আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কি অয়ন, মাথাব্যথা করছে নাকি?’
আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে আবার সামনের সীটে মাথা ঠেকিয়ে রাখে সে। বাস তখন সম্ভবতঃ বাবুবাজার পার হলো বা এর কাছাকাছি। খানিক পরে আরেকবার ডাকলে সে মুখে আঙুল চেপে ইশারা দেয়, যার অর্থ হলো – ‘চুউপ, কথা নাই।‘
একবার ভেবেছিলাম – অয়ন নামাজ পড়ছে। যাত্রাপথে বাসে অনেকেই ইশারায় নামাজ পড়েন, এমন দেখেছি। তাই চুপ থাকি। টিভিতে নাটক চলছে ‘স্ক্রিপ্ট রাইটার’। বেকার নায়ক চাকরির জন্য এখানে ওখানে ঘুরছে...। বন্ধুরা টিপ্পনী কাটছে। এক বিজ্ঞাপনী সংস্থায় স্ক্রিপ্ট রাইটারের অফার আসে। নায়ক রাত জেগে কাগজ কলমে কাটাকুটি করে, নানান দৃশ্য কল্প জাগে তার মনে।
আরও পরে অয়ন মাথা সোজা করে সিটে থিতু হয়। মুখে শয়তানি হাসি। জিজ্ঞেস করি, ‘কাহিনী কী?’
অয়ন বলে, ‘ওরা কী বলে শোনার চেষ্টা করলাম।‘
‘কী বলে?’
‘বোঝা যায় না, ফিসফিস করে...।‘
আমি আবার নাটকে মন দিই। সামনের দুই সীটের ফাঁক দিয়ে দৃশ্য দেখার চেষ্টা করেছিলাম শুরুতে। ব্যবধান শুন্য ইঞ্চি ঘনিষ্টতায় দুজনের আসলে একটি সীট হলেই চলতো। তবে খুলে রাখা স্কার্ফের আড়ালে কিছু দেখা যায় না। আমি তাই হতাশ হই, এরচে’ বরং নাটক দেখা ভালো। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জয়া আহসান তার স্বামী আতিককে প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বলছে – ‘আচ্ছা, তুমি কখনো কচ্ছপ দেখেছো?’
অয়ন এবার আমাকে গুতা দিয়ে ইশারা দেয়। সে বসেছে জানালার পাশে। চোখ একটু এংগেল করে তাকালে সামনের সীটে কী হচ্ছে দেখা যায় জানালার কাঁচে। হাসি আঁটকাতে আমি মুখে হাত চাপি। আমার ডানে পেছনে সীটে বসা স্থুলকায়া আন্টি কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে...।
সেদিন ২২ আগস্ট, শুক্রবারে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম পান্থপথ থেকে। ঢাকা শহরের আরও তিনটি কাউন্টারে থেমে থেমে ফকিরাপুল থেকে সোহাগ পরিবহন যখন ছাড়ে তখন সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। আমার হিসেব ছিলো, সোয়া পাঁচটায় পান্থপথ থেকে ছাড়লে চল্লিশ মিনিটেই কাঁচপুর ব্রিজ পার হবো। সেসব হিসেব ওলট পালট হয়ে যাত্রা বিলম্বিত হয়। খিদেও চাড়া দেয়। চিপসের প্যাকেট কিনেছিলাম আগেই। এবার যখন চোখে পড়লো গরম গরম সমুচা-সিংগাড়া ভাজা হচ্ছে, তখন আমার পা চালানো দায়। অয়নকে বলি, ‘তুমি বাসে গিয়ে বসো, আমি কিছু কিনে আনি।‘
বাসে উঠে দেখি অয়ন জানালার পাশে সীট দখল করেছে। কী আর করা...। এই মন খারাপে আরও মন খারাপ যোগ হলো যখন বুরখা পড়া কিশোরীবাতরুণীকিংবামহিলা এক সুদর্শনবখাটেভাবের তরুণের হাত ধরে বাসে ওঠে। এসে বসে আমাদের সামনের সীটে। বুরখাওয়ালী জানালার পাশের সীটে, তরুণ আমার সামনের সীটে। আমার সংগোপন মন খারাপের মাত্রাকে ছাড়িয়ে অয়নের হতাশা নীরবতা ভাঙে। সব দোষ দেয় আমার ওপরে –
‘এইটা আপনার কারণে হইলো...’
