কবিতার অন্তর্গলি

মাহবুব লীলেন's picture
Submitted by leelen on Mon, 22/10/2018 - 7:20am
Categories:

কবিতা কী এইটা বড়ো মুশকিলের প্রশ্ন। এইটার উত্তর হয় ইশকুলের ছাত্রের মতো হয়; নাইলে হয় মাস্টরের মতো। কিন্তু কোনোভাবেই কবির মতো হয় না। আমি বরং কবিতার মইদ্যে কী পাই সেইটা বলি। কবিতার মইদ্যে আমি মূলত দুইটা জিনিস পাই। প্রথমত একটা পরিস্থিতি আর দ্বিতীয়ত সেই পরিস্থিতির অনুভূতি কিংবা প্রতিক্রিয়া। মানে ততক্ষণে মেঘ গর্জাইয়া বৃষ্টি শুরু হইয়া গেছে নাকি সুরঞ্জনা আরেক বেটার দিকে চইলা যাইতাছে সেইটা। তারপর কবি তার অনুভূতি কিংবা প্রতিক্রিয়া বলা শুরু করেন মানে ‘কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা’ কিংবা ‘বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে...

কবিতার প্রেক্ষিত আর প্রতিক্রিয়া দুইটাই কিন্তু কবির তৈরি। সকল কবিই পরিস্থিতি নির্মাণ কিংবা নির্বাচন করেন অভিজ্ঞতা আর কল্পনা দিয়া। কিন্তু বড়ো কবিরা প্রতিক্রিয়া কিংবা অনুভূতিরে কইরা তোলেন বিশ্বজনীন আর ছোট কবিরা কিপ্টার মতো বানাইয়া রাখেন ব্যক্তিগত। যার লাইগা কারো কবিতা পইড়া পাঠকের মনে হয়- আরে এইটাতো আমারও কথা। মানে সেই পরিস্থিতিতে সেই পাঠক সেইরকমই ভাবতেন কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখাইতেন...

ছোট কবিরা নিজেগো পচাগান্ধা আবেগ নিয়া এতই মগ্ন থাকেন যে অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়াগুলা আর সেই ব্যক্তি কবিরে অতিক্রম কইরা অন্যদের জিনিস হইবার সুযোগ পায় না। যার লাইগা ওইগুলা পড়লে আর ভাল্লাগে না। আরেকজনের ব্যক্তিগত ঘ্যানঘ্যানানি আমার আর কতক্ষণ সহ্য হইব কন?

কেউ কেউ কবিতার মইদ্যে ফিলোসফি চাপাইতে যান। আমার মনে হয় কবিতার মইদ্যে ফিলোসফি চাপাইতে গেলে সেইটা মূলত নিম পাতার শরবতে পরিণত হয়; যা শরীরের লাইগা উপকারী হইলেও ভয়ানক তিতা। হয়ত সেইটা গবেষকগো লাইগা ভালো খোরাক কিন্তু পাঠকের লাইগা অত্যাচার। আরে বাবা কবিতা তো শেষ পর্যন্ত বিনোদন; তাই না?

ফিলোসফি মূলত ব্যক্তির ধারক। ব্যক্তির ফিলোসফিই তার কবিতায় ফুইটা উঠে। মানে ব্যক্তি কবি যে ফিলোসফি ধারণ করেন সেইটাই প্রকাশিত হয় তার অনুভূতি কিংবা প্রতিক্রিয়া প্রকাশে। রবীন্দ্রনাথ গ্যাঞ্জামবিরোধী ভক্তিবাদী মানুষ আছিলেন। তার সব কবিতা শেষ পর্যন্ত কার কাছে যেন হাঁটু গাইড়া বইসা সমাধান প্রার্থনা করে। নজরুল ধর মার কাট। থাবা দিয়া ছিনাইয়া আনার পক্ষপাতি মানুষ। তার কবিতা সব থাবাইয়া খামচাইয়া সমস্যা সমাধানের কথা কয়। জীবনানন্দ ছাড়া ত্রিশের বাকি কবিরা বৃটিশের ছায়ায় বাঙালি নাগরিকত্বের আভিজাত্য উপভোগের পক্ষপাতি মানুষ। তাগো কবিতা সেইরকম। সেইখানে বাঙাল নাই। আছে অকম্মা বাবুদের নাগরিক সঙ্কট। জীবনানন্দ কিন্তু আলাদা। জীবনানন্দ মূলত রাজনীতি এবং নাগরিকতার বাইরে গ্রামবুড়া এক বাঙাল কৃষক। খুব কম বাঙালি আছে যারে জীবনানন্দ আক্রান্ত করে না। এর কারণ কিন্তু ওই কৃষিটাই। সব বাঙালি কিন্তু এখনো ভেতরের ঘরে চাষা...

