মদ্র দেশের নিঃসন্তান রাজা-রানী, অশ্বপতি এবং মালবী সন্তানের আশায় সূর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সাবিত্রীর নামে পুজো দিয়ে এক কন্যা সন্তান লাভ করেন। দেবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে মেয়ের নামকরণ হয় 'সাবিত্রী'। কালক্রমে সেই মেয়ে নিজের সতীত্বের বিশাল ব্যাপক নজির রাখেন। যেকারণে হিন্দু পুরাণে তিনি 'সতী সাবিত্রী' হিসেবে খ্যাত। হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় উপন্যাস "সাবিত্রী উপাখ্যান" এর কেন্দ্রিয় চরিত্র সাবিত্রী'র নামকরণ সেই দেবী কিংবা রাজকন্যার নামানুসারে হয়েছিল কিনা জানা নেই। তবে সূর্যের আলো কিংবা তথাকথিত সতীত্বের অহংকারের ঠিক বিপরীতে চরিত্রটির নির্জীব অবস্হান। এই অবস্হান নিয়তি নির্ধারিত ছিল না। কিছু পশুর অধম মানুষ আর বিকলাঙ্গ সমাজ সাবিত্রীর পরিণতির জন্য দায়ী। যে কারণে, পরবর্তীতে আলোহীনতার মাঝে সাবিত্রীর স্বস্তি খুঁজে ফেরা। বিকারগ্রস্হ হয়ে মৃতপ্রায় একটা কিশোরী জীবন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া মর্মান্তিক বার্ধ্যকের দিকে(পঁচাশি বছর বেঁচে ছিলেন সাবিত্রী)।
"সাবিত্রী উপাখ্যান" হাসান আজিজুল হকের মনগড়া কাহিনির ভিত্তিতে রচিত উপন্যাস না। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে রাঢ় বাংলার শ্রীকৃষ্ণপুরের সাবিত্রী নামের এক কিশোরীকে সদলবলে অপহরণ এবং সম্মিলিত ধর্ষণের পর তাকে অপরাধী দলের পাপীষ্ঠ সবুরের উপর ছেড়ে দিয়ে অন্যরা সরে পড়ে। নিরাপত্তার কারণে এরপর তাকে নিয়ে সবুর শুরু করে ভ্রাম্য জীবন। ভ্রমণকালীন সময়ে সবুরের কুকর্মের সঙ্গী হয় বক ধার্মিক সৈয়দ সাহেব, সবুরের বন্ধু হুদা, হুদার আত্মীয় মওলাবখ্শ। হরির লুটের জিনিসে ভোগের আনন্দ তো ভাগেও! সাবিত্রী তখন ভিন্ন কোনো সত্তার অধিকারী নয়, কেবলি মাংসের দলা। যার উপর নিরন্তর চলে নেড়ি কুকুরের মত কিছু পুরুষের 'মচ্ছব'। তারই পরিণতিতে একজন প্রাণবন্ত কিশোরীকে প্রায় নো ম্যান্স ল্যাণ্ডের বাসিন্দা হয়ে পরবর্তী জীবন পার করে যেতে হয়। সাবিত্রীর সেসব ক্লেদাক্ত আর মর্মযাতনায় ভরা দিনরাত্রির কাহিনি নিয়ে এ উপন্যাস।
