নববর্ষের ভোরে, জিব্রানের দ্বারেঃ সুখের প্রতিমাণ

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Sat, 22/02/2020 - 9:23am
Categories:

প্রস্তাবনাঃ

কাহলিল জিব্রান। কবি, চিত্রকর, দার্শনিক এবং কারো কারো কাছে মরমিয়া দ্রষ্টা।

জন্ম তাঁর লেবাননে ১৮৮৩ সালে, আর প্রয়াণ ১৯৩১ সালে। মাত্র ৪৮ বছরের আয়ুকে তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে পরমায়ু করে তুলেছেন। অন্তরকে সমৃদ্ধ করার নীরব সাধনা প্রতিভাত হয়েছে সৃষ্টিশীলতা বিকাশের নানা মাধ্যমে। তা না করলে আমরা বঞ্চিত হতাম তাঁর অসাধারণ সব কাজ থেকে। তাই বলা যেতে পারে যে, এইসব কাজ তিনি শুধু নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করার জন্যে করেননি, পুরো মানবজাতির জন্যেই করেছেন। সশ্রম সাধনায় মানবজমিন চাষ করে তিনি তুলে এনেছেন সোনার সব ফসল। দ্য ম্যাডম্যান (১৯১৮), দ্য প্রফেট (১৯২৩) বা দ্য আর্থ গডস (১৯৩১) এর পাতায় পাতায় উজ্জ্বল শব্দমালায় আর চিত্রকর্মের সৌষ্ঠবে সেসব মণিমুক্তা ছড়ানো। তাই জীবনে, এবং মৃত্যুতেও তিনি পৃথিবীজুড়ে রেখে গেছেন অগণিত মুগ্ধ পাঠক।

শান্তি, বিশ্বভ্রতৃত্ব বা পরিবেশ ইত্যাদি বিষয় বিশেষজ্ঞ মহল হয়ে সাধারণ-মানসে আসার বহু আগেই জিব্রান নিজস্ব সজ্ঞায় তাদের গুরুত্ব বুঝে গিয়েছিলেন। তিনি এসব বিষয়ে যা বলেছেন সেসবের পুরোটাই তাঁর গভীর ও মরমিয়া জীবনবোধ থেকে উৎসারিত। সাধারণভাবে বলতে গেলে স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলে গেছেন কোমল শব্দচয়নে। সে ভাষার মাধুরী অপরূপ, তার সুষমা অনুপম। অনুবাদকের আজকের প্রচেষ্টা সেই সৌন্দর্যের প্রতি কোন সুবিচারই করতে পারেনি। কিন্তু ভালোবাসার কাছে সে অসহায়। তাই এই অযোগ্যের অক্ষম বয়ানে ভালোবাসাটুকু প্রকাশ করে যাওয়া।

জিব্রান কথা বলেন প্রাচীনতার আবহে, যেন তা কোন মহাকালের কন্ঠস্বর। সুমধুর রহস্যে মোড়া সে ভাষা ধ্বনিত হচ্ছে আজকের মরমী মনে আর তা প্রতিধ্বনিত হবে আগামীর অনাগত হৃদয়েও। দ্য প্যাটার্ন অব হ্যাপিনেস [অনুবাদে, ‘সুখের প্রতিমাণ’] মূলতঃ জীবনের গভীর বিষয়াদিতে জিব্রানের উপলব্ধির সংকলন। গ্রন্থনার কাজটি করেছেন বেন ডব্লিউ. হুইটলি। আর প্রকাশ করেছে হলমার্ক কার্ডস ইনকর্পোরেশন, ১৯৭১ সালে। কথাগুলো মানবাত্মাকে আশায় উজ্জীবিত করে, আর সচেতন হৃদয়কে প্রাণিত করে পরমানন্দে। জিব্রানের নিজের ভাষ্যে এই শব্দাবলীর স্থান, “দৃশ্যমান জগতের ঊর্ধ্বে”। জিব্রানের মহত্ত্ব আর জিব্রানের পাঠকের সহৃদয়তার কাছে প্রশ্রয় কামনা করে, আজকের নিবেদন।

১.
মনুষ্যসৃষ্ট কোন ভূষণই, নব-পরিণীতার ন্যায় এই পৃথিবীর কমনীয়তা বাড়াতে পারে না; বরং তা পূর্ণতা পায় শষ্যক্ষেত্রের সবুজ শ্যামলিমায়, সৈকতের সোনালী বালুকারাজিতে, এবং পর্বতমালার বহুমূল্য প্রস্তরশোভায়।

২.
মানবতা এক দীপ্যমান নদী যা পর্বতমালার নিগুঢ় রহস্য সঙ্গীতমুখরতায় বয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রের হৃদয়ে।

