লেখকের কথা, দ্য অ্যালকেমিস্ট

অতিথি লেখক's picture
Submitted by guest_writer on Fri, 09/08/2019 - 3:17pm
Categories:

চিঠিটা পেয়েছিলাম আমেরিকান প্রকাশনা সংস্থা হারপারকলিন্স থেকে, সেখানে বলা হয়েছিল, “দ্য অ্যালকেমিস্ট পড়ে মনে হয়, ভোরে ঘুম থেকে উঠে সূর্যের আবির্ভাব দেখা যাচ্ছে, অথচ বাকি পৃথিবী তখনও ঘুমিয়ে।” বাইরে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালাম, নিজের মনেই ভাবলাম, “বইটা তাহলে অনুবাদ হতে যাচ্ছে!”
তখন এমন একটা সময় যখন সবাই বলছিল- সম্ভব না; তবুও নিজেকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি যুদ্ধ করছিলাম, আমার নিজের পথ ধরে এগোতে চাচ্ছিলাম।

আর তারপর খুব ধীরে সন্তর্পনে আমার স্বপ্নটা সত্যি হয়ে উঠতে লাগল। বইটার দশ, একশ, হাজার, মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল আমেরিকায়। একদিন এক ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক ফোন করে জানালো, প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন সেই বই পড়ছেন এমন একটা ছবিও নাকি তোলা হয়েছে। তার কিছুদিন পর, তখন আমি তুরস্কে, ভ্যানিটি ফেয়ার পত্রিকা খুলে বসতেই দেখি জুলিয়া রবার্টস ঘোষনা দিয়েছেন বইটা তার খুব ভালো লেগেছে। একদিন একা একা মায়ামির রাস্তায় হাঁটছি, শুনলাম এক মেয়ে ওর মা’কে বলছে, “তোমার অবশ্যই দ্য অ্যালকেমিস্ট পড়া দরকার!”

বইটা ৭৪ টা ভাষায় অনুদিত হয়েছে, সারা পৃথিবীতে ৬৫ মিলিয়নেরও বেশী কপি বিক্রি হয়েছে আর লোকে জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছে, “এইযে এত সফলতা, এর রহস্য কি?” সত্যি কথা বলতে কি, কারনটা আমার জানা নেই। তবে যতটুকু জানি, তাতে একথা অন্তত বলতে পারি, মেষপালক সান্টিয়াগোর মত সবারই উচিৎ নিজের মনের ডাকটা শুনতে পাওয়া। মনের ডাক কি জিনিস? অবশ্য মনের ডাকও বলা যায়, আবার ঐশ্বরিক আশীর্বাদও বলা যায়। পৃথিবীতে একজনের জন্যে তৈরী করে রাখা পথ, যে পথ ধরে তার যাবার কথা। আমাদের সবারই ভাললাগার কোনোনা কোনো কাজ থাকে। আর সে কাজ যদি মনের কানায় কানায় অপার্থিব শান্তির পূর্নতা এনে দেয়, তবে আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। কিন্তু নিজের সেই সুপ্ত স্বপ্নের মুখোমুখি হবার সাহস আমাদের সবার থাকেনা। কেন?

চারটা বাঁধা আছে! প্রথম বাঁধাটা হলো, একটা ধারণা। ছোটবেলায় মনে হতো যা চাই তাই হতে পারব। কিন্তু যতই একটু করে বড় হতে থাকলাম ততই জানতে পারলাম- সেটা সম্ভব না। এই ধারনাকেই সাথী করে আরো বড় হই, আর যত দিন যায়, ততই সেই সংস্কার, ভয় আর আত্মগ্লানির পরত বাড়তে থাকে। ততদিনে সেই ডাক আত্মার এত অতলান্তে মিলিয়ে যায় যে তার ধ্বনি আর শুনতে পাইনা। কিন্তু তারপরও সেটা কোনো এক গোপন কুঠুরিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, বসেই থাকে।

আবার যদি নিজের স্বপ্নটাকে আবিষ্কার করে উঠতেও পারি, তখন বাঁধ সাধে দ্বিতীয় এক বিপত্তিঃ ভালবাসা। জানি, বুঝি, কি করতে চাই, তবু ভয় হয়, সব ছেড়েছুড়ে স্বপ্ন পূরণে মত্ত হলে ভালবাসার মানুষেরা পাছে কষ্ট পায়! বুঝিনা যে ভালবাসা কেবল একটা প্রেরণারই নাম, সামনে এগোতে তা বাঁধতো সাধবেইনা বরং সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রিয়জনের মানসিক প্রশান্তি চায়, চায় জীবন-পথের সে যাত্রায় সঙ্গী হতে।

