বেগুন নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণা, হলুদ সাংবাদিকতা এবং গবেষকদের বিজ্ঞান যোগাযোগ

সচল জাহিদ's picture
Submitted by socol zahid on Tue, 08/11/2022 - 4:09am
Categories:

গত ২ নভেম্বর ২০২২ এ “একাত্তর জার্নাল” এর ফেইসবুক পেইজে একটি ভিডিও [১] দেখে আজকের এই লেখার অবতারণা। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে একাত্তর টিভির সঞ্চালক মিথিলা ফারজানা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন এর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। সাক্ষাৎকারের বিষয় হচ্ছে বেগুন নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধ। যতটুকু বোঝা গেল, এই প্রকাশিত প্রবন্ধটির উপর ভিত্তি করে বেগুনে ক্যান্সারের উপাদান পাওয়া গেছে শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মিথিলা ফারজানা সেটার সত্যতা যাচাই করার জন্য সেই গবেষণা প্রবন্ধের লেখকদের মধ্য থেকে অধ্যাপক হোসেন কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত রয়েছেন আরও দুজন সাংবাদিক: মাসুদা ভাট্টি এবং উদিসা ইসলাম। ব্যক্তিগত ভাবে মাসুদা ভাট্টিকে আমি চিনি বাংলা ব্লগ সচলায়তনে লেখালেখির মাধ্যমে। সেই ২০১০ সালে উনি উনার সম্পাদিত মাসিক “একপক্ষ” এর জন্য আমার কাছ থেকে “ভারত বাংলাদেশ পানিসম্পদ” নিয়ে একটি লেখা নিয়েছিলেন। লিঙ্কডিন [২, ৩] থেকে জানলাম দুজনেই ঢাকা ট্রিবিউনের সাথে সংযুক্ত আছেন। ভিডিওটি দেখে আমি আঁতকে উঠেছি, একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ ও গবেষক হিসেবে নিজেকে অতি নগণ্য মনে হয়েছে। তার থেকেও বড় কথা, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের নৈতিকতা ও আদর্শ নিয়ে বিশাল এক প্রশ্ন জেগেছে। আমার বন্ধুদের অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। তাদের প্রতি শতভাগ শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি আমার কাছে এটাকে হলুদ সাংবাদিকতা মনে হয়েছে। সেই সাথে বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে ড. হোসেনের বিজ্ঞান যোগাযোগের দক্ষতা দেখে বেশ হতাশ হয়েছি। এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করার চেষ্টা থাকবে এই নিবন্ধে।

আলোচনার শুরুতেই জেনে নেই বেগুন নিয়ে অধ্যাপক হোসেন ও তার সহকর্মীদের গবেষণার বিষয়টি। গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে গত ২২ আগস্ট ২০২২ সালে, সায়েন্টিফিক রিপোর্টস নামক একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে। আমরা যারা টুকটাক গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট তারা জানি সায়েন্টিফিক রিপোর্টস একটি অত্যন্ত সম্মানজনক প্রকাশনা। এটি আসলে বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নেচার পাবলিশিং গ্রুপ, যা কিনা বর্তমানে নেচার পোর্টফলিও নামে পরিচিত, এর একটি প্রকাশনা। নেচার এর গবেষণা প্রকাশনার সূচনা আসলে সেই ১৮৬৯ সালে। সেইসময় যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে এটি সাপ্তাহিক বিজ্ঞান পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হত। গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে “Human health implications of trace metal contamination in topsoils and brinjal fruits harvested from a famous brinjal-producing area in Bangladesh” এই শিরোনামে। আমি এই লেখার নিচে মূল গবেষণা প্রবন্ধটির উৎস [৪] দিয়ে দিলাম, আগ্রহী পাঠক চাইলে পড়তে পারেন।