হাসান আজিজুল হকের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস "আগুন পাখি"র ভীষণ সাদামাটা কথক নারী চরিত্রটির সময় মত প্রজ্ঞাময় বলিষ্ঠতায় উচ্ছ্বসিত- মুগ্ধ, এই পাঠক। আগ্রহ নিয়ে সেরকম কিছুর আশায় তাঁর দ্বিতীয় রচনা পাঠের পর উপাখ্যানে সাবিত্রী চরিত্রটির প্রতিবাদহীনতা এবং জীবনকে বঞ্চিত করতে দেখে যুগপৎ ব্যথিত এবং হতাশই লেগেছে। সবুর যখন তাকে স্হান থেকে স্হানান্তরে নিয়ে বেড়াচ্ছে, সেসব সময়ে সাবিত্রীর ভাবনায় যে চমক ছিল, ছিল গভীর জীবনবোধের ইশারা; জীবনের ক্ষেত্রে তার যথার্থ প্রয়োগের কোন লক্ষণই দেখা যায়নি। মানছি, এক্ষেত্রে সমাজ-সংসার তাকে সঙ্গ দেয়নি সেভাবে, সময়কালটাও একটা বড় ফ্যাক্টর। কিন্তু যে মানুষ নিজের উপর ঘটে যাওয়া চরম অন্যায়ে নিজেকে মৃত্যুর হাতে সঁপে না দিয়ে সাহসের সাথে ভাবতে পেরেছিল 'কেউই বাঁচা বাদ দেবে না, তাহলে সেই বা দেবে কেন?' তার সে ভাবনাকে সঙ্গী করে সে তো বাঁচার আনন্দে বেঁচে নিতে পারতো! তা সে করেনি, বরং বলা ভালো করতে দেয়া হয়নি, তাই যাপনের আগ্রহ হারিয়ে পূর্ণিমার আলোকে অচ্ছুৎ রেখেছে বাকী জীবন, নানান বিকারে হয়েছে আক্রান্ত। অন্যের পাপে নিজেকে শাস্তি দেবার এই ব্যাপারটায় মন সত্যিই ভারাক্রান্ত হয়েছে।
নিরন্তর ভাবনায় সাবিত্রী তার মনের ঘৃণা যথেচ্ছা উপুড় করেছে, 'পিথিমির মদ্দা কোনো শোওর যেন তার কাছে না আসে' কিন্তু ঘটনাকালে(প্রথমবার বাদে) সে প্রতিবাদহীন থেকে গেছে। তার এই প্রতিবাদহীনতা ছিল পীড়াদায়ক। সবুরের মণ্ডুটা আঁশবটি দিয়ে কোপ বসানোর জন্যেও সে হাড়িদিদির উপস্হিতি কামনা করেছে, স্বপ্রণোদিত হয়ে বটির সন্ধানে উন্মুখ হয়নি। নারীর এহেন প্রতিবাদহীনতায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর তার কাছে মেরুদণ্ড বন্দক রাখা পুরুষ সকল যথেচ্ছা সুযোগ নিতে থাকে। সাবিত্রীকেও তাই ছাড় দেয় না সবুর বা তার পরিচিতরা।
একই সুযোগে ঠুলি পরা মানুষের দ্বারা তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে মুখরোচক গান, 'সাবিত্রীর এই যাওয়াতে ছেড়েছে পতি। কী কারণে মেয়েমানুষ এমন কুকর্মে মতি।' বটেই তো। পতি পরম গুরু, সে যতই মেরুদণ্ডহীন হোক, দুকড়ি আয় উপার্জনের মুরোদ নাই থাকুক, নারীর জন্য তার চে' বড় সহায় আর কে হতে পারে! সহায় কেউ হয়নি সাবিত্রীর, না স্বামী, না সমাজ না পুলিশ প্রসাশন বা বিচার ব্যবস্হা। তাই এমন অপরাধের শাস্তি হিসেবে একজনেরও মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন হয়নি। নানা মেয়াদের জেলবাসের শাস্তি সদ্য বিবাহিতা কিশোরী এক মেয়ের জীবনটা তছনছের মূল্য হিসেবে ধার্য হয়েছিল মাত্র। সাবিত্রী অপহরণ ঘটনা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষে লাশ পড়লেও তাতে সাবিত্রীর ভাগ্যের কিস্যু হেরফের হয়নি। ভাইয়ের সংসারের এককোণে বাতিল হওয়া আসবাবের মতই জীবনকে বরণ করে নিতে হয়, আগুন পাখি হয়ে ওঠার মন্ত্র সাবিত্রীর জানা ছিল না!
