচার্য্যের লেখা অনেক জায়গায়ই বাঙালির অতিআবেগজনিত অতিশয়োক্তিতে ভরা হলেও এই বইটা রবিশঙ্করের বর্ণনার প্রসাদেই উৎরে গেছে। বিলায়েতের আত্মজীবনীটা অবশ্য আমার আরো ভালো লেগেছে, উপাদেয় সব খাবার-দাবারের বিবরণের কারণে। এও মনে পড়ছে আমার সঙ্গীতপ্রিয় বন্ধু রাজীব ৫০০০ টাকার সঙ্গীতবিষয়ক বই আজিজ থেকে কিনিয়ে ছোট ভাইকে দিয়ে দশ হাজার টাকায় ফেডেক্স করিয়েছিল!

আপনি যে একজন সঙ্গীতপ্রেমীও তা জেনে বড়ই পুলকিত হলাম। আজকালকার যুগে সঙ্গীতপ্রেমী খুব বেশি পাওয়া যায় না, মার্গসঙ্গীত তো একেবারেই ব্রাত্য। আমার কিছু বন্ধু কিছুদিন আগে রশীদ খান ও অরুণ ভাদুড়ীকে যা তা বলে ভেবেছিল আমি বোধহয় রেগে যাবো এবং আর কোনদিন আড্ডায় যাবো না, আমি বললাম তা কি করে হয়। কেউ যদি নিজেকে উলঙ্গ দেখিয়ে আনন্দ পায় তো তাতে আমার কি সমস্যা? তাছাড়া রশীদ খান তো আমার বড় ভাই নন আর অরুণবাবুও আমার দাদু নন!

অথচ এমন কিন্তু ছিল না! মার্গসঙ্গীত কিন্তু এককালে পপ সং অর্থাৎ জনপ্রিয় গানই ছিল। অনেকেই মার্গসঙ্গীতকে শুধু গুটিকয় চাটুকারের দরবারী সঙ্গীত বলে ভাবেন যার পেছনে দায়ী ভুল প্রচার। অনেকে প্রচার করল যে সঙ্গীত ছিল দু রকম। যথাঃ গান্ধর্ব ও দেশি, প্রথমটা দেবতা ও কিন্নরদের তৈরি এবং উচ্চস্তরের পন্ডিতদের জন্য দ্বিতীয়টা মানুষের জন্য। কিন্তু দেখা যায় এই শ্রেণীবিভাগ আসলে ভুল। বস্তুত গান্ধর্বগীতি আসলে কী ছিল তা আমাদের পক্ষে আর জানা সম্ভব হয়নি, হয়তো হবেও না। এই 'দেশি' সঙ্গীতই প্রথমে মন্দিরে ও পরে দরবারে গীত হোত। এই দেশি সঙ্গীতই রাগসঙ্গীত এবং এসবেরই জননী লোকগীতি। কাজেই দেশি সঙ্গীত বা রাগসঙ্গীত জনপ্রিয়তায় লোকসঙ্গীতের ঠিক পরে পরেই ছিল। কিন্তু উত্তরভারতে দরবারে ঢুকেই এই সঙ্গীত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। দক্ষিণ ভারতে কিন্তু এখনো মার্গসংগীত অত্যন্ত জনপ্রিয়। আমাদের ঠাকুরদার আমলেও মুচি মালকোষে আস্থায়ী গাইত, বাপের আমলে রিকশাওয়ালা গজল গাইত, লোকগীতি গাইত। পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে সকল বাঙালি এবং উচ্চাঙ্গের শিল্পগুলো কীভাবে ধ্বংসের দোরগোড়ায় গেছে, তা ওয়াহিদুল হক সাহেবের লেখায় আমরা তরুণেরা পড়েছি। তবে ইদানীং এই দুরবস্থা কাটানোর চেষ্টা চলছে। যদিও মার্গসঙ্গীতের প্রচারে আমাদের ভুমিকা যথেষ্ট নয়। রিপোর্টিং তো অতি নিম্নমানের। মাছারাঙার খবরে তো আলী আকবর খাঁ সাহেবকে "আকবর আলী খান" বানিয়ে দিল! রিপোর্টিং এও মীড়খণ্ড- ঘোর কলি!

আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ লেখাটার জন্য। কারণ সঙ্গীত বিষয়ে আপাতত আর লিখতে চাই না। লিখব যে, তার যোগ্যতা কি আমার? আজকাল কোন বিষয়ে আলোচনা করতে গেলেই একদল মোড়ল দাঁড়িয়ে বলে এ বিষয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা কী? বিসিএস পদ্ধতির সংস্কারের কথা বললে বলে "পরীক্ষাটা কি পাস করা হয়েছে?"উত্তর হ্যাঁ হলে বলে-" তাহলে বুঝতে পারছি কীভাবে ম্যানেজ করেছেন"(প্রশ্ন পাবার ইঙ্গিত!)। তাই জীবনানন্দের ভাষায় বলি " আমাদের চেয়ে হালু ভালু বেশি জানে বলে
এখন বেবুন চালাবে মাইক্রোফোন। "-উদ্ধৃতিটা ভুল হলে মাফ করে দেবেন।

নির্ঝর অলয়

তারেক অণু's picture

অসাধারণ ফিডব্যাকের জন্য ধন্যবাদ, সেই সাথে লজ্জিত বোধ করছি আপনার অপাত্রে বর্ষণ করা প্রশংসার জন্য, সঙ্গীত সম্বন্ধে, রাগ তাল লয় সম্পর্কে আমার কোন ধারনাই নেই, কেবল যেটা শুনলে ভাল লাগে, ভিতরটা নেচে ওঠে তেমনটাই বারবার শুনি মনের আনন্দে। ফিনকি দেয়া জ্যোৎস্না উঠলে আমজাদ আলীর সরোদ শুনতে ইচ্ছে করে, ঝিরঝিরিয়ে হাওয়া বইলে রবির সেটার শুনতে ভাল লাগে, চৌরাসিয়ার বাঁশি শুনি নিস্তব্ধ রাতে- কেবল ভাল লাগে বলেই শুনি, এর বাহিরে জানা নেই কিছুই।

অতিথি লেখক's picture

অত বুঝে কাজ নেই। ভেতরটা নেচে উঠলেই হোল। সেটাই আসল সমঝদারী। কিছুক্ষণ আগে ডেরায় গিয়ে এক বাণিজ্যিক গান শুনলাম- "আজি ঝরোঝরো মুখর বাদর দিনে।" গায়িকা নাকি তানিয়া, গানটা ঢাকাই ছবির গানকেও হার মানায়! গানটা হুমায়ুন আহমেদের কোন এক ছবিতে ব্যবহার হয়েছে। "কিছুতে কেন যে মন লাগেনা, লাগেনা- ' এভাবে গাওয়া! কাজেই এদেশে সঙ্গীত আলোচনা করে কালক্ষেপন না করাই শ্রেয়! অথচ এই গানটি অতীতে কত কাব্যিক ভাবে সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই বলছি এযুগে আমজাদ আলী, রবিশঙ্কর আর চৌরাসিয়া শুনে নেচে ওঠার মত শ্রোতা দুর্লভ, আজকাল তো চলে কেবল খেমটা নাচ!
নির্ঝর অলয়

তারেক অণু's picture
নূপুরকান্তি 's picture

প্রিয় নির্ঝর অলয়,
রাগসংগীত বিষয়ক আপনার আলোচনাগুলো খুবই উপভোগ‌্য হয়, মোড়লদের কথা, আচরণে দমে যাবেননা।
এ সুযোগে একটি ব্যক্তিগত অভিমত: আমার কিন্তু 'কোমল গান্ধার' এর থেকে 'রাগ অনুরাগ' ই বেশি ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক's picture

বাজনায় যাই হোক অন্তত খাবার দাবারে বিলায়েত খাঁই এগিয়ে। সিরাজীর বিরিয়ানি আর চাঁপ- উলস! ওই কারণেই কোমল গান্ধার বেশি ভালো লেগেছে! হাসি

দমে আমি ইতোমধ্যে গেছি। আমার মনে হচ্ছে এই সমাজে তরুণদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। বুড়োরা লোক দেখানো পিঠ-চাপড়ানি দেয় বটে, আদতে তরুণদের কেউ সহ্য করতে পারেনা। অবশ্য এই ধরনের বুড়োর দলে অনেক অল্পবয়স্ক লোকও পড়েন! তাই আপাতত কয়েকবছর কিছু তথাকথিত যোগ্যতা অর্জন করে নিই। জীবনে অনেক অর্থহীন পরীক্ষাই দিতে হয়েছে মূর্খদের চোখে যোগ্যতা প্রমাণের জন্য।

আমাকে তো কেউ গাইয়ে বা বাজিয়ে বলে চেনে না, তাহলে মিউজিক হোল না বলে মিউজিকোলজিস্ট- এই খেতাব আমি পেতে চাই না। যদিও জানি যে শ্রোতা তৈরি না হলে একসময় বড়ে গুলাম আলী খান সাহেবের মত অতিমানবীয় কণ্ঠও কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। তাতে সুরের জগতের সমূহ ক্ষতি, কারণ শিল্পের রাজ্যে সুন্দরকে কখনো কখনো ধরা যায়, সবসময় নয়।

নির্ঝর অলয়

তারেক অণু's picture
সাজ্জাদুর's picture

রবিশংকর ১৯৯৮ এ সুইডেন থেকে পোলার মিউজিক পুরস্কার পেয়েছিলেন। পোলার মিউজিক পুরস্কারকে ধরা হয় মিউজিকের নোবেল পুরস্কার হিসাবে।

