হাসপাতালের দিনগুলো...

নজমুল আলবাব's picture
Submitted by albab on Sun, 04/11/2018 - 1:10am
Categories:

রাত এগারোটায় হাসপাতাল থেকে ফোন আসলো, আপনি মি. তুলি? হ্যাঁ বলতেই বল্লো, মাত্র ফোন পেলাম। আপনার স্ত্রীকে পোস্ট অপারেটিভ থেকে নিয়ে আসবে ১৫ মিনিটের মাঝে। আসতে চাইলে আসুন। বল্লাম, আধা ঘন্টা লাগবে কমপক্ষে। উত্তরে হ্যাঁ সূচক জবাব পেলাম। আবার আব্দার করলাম, ছেলেকে নিয়ে আসবো... তাতেও হ্যাঁ।

গত ৩/৪ ঘন্টা ধরে এই মহিলাকে ১৫/১৬ বার ফোন করেছি। গলা শুনে অনেক বয়েসী কোন মানুষ মনে হয়। ছেলেকে নিয়ে ছুটলাম। রাস্তা একদম ফাঁকা, তবু জোরে চালানো যাবেনা। মোড়ে মোড়ে ক্যামেরা। লাইসেন্সে এমনিতেই তিন পয়েন্ট জমা হয়ে আছে। আর কিছু হলে ব্যান করে দেবে।

বাবাই লম্বায় সেই কবেই আমাকে ছাড়িয়েছে। এখন মনেহয় বুঝতে পারাতেও... বারবার বলে, বাবা চিন্তা করোনা। মা ঠিক আছে। তুমি ঠিক থাকো। ভেতরে ভেতরে আরো গলে যাই, ছেলেটা ভেতরে বিষ চাপা দিতে শিখে যাচ্ছে।

যা ভেবেছিলাম তাই। আম্মার বয়েসি নার্স। ওয়ার্ডের দরোজায় দাঁড়িয়ে। "দেখো বাবা, এটা একদম নিয়মের বাইরে। তোমার বার বার ফোনের কারণে আমি সুযোগটা দিচ্ছি। আস্তে আস্তে যাবে। কথা বলবেনা। লম্বা অপারেশন হয়েছে। এটা সবচে বড় অপারেশন গুলোর একটি। মেয়েটা এখন ঘুমুচ্ছে। শুধু চোখের দেখা দেখবে।" হাঁটছেন আর কথা বলছেন। ছেলের হাত ধরে পাশে পাশে চলছি।

সাড়ে দশ ঘন্টা পর পর আমাদের দেখা হলো। এবার তিনি ফিস ফিস করে কথা বলছেন। রুগীর সাথে যে ফাইল এসেছে এবং যিনি ওকে দিয়ে গেছেন তার কথা অনুযায়ী তোমার স্ত্রী ভালো আছেন। এর বেশি কিছু আমি বলতে পারবোনা। প্রার্থনা করো। ঠিক দশ মিনিট পর তোমাদের চলে যেতে হবে, বলে তিনি পর্দা টানিয়ে চলে গেলেন।

চোখ অল্প একটু মেলে তুলি বলে, চলে যাও। ঠিক আছি। বল্লাম, দশ মিনিট মাত্র সময়। তুমার ছেলে এসেছে, দেখেছো? মাথা নাড়ার চেষ্টা করলো মনে হলো। দু-তিন মিনিট আর কোন কথা নেই। আবার একটু চোখ মেলে বলে, মাথা এদিকে আনো, কথা বলি। এগিয়ে গেলাম, কিন্তু কথা নেই। আরও মিনিট দুয়েক পর, একদম ফিস ফিস করে বল্লো, আমি কিন্তু ঘুমাই নাই, এমনি পড়ে আছি... ভংগি ধরে আছি... নয়তো এরা মরফিন দিয়ে দেবে... আমরা বাপ-ছেলে অবাক হয়ে তাকাই। বাবাই অবিকল মাকে নকল করে বলে, "ভালো করেছো, এভাবে পড়ে থাকো। আমরা চলে যাবো এখন। মিজান আংকেল ঈদের খাবার দিয়ে গেছেন, সেটা গিয়ে খেতে হবে। ঈদের মাত্র মিনিট বিশেক আছে আর!"

