আঁকটোবরের শেষ গল্প: ফেরারী সীমান্ত

নীড় সন্ধানী's picture
Submitted by hrrh69 on Mon, 31/10/2022 - 1:11pm
Categories:

১.
জারিয়া ঝাঞ্জাইল নামে বাংলাদেশে কোন স্টেশন আছে জানা ছিল না মারুফের। প্ল্যাটফর্মে নামার পর স্টেশনের অদ্ভুত নামটা দেখলো সে। ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে ময়মনসিংহের ট্রেনে ওঠার সময় তাকে বলে দেয়া হয়েছিল ময়মনসিংহও তার জন্য নিরাপদ নয়। সে যেন ময়মনসিংহ নেমে শহরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা না করে জারিয়াগামী কোন একটা লোকাল ট্রেনে উঠে পড়ে। জারিয়া থেকে সড়কপথে দুর্গাপুর। দুর্গাপুর থেকে নদী পার হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করতে হবে। এই ছিল শওকতের বাতলে দেয়া পলায়নপথ। মারুফ জীবনে কোনদিন উত্তরবঙ্গে আসেনি। বাংলাদেশে তার গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত।

এখন এই অদ্ভুত সময়ে, অদ্ভুত একটা স্টেশনে নেমে সমস্ত শরীরের ক্লান্তি যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো তার শরীরে। এরকম জঘন্য ট্রেনে সে জীবনেও চড়েনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার বগিতে, অচেনা অজানা বিচিত্রসব লোকজনের ভিড়ের মধ্যে বসে গরমে তার শরীর চ্যাটচ্যাটে হয়ে আছে। ট্রেনটা এক ঘন্টা দেরী করে সাড়ে আটটার জায়গায় রাত সাড়ে নটায় ছেড়ে জারিয়া পৌঁছেছে রাত বারোটার দশ মিনিট আগে। বাংলাদেশের মানচিত্র সম্পর্কে তার কিছু কিছু ধারণা থাকলেও এদিকটা সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকার। দুদিন আগেও সে কী জানতো এমন একটা ঘটনায় তাকে প্রাণ বাঁচাতে এমন করে পালিয়ে আসতে হবে চিরচেনা ঢাকা শহরের নিরাপদ জীবনকে পেছনে ফেলে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে গেল। এটা যেন অনিবার্য ছিল। আত্মীয় পরিবার বন্ধুবান্ধব কেউ তাকে আশ্রয় দেবার সাহস করেনি। একমাত্র শওকতই সাহস করে এগিয়ে এসে তাকে গোপনে ময়মনসিংহের ট্রেনে তুলে দিল।

বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামের স্টেশনের মতো অবহেলিত, নোংরা আবর্জনায় ভরপুর একটা স্টেশন। স্টেশনে যারা নেমেছিল সবাই স্থানীয় লোকজন। যে যার গন্তব্যে চলে গেল। কিন্তু মারুফের গন্তব্য তো আরো দূরে। তাকে যেতে হবে দুর্গাপুর। জারিয়া থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার উপায় কী। এত রাতে তো কোন গাড়ি ঘোড়া নাই। কয়েকটা ব্যাটারী রিকশা ছিল সেগুলা নিয়ে চলে গেছে যাত্রীরা। প্ল্যাটফর্মে একটা চা বিস্কুটের দোকান খোলা আছে। মারুফ তার সামনে গিয়ে এক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। রুটি আর কলা কিনে খেতে শুরু করলো। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। সারাদিন উপোষ প্রায়। আর কোন খদ্দের নেই বলে দোকানী বন্ধ করার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। মারুফ তার কাছে জানতে চাইল, এখান থেকে দূর্গাপুর কতদূর। দোকানী জানালো, বারো চোদ্দ মাইল হবে। তবে এখন যাওয়ার উপায় নাই। সকালের আগে কিছু পাওয়া যাবে না। ডাকাতির ভয়ে পথে কোন গাড়ি চলে না রাতের বেলা।

তাহলে উপায়? মারুফের খাওয়া থেমে গেল। চেহারা দেখে কথাবার্তা শুনে দোকানী বুঝলো সে নতুন মানুষ। সে পরামর্শ দিল, রাতটা কষ্ট করে প্ল্যাটফর্মে কাটিয়ে দিতে। বাইরে যে কোন বিপদ ঘটতে পারে। এলাকাটা ভালো না। পরামর্শ দিয়ে দোকানী চা নাস্তার পয়সা নিয়ে দোকানের ঝাঁপ ফেলে চলে গেল।

মারুফ মনে মনে বললো, নামটা যেমন অদ্ভুত - জারিয়া ঝাঞ্জাইল - জায়গাটাও অদ্ভুত। এই দেশটাই যত্তসব গোলমেলে জায়গা। তার কাছে একটা ব্যাকপ্যাক ছাড়া আর কিছু নেই। মোবাইল ফেলে দিয়েছে দুদিন আগেই, যেদিন টের পেল মোবাইল ট্র্যাকিং করে তাকে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। পকেটে টাকাপয়সা খুব বেশী নেই। পাঁচ হাজারের সামান্য বেশী। তবে শওকত একটা ১০০ ডলারের নোট গুঁজে দিয়েছিল গত রাতে। সীমান্ত পার হবার পর লাগবে। এটা ছাড়া তার কাছে মূল্যবান সম্পদ বলতে আছে ওয়েস্টার হাতঘড়িটা। চোর ডাকাতের কবলে পড়লে এই সবই চলে যাবে। মারুফ ঠিক করলো রাতটা স্টেশনেই কাটিয়ে দেবে কোনমতে। এখানে অন্তত পুলিশের ভয় নেই আপাতত।

