অভাজনের রামায়ণ: রাবণ ০২

মাহবুব লীলেন's picture
Submitted by leelen on Thu, 27/10/2022 - 8:30am
Categories:

- ও ব্যাডা নিজের গতরের মাপে একখান হরিণের মনোহর ছাল নিয়া বাইরা তো দেখি…

বিলপারের জনস্থানে পৌঁছায়া রাবণ যায় তাড়কাপুত্র মারিচের ঘরে। রাজায় ক্যান হরিণের চামড়া খোঁজে সেইটা বুঝায়া বলতে হয় না তারে। পশুর চামড়া পইরা পশুর ডাক দিয়া পশু ডাইকা শিকার একেবারে সাধারণ কৌশল…

বাইছা একটা শিঙেল মায়া হরিণের সোনালি চামড়া নিয়া মারিচ হাজির হইলে রথের লাগাম বাড়ায়া দিয়া রাবণ কয়- ল এইবার। দশরথের পোলারা যেইখানে থাকে সেইখানে নিয়া চল মোরে…

পাছায় পাজনের গুঁতা দিয়া খচ্চর চালু কইরা মারিচ রাবণের আগাগোড়া তাকায়- দেইখা তো মনে হয় না রাজা শিকারে যাইতে আছেন…
দাড়িতে হাত বুলায়া রাবণ কয়- শিকারেই যাই…
মারিচ কয়- অস্ত্রপাতিও তো কিছু দেখি না…
রাবণ কয়- খালি হাতিয়ারপাতিরেই কি অস্ত্র কয়? মাথার ঘিলুটা লগে আছে না?

এমন সাইজাগুইজা কেউ শিকারে যায় না। আবার অতগুলা বন ফালায়া শিকারের লাইগা রামের আশ্রমেও যাবার কথা না। কিন্তু রাজায় তাইলে হরিণের চামড়া আনতে কইল ক্যান?

রাজা খুব ভাবে আছে। সোজা উত্তর মিলবে না। কথা বাড়ানের লাইগা মারিচ কয়- বাইছা সেরা চামড়াটাই আনছি। চাইরটা ঠ্যাং আর শিংশুদ্ধা মাথাটাও যুইত করা আছে; পইরা বনে খাড়াইলে হরিণেও বুঝব না যে এইটা হরিণ না…
রাবণ কয়- ভালো করছস…
মারিচ কয়- কোন সময় কী করব যদি একটু বুঝায়া দিতেন…
রাবণ কয়- সময়ে সব বুঝবি। তয় রথটা আশ্রম থাইকা দূরে আড়ালে রাখবি যাতে কেউ টের না পায়…

আরেকবার রাবণের আগাগোড়া তাকায়া ফোকলা হাসে মারিচ- রাজার শিকার বুঝতে পারছি এখন। মাইয়াটা আসলেই সুন্দর…
রাবণ কয়- নিয়া চল। নিজের চোখেই দেখব…
মারিচ কয়- কিন্তু একেবারে খালি হাতে যাইতেছেন যে? দশরথের দুই পোলা কিন্তু পালা কইরা ওরে পাহারা দেয়…
রাবণ কয়- জানি তো…
মারিচ কয়- পোলা দুইটা কিন্তু তির চালায় রাজা। অনেক দূর থাইকা মারে…
রাবণ কয়- জানি তো…
মারিচ অস্থির হইয়া উঠে- খর আর দূষণ কিন্তু ওগো কাছেই ভিড়তে পারে নাই। দূরে থাকতেই মইরা গেছে…
রাবণ কয়- জানি তো…

হিসাব মিলাইতে পারে না মারিচ। দশরথের পোলা রাম ছোটকালেই তির দিয়া তার মা তাড়কারে মাইরা জমির দখল নিছে। মায়ের হত্যার শোধ নিতে গিয়া রাম-লক্ষ্মণের তিরের জ্বালায় ভাইগা জান বাঁচানো লাগছে তার। সে কয়- কিন্তু ওগো ঠেকাইবার মতো কিছু তো দেখতেছি না রাজা…
রাবণ কয়- আছে তো। তুই আছস না?