বিংশ শতকের গোড়ায় সাবিত্রী তার ঈশ্বরের প্রতি প্রশ্ন রেখেছিল 'হায় ভগোমান পিথিমিতে মেয়ে মানুষ কেন জন্মায়!' একবিংশ শতকেও এমন আহাজারিতে পৃথিবীর বাতাস সমানভাবে ভারী হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় একজন পূর্ণিমা রানীর জায়গায় বসানো হয় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চার সন্তানের হতভাগী জননীকে। যুদ্ধ বিগ্রহ, ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই, কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটাতে নারী আজও দুপেয়ে সারমেয়দের লক্ষ্যবস্তু। সবুরদের মতো সারমেয়রা আজীবনই পশু থেকে যায়। মানুষ হতে পারেন না। তাদের থাবার নীচে নারী শরীর কেবলি মাংস পিণ্ড।
অত্যন্ত পছন্দের লেখকের কাছ থেকে বহুদিনের অপেক্ষার পর পাওয়া "সাবিত্রী উপাখ্যান" নিয়ে যতটা আশা ছিল, তা পুরোপুরি মিটেনি যেন। কাহিনি বর্ণনার মাঝে মাঝে এই ঘটনার সাক্ষি সবুদের ডকুমেন্টেশনের উপস্হাপনা উপভোগ্য লাগেনি মোটেও, বরং কোথাও কোথাও কাহিনি ছন্দ হারিয়ে বিরক্তি এনেছে। এই উপন্যাসের সবচে' বড় অলংকার হাসান আজিজুল হকের জাদুকরী ভাষার কারুকার্য। তাঁর অনবদ্য শব্দচয়ন আর ভাষাভঙ্গির প্রতি পাঠক মন নতজানু হবে বলেই বিশ্বাস। বইটির ২১৫ পাতাকে আমার বাহুল্যই মনে হয়েছে।
*******
সাবিত্রী উপাখ্যান - হাসান আজিজুল হক
বেঙ্গল ই-বই
প্রথম বেঙ্গল ই-বই প্রকাশ:
জানুয়ারি ২০১৬
প্রকাশক : বেঙ্গল পাবলিকেশনস্ লিমিটেড
প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
মূল্য-
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ২১৫
Comments
বই নিয়ে আলোচনায় বইয়ের প্রচ্ছদ কি জুড়ে দেওয়া যায়? প্রচ্ছদ অনেক সময় নোঙরের কাজ করে। আমি আরো এক ধাপ এগিয়ে লেখাটারও একটা নিজস্ব প্রচ্ছদ বা শিরশ্চিত্র চাই, লেখকের কাছ থেকে।
অনেক উপন্যাসই কোনো না কোনো পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার কলেবরানুকূল্যে প্রথম প্রকাশিত হয়, তারপর স্বকীয় বাঁধাই নিয়ে পাঠকের হাতে বই আকারে আসে। পত্রিকায় সাধারণত দায়সারা অলংকরণ থাকে (যেগুলোর শিল্পমূল্য সচরাচর কম বা নেই), বইতে এসে সেটাও লোপাট হয়ে যায়। সম্ভবত আমাদের দেশে বইয়ের জনপ্রিয় আকার (A5 এর কাছাকাছি) অলংকরণবান্ধব নয় বলেই এমনটা ঘটে। উপন্যাস বা গল্পে অলংকরণ বইয়ের একটা আবশ্যক অঙ্গ হওয়া উচিত। সোভিয়েত আমলে প্রগতি-রাদুগা-মিরের বইগুলোতে অলংকরণ দেখে টের পেয়েছি, রেখাচিত্র পাঠকের মনে গল্পের জন্যে স্বতন্ত্র পাড় তৈরি করে। আমাদের প্রকাশনা ব্যবসা লেখকের সম্মানীই ঠিকমতো দিতে পারে না, অলংকারী সে জায়গায় কাজ কেমন পাবেন, জানি না। যদি লেখক-অলংকারীর যুগলবন্দি