প্ল্যাটফর্মের পাকা বেঞ্চির একটা বেছে নিয়ে মাথায় ব্যাগটা দিয়ে শুয়ে পড়লো মারুফ। এরকম বেকায়দা জায়গায় জীবনে কখনো শোয়নি সে। ঘুমানোর জন্য বাসায় কত রকমের সুবন্দোবস্ত সেসব ভেবে বুকটা হু হু করে উঠলো না। ক্যাডার আর পুলিশের হাত এড়িয়ে প্রাণে বেঁচে আছে এখনো সেই বিষয়টাই আনন্দের। ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু শত শত মশা হামলে পড়েছে তার উপর। পায়ের দিকে সুবিধা করতে না পারলেও হাত এবং নাক মুখ দিয়ে হু হু করে সেঁদিয়ে যেতে চাইছে। সে চড়চাপড় দিয়ে তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কোন কাজ হলো না। সে তবু চোখে রুমাল চাপা দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকলো।

২.
চোখটা লেগে এসেছিল, অমনি হঠাৎ তার চুলের মুঠি ধরে কেউ হেঁচকা টান দিয়ে তুলে দিল কেউ। আচমকা ধাক্কা খেয়ে সে উঠে পড়লো। চোখের সামনে উস্কোখুশকো চুলের ময়লা দুর্গন্ধময় পোশাক পরা এক লোক কাঁধে ছালার বস্তা নিয়ে তার বেঞ্চের সামনে দাঁড়ানো। মারুফ ধাতস্থ হয়ে বুঝলো এটাও বাংলাদেশের অতি পরিচিত একটা দৃশ্য। কেন জানি দেশের প্রায় সব স্টেশনে একটা পাগল থাকে। পাগলরা হয়তো রাত্রিবাসের জন্য স্টেশনকে পছন্দ করে। পাগলের রাঙানো চোখ এবং পাকানো ঘুষি দুটো দেখেই মারুফ নিজের অপরাধটা বুঝতে পারলো। এই বেঞ্চিটা হয়তো পাগলটার রাত্রিবাসের স্থায়ী ঠিকানা। সে এখানে উটকো মেহমান। পাগলদের কাছে মেহমানের খাতির নেই। মারুফ ব্যাগটা নিয়ে সটকে পড়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু পাগলটা আবারো তার চুলের মুঠি চেপে ধরে হুকুম করলো- পালাবি কোথায়, আমি সব জানি, চুপ করে বস!

কে রে বাবা এই লোক?? সুস্থ লোকের মতো প্রমিত বাংলার উচ্চারণে কথা বলছে! পাগল সেজে পুলিশ নয় তো! সমস্ত শরীরে কাঁটা দিল। আশেপাশে আর কেউ নেই। সে আর পাগলটাই আছে এখানে। অচেনা জায়গায় অচেনা বিপদে পড়লো আবার। পাগল বিড়বিড় করে কী বলছে সে বুঝতে পারছে না। সে যতবারই উঠতে চেষ্টা করছে, শক্ত হাতে তাকে টেনে বসিয়ে দিচ্ছে।

বলছে- ‘পালাবি কোথায়? তোর সব খোঁজ নিয়েছি। দুর্গাপুর থানার দারোগা বসে আছে বাইরে’।

থানার কথা শুনে বুকের ভেতরটা সাঁৎ করে উঠলো মারুফের। ধরাটা এখানেই পড়তে হলো। তাকে ধরার জন্য এত গোয়েন্দা জাল পেতে রেখেছে পুলিশ। কে বলে বাংলাদেশের পুলিশ অক্ষম। ঢাকা ছেড়ে পালাবার বারো ঘন্টার মধ্যে ধরে ফেললো তাকে। প্রবল হতাশায় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে পুলিশ বাহিনী হাতকড়া নিয়ে এগিয়ে আসছে কিনা।

কিন্তু কোথাও কেউ নেই এই পাগল ছাড়া। পাগল খুব শক্ত ঠাণ্ডা হাতে তাকে ধরে রেখেছে। অন্য হাতে বস্তার ভেতরে হাত গলিয়ে বাসী পাউরুটির টুকরা বের করে আনলো। সেটা তার মুখের কাছে তুলে দিয়ে বললো, “হা কর বাপ! এটা খেয়ে ফেল গপ করে। বোতলের পানি আছে। পানি খাবি পেট ভরে। নদীর পানি খাবি না। বোতলের পানি খাবি। কংস নদীর পানিতে রাক্ষস আছে রাক্ষস।”

কী মুসিবতের কথা! কথাবার্তা শুনে পাগলই তো মনে হচ্ছে। মারুফ দ্বিধায় পড়ে গেল। সে ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যেতে পারে। শক্তিতে বুড়ো পারবে না। কিন্তু পালানোর বিপদ দুটো। সত্যি যদি আশেপাশে পুলিশ থাকে সে পালাতে গেলে পিছু তাড়া করবে, এমনকি গুলিও করতে পারে, যাকে বলে ক্রস ফায়ার।

দ্বিতীয়ত: পুলিশ না থাকলেও পালিয়ে কোথায় যাবে এই মধ্য রাতে? এই এলাকার কিছুই চেনে না। তাছাড়া এলাকাটা ডাকাতের জন্য প্রসিদ্ধ। বেঘোরে মারা পড়ার চেয়ে পাগলের অত্যাচার সয়ে যাওয়া ভালো হবে। সে লক্ষী ছেলের মতো বসে থাকলো। বাড়িয়ে দেয়া পাউরুটি হাতে নিয়ে দেখলো। এক গাদা ময়লা গিজগিজ করছে, কবেকার পাউরুটি কে জানে। সে তবু হেসে হেসে পাগলকে আশ্বাস দিল পাউরুটি খাবে। পানিও খাবে।

পাগল তার হাত ছেড়ে দিল এবার। কথা বলতে শুরু করলো আপনমনে। কিন্তু কোন শব্দই বোঝা যায় না। মারুফ পাউরুটির টুকরাটা কোথাও লুকোনো যায় কিনা ভাবছে। ভরসা পাচ্ছে না। পাগল চুলের মুঠি ধরে মার শুরু করতে পারে। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলো পাগলটা আসার পর মশা বাহিনী উধাও হয়ে গেছে। মশারাও পাগলের উৎপাত পছন্দ করে না? নাকি পাগলের গায়ের বিকট দুর্গন্ধে পালিয়েছে। ওটাই আপাতত সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। রাত কখন ভোর হবে, সে উঠে পালাবে, সেই চিন্তায় মারুফ কাহিল।

