মানিব্যাগ,আমার মানিব্যাগ

ইমরুল কায়েস's picture
Submitted by imrulkayes on Sun, 06/04/2008 - 2:21am
Categories:

একটি মানিব্যাগের স্বপ্ন আমার ছোটবেলা থেকেই।বাবা-চাচাকে মানিব্যাগ পকেটে করে সগর্বে হাটতে দেখে আমারও একটি মানিব্যাগের গর্বিত মালিক হওয়ার ইচ্ছে জাগে।চাচাকে দেখতাম মানিব্যাগের মধ্যে দুনিয়ার যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে ঘুরতেন।জানতে চাইলে বলতেন বড় হ বুঝবি।হ্যাঁ ,বড় হওয়ার আগে যে মানিব্যাগ কেনার টাকা পাওয়া যাবে না তা আমি জানতাম।তাই প্রথমদিকে মানিব্যাগ দেখেই দর্শনতৃপ্তি লাভ করতে হত,কিন্তু আত্বতৃপ্তি পেতাম না।বাসায় আত্বীয়স্বজন বেড়াতে আসলে আমি প্রাথমিক আলোচনার পরেই তাদের মানিব্যাগ দেখতে চাইতাম।তাদের অধিকাংশই বিরক্ত হত,মুখে বলত না কিছু কিন্তু বাসায় ঝাড়িটা খেতাম ঠিকই।

ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রবলভাবে মানিব্যাগপ্রাপ্তির আশা চেপে বসল আমার মনে। পণ করলাম যে করেই হোক এ জিনিস আমাকে একটা অধিকার করতেই হবে।কিন্তু চাইলেই তো সব হয়না তার জন্য দরকার উপযুক্ত কার্যকরন।চেষ্টার কমতি ছিল না আমার।একটি মানিব্যাগের জন্য আমি নানানভাবে টাকাপয়সা নয়-ছয় করতে শুরু লাগলাম।আম্মা অফিস থেকে ফিরলেই অপেক্ষা করতাম কখন রান্নাঘরে যাবেন আর আমি আলগোছে আলমারীতে রাখা ওনার অফিসব্যাগ থেকে এক-দুইটা একটাকার পয়সা সরিয়ে ফেলব।টাকাপয়সা আরো থাকত কিন্তু ধরা পড়ার ভয়ে হাত বাড়াতাম না। আব্বার জন্য অপেক্ষা করতাম দুপুরে,কখন দুপুরের ভাত খেয়ে আব্বা ঘুমাবেন আর আমি হ্যাংগারে রাখা শার্ট থেকে দু-একটা টাকা সরাব।এভাবে নানান কাটখড় পুড়িয়ে চল্লিশ টাকার বিনিময়ে এক হাটের দিনে মফস্বলের বাজার থেকে একটি মানিব্যাগ কিনলাম,গর্বিত মালিক হলাম একটি মানিব্যাগের।ছোট চাচার মত অজস্র কাগজ ভরিয়ে পেট মোটা করে ফেললাম মানিব্যাগের।স্কুলে গিয়ে পকেটে মানিব্যাগ নিয়ে বুক ফুলিয়ে হাটি,কারনে-অকারনে অন্যদের সামনে বের করে উল্টেপাল্টে দেখি।বন্ধুদের বলি দেখ,মানিব্যাগ দেখ,আমার,তোর আছে এরকম।বন্ধুরা ঈর্ষায় জ্বলে,ওরাও মানিব্যাগের স্বপ্ন দেখা শুরু করে।