তারেক অণু's picture
প্রৌঢ় ভাবনা's picture

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের খবরকে বিশ্ব-দরবারে জানান দেবার প্রচেষ্টায় জর্জ হ্যারিসনকে অনুরোধ করে এবং নিজের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন।

তাঁকে নিয়ে আপনার এই লেখাটি সময়োপযোগী ও সার্থক হয়েছে। চলুক

তারেক অণু's picture

সত্যই তিনি একজন প্রকৃত বন্ধু ছিলেন।

দিগন্তু চৌধুরী's picture

অণু ভাই, শঙ্করলাল ভট্টাচার্যেরই শ্রুতিলিখনে "স্মৃতি : রবিশঙ্কর" ও "অন্য রবিশঙ্কর" সম্প্রতি কলকাতার প্রতিভাস প্রকাশনা থেকে বের হয়েছে। দুটোই ধারণা করি রাগ-অনুরাগের বাইপ্রোডাক্ট। তবে এই দুটোর থেকে ভালো বই অনেকে বলছেন অতনু চক্রবর্তীর "মুখোমুখি রবিশঙ্কর"-কে। ওটাও প্রতিভাসের বই।

তারেক অণু's picture

অনেক ধন্যবাদ

জোহরা ফেরদৌসী's picture

লেখাটা খুব ভাল লেগেছে অণু ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

তারেক অণু's picture
অতিথি লেখক's picture

#দারুন লেগেছে প্রিয় তারেক অণু ভাই, সেতারের ধ্বণি থেমে গেছে-সুর রয়ে যাবে চিরকাল হাসি

#পন্ডিত রবিশংকরের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা, ভাল থাকুন।

আশরাফুল কবীর

তারেক অণু's picture

সেতারের ধ্বণি থেমে গেছে-সুর রয়ে যাবে চিরকাল

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি's picture

চলুক

ঈপ্সিত আর চম্পাকলি
---------------------------------
বোলতা কহিল, এ যে ক্ষুদ্র মউচাক,
এরি তরে মধুকর এত করে জাঁক!
মধুকর কহে তারে, তুমি এসো ভাই,
আরো ক্ষুদ্র মউচাক রচো দেখে যাই।
--------------------------------------------

তারেক অণু's picture
অমি_বন্যা's picture

লেখাটা বেশ ভালো লেগেছে অনু দা।
পণ্ডিত রবি শঙ্করের প্রতি শ্রদ্ধা।

তারেক অণু's picture

৯২ বছর অনেক লম্বা সময়, তারপরও খারাপ লাগছে

রংতুলি's picture

লেখা ভালো লাগলো! চির শ্রদ্ধা মানুষটার প্রতি!

তারেক অণু's picture
অবনীল's picture

কালজয়ী শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা । লেখাটা ভালো লাগলো অণু।
শ্রদ্ধা

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

তারেক অণু's picture
কুমার's picture

চলুক

তারেক অণু's picture
স্যাম's picture

আমার আগের মন্তব্য হারালো কোথায়? নাকি অন্য পোস্টে দিয়েছিলাম ?! যাই হোক অণুদা আরেকটা পড়ার মত জানার মত লেখা - চলুক অণুদার লেখালেখি আরো জোরেশোরে।

পন্ডিত রবিশংকর কে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান এর জন্য সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি - শিল্পীর জন্য ভালবাসা।

তারেক অণু's picture

মন্তব্য কি ব্যানার হইয়ে গেল! অ্যাঁ

অতিথি লেখক's picture

আপনার লেখা প্রায়ই পড়ি। খুব ভালো লেগেছে।

মগ্ন পথিক

তারেক অণু's picture

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক's picture

দারুণ হয়েছে অণু দা। মানুষটার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। অনেক কিছুই জানলাম ।

পাপলু বাঙ্গালী

তারেক অণু's picture
কড়িকাঠুরে's picture

যেখানেই থাকুন- ভাল থাকুন... শুভ কামনা পৌছে যায়...

তারেক অণু's picture
নিলয় নন্দী's picture

বইটার প্রচ্ছদযুক্ত পোস্ট হলে আরো খুশি হতাম। হাসি
দারুণ লেখা। চলুক

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

তারেক অণু's picture

চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ছবিতে ওয়েবপেজের জলছাপ দেওয়া থাকায় পছন্দ হয় নি

সাফিনাজ আরজু's picture

আগেই পড়েছিলাম, মন্তব্য করা হয়নি।
শ্রদ্ধা কালজয়ী শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা রইল।
বরাবরের মতই খুব চমৎকার লেখা। ভালো লাগল অনুদা। চলুক
উনাকে নিয়ে আরও পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

তারেক অণু's picture

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.