হাজার বছর ধইরা পথ হাঁটার ফাপড় ছাড়লেও জীবনানন্দ কিন্তু সারাজীবন গ্রামের ধানক্ষেতের আইলেই বইসা ছিলেন। জীবনানন্দ কবিতার পুরাটাই কিন্তু গ্রামের বিগত-যৌবন কৃষকের হাহাকার। পুরুষ কৃষক। একটা অদ্ভুত বিষয় হইল কবিতা কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরুষের শিল্প। ভারতীয় পুরাণে সকল শিল্পকলারে স্ত্রীলিঙ্গ বলা হইলেও কাব্যরে কওয়া হইছে শরস্বতীর পুত্র। মানে পুংলিঙ্গ। এর বোধহয় একটা মানে আছে। আর শত বছরের কবিতার দিকে তাকাইলে এইটার প্রমাণও কিন্তু পাওয়া যায়। এই শিল্পটা নারী লেখকদের হাতে প্রায় খোলে নাই দুনিয়ার কোথাও। বাংলাদেশে তো নাই-ই। নারী আর পুরুষের যৌবনের বৈশিষ্ট্য কিন্তু দুই রকম। নারী যৌবনের বৈশিষ্ট্য আকর্ষণ আর ধারণ ক্ষমতা। পুরুষ যৌবনের বৈশিষ্ট্য কিন্তু দখল আর দলন ক্ষমতা। ফলে নারীর যৌবনহীনতার বৈশিষ্ট্য হয় অবহেলা কিংবা পরিত্যাক্ততা বোধ আর পুরুষের যৌবহীনতার বৈশিষ্ট্য হয় শক্তিহীনতা আর ক্ষমতাহীনতাবোধ...

কবি জীবনানন্দ কিন্তু আগাগোড়া একটা বেটা মানুষ। পুরুষভাবনার বাইরে তিনি কিছু ভাবেনই নাই জীবনে। তার পুরা কবিতাই পুরুষের শক্তিক্ষয় ক্ষমতাক্ষয় এবং বাস্তবে সেই ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের কোনো আশা নাই দেইখা ফুল পাখি লতাপাতা হইয়া আবার ক্ষমতা ভোগের বাসনা। জীবনানন্দের কল্পিত নায়করে হয়ত জীবনে কোনো এক বনলতা একবার কইছিল এতদিন আছিলেন কই। হয়ত সেইটা একটা সাধারণ কথার কথা। কিন্তু সেইটাই তার জীবনের একমাত্র বিশেষ হইয়া উঠার দিন। হয়ত কোনো এক সুরঞ্জনা তার কাছাকাছি আসছিল কোনো একদিন। অথবা সে ভাবছিল হয়ত সুরঞ্জনা তার কাছে আসতে চায়। কিন্তু তার পরেই হয় সেই বনলতা তারে গেস্টরুমে বসাইয়া সারারাত পাশের রুমে প্রেম বিলাইয়া দিছে অন্য কাউরে। হয়ত সুরঞ্জনা তার কাছে আইসা একটা সামাজিক হাসি দিয়া চইলা গেছে অন্য কোনো যুবকের লগে। তারপরে কিন্তু জীবনানন্দের মানস-নায়ক সেই গেস্ট রুমে বইসা কিংবা সুরঞ্জনার বাসর ঘরের পিছনে খাড়াইয়া সারারাত শুনছে ঘাই হরিণির শীৎকার। তার মনে হইছে অন্যের প্রেমে মগ্ন থাইকাও বনলতা কিংবা সুরঞ্জনা মূলত ডাকতাছে তারে। কিন্তু সেই ডাকে সে সাড়া দিতে পারে নাই। কারণ শিকারির তাবুর বাইরে সেই নায়ক বড়োজোর নৈশ প্রহরী কিংবা চোর। তাই সে সারারাত হরিণির ডাক আর শিকারির বন্দুকের শব্দ শুইনা থাকছে পুরাই অস্থির। এরপরে দিনের আলোয় ফিরা গেছে সাধারণ গেরস্থালিতে। সেই গেরাস্থালিতে তার বৌ আছে বাচ্চা আছে। সেই গেরস্থালি ঘরে শুইয়া তার মনে হয় কী মানে আছে এইসবের। তার থিকা মইরা যাই। আবার মরতে গিয়া মনে হয় পায়ের তলায় পড়া থ্যাঁৎলা ব্যাঙও তো আরো বাঁচতে চায়। মশা বাঁচতে চায়। প্যাঁচার মতো হুতুম মার্কা একটা নিশাচর বাইচা থাকে মাত্র পরের দিন আরেকটা ইন্দুর ধরার লাইগা। তয় আমার মরার কী মানে হয়? তার থিকা বরং আমি প্যাঁচার মতো জীবনের সবগুলা ভাণ্ডার কেন শেষ কইরা না যাই...