কিন্তু সুখের দিন আমার বেশিদিন স্থায়ী হয়না।এক ছুটির দিনে দুপুরে কাপড় কাচতে গিয়ে আম্মা দেখে ফেলেন আমার গোপন সম্পত্তি।কখন,কোথায়,কিভাবে পেয়েছি তা নিয়ে জেরা চলতে থাকে।বলাতো যায়না যে চুরি করা টাকা দিয়ে মানিব্যাগ কিনেছি তাই নানান সময়ে নানান কথা বলতে হয়।ধোপে টেকেনা আমার যুক্তি।সীজ হয়ে যায় আমার সাধের মানিব্যাগ।কিন্তু তবুও আমার একটি মানিব্যাগের স্বপ্ন শেষ হয়না।
বৈধভাবে আমার প্রথম মানিব্যাগ কেনা হয় এস,এস,সি পাশ করে মফস্বল থেকে জেলা শহরে কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়।এবার আর কাউকে বলতে হয়না,বাসা থেকেই টাকা দিয়ে দেয় মানিব্যাগ কেনার জন্য।পয়ষট্রি টাকা দিয়ে কালো রঙের মানিব্যাগ কিনি একটি।ছোটখাট একটা ভল্ট হিসেবে ব্যবহার শুরু করি একে।বাসা থেকে পাঠানো আম্মার চিঠি,সময়ে অসময়ে লেখা ছড়া-কবিতা,নানান ধরনের দলিল-দস্তাবেজ ভরে ফেলি এতে।ধীরে ধীরে আমার ব্যক্তিগত এনসাইক্লোপেডিয়া হয়ে ওঠে
মানিব্যাগটি।আমার অস্তিস্তের সাথে মিশে যেতে থাকে মানিব্যাগটি।আমাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয় এর অস্তিস্ত রক্ষায়।মানিব্যাগ রাখার জন্য নতুন বানানো প্যান্টগুলোতে দর্জির কাছে গিয়ে পিছনের পকেটের উপরে বোতামসহ ঢাকনা বানিয়ে আনি ,মেসে ঘুমানোর সময় বালিশের নিচে রাখি,বাসে বা ভীড়ের মধ্যে চলাচলের সময় মাঝে মাঝে হাত রাখি পকেটে,বুঝতে চেষ্টা করি ঠিক আছে তো সব।এভাবে মানিব্যাগটির সাথে আত্বীয়তা করে সময় গড়িয়ে যায় আমার। কিন্তু শেষরক্ষা শেষ পর্যন্ত হয়না।এইচ,এস,সি পাশের পর ঢাকায় এসে মানিব্যাগটি বেহাত হয়ে যায়।মফস্বল থেকে সদ্য পাশ করা বোকা এই আমি জানতাম না এই শহরে দিনদুপুরে লোকজন অন্যের জিনিসপত্রে চোঁখ দেয়,ছিনিয়ে নেয় জোর করে।একান্ত বন্ধুর মত সবসময় সাথে থাকা মানিব্যাগটি হারিয়ে আমি যেন র্নিবান্ধব হয়ে পড়ি, মানিব্যাগটিতে থাকা জিনিসপত্রগুলোর জন্য হয়ে পড়ি কাতর।সর্বোপরি মানিব্যাগটির শোকে কাতর আমাকে আরো কয়েকমাস মানিব্যাগবিহীন থাকতে হয়।

বু্য়েটে ভর্তি হই।স্বাভাবিকভাবে জীবন চলতে থাকে,একটু ভালোভাবে থাকার জন্য টিউশনি ধরি।মাসশেষে অনেকগুলো টাকা ওঠে হাতে।বন্ধু-বান্ধব অনেকে বলে পুরানো মোবাইল ব্যবহার করিস একটা নতুন মডেলের মোবাইল নে।আমি মোবাইল কেনার জন্য মার্কেটে যাই কিন্তু ফিরে আসি মেন্জ ক্লাব থেকে পনেরস টাকা দিয়ে মানিব্যাগ কিনে। বন্ধুরা যারা আমার মানিব্যাগের ঘটনাবলী জানে তারা হাসে,বলে আবার মানিব্যাগ। অনেকে বলে শুধু টাকা রাখার জন্য এত টাকার মানিব্যাগ,অপচয়,পুরোটাই অপচয়।ওরাতো জানে না মানিব্যাগ শুধু আমার কাছে একটি অর্থথলি নয়,এটা আমার ভল্ট,আমার বন্ধু।আবার আমার মানিব্যাগ মোটা হতে শুরু করে।স্থান পেতে থাকে প্রেমিকার পত্র থেকে শুরু করে সদ্য কেনা ঘড়ির দোকানের ম্যামো পর্যন্ত ।কিন্তু এবারও শেষরক্ষা হয়না।এক ফাল্গুনের দুপুরে ল্যাব থেকে ফিরে এসে যখন প্রবলভাবে ঘুমাই তখন হলে আমার রুম থেকে তিনশ টাকাসমেত চুরি হয়ে যায় মানিব্যাগটি। আমাকে অনেক যন্ত্রনা পোহাতে হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড হারানোতে থানায় জিডি করতে হয়,ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড হারানোতে পাঁচশত টাকা দিয়ে নতুন করে তুলতে হয় ক্রেডিট কার্ড ।আমার আফসোস বাড়ে ইস! আরএকটু যত্ন করে যদি রাখতাম মানিব্যাগটি,ইস! ঐ সময়ে যদি অমন কুম্ভকর্নের মত না ঘুমাতাম।আফসোস করতে করতে আমি আবারো একটি নতুন মানিব্যাগ কেনার স্বপ্ন দেখি।
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।


Comments

অতিথি লেখক's picture

খুব সুন্দর!!
( আপাতত আমি সচলায়তনে সচল হবার স্বপ্ন দেখি!! হাসি)