গবেষণা প্রবন্ধটি পড়ে জানা গেল গবেষকরা বাংলাদেশের জামালপুর জেলার দুইটি উপজেলা, ইসলামপুর এবং মেলান্দহ থেকে বেগুণ ক্ষেতের মাটি ও আবাদ করা বেগুন সংগ্রহ করেছেন। এই দুইটি উপজেলার মোট বিশটি ক্ষেত থেকে ষাটটি মাটির নমুনা ও আশিটি বেগুন সংগ্রহ করে সেগুলো গবেষণাগারে পরীক্ষা করে তাতে বেশ কিছু ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন যার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এই মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ ধাতুর উপস্থিতি মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে বলতে গেলে, এর মধ্যে কিছু ধাতু রয়েছে যা কিনা মানব দেহে ক্যান্সার তৈরির উপকরণ (Carcinogens) হিসেবে বিবেচিত। এখন প্রশ্ন হল এইসব ক্ষতিকর ধাতু বেগুনে আসলো কি ভাবে? সেটি নিয়ে গবেষকদের ধারণা হচ্ছে সম্ভবত বেগুন ক্ষেতে প্রয়োগ করা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক থেকে এই ক্ষতিকর ধাতু বেগুনে প্রবেশ করেছে। এই গবেষণার ভিত্তিতে তারা পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশের অন্যান্য কৃষি অঞ্চলেও এই জাতীয় গবেষণা করে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে।

এবারে আসি সংবাদ মাধ্যম এই গবেষণাটির খবর কিভাবে প্রকাশ করেছে। শুরুতেই বলে নেই, এই গবেষণার সারমর্ম কিন্তু এই না যে বেগুন খেলে ক্যান্সার হবে। গবেষণাটির সারমর্ম হচ্ছে জামালপুরের ঐ বিশেষ দুই অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেতের মাটিতে বেশ কিছু ক্ষতিকর ধাতু মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে রয়েছে যা কিনা মাটি থেকে বেগুনে প্রবেশ করেছে। ঐ বিশেষ ক্ষেতগুলোর বেগুন ভক্ষণ করতে থাকলে তা মানবদেহে ক্যান্সার তৈরির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিবে। অথচ সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি এসেছে বেগুন খেলে ক্যান্সার হয় এইরকম শিরোনামে। The Bussiness Standard এর বাংলা ভার্শনে ২৭ সেপ্টেম্বর সংবাদ শিরোনাম হয়েছে “বেগুনে ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি, রয়েছে ক্যান্সারের ঝুঁকি: গবেষণা” [৫]; জনকণ্ঠ ১৮ অক্টোবর ২০২২ এ সংবাদ শিরোনাম করেছে “নিয়মিত বেগুন খেলে ক্যান্সার হতে পারে” [৬]; নয়া দিগন্ত ২ নভেম্বর ২০২২ এ শিরোনাম করেছে “বেগুনে ক্যান্সারের উপাদান পেয়েছেন বাকৃবির গবেষকরা” [৭]; ইনকিলাব ৩ নভেম্বর ২০২২ এ সংবাদ শিরোনাম করেছে “বেগুনে ক্যান্সার ঝুঁকি, দাবি বাকৃবি গবেষকদের” [৮]। এই প্রত্যেকটা সংবাদেই সরাসরি যে বিষয়টা উঠে এসেছে তা হল বেগুন খেলে ক্যান্সার হবে বা হবার সম্ভাবনা বাড়বে। অথচ সংবাদটা আসা উচিৎ ছিল “জামালপুরের বেশ কয়েকটি আবাদি জমির বেগুনে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে” এইভাবে। ব্যাপারটা তুলনা করা যেতে পারে বাংলাদেশের অর্সেনিক সমস্যার সাথে। বাংলাদেশে বেশ কিছু অঞ্চলে নলকূপের পানিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে যা কিনা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। এখন যদি সংবাদে প্রকাশিত হয় “নলকূপের পানি খেলে আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হবে” সেটা কিন্তু ভুল। এক্ষেত্রে এরকম ব্যাপারটিই ঘটেছে।