মারিচ থতমতো খায়- আমি কিন্তু রাজা কোনো হাতিয়ারপাতি লগে আনি নাই…
রাবণ কয়- হাতিয়ার দিয়া কী হবে? হাতিয়ার নিয়া তো একবার ওগোরে মারতে গিয়া প্যাদানি খাইছস। এইবার দেখি ছালা দিয়া কিছু করতে পারস কি না…
মারিচ কয়- চামড়াটা কিন্তু পাতলা রাজা; তির মারলে ঢুইকা যাবে…
রাবণ কয়- তির খাবি ক্যান? হরিণ মনে কইরা তির ধনুক নিয়া তোর পিছে জঙ্গলে চক্কর খাবে তারা। সেই ফাঁকে আমি গিয়া বৌটার লগে দুইখান মিঠা কথা কব…
মারিচ হাসে- তোমার চিন্তা প্রায় বুইঝা ফেলছি রাজা। তয় একটা ল্যাঞ্জা বাকি আছে…
রাবণ কয়- জিগা…
মারিচ কয়- পোলা দুইটা কিন্তু একলগে শিকারে যায় না। একজন বাইরে গেলে আরেকজন থাকে ঘরে। দুইটারে একলগে কেমনে পিছে পিছে নিব?
রাবণ কয়- শুনছি তারা একটা নাকি আরেকটার বিপদে বুক পাইতা খাড়ায়। কথা কি ঠিক?
মারিচ কয়- হ হ। একেবারে ঠিক…
রাবণ কয়- তাইলে আর কী সমস্যা? একটা বনের ভিত্রে বিপদে পইড়া চিক্কুর দিলে আরেকটা দৌড়ায়া ঢুকবে বনে…

মারিচ মাথা চুলকায়- কিন্তু রাজা পয়লাটা বনে গিয়া চিক্কুর দিব ক্যান?
- ক্যান আবার? বিপদে পইড়া…
- কিন্তু বিপদে পড়ব কেমনে?
- ক্যামনে আবার? তুই বিপদে ফালাবি…

মারিচ নাতাবুতা হারায়া ফেলে- আগেই কইছি রাজা। আমি কোনো অস্ত্রপাতি আনি নাই। আর ওগো যেকোনোটারে চাইপা কাবু করাও কিন্তু কঠিন; শক্তপোক্ত মানুষ…
রাবণ কয়- মনে হইতেছে দশরথের পোলাগো তুই ডরাস…

মারিচ ঝাঁকি দিয়া উঠে- বনুয়ারে ডরের খোঁটা দিও না রাবণ। কুলাইতে না পাইরা ভাগছি মানে এই না যে আমি ওগোরে ডরাই। আমি খর-দূষণের মতো হুদাকামে মরতে রাজি না। আমার মরণটা যেন কোনো না কোনো কামে লাগে; সেইটা হইল কথা…
রাবণ কয়- খ্যাপস ক্যা? তোরে একটু খোঁচাইলাম। তোর সাহসের অভাব নাই বইলাই তো খালিহাতে তোর ভরসায় যাইতে আছি…
মারিচ কয়- সারা জীবন হাতিয়ারপাতি দিয়া মাইরদাঙ্গা করছি; এই পয়লাবার ছালা নিয়া যাইতেছি যুদ্ধে। বুদ্ধিতে কুলায় না বইলা তোমারে একটু বেশি বেশি জিগাই। রাগ নিও না রাজা…
রাবণ কয়- পশুর ছাল দিয়া তুই পশুশিকার কেমনে করস?
মারিচ কয়- চামড়া পইরা পশু সাইজা ভুলকিভালকি দেই আর পশুর গলা নকল কইরা পশুরে কাছে ডাকি। এই তো…
রাবণ কয়- খালি পশুর গলাই নকল করস; মানুষের গলা নকল করতে পারস না?
মারিচ কয়- এরে রাজা। গুরুগৃহে তুমি কলাবিদ্যা শিখছ বইলা তোমারে কয় নটরাজ। আর নিজের বুদ্ধিতে অভিনয় করি বইলা মাইনসে আমারে কয় ভাঁড়; সেইটা না হয় ঠিকাছে। কিন্তু আমার অভিনয় তো নিজেও দেখছ তুমি। তোমার গলা নকল কইরা তোমার বৌরে পর্যন্ত ঘাবড়াইছি না?
রাবণ কয়- তোরে কিন্তু আইজ লগে নিতাছি অভিনয়ের কামে। দশরথের পোলাগো গলা নকল করতে পারবি না?
মারিচ কয়- এখনই কইরা দেখাইতেছি। বড়োটার গলা একটু চিকন; আর ছোটটার গলা ভাঙা ভাঙা মোটা…
রাবণ জিগায়- দুইটার কেডা কারে কী বইলা ডাকে জানস?
মারিচ কয়- জানি তো…
রাবণ কয়- একটারে তোর পিছে পিছে পাহাড়ে নিয়া যাবার পর ওইটার গলা নকল কইরা অন্যটার নাম ধইরা দিবি একখান মরণ চিক্কুর। সেইটা শুইনা ঘরেরটাও দৌড়ায়া ঢুকব বনে…

