অণুগল্প কেন লিখি? কীভাবে লিখি?

Sohel Lehos's picture
Submitted by mmalam1978 [Guest] on Thu, 10/01/2019 - 10:58pm
Categories:

অণুগল্প কেন লিখি প্রশ্নটি করার আগে সম্ভবত যে প্রশ্নটি করা উচিত তা হলো আমি কেন লিখি?

আমি কেন লিখি? বিশেষ কোন লাভ-ক্ষতির জন্য আমি লেখালেখি করিনা। আমি লিখি কারণ এতে আমার মনের শান্তি হয়। আনন্দ লাগে। লেখার পর মনে হয় ভাল কিছু একটা করলাম। অনেক কিছু নিয়েইতো লেখা যায়। তবে কেন অণুগল্প লেখা?

শ্রমসাধ্য কাজের ফল প্রায় সময়ই বেশ তুষ্টিকর হয়। অণুগল্প লেখা শ্রমসাধ্য ব্যাপার। আপনার ভ্রু কুঁচকে ওঠার আগেই বলে রাখি- অণুগল্প আকারে ছোট বলেই যে লেখা সহজ তা নয়।

দীর্ঘ দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাবার সময় যখন ব্যাগ গোছানোর দরকার পড়ে তখনকার কথা ভাবুন। এয়ারলাইনস মাত্র দুটো ব্যাগ বিনামূল্যে নিতে দেবে। আপনি দেশের বাড়ি যাচ্ছেন মাস তিনেকের জন্য। নিজের জামা-কাপড়, লুঙ্গি, জাঙ্গিয়ার কথা না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু কত জনের জন্য কত গিফটই না নিতে হয়।

ছোটবোন আছে তার জন্য গিফট। বড় বোনের দুই ছেলে এক মেয়ে। তাদের জন্য গিফট। দুলাভাই এর জন্য একটি ল্যাপটপ। বাবা-মা'র বয়স হয়েছে। সেই অনুপাতে তাদের জন্য গিফট। ছোটভাই আছে তার জন্য আলাদা গিফট। জানে দোস্ত বলে দিয়েছে তার জন্য লেদার জ্যাকেট নিয়ে আসার জন্য। আত্মীয় স্বজনও সংখ্যায় কয়েক হাজার। সবার জন্য কিছু না হলে অন্তত পক্ষে কিছু চকলেট নেয়া চাই। সাথে সাবান শ্যাম্পু, স্নো-পাউডারতো আছেই। এখন আসুন এক এক করে এগুলো দুটো ব্যাগে ভরা যাক।

ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আপনার চক্ষু চড়কগাছ। দুই ব্যাগ কেন বিশখানা ব্যাগ এনে দিলেওতো এত কিছু ধরবার নয়। কিন্তু আপনাকে এত কিছুই দুটো ব্যাগের ভেতরই ভরতে হবে। অণুগল্পও অনেকটা সেরকমই। অনেক কিছুই বলার আছে। তবে বলার পরিসর সংক্ষিপ্ত।

বড়গল্প কিংবা ছোটগল্প যেটাই হোক আকারভেদে তাতে পরিসর থাকে। চরিত্র কিংবা ঘটনা নিয়ে বলার অবকাশ থাকে। কিন্তু অণুগল্পের জমি কম। অল্প জমিতে ফসলের বাম্পার ফলন ঘটানোই অণুগল্প।

আমার কাছে গল্প ছাড়া কোন গল্পকেই গল্প বলা যায় না। অণুগল্প হতে হলে তাতে একটা গল্প থাকতে হবে। গল্প না থাকলেও গল্পের কিছু গন্ধ থাকতে হবে। ভাল খাবার যেমন না খেয়েও ঘ্রাণ শুঁকে বলে দেয়া যায় খাবার সুস্বাদু হয়েছে তেমনি হল অণুগল্প। গল্পের গন্ধেই পাঠক বুঁদ হয়ে যাবেন।

যে গল্পে গল্প বলে দেয়া হয় তা অণুগল্প নয়। লেখক এমনভাবে লিখবেন যেন গল্প লেখা হবে পাঠকের মস্তিষ্কের ভেতর। যেহেতু সব পাঠকই আলাদা সেহেতু পাঠকভেদে গল্পের মর্ম হবে একেকরকম। এক্ষেত্রে লেখক লিখে যাবেন কিন্তু তার অর্থ বের করে নেবে পাঠক।