কিন্তু একজন গেরস্থ তো আবার একজন বাস্তবিক মানুষ। ধান ক্ষেতের আইলে খাড়াইযা তার মনে হয় শইলে তো আর সেই বল নাই লাঙ্গল ধরার। সেই তাকত নাই আচোটা জমি আবার আবাদি করার। কোনো সম্ভবনা নাই আবার মানুষ হইয়া জন্মাইবার। তো তাইলে কি দীর্ঘশ্বাসগুলা ধানি জমির খাল দিয়া ভাইসা যাবে? সেইটা তো হইতে পারে না। আর তার লাইগা; না হয় না হইলাম মানুষ; কাউয়া শালিক হইয়াও তো ফিরা আসতে পারি। তা হইলেও তো দেখতে পারব যা এই জীবনে তৃপ্তি ভইরা দেখতে পারি নাই। এর লাইগাই জীবনান্দ তার কবিতায় প্রেতাত্মার মতো পশুপক্ষি হইয়া ঘুইরা বেড়াইছেন তার পরিচিত জায়গায়। হয়ত এই কারণে যে মানুষ হইয়া আবারও যদি ফিরা আসি তবে কি আর সবকিছু জায়গামতো থাকবে যা আমি থাকতে দেখতে চাই?

শিল্পী নচিকেতারে আমার আগাগোড়া একটা জীবনানন্দ আক্রান্ত মানুষ মনে হয়। নচিকেতার রাজশ্রী-৪ গানটা মনে আছে? ‘আজ থেকে এক হাজার শীত বসন্ত শেষে/ এই পথেই যদি আসি আবার’ …আমার মনে হয় এই গানটা পুরুষদের জতীয় সংগীত। ...শালার এই জীবনে সব চাইলাম। পাইলাম না প্রায় কিছুই অভিজ্ঞতা আর ক্ষমতার দোষে। কিন্তু যদি আরেকটা জন্ম পাই; আরো অভিজ্ঞতা আর আরো ক্ষমতা নিয়া ফিরা আসি তাইলেই কি হবে? সব কি তখন ফিরা পাওয়া যাবে? তখন তো ফিরা আইসা দেখতে হইব যে থুত্থুরে বনলতা উঠানে বইসা নাতনির ঘরের পোতারে পেশ্শাব করায়। ...তো? ফিরা আসা কি আদৌ কোনো সমাধান?

দুনিয়াতে বুইড়া কিংবা অক্ষম পুরুষের লাইগা কিন্তু সহানুভূতির বড়োই অভাব। জীবনানন্দ যৌবনটারে খুব বেশি বুঝছিলেন বইলা সম্ভাব্য যৌবনহীনতার কথা কইছেন। যেইটা কিন্তু মনে মনে সকল বেটা মাইনসেরই দুশ্চিন্তা। কারণ চুলে রং কইরা বাইরে চ্যাংড়া সাজলেও নিজের মাজার জোরের খতিয়ান তো হগ্গলে নিজেরা জানে...

জীবনানন্দের বেশিরভাগ কবিতাই হয় পাস্ট টেন্স না হয় ফিউচার টেন্সে- এইটা হইছিল আর ওইটা হওয়াইমু। বর্তমান প্রায় অনুপস্থিত। কারণ তার বর্তমানটা হইল ধানক্ষেতের আইলে বইসা দীর্ঘশ্বাস ফেলবার সময়...

আমরা বাঙালরা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত গ্রামীণ বইলা গ্রাম-জীবনের চিত্রকল্প তুইলা আনা জীবনানন্দ বাঙালির কাছে এখনো অত বেশি প্রিয়...

জীবনানন্দের পাশাপাশি যদি শামসুর রাহমানরে বসাই তাইলে কী দেখা যায়? শামসুর রাহমান নাগরিক মানুষ। বাঙালিরা কিন্তু এখন নাগরিক হইবার পথে। নাগরিকতার কিছু কিছু বিষয়ে তাগো আগ্রহ জন্মাইছে। যার লাইগা কিন্তু জনসমাগমে বাঙালি শামসুর রাহমানের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু একাকীত্বে আবার চাষা; আবার সেই জীবনানন্দ কিংবা ভক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথ...

সৈয়দ হক কিন্তু বাংলা ভাষায় লিখতে থাকা একজন ইউরোপিয়ান লেখক। লেখার কারিগরি জানেন খুব বেশি; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার লেখায় বাঙালিরা অনেকটাই আরোপিত কারেক্টার। সারাজীবন চেক এন্ড ব্যালেন্স কইরা চলা সৈয়দ হক ব্যক্তিজীবনে যেমনি ঝাপসা মানুষ তেমনি তার লেখায় ফিলোসফিও ঝাপসা। তার কবিতাগুলারে শেষ পর্যন্ত কোনোখানে নিয়া গিয়া আপন করা যায় না; শুধু তার ‘পরানের গহিন ভিতর’ ছাড়া। ওইটা অনেক বেশি আন্তরিক মনে হয়; মনে হয় এই কারণে যে তিনি নিজে ভাওয়াইয়া বাংলার সন্তান আর গেরস্থ মানুষ আর কবিতার বইখানও করেছেন সেই ভাওয়াইয়া টোনে গেরস্থালি বিষয় নিয়া... কিন্তু বাকিগুলা? ইউরোপিয়ান স্টাইলে বাংলাদেশ আর বাঙালির বর্ণনা...