বেশ কিছুক্ষণ পর মারুফ দেখলো পাগলটা ঘুমে ঢুলছে। কথা বন্ধ করে মাথাটা ঝুঁকিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেছে লোকটা। মারুফ এবার উঠলো। না পালাবে না। বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়। অন্য বেঞ্চে গিয়ে সেও ঘুমানোর চেষ্টা করবে। চায়ের দোকানটার সামনে একটা পত্রিকার টুকরা পড়ে আছে। সে ওটা বিছিয়ে শুয়ে পড়লো মেঝেতে। মাথায় ব্যাগটা দিয়ে চোখ বন্ধ করলো।

ভোরের দিকে কুকুরের ঘেউ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। তড়াক করে উঠে বসলো। সব ঠিকঠাক আছে তো! ঢাকা শহর হলে এতক্ষণে হাওয়া হয়ে যেতো। হাতের ঘড়িটা, মাথার নীচের ব্যাগটা সব আছে। ওদিকে তাকিয়ে দেখলো, পাগলটা নেই। যাক বাবা, বাঁচা গেল। দিনের আলো ফুটছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। হাত পায়ে লাল হয়ে গেছে মশার কামড়ে। চুলকাতে চুলকাতে চামড়া ছড়ে যাবার দশা। পোয়াখানেক রক্ত গিলেছে রাতভর।

দুর্গাপুর যাওয়ার জন্য গাড়ির সন্ধানে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় চলে এলো। এখনো জনশূন্য পথ। রাস্তার পাশে একটা টং দোকান খুলেছে। সেখানে গিয়ে চা খেতে খেতে দুর্গাপুর যাবার গাড়ির ব্যাপারে খোঁজ নিল। গাড়ি আসতে দেরী আছে। ময়মনসিংহের বাস আসতে আসতে বেলা দশটা পার হবে। দোকানীর সাথে আলাপ করতে গিয়ে রাতের সেই পাগলের কথাটা তুললো।

দোকানী শুনে হাসলো। বললো - “আপনারেও পাইছিল? মইজ্জা পাগল। দশ বছর আগে তার ছেলে কংস নদীতে ডুবে মারা গেছিল। সেই থেকে সে বাইরে থেকে আসা তরুন যুবক পাইলে হামলে পড়ে। তারে নিজের হারানো ছেলে মনে করে। থানা পুলিশের ডর দেখায়। মইজ্জার ধারণা তার ছেলে মরেনি, কোথাও গিয়ে ভেসে উঠছে। ছেলেটার লাশ পাওয়া যায়নি। ভরা বর্ষার স্রোতে ভেসে চলে গিয়েছিল। ওই ছেলে বাদে আর কেউ ছিল না তার সংসারে। সেই থেকে মাথা নষ্ট লোকটার।”

মারুফ স্তব্ধ হয়ে যায় শুনে। বুকের ভেতর কেমন একটা কান্না দলা পাকিয়ে ওঠে। তার বাবা শৈশবে মারা গেছে। পিতৃস্নেহ সে কখনো পায়নি।

সেই দোকানে চা খাচ্ছিল এক ট্রাক ড্রাইভার। যে বালি ভর্তি ট্রাক নিয়ে দুর্গাপুর যাচ্ছে। সে প্রস্তাব দিল জরুরী হলে তার ট্রাকে করে দুর্গাপুর চলে যেতে পারে এখনি। তবে তাকে ১০০ টাকা দিতে হবে। মারুফ রাজী হলো।

চা শেষ করে ট্রাকে উঠে বসলো। যেতে যেতে ড্রাইভার জানতে চাইল সে কোন কাজে এসেছে ইত্যাদি। মারুফ শেখানো তোতাপাখির মতো বললো, বিরিশিরি দেখতে এসেছে, ওখানে চীনামাটির পাহাড় আছে, সবুজ লেক আছে, সেসব ঘুরে দেখতে এসেছে।

ড্রাইভার জানালো, “সেটা তো দুর্গাপুরে না বিজয়পুরে। বিজয়পুর যেতে হলে নদী পার হতে হবে। নদীতে খেয়া নৌকা আছে, পার হওয়া সহজ। অনেক লোকে দেখতে আসে। ঢাকার মানুষের খায়া কাজ নেই। কী আছে ওই মাটি আর এতটুক একটা পুকুরে।”

ড্রাইভারের কাছ থেকে এমন প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য পাওয়া গেল যেটার মূল্য লাখ টাকার বেশী। তার একটি হলো অনুপ সাংমার সন্ধান পাওয়া এবং তার গেস্ট হাউজে ৩০০ টাকায় রাত কাটানোর ব্যবস্থা করা। ড্রাইভারেরা খেপ মেরে রাত হয়ে গেলে মাঝে মাঝে ওখানে থাকে। যদিও কোনমতে রাত পার করা। মারুফের জন্য এখন সেরকম একটা ব্যবস্থা দরকার ছিল।

দুর্গাপুর আসার আগেই একটা বাজারমতন জায়গায় ট্রাক থামালো ড্রাইভার। টাকাটা হাতে নিয়ে ইঙ্গিতে দেখালো ওপাশে বিচিত্রা গেস্ট হাউজ। ওটাই অনুপ সাংমার ঠিকানা। সাইনবোর্ড দেখে বুঝলো জায়গাটার নাম উৎরাইল বাজার। এখান থেকে কয়েকশো গজ সামনে বাঁয়ে গেলে বিরিশিরি যাবার ফেরীঘাট। সোমেশ্বরী নদীর তীরে।