‘আমার কী দোষ?’ আমি অবাক হই।
‘বুঝেন না, আপনার কী দোষ? এত এত বাসে চড়লাম কখনো এমন হয় নাই, আর আজ আপনি আসতেই বুরখাওয়ালী উড়ে আসলো...’
আমি কী করে বুঝাই, ভাই অয়ন – এই বুরখাওয়ালী জোটার সংগে আমার সম্পর্ক নেই, আর যদি আমার ক্ষমতা থাকতো তবে এই সোহাগ পরিবহনের প্রতিটি সীট সেই কবে ফেলে আসা কো-সামেট আর কো-চ্যাঙ আইল্যান্ড বীচের তীক্ষ্ম-ধারালো তরুণী দিয়ে ভর্তি করে দিতাম। অয়নকে বোঝানো হয় না। বাসের সুপারভাইজর ভাইজান তখন পানির বোতল আর বিস্কুটের প্যাকেট দিয়ে যাচ্ছে। বিস্কুটের নামটা মনে পড়ছে না এই মুহুর্তে, তবে টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখেছি ঐ বিস্কুট খেলে মুখ দিয়ে ফটফট করে ইংরেজী কথা বের হয়। সাইফুরসের ব্যবসা লাঠে ওঠলো বলে...। এসব যখন ভাবছিলাম, তখন বাস চলছে, আর সামনের বুরখার স্কার্ফ গেছে খুলে। আরও মিনিট কয়েক পরে কিশোরীবাতরুণীকিংবামহিলা বিভ্রম কাটে যখন তিনি দাঁড়িয়ে কালো বুরখা খসিয়ে দিচ্ছেন গা থেকে। অয়ন ব্লগে তেমন লেখালেখি করে না, লিখলে উদ্ভিন্নাযৌবনা শব্দটি নির্ঘ্যাৎ নিয়ে আসতো বিশেষণ হিসেবে।
গলা একটু চড়া করে জিজ্ঞেস করি, ‘কী খবর অয়ন, কেমন আছো?’
একথা আরও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, সেদিন বাসে, পরদিন সিলেটে রাস্তায় চলতে গিয়ে। অয়ন যা বোঝার বুঝে গেছে...। তার আসলে না বুঝে উপায় নেই। স্কার্ফ বুরখা খুলে তারা ক্রমশঃ ঘনিষ্ট হয়, ডান পাশের জন ক্রমাগত বাম পাশে যায়। একটি মাথা অন্য ঘাঁড়ে আশ্রয় নেয়, ব্যবধান শুন্য ইঞ্চি হয়। আর অয়ন মাথা নিচু করে সামনে সীটে ঠেক দিয়ে শোনার চেষ্টা করে তারা কী বলে...। আমার প্রশ্নের উত্তরে বলে - ‘বোঝা যায় না, ফিসফিস করে...।‘
বাইরে রাত নেমে এলে, বাস অন্ধকার হয়। আমরা টিভিতে নাটক দেখি। হুমায়ুন আহমেদের ‘চোর’। গুরু এজাজুল ইসলাম শিষ্য ফারুক আহমেদকে টিপস দিচ্ছে, ‘তিন ধরণের বাড়ীতে চুরি করতে যাবি না, এক- যে বাড়ীতে বৃদ্ধ থাকে, ওদের ঘুম পাতলা। দুই- যে বাড়ীতে শিশু থাকে, সারারাত কাঁদে, মা বাপ ওঠতে হয় বাচ্চার জন্য, আর তিন নম্বর হলো – যে বাড়িতে নতুন বিবাহিত স্বামী স্ত্রী আছে, তারা সারারাত ফুসুরফুসুর করে, ঘুমায় শেষ রাতে...। মুগ্ধ শিষ্য গুরুর পায়ে ধরে সালাম করে আশীর্বাদ নেয়।
অয়নকে জিজ্ঞেস করি, ‘এরা কি হানিমুনে যাচ্ছে?’
অয়ন বলে- ‘মনে হয় বাসা থেকে পালাচ্ছে’।
তখন টিভিতে সোহাগ পরিবহনের বিজ্ঞাপন চলছে। একদল ছেলেমেয়ে বাসে করে যাচ্ছে। অন্ত্যাক্ষরী খেলছে তারা। নাচছে সবাই, মুরুব্বীও যোগ দিচ্ছেন। পে-অফ লাইন – নিরাপদ আনন্দময় ভ্রমণের জন্য সোহাগ পরিবহন। অয়ন বলে, বিজ্ঞাপনটা ফালতু। জিজ্ঞেস করলাম – ‘কেন’?