এবারে আসি মূল সাক্ষাৎকার এর প্রসঙ্গে, যার ভিডিওটি নিয়েই আমার মূল আগ্রহ। মিথিলা ফারজানা তার সাক্ষাৎকার শুরুই করলেন “বেগুনে ক্যান্সারের কোষ পাওয়া গেছে” এই উক্তি দিয়ে। ব্যাপারটা এরকম যে ক্যান্সারের কোষের হাত পা আছে এবং তা লাফাতে লাফাতে বেগুনে গিয়ে ভর করেছে। উনি যদি কিঞ্চিৎ পড়াশুনা করে আসতেন এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের আগে তাহলে জানতেন ক্যান্সারের কোষ বেগুনে পাওয়া যায়নি বা মানব দেহের ক্যান্সার কোষ বেগুনে থাকার কথা নয়, কিছু ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে অস্তিত্ব পাওয়া গেছে গবেষণার নমুনাতে যা ভক্ষণ করলে ঐ পদার্থগুলি মানব দেহে প্রবেশ করতে পারে যা কিনা ক্যান্সার সৃষ্টির পক্ষে অনুকূল। মিথিলা ফারজানার যে গোড়তেই গলদ সেটা অধ্যাপক হোসেন শুরুতেই বলে নিলেন “আপনার উপস্থাপনা যেভাবে হয়েছে , মেসেজ কিন্তু সেটা নয়”। এর পরে অধ্যাপক হোসেন যেই বিষয়টি নিয়ে কেবল আলোচনা শুরু করবেন, তখনি মাসুদা ভাট্টি ঝাঁপিয়ে পড়লেন এই বলে যে এই গবেষণার কারণে বেগুনে ক্যান্সারের “জীবাণুর” অস্তিত্ব বাংলাদেশ জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। মাসুদা ভাট্টি হয়ত জানেননা ক্যান্সারের জীবাণু বলতে কিছু নেই। ক্যান্সার জীবাণুর মাধ্যমে হলে এতদিনে হয়ত ক্যান্সারের টীকাও আবিষ্কার হয়ে যেত! অধ্যাপক হোসেন আবারও যখন বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান করতে যাবেন তখনি উদিসা ইসলাম বলে উঠলেন “আপনারা কি করেছেন” এবং একসাথে তিন সাংবাদিক কথা বলা শুরু করলেন। যাই হোক, এর পর অধ্যাপক হোসেন যখন বিষয়টি ব্যাখ্যা শুরু করলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই মিথিলা ফারজানা বলে উঠলেন যে অধ্যাপক সাহেব যা বললেন তার একটা বর্ণও তারা তিন জনের একজনেও বোঝেন নাই। একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে উনি সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন তার জন্য ন্যুনতম যতটুকু প্রস্তুতি লাগে তার কিয়দংশও যদি না করে আসতেন তাহলে উনি জানতেন “কার্সিনোজেনিক” মানে যা ক্যান্সার তৈরি করতে পারে। ঠাকুরমার ঝুলি শুনতে আসলেও রাক্ষস-খোক্কস বোঝা লাগে, রাক্ষসের জান যে শরীরে না থেকে সাত সমুদ্র তের নদী দূরের কোন এক অজানা দ্বীপের উঁচু বিল্ডিং এ লোহার খাঁচায় বন্দী পাখিতে থাকে সেটা জানা লাগে। এর পরে মাসুদা ভাট্টির প্রশ্ন জাগল নমুনা হিসেবে কেন বেগুন নেয়া হল? কেন ঝিঙা নেয়া হলনা! ভাগ্যিস আলু, পটল, লাউ এগুলো নিয়ে আগ্রহ দেখাননি। অধ্যাপক হোসেন ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা শুরু করার পরে মাসুদা ভাট্টি শুরু করলেন কেন এই বিষয়টাকে পাবলিক করা হল? এক্ষেত্রে বলে নেয়া ভাল, বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে যাদের ন্যুনতম ধারণা আছে তারাও জানেন যে একটি গবেষণা প্রবন্ধ ভাল একটি প্রকাশনায় প্রকাশ পাবার জন্য একটি প্রক্রিয়া আছে যাকে বলা হয় “পিয়ার রিভিউ”। এর মানে হচ্ছে নতুন কিছু প্রকাশের আগে সেটার খসড়া ঐ গবেষণার বিষয়বস্তুর সাথে যাদের পড়াশুনা আছে তারা যাচাই করে দেখেন। যেই যাচাইয়ের ভিত্তিতেই একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। একজন বিজ্ঞানী হিসেবে সবার স্বাধীনতা আছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করে সেটার ফলাফল প্রকাশ করার। মাসুদা ভাট্টি জানেননা যে এই গবেষণাটি ইতিমধ্যে এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছে এবং সেটি অত্যন্ত সম্মানজনক একটি বিজ্ঞান প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছে। উনি জানেননা কারণ উনি কোন প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি। এমনকি উনি যদি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলিতেও চোখ বুলিয়ে আসতেন তাহলে বিষয়টি জানতেন কারণ সবগুলো সংবাদেই এই প্রকাশনার কথাটা উল্লেখ করা হয়েছে। এর পরে উনি সায়েন্টিফিক রিপোর্টস (যে প্রকাশনার গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে) নিয়ে হাজারো প্রশ্ন শুরু করলেন যা তার এই সাক্ষাৎকারে আসার আগেই নিজের দায়িত্বে জেনে আসা উচিৎ ছিল। উনার জানা উচিৎ ছিল যে এই জার্নালে কোন গবেষণা প্রকাশিত হলে গর্বে যেকোনো গবেষকের বুকের ছাতি ফুলে যায়। পৃথিবীর সব দেশের নেচার পাবলিকেশনের কোন জার্নালে কিছু প্রকাশিত হলে সেটা নিয়ে সাড়া পড়ে যায়।