নিশ্চিত করা যেতো (প্রয়োজনে বইয়ের পাইকারি আকার পাল্টে নতুন কোনো অলংকরণবান্ধব আকারে), এক একটা বই বস্তুগুণেও পাঠককে মুগ্ধ করতো। এ চর্চাটা চাইলে সচলায়তনে আমরা জোরদার করতে পারি। লেখক যদি নিজেই আঁকেন, কিংবা শিল্পী বন্ধুর সাথে একটি যৌথ সৃজন প্রকল্প নিয়ে লেখেন-আঁকেন, লেখায় ভিন্ন স্বকীয় মাত্রা যোগ হবে। তাছাড়া যৌথকর্ম অনেক সময়ই পৃথক দু'টি প্রতিভার যোগফলের চেয়ে বেশি কিছু আমাদের সামনে আনে, এমন সংকীর্তি (Synergy) এখন জরুরি। ওজস্বী লেখকদের অহমিকা হয়তো এ চর্চাকে এগোতে দেবে না, হালকাপাতলাদেরই এগিয়ে আসতে হবে।
বইয়ের আলোচনায় বইয়ের প্রচ্ছদ জুড়ে দেয়া, শেষে বইয়ের তথ্য জুড়ে দেয়া আবশ্যক। নয়তো ব্যাপারটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
এক কালে বিচিত্রা, পূর্বাণী, শিশু, নবারুণের মতো পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত সাহিত্যকর্মের সাথে মানানসই অলঙ্করণ থাকতো। সেসব অলঙ্করণ যথেষ্ট মানসম্পন্ন ও মনোগ্রাহী হতো। শিশু বা নবারুণের সাধারণ সংখ্যায়ও এই চর্চ্চাটা ছিল। সেখানকার সাহিত্যকর্মগুলোর কোন কোনটা যখন বই আকারে বের হতো অধিকাংশ সময়ে দেখা যেতো পত্রিকায় ব্যবহৃত অলঙ্করণ বইয়ে ব্যবহৃত হয়নি। এটা সম্ভবত অলঙ্করণের মেধাসত্ত্বসংক্রান্ত অবনিবনার জন্য হতো। এর একটা উদাহরণ হচ্ছে শিশুতে প্রকাশিত হাসান আজিজুল হকের ‘লাল ঘোড়া আমি’ উপন্যাসে হাশেম খানের অসাধারণ অলঙ্করণ বই আকারে বের হবার সময় ধ্রুব এষের বীভৎস অলঙ্করণ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। আবার এক বই অন্য কোন প্রকাশনী থেকে পুনঃপ্রকাশিত হলেও এই প্রকার ঘটনা ঘটে।
আমাদের দেশে একটা সাধারণ ধারণা হচ্ছে, বড়দের বইয়ে কোন ছবি (অলঙ্করণ) দরকার নেই। এই কারণে প্রচ্ছদের বাইরে বড়দের বইয়ে অলঙ্করণ শিল্পীর কিছু করার থাকে না, বইয়ের আকারও A5 ধরনের হয়। যেসব বইয়ে আলোকচিত্র ছাপা হয় সেসব বইয়ের আকার কিছুটা বড় হয়।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের বেশিরভাগের প্রচ্ছদ দেখলে মনে হয় প্রচ্ছদ শিল্পী বইটি না পড়ে, হালকা-পাতলা শুনে কিছু একটা এঁকে দিয়েছেন। আমার এই ধারণাটির সত্যতা পাই নিজে যখন বই প্রকাশ করতে যাই (অন্যের লেখা বই)। প্রকাশক কোন প্রকার ভণিতা না করে বললেন, “আমাদের কিছু শিল্পী আছেন তাদের কেউ না কেউ প্রচ্ছদ এঁকে দেবেন, এটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু বলুন কত টাকা দামের প্রচ্ছদ চান — ** হাজার, নাকি *** হাজার, নাকি **** হাজার টাকা?” হতবাক আমি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী টাকার অঙ্ক বললাম। তারপর সেই প্রচ্ছদ হলো ‘যতো চিনি, ততো মিষ্টি’র মতো — বইয়ের কনটেন্টের সাথে দূর সম্পর্কীয়।
উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-কবিতার বই বের করেও নিশ্চয়ই প্রকাশকের লাভ হয়, নয়তো প্রতি বছর হাজার হাজার উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-কবিতার বই বের হয় কী করে! কিন্তু খুব কম প্রকাশক উপন্যাস-গল্প-প্রবন্ধ-কবিতার ক্ষেত্রে লেখক সম্মানী দেন। আমার এক আত্মীয়, তার খান ত্রিশেক বই প্রকাশিত হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি জানালেন দুটি প্রকাশনী ছাড়া আর বাকিদের কাছ থেকে তিনি কখনো সম্মানী বা বই বিক্রির হিসাব পাননি। অলঙ্করণ শিল্পীদেরকে বোধকরি এমন ভরা হাটে হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দেয়া যায় না, তাই বইয়ে অলঙ্করণ কম হয়।
আমি খুব আনন্দিত হতাম যদি আমার প্রতিটি লেখার সাথে মানানসই অলঙ্করণ থাকতো। কিন্তু আমি নিজে আঁকতে পারি না। একটা লেখা শেষ করার পর তাই আমাকে কোন শিল্পীর দ্বারস্থ হতে হবে। আমার প্রস্তাব শুনে আমার পরিচিত কোন শিল্পী রাজী হবেন বলে মনে হয় না। তাদেরকে যতটুকু দেখেছি তাতে এই প্রকার মামাবাড়ির আবদারে তাদের মন গলবে না। আমি জানি না কোন লেখা পড়ে কোন অলঙ্করণ শিল্পীর মনে হয় কিনা যে তিনি স্বেচ্ছায় এটার উপযুক্ত চিত্র আঁকেন। সচলের এই পোস্টটার মতো ঘটনা সহসা ঘটে না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বাঙালির চোখে প্রমিত "বড়দের জগৎ"গুলো খুব নিরানন্দ। সেদিন ইউটিউবে আসুরবিদ (assyriologist) ও কিউনেইফর্ম লিপিবিশেষজ্ঞ আরভিং ফিঙ্কেলের কয়েকটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম, বুড়ো খুবই রসিক (তবে ব্যাটার তলানিতে খানিকটা বৃটিশ-সাম্রাজ্য-প্রীতি আছে, মাঝেমধ্যে নাড়া লেগে সেটা উঠে এসে অনেক আলাপ ঘোলা করে দেয়)। এমন বাঙালি সপ্রতিভ সুরসিক বুড়ো বকিয়ে কেউ আছে কি না, ভাবতে গিয়ে কারো নাম মাথায় এলো না। আমাদের সমাজে পণ্ডিতরা সরসতাকে এমনভাবে এড়িয়ে চলেন, যেন এটা নোংরা কিছু। এ কারণে যে কচি পণ্ডিত পাণ্ডিত্যের রাস্তা ধরেন, তিনিও সারাক্ষণ প্রাণপণ চেষ্টায় গোমড়া হয়ে থাকেন। প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন, একমাত্র অর্ধপণ্ডিতই সারাক্ষণ ধরা পড়ার ভয়ে থাকে বলে সরসতা বর্জন করে চলে, এটা আমাদের বানানো আমাদের বড়দের জগৎ দেখলে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়।
সচলায়তনের পাঠকদের মধ্যে যাঁরা কিছুমিছু আঁকেন, তাঁরা আমাদের এ চেষ্টায় যোগ দিতে পারেন স্বচ্ছন্দে। গল্প ছোটোদের হোক আর বড়দের, দৃশ্যগুণ থাকলে সেটা না আঁকাই বরং নিজের গুণের প্রতি অবিচার।