তো ফিলোসফিটা কিন্তু বিশেষ কোনো কবিতার না। কবির। সেইটাই কবি লিখতে থাকেন সারা জীবন ধইরা। আর আমরাও সেইটা খুইজা নিয়া নিজেগো লগে মিলাইয়া কই- অমুক কবিরে আমার ভাল্লাগে অমুকরে তেমন না...

মাঝে মাঝে কেউ অবশ্য কবিতার ক্ষেত্রে ভাষা ছন্দ গ্রামার এইগুলা নিয়া বহুত মাতামাতি করেন। কিন্তু ওইগুলা কবিতার বড়ো উপাদান হইলে তো সত্যেন্দ্রনাথ কিংবা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হইতেন বাংলার সবচে বড়ো কবি। ওইগুলা কিন্তু কবিতার বাড়তি অলংকার। সুন্দর মাইনসেরে অলংকার পরলে হয়ত একটু বেশি ভালো লাগে; কিন্তু সৌন্দর্যটা মূলত তার নিজস্ব গুণগত বিষয়। অলংকারের আলনা তো আর সৌন্দর্যের লাইগা পুরস্কার পাইতে পারে না। ঠিক না? তো বেশি অলংকারওয়ালা কবিতারেও বরং মনে হয় কবিতার গ্রামারের পাঠ্যপুস্তক; কবিতা না...

যে কবিতটা লেখা হইতাছে সেইটা কার লাইগা লেখা হইতাছে সেইটা কিন্তু একটা বিষয়। মানে যে পরিস্থিতিটা তৈরি করা হইতাছে সেইটা পাঠক কল্পনা করতে পারব কি না। কিংবা সেইটারে নিজের পরিস্থিতি ভাবতে পারবে কি না সেইটা কিন্তু কবিতার গ্রহণযোগ্যতার মূল বিষয়। আগ্নেগিরির মুখের মইদ্যে গোলাপ গাছ কল্পনা করা বাঙালির পক্ষে যেমন সম্ভব না তেমনি পাইন গাছের পাতা ঝরা বিষণ্নতা কল্পনা করাও সম্ভব না। ফলে অগ্নিগিরির মুখে পইড়া গোলাপ হাসে না কান্দে কিংবা ঝরাপাতা পাইন গাছের গোড়ায় বসলে পচা পাতার গন্ধে দম আটকায় না মন ফুরফুরা হয় সেইটা কিন্তু কোনোদিনও বাঙাালির পক্ষে ভাবা সম্ভব না। ফলে এই চিত্রকল্পগুলা নিজের মনে হয় না....

বাঙালিরা কিন্তু বহুত বিদেশি বই পড়ে। বাংলাদেশে বহুত বিদেশি নাটক উপন্যাস মারাত্মক মাত্রায় জনপ্রিয় আছে। কিন্তু জীবনে কোনোদিন বাংলাদেশে কোনো বিদেশি কবিতা জনপ্রিয় হইতে শুনছেন? দেখছেন? ওইগুলা হয় না। হওয়ার কথা না। কারণ সেই পরিস্থিতিটারে কোনোভাবেই আমরা নিজের পরিস্থিতি বইলা ভাবতে পারি না। তো প্রতিক্রিয়াটা আমার হইব কেমনে?

আরেকটা বিষয় হইল ভাষা। মধুসূদনের মতো লোকজ আর গ্রাম্য লেখক কিন্তু বাংলায় দ্বিতীয় কেউ নাই। কিন্তু তিনার ভাষাটা সংস্কৃত’র মতোই কঠিন। ফলে কী হয়? রাক্ষসপতি প্রাসাদ শিখরে উঠার পর থাইমা যাইতে হয়। তিনি ইউরোপে মাইর খাইয়া বাংলা আইসা বাঙাল হইলেও কিন্তু কবিতায় আভিজাত্য তৈরি করতে চাইছিলেন। তিনি বাঙাল বিষয় নিছেন কিন্তু বাঙাল ভাষা নেন নাই। অথচ তার নাটকগুলা কিন্তু সাবলীল বাংলায় লেখা। ফলে তিনি মাইর খাইছেন ভাষায়। তার ভাষা পইড়া অনুভূতিগুলা ঠিক বোঝা যায় না। হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’ এই পর্যন্ত বোঝার পর সেই ভাণ্ডারের রতন পাহারা দেওয়া হইব না চুরি করার মতলব আছে সেইটা বুঝতে কিন্তু ডিকশোনারি ঘাঁটতে হয়। আর ডিকশনারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে পাঠকের আবেগ ঢিলা হইয়া যায়। এই ভাষা সমস্যা নতুন কবিগো মাঝেও আছে। এমন সব শব্দ দিয়া এমন সব পরিস্থিতি কিংবা চিত্রকল্প তৈরি করেন যে আগামাথা কিছুই মাথায় ঢোকে না। তো সেইগুলা খুব সুন্দর বাক্য রচনা হইলেও আমার মনে হয় না কবিতা হইয়া উঠে। কারণ কবিতা যদি কবির মগজ থাইকা বাইর হইবার পর পাঠকের মগজে ঢুইকা তার নিজের চিত্রকল্পে পরিণত না হইতে পারে তো সেইটা কবিতা হয় কেমনে?