এই পর্যায়ে সাক্ষাৎকারের মূল সঞ্চালক সায়েন্টিফিক রিপোর্টস এর গুষ্ঠি উদ্ধারে লেগে গেলেন। তার সহকারীদের কে এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করার নির্দেশ দিলেন। তার মানে মিথিলা ফারজানা নিজেও কোন প্রস্তুতি নিয়ে আসেননি। এবার শুরু করলেন উদিসা ইসলাম, তিনি বলে ফেললেন যে আগে গবেষকরা বলেছেন বেগুন খেলে ক্যান্সার হয়, এখন কেন অস্বীকার করছেন। এর পরে মাসুদা ভাট্টি বিষয়টিকে নিয়ে গেলেন যে মাত্রায় যা হয়ত বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই গবেষকরা কেন গবেষণাটি প্রকাশ করে সেটাকে মানুষের সামনে নিয়ে আসলেন সেটাকে তিনি তুলনা করলেন ফৌজদারি অপরাধ এর সাথে। বোঝা গেল, বিজ্ঞান কেন, আইন সম্পর্কেও উনি ন্যুনতম কোন ধারণা রাখেন না। এর পরে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস নিয়ে একাত্তর টিভির “ইনস্ট্যান্ট” গবেষণার ফিরিস্তি আসা শুরু করল। বোঝা গেল সায়েন্টিফিক রিপোর্টস যে নেচার পোর্টফলিও প্রকাশনা সংস্থার একটি প্রকাশনা যেটা বোঝার মত একজন মানুষও নেই। বিষয়টা খুব সহজ করে বুঝিয়ে দেই: ধরুন হুমায়ূন আহমেদ অন্যপ্রকাশ থেকে একটি বই বের করলেন যার নাম হচ্ছে ভূত সমগ্র। সেই বইয়ে যদি একটি ভূতের গল্প থাকে সেটি হচ্ছে বেগুন নিয়ে অধ্যাপক হোসেনের গবেষণার মত, “ভূত সমগ্র” হচ্ছে “সায়েন্টিফিক রিপোর্টস”, আর “অন্যপ্রকাশ” হচ্ছে “নেচার পোর্টফলিও”।