অণুগল্পকার মাত্রই একজন ম্যাজিশিয়ান। তার গল্পের টুপি আছে। টুপির ভেতর এবং বাহিরটা লেখক বের করে দেখাবেন। দর্শকরুপী পাঠকেরা এসে তা যাচাইও করে যাবেন। কিন্তু যখন খালি টুপিখানার ভেতর থেকে খরগোশ বেরিয়ে আসবে তখন পাঠকেরা বাহাবা দেবে। খালি টুপির ভেতর থেকে খরগোশ বের করে আনার মধ্যেই অণুগল্পকারের কৃতিত্ব।

কথায় আছে- লোভে পাপ। পাপে মৃত্যু। তেমনি অণুগল্প লিখতে গিয়ে লোভে পড়েছেন তো মরেছেন। লোভ অণুগল্পের শত্রু। লোভে পড়লে অণুগল্প আর অণুগল্প থাকে না। ছোটগল্প হয়ে যায়। যে লক্ষ্যে লেখতে বসা সেই লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য লোভ সংবরণ বাঞ্ছনীয়।

আমার লেখালেখির শুরু মূলত ছোটগল্প দিয়ে। ফেসবুকের দেয়ালে এক বন্ধুর লেখা অণুগল্প দেখে আমার ভেতর অণুগল্প লেখার শখ চাগা দিয়ে উঠে। স্বল্প সময়ের ভেতর হালি খানেক অণুগল্প পয়দা করে দিলাম। সেই বন্ধু এক অণুগল্প গ্রুপের হদিস দিল। গ্রুপে ঢুকে ভাল একটা ধাক্কা খেলাম।

অসাধারণ কিছু লেখা পড়ার সৌভাগ্য হল। বুঝতে পারলাম অণুগল্প নামে এই কয়দিন যা লিখেছি তা আসলে অণুগল্প হয়নি। যা হয়েছে তাহলো ছোটগল্প এবং অণুগল্পের মিশ্রণের এক হাইব্রিড বস্তু। গ্রুপে পোষ্ট করা ভাল লেখাগুলোকে অনুকরণ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সমস্যা হলো লোভ সামলাতে পারিনা। লেখকের আনন্দ যেহেতু লেখাতে সেহেতু আনন্দের অতিশায্যে সীমা অতিক্রম করে ফেলি। গল্পের ডালপালা গজায়। হাভাতের মত গল্প হা করে থাকে। আমি ঠেশে তাকে পোলাও কোর্মা খাওয়াই। গল্পের স্বাস্থ্য বাড়ে। মেদ জমে।

যেকোন ধরণের লেখালেখি রপ্ত করার জন্য সাধনা লাগে। আন্তরিক চেষ্টা লাগে। অণুগল্পের বেলায়ও তাই। আকারে ছোট বলে অণুগল্প সহজেই লেখকের আয়াত্বে চলে আসবে তা নয়। সংযম সাধনা যে কত কষ্টের রমজান মাসে তা মাত্রই অনুধাবন করা যায়। অণুগল্প লেখকদের জন্য বছরের বারো মাসই রোজার মাস।

তাহলে এত কষ্ট করে কেন অণুগল্প লেখা? ঐ যে রমজান মাসের কথা বললাম। রোজার পরইতো ঈদ তাইনা? চরম সংযম সাধনার পর নির্মল যে আনন্দ তাই হলো অণুগল্প।

অণুগল্পের পরিসর ছোট। এই অল্প পরিসরের ভেতরেই গল্প ফুটিয়ে তুলতে হবে। গল্প হবে বহুস্বরের সমষ্টি। গল্প শুধু একজনের কথাই বলবে না। বহুজনের মিলিত কণ্ঠস্বর কিন্তু লক্ষ্য এক। পরিণতি এক। তবে পরিণতি পরিষ্কার নয়। যা সুস্পষ্ট করা হয়নি তা মাত্রই রহস্যমন্ডিত। রহস্য অণুগল্পের অনেকগুলো উপাদানের একটি। ছোটগল্প কিংবা বড়গল্পে রহস্য গড়ে উঠে ধীরে ধীরে। কিন্তু অণুগল্পে এত সময় কোথায়? অণুগল্পের প্রথম লাইনটাই হবে রহস্যের শুরু।