শুনেছি সৈয়দ মুজতবা আলী অত্যন্ত সুরসিক জমাটি আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন।
****************************************
"আছে" আর "ছিলো"র মধ্যে পার্থক্য আছে তো।
"সপ্রতিভ সুরসিক বকিয়ে বুড়ো" আব্দুল্লাহ আবু সাইদ
আঁকাআঁকিতে লডংকা, প্রচ্ছদ বই/লেখার নোঙর, পুরোপুরি সহমত জানিয়ে প্রচ্ছদ জুড়ে দিলাম।
***
দারুণ পছন্দ হয়েছে হিমুভাই আপনার প্রস্তাবনা। আমার পরিচিত যে দু'একজন আঁকিয়ে আছেন তারা একাজে উৎসাহী হবেন কিনা জোর দিয়ে বলতে পারছিনা। দেখবো বলে। দারুণস্য দারুণ হতো যদি যুগলবন্দীতে আঁকা আর লেখা দাঁড় করানো যেতো।
লেখার মতো আঁকাও যেহেতু অনেক সময় নেয়, হয়তো খুব সূক্ষ্ম বা বিস্তারিত অলংকরণ শুরুতে করতে রাজি হবেন না কেউ। কিন্তু আঁকিবুকি করতে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁরা হয়তো দু'চারটা দাগ কাটতে রাজি হয়ে যাবেন। লেখক নিজেই যদি doodle করেন, সেটাও খারাপ হয় না। পঞ্চাশ হাজার বছর আগের কন্দরবাসীরা সামান্য গেরিমাটি-এলামাটি সম্বল করে মশালের আলোয় পাথুরে দেয়ালে আঁকিবুকি করতে পারলে আমরাও এই কাগজ-কলম-আঁকুনি আর দাগপাট-দাগুনির যুগে কিছু না কিছু আঁকতে পারবো।
দাগপাট হচ্ছে ট্যাবলেট, আর দাগুনি হচ্ছে স্টাইলাস। আর আঁকুনি হচ্ছে পেন্সিল, সেটা তো জানা কথা।
পরের কোনো লেখায় doodle এর সাহায্যে কিছু করে উঠতে পারি কিনা চেষ্টা চালাবো। পোস্টের ছবিটা ঠিক জায়গায় বসানোর জন্য ধন্যবাদ
'শিরশ্চিত্র' শব্দটা কি ঠিক হলো? একটু ভেঙে দেখাবেন?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
শিরঃ (শিরস্) + চিত্র = শিরশ্চিত্র। বিসর্গের পর চ/ছ থাকলে শ্চ/শ্ছ হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আমি এই বইটি পড়িনি, তাই বইয়ের আলোচনায় যাবো না। পোস্টে একটা বিষয় এসেছে যে, বঞ্চিত/লাঞ্ছিত/অত্যাচারিত/নিপীড়িতরা কেন প্রতিবাদ করে না বা প্রতিশোধ নেয় না বা কেড়ে নেয় না। এটা সম্ভবত মানুষের সাধারণ প্রকৃতি। এই কারণে, প্রতিদিন আমাদের চারপাশে শত অন্যায় ঘটে চলে, আমরা নির্বিকার থাকি। যখন গণঅভ্যুত্থান ঘটে তখনো অধিকাংশ মানুষ নিরব-নিষ্ক্রিয় থাকে। নিয়তিবাদীরা বিচারের ভারটা নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়। যাদের নিয়তিতে বিশ্বাস নেই তারা আরও দুরবস্থার ভয়ে চুপ করে থাকে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
প্রচ্ছদ জুড়ে দিয়েছি। ছবি যুক্ত করার বিষয়টা ভুলে গেছি। তাই বুঝি দু'বার এসেছে ছবিটা। বই সংক্রান্ত তথ্যও জুড়ে দেয়া হলো। হা হা হা.... লিংকটায় গিয়ে স্বেচ্ছায় আঁকাআঁকির স্বেচ্ছাচারিতার সেরাম নমুনা দেখে বাস্তবিকই অট্টহাসি দিতে হইছে