৩.
রাস্তায় নেমেই মারুফের চোখ কিছু একটা খুঁজতে শুরু করলো। এতক্ষণ চেপে রাখা একটা মুর্তিমান যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে হবে সবার আগে। তলপেট ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। অচেনা জায়গায় কোথায় কিভাবে ব্যবস্থা হবে। গেস্ট হাউজে ঢোকা অবধি সহ্য করা যাবে না।

ভাগ্য সহায় হলো। রাস্তার পাশেই একটা মসজিদ। তার পাশে অজুখানা এবং বাথরুম। সে প্রায় দৌড়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

বেরিয়ে আসার পর পৃথিবীটা অনেক সুন্দর মনে হলো তার। এই যে রাস্তার পাশে থিকথিকে কাদা, নর্দমায় জমে থাকা ময়লা, আগাছার জঙ্গল, চারকোনা হুডতোলা রিকশা, সবকিছুর মধ্যে আনন্দ ঝলমল করছে। আটকে থাকা কোন যন্ত্রণা কেটে গেলে মানুষ সুখটা ঠিকমত উপভোগ করতে পারে।

বিচিত্রা গেস্ট হাউজটা দেখতেও বিচিত্র। একপাশে টিনের চালার দশ ফুট বাই পনের ফুট সাইজের একটা ছাপড়া চায়ের দোকান। দোকানের সামনে ভগ্নপ্রায় টুলের উপর দুটো থালায় সিঙ্গারা আর ডালপুরি। পাশে লাকড়ির চুলার উপর লোহার কড়াই। তার পাশে একটা টুলের উপর চিনির বৈয়াম, দুধের কৌটা। টুলের নীচে লাকড়ির স্তুপ। এটা বিচিত্রা গেস্ট হাউজের রেস্তোঁরা হতে পারে।

রেস্তোরার পাশে একই মাপের ছোট্ট একতলা একটা দালান। সেটাই আবাসিক অংশ। দোতলাটি এখনো নির্মীয়মান, ছাদের ঠেকনা তৈরী করা হয়েছে বাঁশ দিয়ে। হোটেলের নামটা একটা প্লাস্টিক ব্যানারে লিখে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে বড় বড় করে মালিকের নাম- অনুম সাংমা। প্রবেশ পথের পাশে হাতলওয়ালা লম্বা কাঠের টুল। সম্ভবত ওয়েটিং এরিয়া। তার সামনে সবুজ তেরপলে ঢাকা একটা বন্ধ টং ঘর। প্রবেশ পথে দুই জোড়া স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল রাখা।

এরকম বিতিকিচ্ছিরি একটা হোটেলে কখনো থাকতে হবে জীবনেও ভাবেনি মারুফ। কিন্তু আজ উপায় নেই। অনুপ সাংমার সাথে দেখা হওয়া প্রয়োজন তার। অনুপ সাংমা হোটেলের মালিক বলে নয়। তিনি এই এলাকার সুপরিচিত ট্যুরিষ্ট গাইড, সেটাও কারণ নয়। মূল কারণ হলো সীমান্তের ওই পারে তার আত্মীয় স্বজন আছে। ট্রাক ড্রাইভারের কাছ থেকে পাওয়া এই তথ্যটা মারুফের জীবন রক্ষাকারী সুত্র হিসেবে কাজ করতে পারে।

কিন্তু অনুপ সাংমা হোটেলে নেই। তিনি গ্রামে গেছেন গতকাল। ফিরবেন কয়েকদিন পর। তিনি উপস্থিত না থাকলেও হোটেলে একটি ঘর পেতে সমস্যা হয় না। ঘরটিতে শুধু একটি নড়বড়ে তক্তপোষ আর দেয়ালে কয়েকটা হুক বাদে আর কোন আসবাব নাই। তিন ঘরের জন্য একটা কমন বাথরুম। খাতায় নাম তোলার সময় সে নাম বদলে বললো ‘জোসেফ হালদার’ এবং ঠিকানা লিখলো ৩৩ সদর রোড, কক্সবাজার। আদৌ সেই ঠিকানা আছে কিনা জানে না। বাড়তি সতর্কতা।

অনুপ সাংমার অনুপস্থিতিতে হোটেলের দায়িত্বে আছে তপু সাংমা নামে তার এক ভাতিজা। পাশের চা দোকানটা সেই চালায়। রাতের বেলা তপুর সাথে আলাপ হলো। কাকা ফিরতে দেরী করলেও সমস্যা নাই। সে নিজেই গাইড হিসেবে কাজ করতে পারে। এখানকার সবকিছু তার চেনা। সীমান্তের ওপাশেও যাতায়াত আছে তার। ভারত সীমান্তের ভেতর বাঘমারা বাজারে তার দিদির শ্বশুরবাড়ি। তথ্যগুলো আশা জাগানিয়া।

সন্ধ্যার সময় তপু জানতে চাইল জোসেফ খ্রিস্টান কিনা। সে মাথা নেড়ে সায় দিলে তপু জানালো তাদের গ্রামে একটা গীর্জা আছে। সেই গীর্জায় একজন ফাদার আছেন খুব ভালো মানুষ । গীর্জার পাশ দিয়ে একটা রাস্তা আছে যেটা গারো পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। সেই পথটা ভারী সুন্দর। সুসং দুর্গাপুরের রাজবাড়ি দেখতে গেলে একদিন ওদিকেও নিয়ে যাবে।

রাতটা নিরাপদেই কেটে গেল। পাশের হোটেলে খাওয়াটা মন্দ ছিল না।

পরদিন তপু তাকে বিরিশিরি নিয়ে গেল খেয়া নৌকায় সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে। চীনা মাটির পাহাড় আর সবুজ হ্রদের জল দেখে মুগ্ধ হলো সে। কী সুন্দর সুন্দর নিরিবিলি একটা জায়গা। সোমেশ্বরী নদীটা তো ছবির মতো সুন্দর। যদি পলাতক মানসিক অবস্থায় না থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই উপভোগ করলো। কিন্তু এখন তাকে উপভোগের ভাণ করতে হচ্ছে। তপু তাকে নিয়ে বিজয়পুর সীমান্তের কাছে জিরো পয়েন্টে গেল। তার আধমাইল পরেই তার বোনের বাড়ি। সোজা পথে যাবার উপায় নেই। কিন্তু বিকল্প রাস্তা আছে।