২০১৬.০১.২৩ শনিবার

[লেখাটা পুরানা এক বেহুদা লেখা। আইজ হঠাৎ মনে হইল ২২ অক্টোবর জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুদিন। মনে হইল লেখাটা প্রকাশ করা যায়। কইরা দিলাম। কবিতারই তো কথা]


Comments

সৈয়দ ফয়সল আহমদ   's picture

ভালো লাগছে কবি।

মাহবুব লীলেন's picture

আহা ধন্যবাদ

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

১। অনেক জায়গায় ভাষাটা আরোপিত মনে হলেও লেখাটা পড়ে আরাম পেয়েছি। কেন? কারণ, আমার নিজের ভাবনাটা এর সাথে মিলে যায়। সিনক্রোনাইজ করে। অনুরণিত হয়। সকাল সকাল লেখাটা পড়ে মনে হলো দিনের শুরুটা ভালো হলো।

২। প্রচুর কবিতা, প্রচুর গদ্যও, মার খেয়ে যায় ভাষা-রূপক-উপমার দুর্বোধ্যতার জন্য। এর কিছুটা জটিলতা বা এক্সেপশনের প্রতি কবি/লেখকের লোভ, কিছুটা আম-পাঠকের প্রতি অবজ্ঞা আর বাকিটা কবি/লেখকের অজ্ঞতা/অক্ষমতার কারণে। আমি এক বহু পুরস্কার পাওয়া গদ্যকারকে দেখেছি যিনি বাস্তব জীবনে সর্বজনবোধ্য ভাষায় কথা বলেন, উদাহরণ দেন; কিন্তু তিনি লিখতে গেলেই কলমের ডগা দিয়ে গ্রানাইট, ব্যাসল্টের মতো জিনিস বের হয়। এটা তাঁর সীমাবদ্ধতা - তিনি স্বীকার করুন আর নাই করুন।

৩। আমি বাংলা ভাষার পাঠক। বাংলার বাইরে অল্প-স্বল্প ইংলিশ বুঝি। ইংলিশে গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ-নিবন্ধ-অভিসন্দর্ভতে দাঁত ফুটাতে পারলেও ইংলিশ কবিতা আমার নাগালের বাইরে দিয়ে চলে যায়। কবি যখন বলেন,

Suddenly I saw the cold and rook-delighting heaven
That seemed as though ice burned and was but the more ice,
And thereupon imagination and heart were driven
So wild that every casual thought of that and this
Vanished, and left but memories, that should be out of season
With the hot blood of youth, of love crossed long ago;

আমি তার শব্দার্থ করতে পারি কিন্তু তার রূপ-রস-সৌন্দর্য কচুপাতার পানির মতো ঝলকে ঝলকে পাতা না ভিজিয়ে চলে যায়। আমার এই সমস্যা বোধকরি অন্য আরও অনেক পাঠকের আছে। তাই খুব ভালো ভালো কবির করা অন্য ভাষার কবিতার বাংলা কাব্যানুবাদও হালে পানি পায়নি।

৪। কবিতার ফর্ম নিয়ে, গ্রামার নিয়ে আলোচনা আমার কাছে দমবন্ধ লাগে। বেশিরভাগ সনেট দেখলে আমার মনে হয় শব্দ-ছন্দ-পংক্তি গুনতে গুনতে কবি আর স্বাধীনভাবে নিজের মনের ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। কবির রোমান্টিক-আধুনিক-উত্তরাধুনিক ইত্যাদি বিভাজন দেখলে মনে হয় "যেহেতু এই ব্যাটার মুখে দাড়ি আছে গোঁফ নাই তাই এ মুসলমান; যেহেতু এই ব্যাটার মাথায় লম্বা চুল আছে তাই এ শিখ" ধরনের ভাগজোক। আর দশক অনুযায়ী কবির বিভাজনকে 'বান্দরের হাতে খন্তা'র কথা মনে করিয়ে দেয়।

৫। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, নচিকেতা, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মধুসূদন দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী - আলোচনাটা আরও চলতে পারতো। আসলে চলা দরকার ছিল। কারণ, বেশিরভাগ জনের কাব্য বিশ্লেষণ বা কবির কীর্তি নিয়ে আলোচনা পড়লে মনে হয় স্কুলে ধর্ম শিক্ষার ক্লাসে বসে আছি। এই লেখাটা পড়লে বোঝা যায় কাউকে নাকচ না করে, কাউকে ছোট না করে, কাউকে অবজ্ঞা বা অবহেলা না করেও তুলনামূলক আলোচনা করা যায়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন's picture

অনেক ধন্যবাদ পাণ্ডব দা। আমি নিজেরে কবিতার ভোক্তা মনে করি। সবজি বাজার থাইকা মাইনসে যেমনে পছন্দ আর পরিমাণ মতো যার যখন যা ইচ্ছা তা নেয়; আমিও সেইভাবে নেই। অন্যগুলা না নেওয়া মানে সেইগুলারে বাদ দেওয়া বোঝায় না; আবার পরে নিব না সেইটাও বোঝায় না...