***
বইটা পড়তে চাইলে ই-সংস্করণ দেয়া যেতে পারে পাণ্ডবদা। আমি নিশ্চিত আপনার সমৃদ্ধ পঠন আর অন্যভাবে দেখার যোগফলটা দারুণ উপভোগ্যই হবে।....এমনিতে 'সাবিত্রী উপাখ্যান' এর মত বই পড়ে শেষ করাটা সত্যিই কঠিন। মনের উপর খুব চাপ ফেলে এমন কাহিনি....তার উপর মূল চরিত্রটা সারা জীবন বঞ্চিতই থেকে গেলো... তার ঘুরে দাঁড়ানো আর হলো না। পাঠক হয়ত তার মত করেই এমন অবস্হা থেকে চরিত্রের উত্তোরণ ঘটুক সেটা চেয়ে থাকেন মনেপ্রাণে...লেখক তো এক্ষেত্রে স্বাধীন, নিজের মত করেই তিনি গল্পের আখ্যান সাজাবেন, সাজিয়েছেনও। এক মানুষ অন্য মানুষের কষ্টের কারণ হয়, ব্যাপারটা মনে নিতে না পারলেও, মেনে নিতে হয়- কী অসহায় অবস্হা!
বঞ্চনা/লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে একজোট হতে যারা পারে না, তারাই কিন্তু আবার গণপিটুনি দেওয়ার জন্য একজোট হয়ে যায়।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নিজের অসহায়ত্বটাকে ততোধিক অসহায়ের উপর ঝাড়ে আরকি!
****************************************
এই বইটি পাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে আরো আলোচনা পড়লাম। পড়ে যে অনুভূতিটা হল, সেটা তোমার লেখা পড়ে যা মনে হচ্ছিল, সেটাই আরো জোর পেল। একদিকে এ বই অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের কোন ইংগিত রাখেনি। অন্যদিকে এ বইতে শৈল্পিক উপস্থাপনের মোড়কে 'যত্ন'-সহকারে সাবিত্রীর একের পর এক নানা সময়ে ধর্ষিত হওয়ার বিবরণ দিয়েছেন। যেহেতু নিজে বইটি পড়িনি তাই এর বেশী বলার মত জোর নেই। বিভিন্ন পাঠের যোগফলে বইটি সম্পর্কে যে বিরক্তির সৃষ্টি হয়েছে সেটা কাটিয়ে উঠে বইটি পড়ার কোন আগ্রহ হওয়া সম্ভব নয়। ঐ, যেমন তুমি লিখেছ, লিখনশৈলী যত ভালোই হোক - "বইটির ২১৫ পাতাকে আমার বাহুল্যই মনে হয়েছে।"
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
তোমার অনুভূতিটা সটান লক্ষ্য ভেদ করেছে দাদাই। আসলেই তাই...বর্ণনাগুলো পাঠক হিসেবে পড়ে ওঠা খুব কষ্টকর মনে হয়েছে। বইটা পড়ে দিন দুয়েক কেমন একটা রোগ..দুঃখবোধ আমাকে খুব জ্বালিয়েছিল মনে আছে। হাসান আজিজুল হকের লেখা আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়বার চেষ্টা করি। "সাবিত্রী উপাখ্যান'' আর "মা মেয়ের সংসার" পড়তে গিয়ে খুব চাপ পড়েছে মনে। ভয়ে বলিনা..আকাঠ পাঠক এমন বললে অনেকেই হা হা করে ওঠবেন হয়ত...বর্ণনাকে টেনে অযথাই লম্বা করার একটা মনোভাব দেখেছি এই দুটো লেখাতে।