এবারে আসি বিশ্লেষণে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা প্রবন্ধ ভাল মানের একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান প্রকাশনায় প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন সেটিকে প্রকাশ করেছে। এই প্রকাশে যে গুরুত্বপূর্ণ ভুল হয়েছে তা হচ্ছে বিষয়টিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাব প্রকাশ করা হয়েছে। একাত্তর টিভির সঞ্চালক মিথিলা ফারজানা সেই বিষয়টিকেই খোলাসা করার জন্য গবেষক দলের প্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু মিথিলা ফারজানা সহ অন্য দুজন সাংবাদিক উদিসা ইসলাম এবং মাসুদা ভাট্টি এই তিন জনকেই দেখে মনে হয়েছে তারা অধ্যাপক জাকির হোসেনকে হেনস্থা করার জন্যই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। শুরু থেকেই তাদের কথাবার্তা, আচার আচরণ সবকিছুতেই একটা আক্রমনাত্বক ভাব ছিল। তারা ধরেই নিয়েছেন সরকারী টাকায় অধ্যাপক হোসেন একটা বস্তাপচা গবেষণা করেছেন এবং সেই গবেষণার খবর প্রকাশ করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সাথে যতটুক সম্মান সুলভ আচরণ করা উচিৎ তারা তার কিছুই করেননি। সাংবাদিক হিসেবে তারা ন্যুনতম হোম ওয়ার্ক করে আসেননি। এমনকি সাক্ষাৎকারের শুরুতেই অধ্যাপক জাকির হোসেন বিষয়টিতে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সেটি উল্লেখ করলেও তার কোন গুরুত্ব দেননি কেউই। বলতে গেলে শুরু থেকেই তাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে বার বার। অধ্যাপক হোসেন নেহায়েত ভদ্র মানুষ বলে শেষ পর্যন্ত ছিলেন, অন্য কেউ হলে সাক্ষাৎকারের মাঝখানেই হয়ত চড়া গলার কিছু কথা বলে সসম্মানে বের হয়ে আসতেন। সাংবাদিকতার জন্য যতটুক জ্ঞান থাকা উচিৎ, যতটুকু শোভন হওয়া উচিৎ তার কোনটাই তাদের ছিলনা।

এবারে আসি বিজ্ঞান যোগাযোগের প্রসঙ্গে। একজন বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক হিসেবে একটি জটিল বিষয়কে সহজ ভাবে উপস্থাপনের যে প্রয়োজনীয়তা ছিল সেটি করতে ড. হোসেন ব্যর্থ হয়েছেন। তার জানা উচিৎ ছিল তিনি আসছেন সংবাদ মাধ্যমে একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলতে, যা ইতিমধ্যেই ভুল ভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে। তার কাছ থেকে আমরা খুব দৃঢ় ভাবে সঠিক খবরটি আশা করতেই পারি। অনেক ক্ষেত্রেই কারিগরি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা ও কাজ করা মানুষের মধ্যে সংবাদ মাধ্যমে কিভাবে একটি বিষয় সহজ ভাবে উপস্থাপন করতে হয় সেটির অভিজ্ঞতা থাকেনা। সেক্ষেত্রে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া বিভাগের কাউকে নিয়ে আসতে পারতেন। বিদেশে যখন একটি বিষয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রস্তুতি হিসেবে সেই গবেষণাটির “মূল সারাংশ” বা “Key Messages” তৈরি করে রাখা হয়। এক্ষেত্রেও সেরকম কিছু তৈরি করে নিয়ে আসতে পারতেন।

পরিশেষে বলা প্রয়োজন, সত্যিকার অর্থেই যদি আমরা এদেশে বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিজ্ঞান মনস্ক করে গড়ে তুলতে চাই তাহলে বিজ্ঞানীদের নিয়ে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সাংবাদিকদের তাদের পেশার প্রতি আরও যত্নবান হতে হবে, বিশেষত সাংবাদিকতার মত মহান একটি পেশার নৈতিক দিকটাতে তাদের আরও গুরুত্ব দিতে হবে।

তথ্যসুত্রঃ
[১] https://fb.watch/gAyKQtQYdB/
[২]https://www.linkedin.com/in/udisa-islam-22279b65/
[৩]https://www.linkedin.com/in/masudabhatti/
[৪]https://www.nature.com/articles/s41598-022-17930-5
[৫] http://bit.ly/3fI30Cb
[৬] http://bit.ly/3hnEJS5
[৭] http://bit.ly/3ElpRgt
[৮] http://bit.ly/3EcMJyq


Comments

নুশান's picture

বিশেষভাবে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই এই প্রয়োজনীয় আলোচনাটির জন্য।

সচল জাহিদ's picture

ধন্যবাদ নুশান!