মারিচ হাসে- অভিনয়রেও দেখি রাজায় আইজ যুদ্ধকলা বানাবে। ধন্য দশানন। কিন্তু রাজা; ওই দুই পোলারে কিছু করবা না? খর-দূষণের রক্ত এখনো শুকায় নাই…
রাবণ কয়- খর দূষণ বেটা মাইনসের মতো লড়াই দিয়া মরছে। ভাই দুইটা মরায় দুঃখ পাইলেও অভিযোগও নাই। কিন্তু দশরথের পোলা যে জমির লাইগা তোর বিধবা মায়েরে তির দিয়া মারল; আমার লগে শত্রুতা করতে শূর্পণখার নাককান কাইটা দিলো; সেইগুলার লাইগা প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তার…

রাবণের পায়ে হাত ঠেকায় মারিচ- বাইচা ফিরব কি না জানি না। তয় লঙ্কেশ্বর; ওই পোলার শাস্তির কী বিধান তা জাইনা মরতে চাই…
রাবণ কয়- তার শাস্তি হইল কান্দন আর অশান্তি। মাইয়া মানুষের মতো বনে বনে কানব হালায়। আর যতদিন বাঁচব; এক রাত্তিরের লাইগাও শান্তিতে ঘুমাইতে পারব না হুমুন্দির পুত…

খচ্চর দাবড়ায়া মারিচ গিয়া আশ্রমের কাছে আড়ালে খাড়ায়- আইজ মরলেও দুঃখ নাই। মরার আগে দশরথের পোলার দুর্গতি শুরু কইরা যাব…

মারিচরে জড়ায়া ধরে রাবণ- তোর মায়ের আত্মা শান্তি পাবে। শূর্পণখার অপমান প্রশমিত হবে। আর তোর মায়ামৃগের কথা যুগ যুগ ধইরা গাইবে কবিগণ…

আসমানে ছালা উঁচায়া পেন্নাম ঠোকে তাড়কাপুত্র মারিচ- ওম নমঃ শিবায়। আইজ শুরু হবে খেলা…
………………………………..
অভাজনের রামায়ণ: রাবণ ০১


Comments

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

অ্যাকশন শুরু হলো তাহলে! কাহিনীর হরিণ, হনুমান/বানর, ভালুক, শকুন ইত্যাদিকে রূপক ধরলেও বনে এগুলোর উপস্থিতি আবশ্যক, নয়তো এগুলো রূপক হিসাবে আসতো না। এসব পশুপাখি থাকলে সেই বনটা বিষুবীয় বা ক্রান্তীয় বন হবার সম্ভাবনা বেশি। গাছপালাগুলোর নাম জানতে পারলে আরেকটু নিশ্চিত হওয়া যেত। সোম গাছ, সোম লতা, ভূর্জ ইত্যাদিতে বোঝা যাচ্ছে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন's picture

বন নিয়া ঝামেলায় আছি।যেইসব বনের বিবরণ আছে তাতে বাংঘ সিংহের মতো মাংস খাদকের বিবরণ নাই।এতে অত অত হরিণের উপস্থিতি নিয়া সন্দেহ হয়। আবার ঋষিরা হরিণ পোষেন; তাতেও সন্দেহ বাড়ে আদৌ অত হরিণ আছিল কি না। তাছাড়া সীতা হরিণটা দেইখা পুষতে চায়। হইলে হইতে পারে হরিণগুলা মূলত অন্য কোথাও থাইকা নিয়া আসা গোষ্ঠীস্মৃতি
০২
হনুমান যেইসব ফল খায় সেইগুলা বাগানের ফল। বুনো ফলের বিবরণ নাই

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.