০২
হয়ত অন্য কোনো এক সময় কবিতা নিয়া অন্য দুয়েকটা প্রসঙ্গ লেইখাও ফালাইতে পারি আপনার কমেন্টে ভরসা রাইখা

অতিথি লেখক's picture

এখন আর কেউ এত কিছু মেনে কবিতা লেখে না।
NailaRahaman

মাহবুব লীলেন's picture

কে জানে। মানা না মানা কবির বিষয়; পড়া না পড়া পাঠকের

অতিথি লেখক's picture

এইটা মুশকিলের প্রশ্ন! তোমারে কইছে। বছর বছর বাংলা একাডেমি দিতে হয় না? তিনারা ভালো করেই জানেন উহা কী বস্তু।

প্রেক্ষিত আর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটা দারুণ বলছো।

---মোখলেস হোসেন

মাহবুব লীলেন's picture

কইতে ইচ্ছা করল সাহস কইরা বইলা দিলাম

ত্রিমাত্রিক কবি's picture

লেখাটা ভালো লাগছে। কবিতা নিয়ে গৎবাঁধা চিন্তার বাইরে এইরকম আলোচনা ভালো লাগে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মাহবুব লীলেন's picture

আহা

করবী মালাকার's picture

" কবিতা যদি কবির মগজ ------- চিত্রকল্পে -----------কবিতা হয় কেমন?"
এইডাই আসল কতা। নিয়ম কানুন, ভাষা যা থাহে থাহুক।

মাহবুব লীলেন's picture

হ। কলিজায় ধাক্কামারা বাক্যাবলীই হইল কবিতা

আব্দুল্লাহ এ.এম.'s picture

বড়ো মুশকিলের একটা প্রশ্নের এইরকম সাচিব একটা ব্যাখ্যা দানের প্রচেষ্টায় বেশ জুইত অনুভব করা গেল। চলুক

মাহবুব লীলেন's picture

এইভাবে কইলে কবিতার মানহানির লাইগা যে আবার অনেকে ক্ষেইপা উঠে?

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

লেখাটা পড়ে একজন পাঠক আমাকে প্রশ্ন করেছেন, লেখকের আলোচনায় জসীম উদ্‌ দীন অনুপস্থিত কেন? সেটার উত্তর তো আমি জানি না, তাই এখানে খোদ লেখকের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন's picture

এক্কেবারে সরল উত্তর হইল এই পর্যন্ত লিখতে গিয়া জসমি উদদীনের কথা মাথায় আসে নাই...

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

বাংলা কবিতার কথা বললেন, ধান 'খেত'-এর আইলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কথা বললেন অথচ জসীম উদ দীন আপনার মাথায় আসেনি! তাহলে 'জসীম উদ দীন' কি আপনার মননে ইতোমধ্যে মারা গেছেন? নাকি তিনি আপনার মননে কখনো বাস করতে পারেননি?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন's picture

বিপদে ফালাইলেন। আমার হিসাবে কবি জসিম উদ্দিন পল্লির কাব্যিক ডকুমেন্টারি করছেন; অথবা কইতে পারে ইলাস্ট্রেশন। পড়তে ভাল্লাগে; কিন্তু দাগ কাটে না; সত্য কথা

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

আলোচনাটা একটু বাড়াই। পল্লীবাংলার প্রকৃতি ও মানুষ - এই দুটোর চিত্রায়ণে জসীম উদ দীন অনন্য। এটা কারো ভালো লাগতে পারে, কারো নাও লাগতে পারে। তবে এই চিত্রায়ণের মান, গভীরতা ও বিস্তৃতি নিয়ে সন্দেহের কিছু নেই। এখন ব্যক্তি মাহবুব লীলেনের বাইরে এটাকে যদি একটা সাধারণ সমস্যা হিসাবে দেখি - জীবনানন্দ দাশে আকণ্ঠ নিমগ্ন একজন পাঠকের মাথায় কী কারণে জসীম উদ দীন স্থান করতে পারেন না? আমার কাছে এর দুটো সম্ভাব্য উত্তর মনে হয়।

এক, এই পাঠকের কাছে জসীম উদ দীনের চিত্রিত পৃথিবী পরিচিত বটে, কিন্তু আপন নয়। পরিচিতিটা হয়েছে আরও দশ জনের কাছ থেকে শুনে, কিন্তু সেটা তার প্রত্যক্ষণের সাথে বা যাপনের সাথে সম্পর্কিত নয় বলে আপন নয়। এই কারণে, জসীম উদ দীন তাকে চমৎকৃত করে, কিন্তু দাগ কাটে না।

