"টুকটুকির মা, টুকটুকি এবং আমি"

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Thu, 06/12/2012 - 12:08am
Categories:

টুকটুকি আমার তুলতুলে ছোট্ট পুতুল মেয়ে। নরম তুলতুলে মোমের মতো শরীর। শিউলি ফুলের বোঁটার মতো লাল ঠোঁট। সারাক্ষণ খিলখিল করে হাসে আর হাসে। ও যখন হাসে আমার মনে হয় সারা পৃথিবীটাই হাসে।বয়স কত হবে? এই এক বছর চার -পাঁচ মাস। নিচের মাড়িতে দু’টা দাঁত উঠেছে। ওর দাঁত উঠতে যেন একটু বেশিই সময় লেগেছে। একটু একটু করে হাঁটার চেষ্টা করে । এক কদম দেয় আবার কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় । ঠিক কাকে ধরবে কিংবা কোন জিনিসটাকে আঁকড়ে ধরে সামনের দিকে যাবে যেন সেটাই ভাবে।

মাঝে মাঝে আমাকে ডাকবে বা-ব্-বা। বা-ব্-বা । ওর মাকে ডাকে না বলে ওর মায়ের সেকি রাগ ! আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,তোমার মেয়েকে তুমিই রাখো ।এমন পাজি মেয়ে তো আর দেখিনি। সারাক্ষণ থাকে আমার কাছে ,সব যত্ন আত্তি করি আমি আর সে কি না ডাকবে বা-ব্-বা, বা-ব্-বা। এত কষ্ট করে বাবা ডাকার দরকারটা কি তোর ? মাকে ডাকলেই পারিস।
আমার ছোট্ট পুতুল তার মায়ের কপট রাগ বুঝতে পারে কিনা জানি না,তবে সে তার মায়ের কথা শুনে আরও বেশি করে বা-ব্-বা ডাকে । রাগলে টুকটুকির মাকে অন্য সময়ের চেয়ে আরো বেশি সুন্দর লাগে । তাই সুযোগ পেলেই টুকটুকির মাকে রাগিয়ে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা থেকেই যায় । কিন্তু আমার অতটুকুন মেয়ে এই তথ্য জানলো কেমন করে ? টুকটুকির নাম রাখা নিয়েও আমার সাথে টুকটুকির মায়ের সে কি অভিমান ! আমি বলেছি মেয়ের নাম রাখব টুকটুকি।
সে বলেছে ,না।
আমি বললাম ,কেন না?
কারণ সবাই পরে দষ্টুমি করে আমার মেয়েকে টিকটিকি ডাকবে।
ডাকুক। যার যা খুশি ডাকুক। ডাকলেই কি আমার টুকটুকি টিকটিকি হয়ে যাবে ? যাবে না। আমার টুকটুকি ,টুকটুকিই থাকবে।
তাহলে তুমি কখনো আমাকে টুকটুকির মা ডাকবে না।
কি ডাকব?
আমার নামে ডাকবে।

টুকটুকির মাকে রাগিয়ে দেয়ার আরেকটা বিশাল এবং দীর্ঘমেয়াদী সুযোগ পেয়ে আমি যারপরনাই প্রীত হলাম। অবশ্য মাঝে মাঝে টুকটুকির মাকে আমি টুকুর মাও ডাকি ।

টুকটুকি হচ্ছে আমাদের টোনাটুনির সংসারে ছোট্ট টুনটুনি পাখি। সে পাখির কিচির মিচির এ আমাদের ঘর সদা মুখরিত,উচ্ছ্বাসিত এবং আলোকিত ।
আমার ছোট্ট মা,আমার টুকটুকি। আহ্ নিজের সন্তান ভাবতেই সুখ লাগে।
আমার টুকটুকি নেই।

না, সে ছিল, এখন নেই ব্যাপারটি তা নয়। সে এখনো আসেনি। কখনো আসবে কিনা আমি জানি না। কারণ টুকটুকির মায়ের সাথে এখনো আমার কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। সম্পর্ক তৈরি হয়নি কথাটা অবশ্য পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ টুকটুকির মা আমার বন্ধু। খুব ভালো বন্ধু। তবে সে ভালো বন্ধুকে যে আমি নিজের মনে মনে কন্যার মায়ের স্থান দিয়ে রেখেছি সে কথা সে জানে না। কখনো তাকে জানানোও হবে না। কারণ জানানোর মতো সাহস আমার নেই।

তবুও মনে মনে তাকে আমি টুকুর মা হিসেবেই জানি। বলে রাখা ভালো টুকুর মা মানুষ হিসেবে অসাধারণ মানুষ,বন্ধু হিসেবে অসাধারণ বন্ধু। কিন্তু নারী হিসেবে অসাধারণ কিনা তা আমি জানি না। কেননা নারী পুরুষের উর্ধ্বে আমরা পরস্পরকে মানুষ হিসেবেই জানি। তবুও কখনো কখনো তাকে শুধু নারী ভাবতেই আমার বেশি ভালো লাগে। আমার টুকটুকির মা। আমাদের ছোট্ট সংসার। টুকটুকির মা, টুকটুকি এবং আমি । আমার সকল ভাবনা,সকল সাধনা,সকল ভালোবাসা তাকেই ঘিরে । আমার সকল স্বপ্নে সে থাকে রানী হয়ে।