আবারও সেই বয়েসি নার্স আমাদের এগিয়ে দেন। বার বার বলেন, চিন্তা করোনা। প্রার্থনা করো। অনেক বড়ো অপারেশন... অনেক বড়ো...

শুনশান নীরব হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে হাঁটতে থাকি। সড়ক বাতির জন্ডিস আলোয় আমাদের ছায়া পড়ে। বাবাইর ছায়ার পাশে আমার ছায়াটাকে মনে হয় বাচ্চা... আজ থেকে উনত্রিশ বছর আগে আব্বা ঠিক এভাবেই আমাকে নিয়ে রাতের সিলেটে বাড়ি ফিরেছেন। আম্মা একা শুয়ে ছিলেন হাসপাতালে। আমি আব্বার হাতে শক্ত করে ধরেছিলাম। সারারাত আব্বার বুকের ভেতর ঘুমিয়ে ছিলাম।

আমার ছেলে বাতি নিভিয়ে বলে, বাবা একদম চিন্তা করোনা। ঘুমানোর চেষ্টা করো। কিছু লাগলে ডাক দিও! বলে নিজের রুমে চলে যায়। বাবাইটা বড়ো হয়ে গেলো...


Comments

এস এম মাহবুব মুর্শেদ's picture

মন খারাপ
ঘটনা বিস্তারিত বলেন। অপারেশন কিসের?

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

এইটা কি ছোট গল্প পাইছেন যে অর্ধেক কথা বলবেন, ট্যুইস্ট দেবেন! দিলেন তো চিন্তায় ফেলে। সব খুলে বলেন।

আমার ছোট ভাইয়ের বয়স যখন বারো তখন আমাদের পরিবারে একটা বড় ঘটনা ঘটে। ঐ সময়ে মাত্র তিন দিনে আমার চোখের সামনে ভাইটা বড় মানুষ হয়ে যায়। আজ সে আমাদের গোটা পরিবারের কর্তা। মানসিক কৈশোরত্বের সীমা বোধ করি এমন একটা অভিঘাতে ভেসে যায়। (চিঙ্গিস আইৎমাতভের 'জামিলা' গল্পে জামিলার চলে যাবার দৃশ্যে প্রটাগনিস্টের বড় হয়ে যাবার ব্যাপারটা স্মর্তব্য)


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নজমুল আলবাব's picture

আপনি একটা খারাপ মানুষ। জামিলার কথা মনে করিয়ে দিলেন। সাদা কালো প্রচ্ছদের ছোট্ট বইটার কথা মনে করিয়ে দিলেন। যদি কখনো ফিরতে পারি, নিশ্চিতভাবেই শেলফে ওটা আর দেখতে পাবোনা।

এক লহমা's picture

চিঙ্গিস আইৎমাতভের 'জামিলা' ও-হো-হো-হো - কি যে সব ফেলে চলে এসেছি! ওঁয়া ওঁয়া

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

হাসিব's picture

টেনশনে ফালায় দিলেন। ঘটনা খুলে বলেন।

নীড় সন্ধানী's picture

ছেলে যখন ভরসা দেবার মত বয়সে পৌঁছে যায়, তখন বুকের ভেতর কেমন একটা স্বস্তি কাজ করে না?

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নজমুল আলবাব's picture

স্বস্তির সাথে কিছু একটা হারানোর ভয়ও ঘিরে ধরে।

নজমুল আলবাব's picture

এটা অনেক পুরনো অসুখ। এন্ড্রমেট্রিওসিস। কমন গাইনি সমস্যা। ওরটা একটু জটিল হয়ে গিয়েছিলো, তাই অপারেশনটাও জটিল হয়েছে। আস্তে আস্তে ভালর দিকে এখন।

এক লহমা's picture

আশা করি এখন সেরে উঠেছেন।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সুলতানা সাদিয়া's picture

পরিবারের সবাই ভাল আছে আশা করি।
মায়ায় ভরা জীবন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

আয়নামতি's picture

এতদিনে ভাবী নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরেছেন। পুরোপুরি সেরে ওঠেন দ্রুত। শুভকামনা।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.