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

পারফেক্ট! ঠিক এই বিশ্লেষণটা দরকার ছিল। কারো প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ পোষণ না করে নির্মোহ অবস্থান থেকে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

বাংলাদেশে টেলিভিশন একটি গতায়ু মিডিয়া। মেধাবী লোকজনের বড় অংশ এখান থেকে চলে গেছেন। তারচেয়ে ঢেড় বেশি মাত্রায় দর্শকরা অন্যত্র চলে গেছেন। তাই টিকে থাকার জন্য নানা রকমের সেনসেশন তৈরি করা ছাড়া এদের বাজার টিকিয়ে রাখার আর কোন উপায় নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সচল জাহিদ's picture

ধন্যবাদ ভাইয়া।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

নীড় সন্ধানী's picture

অতি চমৎকার একটা বিশ্লেষণ।
 
এই ইস্যুটা নিয়ে আমি দুইবার বেকুব বনছি। প্রথমবার বেকুব হইছি যখন ভিডিওটা দেখতে বসি(তখন পত্রিকার খবর বেগুন কাহিনী কিছুই জানতাম না), দ্বিতীয়বার বেকুব বনছি পুরো ঘটনা জানার পর। 

ঘটনা ভাইরাল হবার আগে কেউ একজন পুরো ভিডিও না দিয়ে মাঝখান থেকে কেটে আধখানা শেয়ার করছিল এবং সেই পোস্টে কোন লেখা ছিল না। আমি ক্লিক করে যখন ভিডিওটা দেখতে শুরু করে কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তবু যেহেতু মাসুদা ভাট্টিসহ  তিন নারীকে মিডিয়া সূত্রে নাম জানি, তাই দেখতে থাকি। বোঝার চেষ্টা করছিলাম, ঘটনাটা কী নিয়ে? স্ক্রিনের ওই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই এমন কোন কেলেঙ্কারি করে এসেছেন যাতে এই তিনজন ক্ষেপে গেছে। এত আক্রমণাত্মক কথার মধ্যেও তাঁর মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল না। ভাবলাম লোকটা নিশ্চিত অপরাধী। কী বলবো.... কানে হেডফোন লাগানোর আগে জেরা করতে থাকা তিন নারীর মুভমেন্ট দেখে ঘটনাটা নারী কেলেঙ্কারি বিষয়ক কিনা সেটাও একবার উঁকি দিয়েছিল মাথায়।

কিন্তু পুরো কাহিনী যখন জানলাম তখন দ্বিতীয়বারের মতো বোকা বনে গেলাম এবং তিনজন শিক্ষিত প্রগতিশীল বলে পরিচিত সাংবাদিকের কুপমণ্ডুকতায় লজ্জিত হলাম। এ যেন অন্যকে অপদস্থ করতে গিয়ে নিজেরাই অপদস্থ হওয়া।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সচল জাহিদ's picture

ধন্যবাদ ভাইয়া!


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

খালেদ তমাল's picture

ভাল লিখেছিস, কয়েকদিন ধরে এই সম্পর্কিত ফেসবুক স্ট্যাটাস, কমেন্টস, ভিডিও আর নিউজ পোর্টালে মতামত দেখছি। অনেকগুলা পয়েন্ট কাভার করেছিস। একটা ছোট্ট কারেকশন, [url=https://www.mdanderson.org/publications/focused-on-health/7-viruses-that...'s%20lymphoma.]কিছু জীবানু কিন্তু আছে যা ক্যান্সারের কারন[/url]।

মাসুদা ভাট্টির স্ট্যাটাস দেখলে মনে হবে উনি কি এমন করেছেন বুঝতে পারছেন না। মাসুদা ভাট্টি যখন বললেন, আপনার মারাত্মক রকম দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে, গবেষণাটি কি কোনো জার্নাল এ প্রকাশ পেয়েছে কি না! (যা কিনা রিপোর্টে লেখা ছিল উনি ঠিক মতন পড়েননি), কিন্তু পরে যখন জানলেন অত্যন্ত উঁচু মানের জার্নালে প্রকাশ আগেই হয়েছে, এই বিষয়ে কিন্তু উনার পোষ্টে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন। ঠিক মতন না জেনে একজনকে যে কিনা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসর, তাকে ‘মারাত্মক রকম দায়িত্বে অবহেলা হয়েছে’ এই ভুল কথাটি বলার জন্য পরবর্তিতে তার দুঃক্ষিত তো দূরের কথা, কোনো অনুশোচনাও দেখা গেলনা।