আলোচনাটি পড়ে মনে পড়লো বইটি কিনেছিলাম এবং আমার আরো বেশ কিছু অর্ধপঠিত বইয়ের মধ্যে একটি। কোন কারণে বইটা শেষ করা হয়নি। তবে সেই কারণটা বইয়ের সমস্যা নয়, আমার নিজেরই সময়ঘটিত সমস্যা। মুশকিল হলো অর্ধেক পড়া বইগুলো কেন যেন আর পড়া হয়ে ওঠে না। তবে কেউ যখন বইটি নিয়ে আলোচনা নামায়, তখন পড়ার উৎসাহটা নতুন করে জেগে ওঠে। সে কারণে এই পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য একটা ধন্যবাদ দিতেই হয় আয়নামতিকে।
এই আলোচনার মধ্যে প্রচ্ছদ বিষয়ক যে আগ্রহোদ্দীপক আলোচনা চলছে তা পোস্টের বাড়তি পাওনা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আসলেই তাই। কত বই যে পরে পড়বোর ভিড়ে তলিয়ে যায়। সাবিত্রী উপাখ্যান খুব লাফিয়ে ঝাপিয়ে বেঙ্গল থেকে যোগাড় করেছিলাম। যতটা আশা নিয়ে বইটা পড়তে বসা, দুঃখজনক হলেও সত্যি, ততটা মিটেনি।
আপনি আঁকাআঁকি পারেন কিনা সেটা বলেন ভাইয়া? হেহেহে তাহলে পোস্টের লেখার সাথে ছবিছাবা আঁকবার জন্য আপনাকে পাকড়াও করা হবে..
আমাদের সাহিত্যের এক বিরাট অংশে মেয়ে চরিত্রদের সবটাই যেন পিতৃতন্ত্রের গড়ে দেওয়া, তার হাসি তার কান্না তার গৌরব তার সাফল্য তার দুঃখ তার সর্বনাশ এমনকি তার উপরে করা বঞ্চনাও সবটাই যেন পিতৃতন্ত্রের সুবিধার্থে। কোথাও তাকে সতীলক্ষ্মী বানিয়ে সুখে রাখা, কোথাও সতীলক্ষ্মী বানিয়েও নানাবিধ বঞ্চনা করে তার দুঃখকে "জনমদুখিনী"ইমেজ দিয়ে মহিমান্বিত করা, কোথাও তাকে স্বৈরিণী বানিয়ে নানাবিধ যন্ত্রণায় জ্বালানো ---এই সবটাই পিতৃতন্ত্রের অঙ্গুলিহেলনে, শাঁখের করাতের মতন, যেতেও কাটে আসতেও কাটে। "হেড পড়লে আমার জিত, টেল পড়লে তোর হার" গল্পের মতন।
আজ পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী গল্প-উপন্যাসে পুরোপুরি মানুষ হিসেবে মহিলা চরিত্র প্রায় দেখলামই না, সূক্ষ্মভাবে কোথাও না কোথাও ঢুকে পড়েছে পিতৃতান্ত্রিক নির্দেশ, সেই নির্দেশে সে হয় গৃহদাসী নয় গর্ভদাসী নয় রূপদাসী, নয়তো সবকটাই একসঙ্গে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
একদম ঠিক! এমনকি নারীরা যা কিছু লেখেন তার বড় অংশ পড়লে মনে হয় নারীর হাতে লেখা পুরুষের বক্তব্য। আরও দশ-বিশ হাজার বছরেও এর পরিবর্তন হবে কিনা কে জানে!
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
পিতৃতন্ত্রের শিকার শুধু যে মহিলারা, তা কিন্তু নয়, অনেকক্ষেত্রে পুরুষরাও এর শিকার। অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর অবস্থায় আছে এমন যেকোনো পক্ষই এর শিকার।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
হ্যাঁ, এটা ক্ষমতার রাজনীতির বৈশিষ্ট্য - যেখানে ক্ষমতাবানরা পরিচয় নির্বিশেষে ক্ষমতাহীনদের শোষণ করবে, অপমান করবে, অপদস্থ করবে, দেহে বা মনে আঘাত করবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ওহ চমৎকার বলেছো তুলিদি! মন্তব্যে বিপ্লব
Post new comment