------------
কালবেলা

স্বপ্নাহত's picture

আহারে।

আমি আমার ফার্স্ট মানিব্যাগ কিনসিলাম ক্লাস টেনে থাকতে নিউমার্কেট ওভারব্রীজের পাশের ফুটপাথ থেকে,বিশ টাকা দিয়ে।অনেক দিন ইউজ করসি ঐটা।কলেজ লাইফ অনায়াসে চলে গেছে।ফেলে দেবার আগে সত্যিই অনেক মায়া লাগছে।বাট ঐ জিনিসের এমন অবস্থা হইসিল যে ফেলে দেয়া ছাড়া উপায়ও ছিলনা।

আপনিতো ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চলে গেছেন।আমি এখনো বিশ টাকার উপরে উঠতে পারিনাই দেঁতো হাসি

---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

অতিথি লেখক's picture

সুন্দর লিখেছেন। আমি নিজেও মানিব্যাগ ব্যাবহার। ছোটবেলা থেকেই আমার ও মানিব্যাগের প্রতি বিষন রকমের প্রেম। বড় হয়ে যখন মানিব্যাগ কিনলাম মানুষ দেখী আমার দিকে অন্যরকম করে চায়, যনে মেয়ে হলে ছেলেদের মতো মানিব্যাগ ব্যাবহার করা যা্য় না! কিন্তু আমি কি থোরাই কেয়ার করি... আমি আমার মতো করে মানি ব্যাগ ব্যাবহার করছি...এর মধ্য কয়েকটি মানিব্যাগ আমার আর্কাইভে জমা হয়েছে (যে গুলো ব্যাবহারের পর ফেলে দিতে কষ্ট হচ্ছিল সেগুলো)

মানিব্যাগের প্রতি আমার প্রেমের আরো একটি উদাহরণ হচ্ছে, আমি যতবার দেশে বাইরে গেছি ততবারই সেখানের পরিচিত, সহকর্মী ও বন্ধুদের উপহার সরুপ দেয়ার জন্য অনন্যা সামগ্রীর সাথে একগাদা পাটের তৈরী মানিব্যাগ নিয়ে গিয়েছি ... দেঁতো হাসি

কল্পনা আক্তার
কল্পনাআক্তার@হটমেই্ল.কম

..............................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

সুলতানা পারভীন শিমুল's picture

এই মানিব্যাগ মানিব্যাগ না
আরো মানিব্যাগ আছে...
ইনশাল্লাহ্

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

স্বপ্নাহত's picture

আফা কি অদূর ভবিষ্যতে মানিব্যাগ সাপ্লায়ার হবার ধান্দায় আসেন নাকি?? ইয়ে, মানে...

---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

সুলতানা পারভীন শিমুল's picture

বুদ্ধিখান কিন্তু মনে ধরছে !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

স্বপ্নাহত's picture

হ, আফনের মনে ধরার পরিণাম তো তিন পর্বেই বুঝায়া দিসেন। শাহরুখ ভাই ও তার জ্ঞাতিগুষ্টিরা ভালমতো টের পাইসে।

এই কেসে যে আরো কয়জনের কপাল পুড়বো আল্লায় জানে। মন খারাপ

---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

সুলতানা পারভীন শিমুল's picture

হায় হায় !
আমি আবার কি করলাম !!
কপাল তো পুড়ে জনমদোষে !!!
ক্যান, গানটা শোনেন নাই?
জনমদোষে কপাল পোড়া আমি একজনা...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

স্বপ্নাহত's picture

Quote:
জনমদোষে কপাল পোড়া আমি একজনা...

ভুতের মুখে রাম নাম।এই গান তো যাদের ছ্যাঁকা দিসেন তাগোর গাওনের কথা ইয়ে, মানে...

---------------------------
দুঃখ সুখের স্পর্শ নীরে
সাঁতরে বেড়াই;
নিঃসংগ এক,নিঃসংগ মেঘ।

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

পরিবর্তনশীল's picture

নস্টালজিক দেঁতো হাসি
ভালো লাগল
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আনোয়ার সাদাত শিমুল's picture

জীবনে প্রথম মানিব্যাগের স্ম্বতি ভোলা যায় না।
লেখাটি খুব ভালো লেগেছে।

অতিথি লেখক's picture

সাবলীল লেখা। তবে আমরা moneybag এর একটা পরিভাষা করতে পারি। টাকাধার(শব্দটা কেমন!), সমাসঘটিত শব্দ- টাকা+আধার= টাকাধার।
ক্লান্ত পথিক

Quote:

তামার বিষে বিষন্ন ভুবন

অতিথি লেখক's picture

হ্যাঁ,তা যা বলেছেন শব্দটা ভালই।
eru

-------------------------------------------------
সুগন্ধ বিলোতে আপত্তি নেই আমার
বস্তুত সুগন্ধ মাত্রই ছড়াতে ভালবাসে।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.