সেই বিকল্প রাস্তাটি কী, সেটা জানার আকুলতা চেপে রেখে তপুর সাথে হোটেলে ফিরে এলো।

পরদিন অনুপ সাংমা ফিরে এলেন হোটেলে। বয়স তাঁর চল্লিশের কোটায় হতে পারে। দশ বছর বেশীও হতে পারে। কিছু মানুষকে দেখে বয়স বোঝা কষ্টকর। চরিত্র অনুমান করা আরো কঠিন। প্রথম দর্শনে অনুপ সাংমাকে ভালো লাগল না। কারণ হতে পারে জোসেফকে দেখে তিনি কেমন একটা সরু চাহনি দিলেন। এ ধরণের লোকেরা সুবিধার হয় না। তপুর সাথে তার কোন মিলই নেই। যে ভরসায় মারুফ এই হোটেলে উঠেছিল সেটা দপ করে নিভে গেল তাকে দেখে। কিন্তু তপুর কাছে কোন একটা উপায় মিলতে পারে।

পরদিন সকালে বোঝা গেল তার অসন্তুষ্টির কারণটা। তপুকে গাইড হিসেবে নেয়াটা তিনি পছন্দ করেননি। তিনি এই কাজটার জন্য আলাদা চার্জ নেন। তপু সেটা নেয়নি। সে মারুফকে বিনা খরচে গাইড সার্ভিস দিয়েছে। তপুর উপর ঝাল মেটানোর জন্য তার দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলেছে।

যাবার সময় তপু একটা চিরকুট দিয়ে গেল জোসেফের হাতে। চিরকুটে একটা ঠিকানা- ‘মামা ভাগিনা স্টোর, দুর্গাপুর’।

চুপি চুপি বলে গেল দুপুরের পর যেন হোটেল ছেড়ে দিয়ে ওই ঠিকানায় চলে যায়। তপু অপেক্ষা করবে। সেখান থেকে তাদের গ্রামে নিয়ে যাবে জোসেফকে। গীর্জার ফাদার সুদ্রোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। জোসেফ ওখানে বিনা খরচে থাকতে পারবে এবং ঘুরতে পারবে। তপুকে খুব পছন্দ করে ফাদার। কাকার বকাঝকার শোধ নিতে তবু এই প্রস্তাব দিয়েছে সেটা বুঝতে বাকী নেই মারুফের। যেহেতু কাকার ভাবসাব মারুফের পছন্দ হয়নি, হোটেলও যা তা, তাই তপুর প্রস্তাবে সানন্দে রাজী হলো মারুফ।

দুপুরে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো মারুফ। বাজারের একটা হোটেলে ভাত মাছ খেয়ে নিল। তারপর হাঁটা শুরু করলো। আকাশ একটু মেঘলা। ছায়াশীতল বাতাসে হাঁটতে বেশ লাগছিল। দুর্গাপুর বাজার কাছেই। মাইলখানেকের পথ। নদীটা পার হয়ে অল্প কিছুদূর গেলেই পৌঁছে যাবে। সোজাসুজি পথ। পথের ডানদিকে বেশ বড় বড় প্রাচীন শিরীষ গাছ ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাটা বাঁধের মতো উঁচু হয়ে ব্রীজের দিকে চলে গেছে। রিকশা, সাইকেল আর ইজিবাইক ছাড়া আর কোন যানবাহন নেই। মাঝে মাঝে মালবাহী ট্রাক দেখা যায় একটা দুটো।

ব্রীজটা সরু, কিন্তু বেশ দীর্ঘ। সোমেশ্বরী ব্রিজ বলা হলেও আসলে সেতুটা শানেশ্বর নদীর উপর। নামেই নদী, জলের বদলে দুই দিকেই ধূ ধূ বালির চর দেখা যাচ্ছে। অতি ক্ষীণ জলধারা। নদীর মতো বিপুল জলরাশিপূর্ণ অবয়বের এমন চেহারা দেখলে বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে ওঠে। এতবড় শূন্যতা কোথায় লুকোবে? ভাবতে ভাবতে মারুফ নদী পেরিয়ে যায়। ব্রীজ থেকে অল্প কিছুদূর গিয়ে বাজারমত একটা জায়গা। সে মামা-ভাগিনা স্টোরের সাইনবোর্ড খুঁজতে থাকে।

কয়েকটা দোকান পেরিয়ে প্রায় ফসকে যেতে যেতে মামা-ভাগিনার দেখা মিললো। নেসলের বিশাল বিজ্ঞাপন বোর্ডের নীচে ছোট্ট করে মামা ভাগিনা স্টোর লেখা। দোকানটা বন্ধ। তপুকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। সত্যি আসবে তো ছেলেটা? যদি না আসে? হঠাৎ করে তপুর অনুপস্থিতিতে নিজেকে ভরসাহীন মনে হলো। অথচ ঢাকা থেকে এতদূরে একাই এসেছে। সাথে কেউ থাকবে তেমন কোন প্ল্যান ছিল না। রাস্তার উল্টোদিকে একটা যন্ত্রপাতি মেরামতের দোকান। তারপাশে একটা খালি দোকানঘরের পাকা চত্বরে একটা ছাগল মাথা নেড়ে কিছু একটা ভাবছে এবং একটা কুকুর নিশ্চিন্তে দুপুরের ভাতঘুম দিচ্ছে। মারুফ ঘড়ি দেখলো পৌঁনে তিনটা বাজে।

কিছুক্ষণ পরেই তপুকে আসতে দেখা গেল ব্রীজের দিক থেকে। তাহলে সে গ্রামে চলে যায়নি। এতক্ষণ ছিল কোথায় ছেলেটা? মারুফ একটু বিস্মিত। তপু কাছে এসে হাসতে হাসতে বললো, “চিন্তায় পড়ে গেছিলেন নাকি। একটা কাজ সেরে আসতে দেরী হয়ে গেল। কাকার ওখানে দোকান করবো না আর। নতুন জায়গায় কথা বলে আসলাম।”