তারপর যখন ভালবাসাকে অনুপ্রেরণা ভাবতে শুরু করি, ততদিনে তৃতীয় আরেক বাঁধা এসে খুঁটি গাড়ে; জীবনযাত্রাপথে পরাজয়ের মুখোমুখি হবার ভয়। স্বপ্নজয়ের জন্য যে মানুষ তিলে তিলে সংগ্রাম করল, স্বপ্নধসের যাতনাতো তারই সবথেকে বেশী হবে, কারণ “আমি এটা এমনিতেও চাইনি,” “আমার এটা এমনিতেও হতোনা” এসব চিরচেনা ছুতো আগলাতে আর মন চায়না। অবশ্যই চেয়েছি, সেকথা যেমন মানি, তেমন জানি সে কাজ করতে কত কাঠখড় পুড়েছে; জানি, মনের ডাকে সাড়া দিয়ে পথ চলা চাট্টিখানি কথা না। শুধু একটা কথা জানিনা; স্বপ্নের সে যাত্রাপথে আছে অখন্ড একচেটিয়া এক হৃদয়। তাই আলোর পথের যোদ্ধা বলেই দুঃসময়ে মনোবল ধরে রাখার জন্যে প্রস্তুত হয়ে, বুঝতে হবে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড আমাদের হয়ে কাজ করে চলেছে, অনেকটা অগোচরেই, হয়তো জানিইনা ~ কিভাবে।

নিজেকেই জিজ্ঞেস করিঃ পরাজয় গুলো কি এতোই জরুরী? জরুরী হোক বা না হোক, বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যর্থতাতো আসতেই পারে। স্বপ্ন যুদ্ধে, অভিজ্ঞতার ঝুলি খালি ছিল বলে প্রথম প্রথম অনেক ভুল করতেই পারি। কিন্তু তারপরও, সাতবার পড়ে আটবার উঠে দাঁড়ানোতেই জীবন নিহিত রেখেছে তার রহস্য।

অন্যদের চেয়ে যদি এত বেশী ত্যাগ তিতিক্ষা আর জালা যন্ত্রনার বেড়াজালে জড়াতেই হয় তাহলে কি এমন দরকার পড়েছে মনের ডাকে সাড়া দেয়ার? কারন, যখন একবার পরাজয় কে উৎরে উঠি (আর সবার ক্ষেত্রে সেটাই হয়)- তখন হৃদয় ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে উন্মত্ত অনাবিল আনন্দ, আত্মবিশ্বাসের উল্লাস। মনে মনে এটুকু বুঝি বিস্ময়কর এই জীবন সাগরে অবগাহনের সুযোগ্যতাটুকু অন্তত হয়েছে। সময়ঘড়ির প্রতি দিন বা মুহূর্ত জীবনযুদ্ধেরই অংশ। আর তখন নতুন উদ্যম আর প্রশান্তির প্রলেপ মেখে উঁকি দেয় নিয়ত বেঁচে থাকার আনন্দ। যন্ত্রনাতো থাকেই জীবনে। কিন্তু যন্ত্রনার যতটুকু অসহনীয়, অপ্রত্যাশিত তার সবটাই কোনো এক ক্ষিপ্রতা নিয়ে মিলিয়ে যায় ধরিত্রী গর্ভে, ফেলে যায় তার ঠিক ততটুকু রেশ যতটা বইতে পারা যায়; আর অজান্তেই মন জুড়ে সেই অনুভবের আবিষ্টতা ছেয়ে থাকে, কুরেকুরে খায় আত্মার অন্তর্গলি ততকাল, যতকাল পেরোলে আর কোনোভাবেই সেই বিষাদের ছত্রছায়া থেকে মুক্তি নেবার অবকাশ থাকেনা, আর তারপর, সেই অবশিষ্ট বেদনার আবেশ জীবনের অংশ হয়ে জুড়ে থাকে বাকিটা সময়।

স্বপ্ন খুঁড়ে বের করে, ভালোবাসার সমস্ত প্রভাব খাটিয়ে পেলে-পুষে স্বপ্নটাকে বড় করে, বছরের পর বছর জীবনের ক্ষতচিহ্নগুলো ধারন করে হঠাৎ একদিন দেখি এতদিন যা চেয়ে এসেছি তার পুরোটাই এইতো এখানে, অপেক্ষা করছে, আর একটু সময় মাত্র…হয়তো ঠিক কালই এসে কড়া নাড়বে দরজায়। তখনই এসে ভর করে চতুর্থ বাঁধাঃ সারা জীবন যে স্বপ্নের জন্য সংগ্রাম করে এলাম আমি কি আদৌ সেই স্বপ্নের সমান বড়, আমি কি যোগ্য সেটার?

অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, “প্রতিটি মানুষ যেটা ভালবাসে সেটাই হত্যা করে।” সত্যিই।

যা চাওয়া হয় সেটা পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা গড়পড়তা মানুষের মনে কেমন একটা অপরাধবোধ, একটা অনুতাপ তৈরি করে। তখন তার মনে হয় কোথায় কোনটা করতে গিয়ে পরিনামে কে কি হারিয়েছে, কে কোথায় যা চেয়েছে তা পেতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এসব উদাহরন খুঁজে পেতে পেতে একসময় মনে হয়; থাক, দরকার নেই, আমারও হবেনা। এত সব বাঁধা পার হয়ে, ত্যাগ-তিতিক্ষার পর যে এত দূর আসা, হঠাৎ কি করে যেন আমরা সব ভুলে যাই। যখন অন্তরের অন্তস্থল থেকে উপলব্ধ আহ্বান একেবারে হাতের নাগালে, তখনই নির্বোধ, অর্থহীন সব কাজ করে এক কদম দূরের লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেনি এমন অনেককেই দেখেছি।
আর সব বাঁধার মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক এটাই, কারন এই বাঁধা এমন একটা নূরানি আলোর লহর ছড়িয়ে রাখে যে জীবনের অর্জিত আনন্দ- বিজয় সবই সে আলোর সম্মোহনের কাছে তুচ্ছ মনে হয়। কিন্তু জীবনের সাধন-যজ্ঞে যে জিনিস পেতে কঠিন সব যুদ্ধ পার হয়ে আসা, নিজের উপর আস্থা রেখে কেউ যদি সেটার জন্য নিজেকে যোগ্য ভেবে নেয়, তখন সে ঈশ্বরের একটা কলকাঠি হয়ে বিশ্ব-আত্মার সাহায্যে নেমে পড়ে। আর ততক্ষনে হয়তো জেনেও যায় এখানে আসার কারন।

পাওলো কোয়েলো (লেখকের কথা, দ্য অ্যালকেমিস্ট)
-------------------------------------------------------------------------------------------------

'দ্য অ্যালকেমিস্ট' বইটা বন্ধুর মত পাশে পাশে থাকে। লেখকের কথা অংশটা প্রায়ই পড়ি, নিজের মনে রাখার জন্যই মূলত। সাবলিল ইংলিশ, পড়তে ভালও লাগে।
নিয়তি যাযাবর জীবন দিয়েছে। কখনো মনে হয় ঠিক পথেই আছি কখনো মনে হয় ডিট্যোর নিতে গিয়ে পথ হারাচ্ছিনাতো!
এক সময় লেখকের কথা অংশের এই বাংলাটা করেছিলাম, হুট করে, সাহস করে।
-জে এফ নুশান


Comments

অতিথি লেখক's picture

জীবন বদলে দেয়ার মত কিছু কথা।

অতিথি লেখক's picture

সত্যি। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
-জে এফ নুশান

কর্ণজয়'s picture

ভাল লাগলো পড়তে- পড়তে পড়তে ভাবতে।

অতিথি লেখক's picture

পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। বইটা অসাধারন।
-জে এফ নুশান

এক লহমা's picture

কর্ণজয়-এর মতো আমিও বলি - "ভাল লাগলো পড়তে- পড়তে পড়তে ভাবতে"।

একটা কথা। বাঁধা = বন্ধন। বাধা = প্রতিবন্ধকতা। এই লেখায় আপনি ত দ্বিতীয়টাই বলতে চেয়েছেন, তাই না?

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক's picture

একদম তাই। বানানের এতবড় ভুলে খুবই লজ্জা পেলাম। সারাজীবন মনে থাকবে। আপনার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ এক লহমা। নিজেকে সান্তনা দিচ্ছি এই বলে যে আমাদের যাত্রাপথে গিট্টু খুলে খুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ্‌ চিন্তিত
অনেক ধন্যবাদ।

-জে এফ নুশান

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.