উনার পোস্টে উনি বললেন সাংবাদিক রীতি মেনে সব প্রশ্ন করেছেন, অথচ উপহাস করে কিন্তু উনি বলেছেন, নোবেল পুরষ্কারের মতন কাজ করেছেন আপনারা। পাশের ক্ষেতের ঝিঙ্গা নয় কেন, এই প্রশ্ন কে উনি নিরীহ দাবী করলেও, প্রশ্ন করার সময় তা স্পষ্টতই তীর্যক মূলক, উপহাস করে বলেছেন বলে মনে হয়েছে অধিকাংশের কাছে। রীতিমতন হুমকি দিয়ে বললেন, ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে! জানিনা এগুলা সাংবাদিক রীতিতে আছে কিনা, আমার ধারনা নেই।

এতবার বাঁধা দেয়ার পরেও এবং প্রশ্নকারীদের জ্ঞ্যানের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ড. জাকির কিন্তু একটু হলেও অন্তত মূল মেসেজটা উপস্থাপিকাকে বোঝাতে পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত।

সচল জাহিদ's picture

ধন্যবাদ তমাল মন্তব্যের জন্য।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

সজীব ওসমান's picture

কোন পেশাকে 'মহান পেশা' বলতে আসলে কী বোঝান?

সাবিহ ওমর's picture

মূলত বেতন কম এরকম পেশা। শিক্ষক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ইত্যাদি।

সচল জাহিদ's picture

আমার কাছে যে পেশাগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা বেশি সেগুলোই মহান পেশা।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

জিজ্ঞাসু's picture

সাংবাদিকতা বা অন্য কোন পেশা মহৎ কি না এমন প্রশ্ন আসছে কেন? মনে হচ্ছে পেশাদার যদি তার পেশাকে মহৎ মনে করেন তাহলে দায়িত্ব পালনে সচেতন হবেন; নচেৎ নয়। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান কি বলে? উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায় সেখানে একজন বারবার বা প্লামার হতে লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কেন? আমাদের সমাজে সাধারণত দেখি চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ে ডাক্তারী করছেন, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষকতা করছেন। উন্নত সমাজগুলোতে লাইসেন্স দরকার হয়। লাইসেন্স নেয়ার প্রকৃয়াতে তাহলে কী থাকে? থাকে পেশাদাবিত্ব, সমস্যা সমাধান এবং আইন। মহত্বতা, মহানুভবতা, বীরত্ব বা পরাক্রম ইত্যাদি তাদের মধ্যেও বিদ্যমান। কিন্তু লাইসেন্স দেয়ার সময় সেটা যাচাই করা হয় না। সেখানে যাচাই করা হয় আলোচ্য পেশায় কাজ করতে গিয়ে তাকে কি কি আইন মানতে হবে, এবং ন্যূনতম প্রায়োগিক জ্ঞান তার আছে কি না। এ ধরণের লাইসেন্স প্রদান এবং মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা পেশাদারিত্ব তৈরি করেন যার ফলে অনেক পেশাদার তাদের পেশাকে মহৎ করে তোলেন হোক সে জেনিটার বা ডাক্তার।

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

মেঘলা মানুষ 's picture

"কোথা থেকে ছাপানো?" "কোন দেশের?" --এইটুকু দেখার পর বাকিটা দেখার সাহস করি নাই।
তারা বের করার চেষ্টায় ছিলেন যেন এইটা কোন ক্যারিবিয়ান দেশের ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত নামকাওয়াস্তের কোন জার্নালে মুদ্রিত হয়েছে।

এই অনুষ্ঠান কেন মানুষ দেখে -সেটাই আমার অজানা।

তামান্না ঝুমু's picture

হায় হায়! আমি যে গতকাল দুই কেজি বেগুন কিনে এনে তাদের কিয়দাংশ ভক্ষণও ক'রে ফেলেছি! এখন আমার ও বাকি বেগুনদের কী দশা হবে?

তামান্না ঝুমু

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.