৪.
ফাদার সুদ্রোকে প্রথম দর্শনে মনে হবে আফ্রিকা থেকে আগত কোন মিশনারী। মিশমিশে কালো ভদ্রলোকের চেহারার মধ্যে এমন একটা মায়াবী আলো, যাকে ভালো না লেগে উপায় নেই। তিনি এই অঞ্চলেরই মানুষ। এই গ্রামের অধিকাংশ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মালম্বী। তপু সাংমাও যে খ্রিস্টান সেটা ফান্দা গ্রামে আসার পর জানতে পারল মারুফ। গীর্জার পাশে ছোট্ট একটা বাড়ি, সেখানেই থাকেন ফাদার। সেই বাড়ির অতিথি কক্ষ আছে দুটো, তার একটিতে ঠাঁই হয়ে গেল মারুফের। নিজের মিথ্যে পরিচয় নিয়ে একটু অস্বস্তি হচ্ছে, তবু প্রাণের দায়ে সেটাকে মেনে নিতে হলো।

ফাদার সুদ্রোর হাতে মারুফকে অর্পন করে তপু তার বাড়িতে চলে গেল। পরদিন আসবে। এই বাড়িতে ফাদার সুদ্রো ছাড়া আরো একজন আছেন। তাঁর সাথে দেখা হলো রাতের খাবার সময়। মানায়ামা সাংমা ফাদার সুদ্রোর পালিতা কন্যা এবং এই গৃহের অভিবাবক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পিতা পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহীদ হন। খবরটা গ্রামে আসার পর তাঁর মাও স্বর্গবাসী হন। দেশ স্বাধীন হবার পর তার বাবার বন্ধু ফাদার সুদ্রো অনাথ শিশুটির লালন পালনের দায়িত্ব নেন। সময়মত বিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামীটা দশ বছর আগে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে নিঃসন্তান মানায়ামার দিন কাটে ফাদারের দেখাশোনা এবং ঈশ্বরের সেবা করে।

ফাদার সুদ্রোর বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে। তবু এখনো তাঁর ঋজু শরীর। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সদালাপী ফাদার অল্প সময়ে অনেক গল্প করে ফেললেন জোসেফকে পেয়ে। দুদিনের জন্য এমন একটা আশ্রয় পেয়ে মারুফ আপ্লুত। নিরিবিলি সুন্দর গ্রাম। বসবাসের জন্য আদর্শ। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের অনিশ্চিত ভূমিতে যাবার চেয়ে এখানে যদি ঠাঁই মিলে যেতো আরো কিছুদিনের জন্য। ভারতে পালিয়ে যাবার চিন্তাটা মাথার ভেতরেই জমা আছে এখনো। কাউকে বলেনি।

রাতে ঘুমোতে যাবার সময় উর্বর মস্তিষ্কে দ্বিতীয় মিথ্যার যোগানটা চলে আসলো। পরদিন সকালে চায়ের আসর শেষ করে ফাদারকে জানালো সে একজন প্রকৃতি পর্যবেক্ষক। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর জলবায়ুর পরিবর্তনের উপর গবেষণা করছে। কথাবার্তা শুনে মারুফের অনুমান হয়েছিল ফাদার একজন প্রকৃতিপ্রেমিক। অনুমান মিথ্যে ছিল না। মারুফের গবেষণার বিষয় শুনে তিনি প্রস্তাব দিলেন যতদিন খুশী্ এখানে থেকে মারুফ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে পারে। খুনের মামলার ফেরারী আসামী এখন প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ। মনে মনে হেসে দিল মারুফ।

গীর্জার পাশ দিয়ে একটা খাল বয়ে গেছে। গভীরতা খুব বেশী না। হেঁটে পার হওয়া যায়। সেই খাল বেয়ে মাইলখানেক উজানে গেলেই ভারত সীমান্ত। পরদিন সকালে তপু এসে তাকে নিয়ে গেল উত্তরদিকের পাহাড়ের কাছে। সীমান্তের ওইপারে সবগুলো পাহাড়। তাকিয়ে অদ্ভুত লাগলো মারুফের। দেশটার সীমানা যেন ভাগ করা হয়েছে পাহাড় আর সমভূমি দিয়ে। ছাত্রজীবনে মানচিত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করতো সে প্রায়ই। এই বিষয়টা তখন খেয়াল করেছিল। আজকে নিজের চোখে দেখতে পেল। বাংলাদেশের ভাগে যে কয়টা পাহাড় পড়েছে সেগুলোকে পাহাড় বলা যায় না। বড়জোর টিলা। চারদিকে সবুজ বৃক্ষরাজি। ভারতের পাহাড় থেকে নেমে এসেছে এই ছড়াটি। তপু সীমান্তের কাছে একটা জায়গায় গিয়ে পূর্বদিকের একটা রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো। সামনে একটা ধানক্ষেত, সেই ধানক্ষেতের ওইপাশে দুটো টিলার মধ্য দিয়ে জঙ্গলের ভেতরে চলে গেছে রাস্তাটা। তপু তাকে বললো এই পথ দিয়ে কোন পাহারা থাকে না। এটা দিয়ে সে অবাধে ভারতে আসা যাওয়া করে। ওদিকের পাহাড়গুলোতে যারা বাস করে সব তাদেরই গোত্রের। রাজনীতিবিদরা দেশের সীমানা ভাগ করে দিলেও আত্মাকে ভাগ করা যায়নি। সেই আত্মার টানে তাদেরকে সীমান্তের ওপারে ছুটে যেতে হয় মাঝে মাঝে। মারুফ এক মুহুর্তের জন্য তপুর দৃষ্টিতে দেশটাকে দেখার চেষ্টা করলো। ধাঁধাঁ লেগে গেল তার মাথায়।