তার হতাশা – পুরা বাসটা নিরানন্দ, এরকম নাচে না কেউ...।
সে রাতে সিলেট পৌঁছে আলবাব ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা, বিজ্ঞাপনে যা দেখায় সব কি সত্যি হয়?’
আলবাব ভাই জিজ্ঞেস করে, ‘কেন, কী হইছে?’
‘আজকে বাসে সামনের সীটে...’
আরেকটু শুনে আলবাব ভাই চোখ বড়ো করে চশমায় ধাক্কা দেয়।
অয়ন থামে, আমিও।
এবার বুঝি – বিজ্ঞাপনের মুরুব্বীরা নাচে আর বাসের মুরুব্বীরা নাচে না কেনো...
__
(পরের পর্ব অন্য প্রসংগে।)
Comments
দুর্দান্ত! অপেক্ষায় আছি কিন্তু পরের পর্বের।
হাহাহাহা...সুন্দর পোস্ট, যথারীতি
ভেবেছিলাম শেষ হলে একসাথে পড়বো কিন্তু এটারও একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাব আছে। ভাল্লাগ্লো।
আমি গল্প পড়ি নাই ! তয় নজমুল আলবাব চশমায় ধাক্কা দেয় কেন ?
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
দুধচা খাবেন, না রংচা?
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
---------------------------------------------------------
ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.
রংচা; চিনিকম, দুধবেশি ।
হুম, কিন্তু আমাকে কিন্তু সেই বুরখাওয়ালি অন্যরকম কাহিনী বলছিলো...
অলমিতি বিস্তারেণ
অলমিতি বিস্তারেণ
পেপসি টা কোথায়?
- আমি না এখনো বুঝি নাই, মুরুব্বীরা নাচেনা ক্যান বাসে?
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
আলবাবু বুড়া হয়া গেছে... পেপসি কই?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ভাবছি নামটা এমন কেন? নিয়ন পেপসি।
ইল্যুশনের জগত সৃষ্টিকারী বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে ঝলমল করে পেপসির বিজ্ঞাপন। এমনই অনেক কিছু পাওয়া যায় না হাত বাড়িয়ে, স্বপ্ন রয়ে যায়। দেখা, অথচ না পাওয়ার এ সিম্বল 'নিয়ন পেপসি'। অঞ্জনের গানে যেমন আছে - 'আকাশ থেকে নিয়ন পেপসি ডাকে, জেনারেশন নেক্সট বেচতে চায়'। ধন্যবাদ।
সব বোরখাই খুলে পড়ে। গল্প চলুক।
টিভির মুরুব্বীরা টিভিতে সুন্দর আর বাস্তবের মুরুব্বীরা বাসের সীটে
তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে
*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়
কেন জানি বোরখাওয়ালীদের চোখ খুব সুন্দর হয়।
গল্প দৌড়াক। আলবাব ভাইজানও আরো চশমা ধাক্কাক।
শিমুল বিশেষ ধরণের ভ্রমণ কাহিনী লেখে, অতএব সে বড় হইয়াছে।
হা হা হা
জটিল লাগলো। অয়নের কান আরেকটু শার্প হলে ভালো হতো।
...........................
সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন
...........................
একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা
ঠিকাছে চশমা খুলেই বসলাম। গল্পটা শেষ কর্ এইবার।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
শেষটা দুম করে শেষ করে দেবেন না দয়া করে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
এতদিন অপেক্ষা করে ছিলাম একটু অবসর নিয়ে লেখাটা পড়বো বলে। আপনি নিরাশ করেননি। সুন্দর গদ্যের জন্য পাঁচতারা।
সবাইকে ধন্যবাদ, পড়ার জন্য ও মন্তব্যের জন্য।
হ্যাঁ পড়ে ফেলেছি৷ তারপর?
-------------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'
তারপরে কী তা বলার সময় কই, দমা’পু! একজন একটা ডেডলাইন ধরিয়ে দিয়েছেন, আমি টেনশনে আছি
আহ্, শিমুল ভাইয়ের লেখা পড়লাম
Post new comment