অণুগল্পের আবশ্যকীয় উপাদানগুলির একটি হল মোচড় বা টুইস্ট। মোচড়হীন লেখা আর পান্তাভাত- মূলত এই দুইয়ে কোন পার্থক্য নেই। দুটোই ক্লান্তিকর। শখের বসে নববর্ষের দিন পাঠক একবেলা পান্তা খেতে পারে। কিন্তু একদিনে বছর গড়ায় না। বাকি ৩৬৪ দিন পাঠকের মনোযোগ লাভ এবং মনঃতুষ্টির জন্য লেখায় মোচড় থাকা অত্যাবশ্যকীয়।

গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচনে অণুগল্পকারকে অত্যন্ত সাবধান হতে হবে। ধরুন লেখক এমন বিষয় নিয়ে লেখা শুরু করলেন যার সীমানা অত্যন্ত প্রশস্ত। এমন দীর্ঘদেহী বিষয়বস্তু অণুগল্প লেখককে মুহুর্তেই ল্যাং মেরে নর্দমায় ফেলে দেবে। নর্দমায় পড়ে লেখক কপাল চাপড়াবেন। হা হুতোশ করবেন। লেখার দৈর্ঘ্য বাড়বে। ডালপালা গজাবে। অন্য অনেক কিছুই হয়তো হবে। কিন্তু অণুগল্প হবে না।

তেমনি অতি সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তুও অণুগল্পের উপাদান হতে পারেনা। উদাহরণ স্বরূপ কৌতুক এর কথা ধরা যাক। যে কোন কৌতুকেও একটি ঘটনা থাকে। অতি সামান্য সে ঘটনা। যার কোন শৈল্পিক মূল্য নেই। কৌতুককে ধরা যেতে পারে ক্ষুধার্ত দেহে চিনির প্রতিক্রিয়ার মত। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় চিনি সর্বস্ব খাদ্য তাৎক্ষনিক শক্তি যোগাতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী শক্তির জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজন।

অণুগল্পের বিষয়বস্তু পাঠকের মনে যেন দীর্ঘ মেয়াদী খোরাকির যোগান দিতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রাখা অণুগল্পাকারের দায়িত্ব।


Comments

এক লহমা's picture

আসতে থাকুক অণুগল্প।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

Sohel Lehos's picture

অণুগল্প চলছে। চলবে। সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ!

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

আয়নামতি's picture

এহ হে! যে দু তিনখানা অণুগল্প লিখেছি, আপনার পোস্ট পড়ে বুঝলাম, তার সবই ভূয়া হইছে। উপকারে লাগবে লেখাটা। ধন্যবাদ জানবেন।

Sohel Lehos's picture

সবকিছু মেনে যে অণুগল্প লেখতে হবে তাও কিন্তু নয়। আপনি লেখতে থাকুন একসময় ফর্মেটে চলে আসবেন হাসি

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

শিরোনামটা সম্ভবত 'অণুগল্প কেন লিখি? কীভাবে লিখি?' হবে। 'কীভাবে'কে 'কিভাবে' লিখলে আমি আপত্তির কিছু দেখি না তবু প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহনযোগ্য রীতি মেনে 'কীভাবে' লেখাটা ঠিক হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

Sohel Lehos's picture

শিরোনামটা প্রথমে কিন্তু আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবেই দিয়েছিলাম। পরে কি মনে করে যেন পালটে ফেলেছি ইয়ে, মানে...

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

হিমু's picture

এক সিরীয় অভিবাসী কবি আমেরিকায় বাস করেন, ওসামা আলোমার। যদি সম্ভব হয়, ওনার বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন, হয়তো আপনার অণুগল্প-চিন্তার পালে হাওয়া লাগবে। আলোমারের একটা অণুগল্প পড়তে দিলাম:

Quote:
“The elevator that was going up to the top floor looked at his colleague who was going down to the lowest and called to him disdainfully, ‘You descender!’ But after a while, the roles were reversed and so were the names.”

Sohel Lehos's picture

আহারে! আপনার মন্তব্যটি আগে চোখে পড়েনি। এই ওসামা আলেমার বই কোথায় পাব? ধন্যবাদ!

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

কর্ণজয়'s picture

Quote:
খালি টুপির ভেতর থেকে খরগোশ বের করে আনার মধ্যেই অণুগল্পকারের কৃতিত্ব।

Sohel Lehos's picture

হু হাসি

সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল হাসি

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.