ফিরে আসার সময় মারুফ হিসেবে মেলানোর চেষ্টা করছিল কোথায় নিরাপদ হবে। এখানে লুকিয়ে থাকা নাকি ওপারে চলে যাওয়া। ওপারে গেলে তাকে আশ্রয় দেবে তেমন কেউ নেই। বরং এদিকে যতটা সময় প্রকৃতি পর্যবেক্ষক হিসেবে ফাদার সুদ্রোর আশ্রয়ে কাটানো যায় সেটাই লাভজনক। মনে মনে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো মারুফ। তপুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠলো। দুদিনেই ছেলেটা মন জয় করে ফেলেছে তার। তেমনি জয় করেছে ফাদার সুদ্রো এবং মানায়ামা সাংমা। ঘর ছেড়ে এত দূরে এসে একটা পরিবার পেয়ে গেল সে। অথচ যেখানে তার স্থায়ী ঠিকানা, সেখানে কোন পরিবার নেই তার। এখন নতুন সম্ভাবনার একটা সুখের আশ্বাস বুকের ভেতর সুর তুলে বাজতে থাকে।

৫.
সেদিন রাতের খাবার পর্ব শেষ হবার পর ফাদার সুদ্রো এলেন জোসেফের ঘরে। মুখটা অস্বাভাবিক গম্ভীর। মারুফের বুকের ভেতর একটা অমঙ্গল আশংকা গুড়গুড় করে উঠলো। জানালেন, বাজারে আজ দুর্গাপুর থানার ওসির সাথে দেখা হয়েছিল। তিনি এক খুনের মামলার ফেরারী আসামীকে খুঁজছেন। ঢাকা থেকে পালিয়ে দুর্গাপুর এসেছে। দুদিন আগে সে বিচিত্রা গেস্ট হাউজে উঠেছিল বলে ছবি দেখে নিশ্চিত করেছে অনুপ সাংমা। তারপর কোথায় উধাও হয়ে গেছে সেটা অবশ্য জানাতে পারেনি। কিন্তু ফাদার সুদ্রো জানেন সেই আসামী এখন তারই আশ্রয়ে আছে। ওসির দেখানো ছবি দেখে নিশ্চিত হয়েছেন তার নাম মারুফ রায়হান। প্রকৃতি গবেষক এই গারো পাহাড়ের কোলে এসে বসে আছে। এই ব্যাপারে জোসেফের কিছু বলার আছে কিনা তা জানার ইচ্ছে তাঁর।

মারুফের মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। মাথা নীচু হয়ে গেছে তার। কিছু বলার থাকে না এরকম সময়ে। এমন জায়গায় এসে ধরা পড়বে কল্পনাতেও ছিল না। পালাবার উপায় নেই। পুলিশ নিশ্চয়ই সব জেনে গেছে। গ্রেফতার হওয়া সময়ের ব্যাপার। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে সমগ্র পরিকল্পনাটা নতুন করে সাজানোর কথা ভাবলো। অন্ধকার রাতে ছুটে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুলিশ তাড়া করলেও সে ছুটে বেরিয়ে যেতে পারবে যদি ইতিমধ্যে এলাকা ঘিরে না ফেলে। ফাদারের কথার জবাব দেবার চেয়ে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া জরুরী। খালের পাড় দিয়ে আধমাইল গেলেই সীমান্তের পথটা পাওয়া যাবে। সেখানে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়লেই ভারতের এলাকা। এখানকার পুলিশ ধরতে পারবে না। ভারতীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়লে অন্তত খুনের মামলা হবে না। সীমানা লংঘনের দণ্ড বড়জোর কয়েক মাসের জেল। তাতে সে রাজী। তাছাড়া, তপু…..যদি তপুর সাহায্য মেলে তাহলে ভারতেও আশ্রয় পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তপু কী সাহায্য করবে তার এই মিথ্যে পরিচয় জেনে। তপু জেনে গেলে কী ভাববে তাকে নিয়ে? সে একজন খুনী। পুলিশ যাকে খুঁজছে সে নিশ্চয়ই ঘৃণিত কোন অপরাধে জড়িত। তার খুনের সাথে কী মানবিকতা জড়িত ছিল সেটা কেউ দেখবে না। পুলিশের খাতায় যা লেখা আছে প্রথমত সেটাই বিশ্বাস করবে। মারুফের যা বলার সেটা শোনার সুযোগ হবে না কারো।

মারুফকে নিশ্চুপ দেখে ফাদার জানালেন, আজ রাতটা কাটিয়ে কাল সকালেই যেন মারুফ এখান থেকে চলে যায়। নিতান্ত মানবিক কারণে তিনি আজ রাতেই তাকে বের করে দিচ্ছেন না। বলেই তিনি চলে গেলেন।

কিন্তু মারুফ আর এক দণ্ডও এখানে থাকবে না। আজ রাতেই পালাতে হবে। আর কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। পথের নিশানা সে স্থির করে ফেলেছে। দরোজা বন্ধ করে সে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আস্তে করে বেরিয়ে যাবে।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে দরোজা খুলে পা টিপে টিপে বাইরে আসলো। চারদিক নিঝুম অন্ধকারে ঢাকা। একটানা ঝিঁঝি পোকা আর ব্যাঙের ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। এদিকে ইলেক্ট্রিসিটি সীমিত। সোলার পাওয়ারে চলে সবকিছু। গীর্জার বাইরে একটা বাতি জ্বলে সন্ধ্যার পর। রাত দশটায় সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়। বারান্দা পেরিয়ে বাইরের গেট খোলার জন্য হাত দিতেই খুব কাছের অন্ধকার জায়গা থেকে একটা নারীকন্ঠ শোনা গেল- একটু দাঁড়াও।

ফস করে দিয়াশলাই জ্বলে উঠতেই মারুফ দেখলো মানায়াম সাংমা। তিনি এত রাতে এখানে কী করছেন?