দুই, জসীম উদ দীনের সৃষ্টি মূলত বিশাল ক্যানভাসের এক কোনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অন্তর্দর্শী মানুষের বর্ণিত ঐ ক্যানভাসের বিস্তারিত বিবরণ। সেখানে বর্ণনাকারী ক্যানভাসের অন্তর্ভুক্ত কোন এলিমেন্ট নন্‌। তাঁর রচনায় 'আমি' মোটামুটি অনুপস্থিত (একটা ব্যতিক্রম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে - তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়!)। পক্ষান্তরে জীবনানন্দ দাশে 'আমি'ই প্রবল। সেখানে যাবতীয় কষ্টের, বেদনার, দুঃখের, হতাশার ভারবাহী 'আমি'। আনন্দ, সাফল্য, সুখ, গৌরবের অধিকারীও 'আমি'। তাই সেখানে পাঠক আর লেখক এক সত্ত্বায় লীন হয়ে যান। জীবনানন্দ যতোটা না চমৎকৃত করেন তারচেয়ে বেশি মনে গভীর দাগ কাটতে কাটতে যান।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন's picture

কবিতার উপলব্ধি বিষয়ে আলোচনা শুনি মনোযোগ দিয়া; কিন্তু তর্ক করি না। তবে কোনো এক কারণে চাষিবাংলা থাইকা উইঠা আসা মানুষেরা কবিতায় জসীম উদদীন থাইকা জীবনানন্দের দিকে ঝুইকা পড়ে; সেইটাও একটা বিষয়

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

এসব নিয়ে তর্ক আমারও পছন্দ না, তবে আলোচনা পড়তে/শুনতে মন্দ লাগে না।

Quote:
তবে কোনো এক কারণে চাষিবাংলা থাইকা উইঠা আসা মানুষেরা কবিতায় জসীম উদদীন থাইকা জীবনানন্দের দিকে ঝুইকা পড়ে

- কঠিন কথা বলে ফেললেন। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে কথাটা খুবই সত্যি। যেমন, আমার নিজের ক্ষেত্রে। কিন্তু এটা কেন ঘটে সেটা হিসেব করে কূল পাই না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা's picture

আমার কাছে দুইজনের কবিতাই আপন লাগে, অবাক লাগে! যেখানটায় তফাৎ লাগে - জসীম উদ দীন-এর লেখা পড়ে বুক মোচড় দিয়ে ওঠে আর সেই সাথে মনে হয় কি সহজ সরল ভাবে এল এই মোচড়! বিপরীতে জীবনানন্দ এক অজানা/অভাবিত বিষ্ময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন। কখনো সহজে বুঝি, কখনো সহজে নয় - কিন্তু অভিভূত হই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুলিরেখা's picture

আমার কিন্তু খুব দাগ কাটে। জসীম-উদ-দীন। "আজও এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে/ নীরবে বসিয়া কোন্‌ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে/ মধ্যে অথই শুনো মাঠখানি ফাটলে ফাটলে ফাটি/ ফাগুনের রোদে শুকাতেছে যেন কী ব্যথারে মূক মাটি" অথবা সেই " দুইহাতে বুড়ি জড়াইতে চায় আঁধার রাতের কালি/ উতলা বাতাস ধীরে কয়ে যায় সব খালি সব খালি" অথবা "ওই যে দূরে মাঠের পারে সবুজ ঘেরা গাঁ/ কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা/ সেথায় আছে ছোট্টো কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া /সাঁঝ আকাশে ছড়িয়ে পড়া আবীর রঙে নাওয়া "
-প্রত্যেকটা লাইন বুকের মধ্যে চলে যায়, অন্তরের মধ্যে যে চাষাণী বাস করে আমার, সে জেগে ওঠে। "নতুন চাষার নতুন চাষাণী নতুন বেঁধেছে ঘর/ সোহাগে আদরে দুটি প্রাণ যেন করিতেছে নড়চড়।" এইধরণের পংক্তি অতুলনীয়, এত সরল অথচ এত গভীর!

সম্প্রতি চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পড়তে পড়তেও এই অনুভব হল। অমন সোনার লঙ্কা জমজমাট, কিন্তু ধরে রাখতে পারে না। সুখ নাই শান্তি নাই। রাজরাজেশ্বরী মন্দোদরী বিষ খেয়ে মরতে যায় স্বামীর অবহেলায়। রাজামশাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে লড়াই করে বেড়ান কাহা কাহা মুল্লুকে। এইসব ঝামেলা পার হয়ে যেখানে মাধব আর সতার কথা আসে, সেইখানে এই দরিদ্র ধীবর দম্পতির সংসারের কাব্য পড়ে মনে হল দুনিয়ার আর কোনো মহাকাব্যে কাব্যে কাহিনিতে এইরকম দম্পতি আসে নি, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দম্পতি ওরা।
( হ্যাঁ, এই লেখাতে মহিলা কবিদের নিয়ে যে বক্তব্য আছে, তাতে আমার কিছু দ্বিমত আছে। তেমন তেমন ভালো মহিলা কবির কাজ পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু সেটা সমাজের জন্যও হতে পারে। চন্দ্রাবতীর মত এক দুইজনের কাজ খানিক বেঁচে গিয়েছে, হয়তো অসংখ্য মহিলা শ্লোককারের কাজ হারিয়ে গিয়েছে। মুখে মুখে কাব্যরচনার যুগে হয়তো অনেক মহিলা কবিই ছিলেন, কিন্তু তাঁদের নাম হারিয়ে গিয়েছে )