কি আশ্চর্য মানুষের নিয়তি! যে আমি কিনা কখনো কোনো বন্ধু ভালোবাসা জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়েছে শুনলেই বলতাম,গিয়েছিস দোস্ত ,একেবারেই শেষ হয়ে গিয়েছিস। এমন অতলে চলে যাবি যে আমরা ইচ্ছে করলেও তোকে আর টেনে তুলতে পারব না।হাঃ হাঃ হাঃ।

প্রেম-ভালোবাসা বিদ্বেষী ছিলাম না।তবে কখনো প্রেম-ভালোবাসার প্রতি আগ্রহও হয়নি। আজাইরা প্যাঁচালের মধ্যে একটি টপিক ছিল প্রেম-ভালোবাসা ক্যাঁচাল। কিন্তু সেই আমি কিনা !!

যেদিন প্রথম টুকুর মাকে দেখলাম আমার সমস্ত শরীরে এক অন্যরকম অনুভূতি টের পেলাম। মন তো শরীরেরই অংশ। এমন আশ্চর্য অনুভূতি এর আগে কখনোই উপলদ্ধি করিনি। নিজের কাছেই নিজেকে বড় অচেনা মনে হয়েছিল।

আমি কখনো তাকে বলিনি যে তার জন্য আমার অন্যরকম অনুভূতি হয়,তাকে একটু দেখার জন্য কতটা ব্যাকুল থাকি আমি,তার একটু কথা শোনার জন্য কতটা উদগ্রীব থাকে আমার মন,তার না থাকা অবস্থায় মন জুড়ে নামে অদ্ভুত হাহাকার। না,কিছুই বলা হয়নি তাকে। পাছে বন্ধুত্বটুকু নষ্ট হয়।

মনে বিশ্বাস ছিল একটা সময় টুকটুকির মা হয়তো নিজেই বুঝতে পারবে। সে আমার বন্ধু এটাই আমার জন্য বিশাল প্রাপ্তি। বন্ধু হিসেবে টুকটুকির মায়ের তুলনা সে নিজেই। কারণ তার সাথে কারো তুলনা আসেই না। এমন নিখাঁদ বন্ধু আমি খুব কমই দেখেছি। টুকটুকির মাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে একদিন স্বপ্নের নতুন রূপ আবিষ্কার করলাম। আমাদের টুকটুকি। ছোট্ট একটা পুতুল সারা ঘরময় ছোটাছুটি,হুটোহুটি করে বেড়াচ্ছে। জীবনের রং পাল্টে যেতে শুরু করল। নিজের মনেই সুখের ছড়াছড়ি।
সেই সুখ অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

একদিন জানলাম টুকুর মা অন্য একজনকে ভালোবাসে। শোনার সাথে সাথে নিমিষেই আমার সকল আনন্দ স্তব্ধ হয়ে গেছে। অস্বীকার করব না খুবই কষ্ট হয়েছে আমার। কষ্টের কোনো রঙ নেই। আমি অতি সাধারণ মানুষ। কষ্ট পাওয়াটা আমার জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তারপরই মনে হলো ভালোবাসা মানে তো এক ছাদের নিচে বসবাস নয়। ভালোবাসা মানে নিজের অধিকারে সম্পত্তির মতো থাকা নয়। কষ্টকে সামলে নিলাম। আমি টুকুর মাকে ভালোবাসি,সে অন্য আরেকজনকে ভালোবাসে। তাতে কি ? আমি তাকে ভালোবাসি আমার কাছে এটাই সত্যি। আর টুকুর মাকে ভালোবাসি বলেই তার ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে এতটুকু দ্বিধা হয়নি আমার। আমি টুকটুকির মায়ের বন্ধু হয়েই থাকব সারা জীবন।

কিন্তু গতকাল থেকে আমার জীবনে নতুন এক সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না আমি কি করব কিংবা আমার কি করা উচিৎ।
আজ সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। গত তিন চারদিন থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। তবে আজকে অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি এবং কোনো থামাথামি নাই। শরৎকালে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। বড্ড বিরক্তিকর। মেজাজটা এমনিতেই খিটমিটে হয়ে আছে। তারওপর এই অসময়ে বৃষ্টি।
গতকালের ব্যাপারটা আমার জন্য একরকম জয়ই বলা যায়। তবুও কেন যে এমন অস্থিরতা আর সিদ্ধান্তহীনতা ! আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। কিন্তু আমি এভাবে বিজয়ী হতে চাইনি।

গতকালই আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম টুকুর মাও আমাকে ভালোবাসে। হয়তো আমার চেয়েও বেশিই ভালোবাসে। এ খবরটাতে আমার খুশি হওয়ার কথা । কিন্তু আমি খুশি হতে পারছি না। সংকোচ হচ্ছে মনে। যে অনাকাঙ্খিত কারণে টুকুর মা আমার কাছে আসতে চাইছে সে ঘোর যদি তার কেটে যায় ! এবং তখন যদি এখনকার সিদ্ধান্ততটাকেই ভুল মনে হয় ! এতদিন পর টুকুর মা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি কিভাবে তাকে ফিরিয়ে দেব? তাকে ফিরিয়ে দেয়ার মতো অসম্ভব কাজ আমার কাছে আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু তাকে গ্রহণ করতেও সাহস হচ্ছে না।