মারুফ যতটা চমকালো তার চেয়ে বেশী অবাক হলো।

মায়ানাম সাংমা বললেন- “আমি জানতাম তুমি আজ রাতেই পালাবে। কিন্তু জোসেফ, তোমাকে আমি প্রথম দেখাতে ছেলের মতো জেনেছি। আমি এখনো বিশ্বাস করি এখানে কোথাও ভুল হচ্ছে। এখন সেটা বলার সময় নয়। তুমি চলে যাবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এখন যেও না। ফাদার তোমার অমঙ্গল করবেন না। তিনি পুলিশকে বলেননি তোমার কথা। শুধু নিজের সুনামের কথা ভেবে তোমাকে চলে যেতে বলেছেন। ফাদার সুদ্রো একজন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, তিনি আমার বাবার মতো সরাসরি যুদ্ধ করেননি, কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন সীমান্তের ওপারে। পাকিস্তানীরা তাঁকেও মেরে ফেলার জন্য খুঁজেছিল। স্বাধীন হবার পর দেশে ফিরেছেন তিনি। আমি নিশ্চিত তুমি যদি সত্যি অপরাধী না হও তিনি সবচেয়ে বেশী সুখী হবেন। তিনি আমাকে খুব কষ্টের সাথে তাঁর বিশ্বাস নিহত হবার কথা বলেছেন আজ। তুমি কোথায় পালাবে আমি জানি না। কিন্তু আমার অনুরোধ যদি রাখো তাহলে তুমি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যাও আপাতত। পাশের খাল বেয়ে যে মাটির পথটা সীমান্তের দিকে গেছে, সেখানে হাতের বাঁয়ে একটা পথ চলে গেছে। সেই পথ বেয়ে যে গ্রাম, সেখানে পৌঁছালে পরিমল সাংমার খোঁজ কোরো, তিনি আমার মাসতুতো দাদা। আমার কথা বললে তোমাকে আশ্রয় দেবেন তিনি। তবে এত রাতে না গিয়ে ভোরের দিকে যাও। নইলে পথ খুঁজে পাবে না। আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে ঠিক সময়ে তুলে দেবো। পুলিশ তোমাকে ছুঁতে পারবে না।”

মারুফের চোখ ভিজে উঠলো। সে এমন মায়াময় কথা কবে শুনেছে ভুলেই গেছে। মাসীকে সবকথা খুলে বললে তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন। কিন্তু সেটা এখন নয়। যদি ফিরে আসতে পারে তখন। নতুন আরেকটা সূর্যোদয় দেখার আশ্বাস পেয়ে মারুফ ঘরের ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।


Comments

হিমু's picture

ঊনিশ বছর আগে জারিয়া ঝাঞ্জাইল টপকে বিরিশিরি-দুর্গাপুর-রাণীখং-বিজয়পুর বেড়িয়ে এসেছিলাম। রাণীখং মিশনের পেছনে একটা ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ ছিলো, তার উত্তরে সোমেশ্বরী (নাকি অন্য কোনো নদী?) অগভীর বিস্তৃত বালুভরা থই নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। সীমান্তের ওপারে পাহাড়গুলো রোদে-মেঘে নীল আর গাঢ় নীল দেখায় ওখান থেকে, নদীর আয়নায় অক্টোবরের আকাশভরা তুলোট মেঘ ভেসে বেড়ায়, বালুভরা তট সোনালি। সবচেয়ে বড় শান্তি, নিরালা। এখন জায়গাটা কেমন হয়ে গেছে, জানি না। অনাগত দিনের দেশঘুরেদের জন্যে যেন তেমনই সুন্দর থাকে।

সংযোজন: একটা ছবি জুড়ে দিলাম।

নীড় সন্ধানী's picture

বাংলাদেশের উত্তরে পুরো মেঘালয় সীমান্তটা আমার কাছে একটা আকর্ষণীয় এলাকা। ওই এলাকায় ঘুরতে যাবার স্বপ্ন অনেকদিনের। যাওয়া হচ্ছে না সময় সুযোগের অভাবে। যেতে না পারার আক্ষেপটা মিটিয়ে নেবার জন্য পরের মুখে ঝাল খেয়ে গল্পটা লিখে ফেলছি। যতদূর শুনেছি আপনি যে সময়ে গিয়েছেন সেই সময়ের সৌন্দর্য মোটামুটি অটুট আছে এখনো। উন্নয়ন খুব বেশি থাবা বাড়ায়নি ওদিকে।

উপযুক্ত একটা ছবি সংযোজন করে গল্পের সৌন্দর্য বর্ধিত করার জন্য সম্প্রদান কারকে ধন্যবাদ। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

সকাল সকাল কাজ ফেলে গল্প পড়তে বসলাম, এবং গল্প আমাকে উঠতে দিল না। এটাতো বড় গল্প বলে মনে হচ্ছে যার এমন পটভূমি আছে যেটা এখানে বলা হয়নি। যেটার এমন পরিণতি আছে যেটা লেখকের ভাবনায় আছে। পুরো গল্পটা হোক। এখানে বা আরও কয়েক পর্বে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী's picture

শুরু থেকেই গন্তব্যহীন একটা গল্প ছিল। একটা পথের গল্প লিখবো সেটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছুই স্থির ছিল না। গল্পটাকে স্রেফ ট্রেনে তুলে দিয়ে আমি ভাবলাম দেখি কোথা থেকে কোথায় পৌঁছানো যায়। বাহন বদলাতে বদলাতে গল্পটা শেষমেষ যেখানে পৌঁছালো সেখান থেকে আর কোথাও যাবার ছিল না। পরিণতির একটা সম্ভাবনাকে সীমান্ত টপকাতে দেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সেটা করতে গেলে নাগালের বাইরে চলে যায় কিনা, সেই ভয়ে আর আগাইনি। এখন আপনার পরামর্শ শুনে নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করছে। অপার কৃতজ্ঞতা থাকলো সময় নিয়ে দীর্ঘ গল্পটা পড়ার জন্য।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.