৩.
ঋতু পরিবর্তনের সাথে আমরা নিজেদের বদলাতে পারি, কিন্তু ঋতু (স্বয়ং) আমাদের বদলাতে পারে না।

৪.
ন্যায়পরায়ণেরা জনগণের হৃদয়ের কাছে থাকেন, কিন্তু ক্ষমাশীলগণ থাকেন স্রষ্টার হৃদয়ের কাছে।

৫.
আমার চিন্তাধারা নবীন বৃক্ষপত্রের মতোই সব দিশায় দোলে এবং এই দোলাতেই তার আনন্দ।

৬.
গুহামধ্যে বেড়ে ওঠা বৃক্ষ ফলবতী হয় না।

৭.
নিঃসঙ্গতার সমুদ্রে জীবন এক দ্বীপের ন্যায়, আশা তার প্রস্তরভিত্তি, স্বপ্ন তার বৃক্ষ, আর নির্জনতা ফুলস্বরূপ।

৮.
সমস্ত পৃথিবী আমার জন্মভূমি আর সমগ্র মানবজাতি আমার ভ্রাতৃপ্রতিম।

৯.
বিহ্বলতা জ্ঞানের সূচক।

১০.
সমুদ্রের গানের পরিসমাপ্তি কি সৈকতে, নাকি নিবিষ্ট শ্রোতার হৃদয়ে?

১১.
অনন্তকালের কিতাবে আগামীকাল কখনো কোন গোপনীয়তা রাখে না।

১২.
এখন আমি উপলব্ধি করিঃ কোনরূপ প্রশংসার প্রত্যাশা ছাড়াই বসন্তে বৃক্ষসমূহ পুষ্পিত হয় আর গ্রীষ্মে হয় ফলবতী, এবং কোনরূপ দোষারোপের আশংকা ছাড়াই শরতে হয় পর্ণমোচী আর শীতে পুরোপুরি নিরাভরণ।

১৩.
যা আত্মাকে আকৃষ্ট করে, এবং যা নিতে নয় বরং দিতে ভালোবাসে, তা-ই প্রকৃত সৌন্দর্য।

১৪.
অসীম সমুদ্রসমূহের রহস্য ঘনীভূত আছে জলের একটি বিন্দুতে।

১৫.
যে দুঃখ অনুধ্যান করেনি সে আনন্দ খুঁজে পায় না।

১৬.
মানবাত্মার গভীরে আছে এক শব্দহীন সঙ্গীত।

১৭.
সঙ্গীত আত্মার ভাষা যা জীবনের রহস্য উন্মোচন করে, প্রশান্তি আনে, আর বিবাদ দূর করে।

১৮.
আমাদের চেহারা, বচন, বা কাজ কোনটাই আমাদের নিজস্ব ‘সত্তা’র চেয়ে বড় নয়। কারণ আত্মা তার বাসস্থান, চোখ জানালা, আর বচন দূতমাত্র।

১৯.
ঝঞ্ঝামুখরতার মাঝে নদীর সমাহিত স্তবগান, আমাদের মধ্যে কে শুনতে পায়?

২০.
আত্মার তূরীয় আনন্দ তাদেরই জন্যে যারা তা প্রকৃতির হৃদয়ে খোঁজে।

২১.
স্রষ্টা আমাদের আত্মায় দু’টি ডানা দিয়েছেন, যা দিয়ে আমরা সমমর্মিতা আর স্বাধীনতার অনন্ত অম্বরে উড়ে বেড়াতে পারি।

স্বরূপ-সন্ধানী
---------------------------------------
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালো
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো।


Comments

এক লহমা's picture

বা:! অনুবাদ ভালো লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক's picture

অনুবাদ ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগলো।

সচলায়তনে এটাই আমার পূর্ণাঙ্গ লেখার প্রচেষ্টা। জিব্রানকে ভালো লাগে বললে কম বলা হয়। ভিন্ন ভাষার শব্দের শরীরে অন্য ভাষার গভীর অনুভূতি তুলে আনা আসলেই কঠিন। কতটুকু পেরেছি জানিনা। আপনাদের প্রশ্রয় পেলে এভাবে জ্বালাবো। নয়তো আগের মতো, নিরব পাঠক হয়ে যাবো।

কৃতজ্ঞতা জানবেন আবারো।

স্বরূপ-সন্ধানী
-------------------------------------------
অন্ধকারে সব-চেয়ে সে-শরণ ভালো
যে-প্রেম জ্ঞানের থেকে পেয়েছে গভীরভাবে আলো

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.