সম্ভব-অসম্ভবের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি আমি.......।

মোহছেনা ঝর্ণা


Comments

পুতুল's picture

গল্পটা পুরানো হলেও আপনার উপস্থাপনা বেশ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। কিছু ক্লিশে বাক্য থাকলেও মধ্যবিত্তের গল্প হিসাবে চলে। শুরুটা পড়েই গল্পের সমাপ্তি "আমি" অনুমান করতে পারিনি।

শুরু দেখে নিজেকে নিয়ে, নিজের মেয়ের ঐ সময়টার (এক-দেড় বছর বয়স) স্মৃতিতে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ের নাম নিয়ে মেয়ের মায়ের সাথে কলহে আমি জিতিনি। মেয়েদের সাথে ঝগড়ায় পারা যায়না। এখন মেয়ের সাথেও পারি না। সচলায়তনে স্বাগতম। লিখতে থাকুন হাত খুলে।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

ধন্যবাদ পুতুল গল্পটা পড়ার জন্য।
নিজের মেয়ের সাথে ঝগড়ায় না পারার মধ্যেই অন্যরকম আনন্দ আছে।
"আর মেয়েদের সাথে পারা যায় না" এটার জবাব হলো মেয়েরা যৌক্তিক অবস্থানে বরাবরই অটল থাকে।
ভালো থাকবেন ।

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

ধন্যবাদ পুতুল গল্প পড়ার জন্য।
নিজের মেয়ের সাথে ঝগড়ায় না পারার মধ্যেই অন্যরকম আনন্দ আছে।
মেয়েদের সাথে ঝগড়ায় পারা যায় না -কারণ মেয়েরা যৌক্তিক অবস্থানে বরাবরই অটল থাকে।
ভালো থাকবেন।

ত্রিমাত্রিক কবি's picture

গল্প মোটামুটি লেগেছে। আসলে প্রেম ভালবাসার গল্প তো ক্লিশে হয়ে গেছে, সেই একই কথা, একই অনুভব, তবে সেটাকেও হয়ত অন্যভাবে দেখা যায়, নতুন ভাবে বলা যায়। আরও লিখুন হাসি

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

লাবণ্যপ্রভা's picture

সেজন্যতো বলি ফেরা গল্পটা শেষ করুন

ত্রিমাত্রিক কবি's picture

কীসের মধ্যে কী,ান্তাভাতে ঘি! শয়তানী হাসি

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

ধন্যবাদ কবি ভাই।
ঠিকই বলেছেন।সেই একই কথা,একই অনুভব, তবে সেটাকেও হয়তো অন্যভাবে দেখা যায়,নতুন ভাবে বলা যায়।
ধন্যবাদ এত সুন্দর করে বলার জন্য।

সুলতানা পারভীন শিমুল's picture

ভালো লাগলো।
কেন যেন মজাও লাগলো।
গল্পটার শিরোনাম দেখার পর থেকেই "টুকটুকির মা, ও টুকটুকির মা!" বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে। দেঁতো হাসি
প্রেমের জন্য বন্ধুত্ব নষ্ট হলে সেটা সত্যিই যন্ত্রণার।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

ধন্যবাদ শিমুল।

সাফিনাজ আরজু 's picture

টুকটুকির মা, টুকটুকি, আর টুকটুকির বাপরে ভালা পাইলাম। হাসি

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

টুকটুকির মা,বাবা এবং টুকটুকি ও আপনাকে ভালা পাইছে সাফিনাজ আরজু।
ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক's picture

আপনার ভাবনাগুলো চমৎকার।
ভাল থাকবেন।

শুভকামনা রইল।
তুহিন সরকার

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
ভালো থাকবেন।

নীরা's picture

শুরুটা ভালো ছিলো। সেষটা ভালো লাগলোনা...

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

ধন্যবাদ নীরা গল্পটা পড়ে মতামত জানানোর জন্য।
এরপর যেন শুরুর সাথে শেষটাও ভালো লাগে সে চেষ্টা থাকবে। হাসি

রাজীব মাহমুদ's picture

আপনার লেখায় বেশ তরতরিয়ে পড়ে ফেলা যায়। তবে টুকটুকির মায়ের জীবনের আগের ভালোবাসার কি হল সেটা জানা হলনা।

মোহছেনা ঝর্ণা's picture

তরতরিয়ে পড়া যায় এটা ভাল না খারাপ বুঝতে পারছি না ভাইজান। চিন্তিত
ধন্যবাদ পড়ে মতামত জানানোর জন্য।
টুকটুকির মায়ের জীবনের আগের ভালোবাসা তো অন্য গল্প।পরে আরেক সময় ঠিক জানিয়ে দিব। চোখ টিপি
ভালো থাকবেন।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.