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

প্রাচীনকাল বা মধ্যযুগ লাগবে না, এই কলিযুগেও আমি অনেক নারী দেখেছি যারা ছন্দ মিলিয়ে, উপমা মিলিয়ে কথা বলেন। বিদ্রুপ, শ্লেষ, হতাশা, উৎসাহ মেশানো উত্তর দেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী মুখে মুখে আদি, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, অদ্ভুত, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও শান্ত রসে ডোবানো দ্বিপদী রচনা করেন। অসংখ্য বাংলা লোকগানের রচয়িতা নারী। এখানে নারী হাইলাইটেড হয়নি সামাজিক কারণে, সমাজে নারীর অধঃপতিত অবস্থানের কারণে।

এদেশে নারীরা লেখাপড়া করা শুরু করেছে অল্প কিছু দিন হয়। এখনো বিপুল হারে নারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সংস্রব থেকে বহু দূরে। এবং এখনও নারীর সামাজিক অবস্থান শক্তপোক্ত নয়। তাই ছাপার হরফের বাংলা কবিতায় নারীর অবস্থান দুর্বল হওয়া স্বাভাবিক।

বাংলা কবিতা থেকে নারীর শরীরের বর্ণনা আর তাকে শারিরীকভাবে কামনা করার পুরুষের প্রচেষ্টাকে যদি বাদ দেই তাহলে সেটা মোটামুটি পালকবিহীন, ডানাবিহীন পাখিতে পরিণত হবে। এটা ঠিক নাকি বেঠিক সেই অহেতুক তর্কে না গিয়ে বলা যায় বাংলা ভাষার নারী কবিদের কবিতায় শরীর ও শারিরীক কামনা মোটামুটি অনুপস্থিত। যে এক-আধজন সেই বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করেছেন গোটা সমাজ উঠেপড়ে লেগে তাঁর গায়ে 'নষ্টা' তকমা সেঁটেছে, যদিও একই প্রকার লেখা একজন পুরুষ লিখলে তারা গায়েই মাখেনি। আবেগের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে এই সামাজিক বাধা বাংলা ভাষার নারী কবিদের প্রকাশকে অদৃশ্য আইনের নিগড়ে বেঁধেছে। আবেগের প্রকাশ যদি অবাধ ও সৎ না হয় তাহলে পাঠ্যপুস্তকের কবিতা রচনা করা সম্ভব হলেও মহৎ কাব্য রচিত হয় না।

আলোচনাটা আর বাড়ালাম না। আমার কাছে কাব্য সরস্বতীর পুত্র বা কন্যা নয় - তাঁর আশীর্বাদের অথবা করুণার প্রকাশ মাত্র।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা's picture

পূর্ণ সহমত। এটা ঠিক যে আলোচনাটা আর বাড়ালে সেটা এই পোস্টের জন্য ঠিক না থাকতে পারে। সেই বিবেচনায় তোমার কাছ থেক একটা নূতন পোস্টে আরো আলোচনার অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

দিলেন গুড় লাগায়া!

যেহেতু আমি কবি না, বা কবিতা লেখার ক্ষমতা আমার নেই তাই কবিতা নিয়ে বিশেষ আলোচনা করতে চাই না। কবিতা নিয়ে অকবিদের আলোচনা দেখলে কবিরা বিরক্ত হন। অনেক অকবিও মনে করেন অকবিদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা উচিত না। অমনটা করলে কোন কবি পাশ কাটিয়ে যান বা ভদ্রতাবশত দুয়েকটা কথা বলে বিদায় নেন, আর কেউ কেউ গালাগালি করেন। আমরা সাধারণ পাঠকেরা বরং বিষয়টা সময়ের হাতে ছেড়ে দেই। এক কালের কবিতার বহু রাজাগজাকাপ্তানমৌলানা'র নাম বা কাব্যকীর্তি আজ ইলেক্‌ট্রন মাইক্রোস্কোপ বা হাবল্‌ টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

নারী কবিদের অপ্রকাশের ভার নারীর প্রতি সমাজের এবং পুরুষের অনিঃশেষ অন্যায়, অপমান, অবিচার, অনভিপ্রেত আচরণ প্রকাশের একটা উদাহরণ মাত্র।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন's picture

তক্কে যাব না। তবে কবিতা বইলা এইখানে আমি যা বলছি সেইটার মইদ্যে বোধহয় চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পড়ে না। সেইটা অন্য বিষয়

সোহেল ইমাম's picture

অনেকদিন পর কবিতা নিয়ে একটা সুন্দর লেখা পেলাম।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.