বঙ্গবন্ধু

তাসনীম's picture
Submitted by tmhossain on Wed, 15/08/2018 - 2:24am
Categories:

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার কোন স্মৃতি নেই। আমার স্মৃতি জমাট বাঁধার বয়েস হওয়ার অনেক অনেক আগেই তিনি নিহত হয়েছেন। নিজ বাসভবনের সিঁড়িতে তাঁর বুলেটবিদ্ধ দেহ পড়ে ছিল। আশেপাশে স্বজন, সন্তানদের লাশ। সেই লাশের মিছিলে তাঁর ১০ বছর বয়েসি পুত্রও ছিল। তিনি নিহত হয়েছিলেন সেনাবাহিনির একাংশের হাতে। আমি সারাজীবন ধরে সেই রকমই শুনে এসেছি। সেনাবাহিনির অন্য অংশ তখন কি করছিল সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাটা মনে হয় মহাপাপ। পরদিন সকালের খবরের কাগজ (যেটা এখন অনলাইনে পাওয়া যায়) একদম "বিজনেস অ্যাজ ইউসুয়াল" - দৈনিক বাংলার পেছনের পাতায় দেশে চোখের রোগ বেড়ে যাচ্ছে বলে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। খবরে জানা যায় - ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার শপথ নিয়েছে। কোথাও কোন প্রকাশ্য শোক নেই।

১৯৭৫ সালের ১৫ ই অগাস্ট আমার বয়েস ৫ এর মতো। সেইদিন সকালের কথা সামান্য মনে আছে। বাসায় বড়দের দেখে মনে হয়েছিল ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। আকাশ সম্ভবত মেঘলা ছিল, কিংবা সেটা আমার কল্পনাও হতে পারে। সেই বর্ষার দিন থেকে বঙ্গবন্ধু শুধু নিহত নন, নির্বাসিতও হলেন। আমার মনে আছে শাহবাগের কাছাকাছি একটা বিলবোর্ডে বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি ছিল। সেই ছবিটা থেকে ঘষে ঘষে তাঁকে তুলে ফেলা হল। একটু লক্ষ্য করলে যদিও তাঁকে খুঁজে পাওয়া যেত। কিছুদিন পরে সেই বিলবোর্ডও গায়েব। ঘাতকবান্ধব রাজকারতন্ত্র ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। তারা খানাতল্লাশী করে বংগবন্ধু মুছে ফেলা শুরু করল। পারলে মানুষের বুক চিরে বঙ্গবন্ধুকে বের করে নিয়ে আসে তারা।

৩২ নম্বরে তাঁর বাসভবনে কবরের নিস্তব্ধতা। সামনে টিমটিমে একটা বাতি জ্বলে - আধমরা দু'জন পুলিশ পাহারা দেয় সেই বাসা। বঙ্গবন্ধু কোথাও নেই, সিলেবাসে নেই, লেবাসে নেই, স্বাধীনতা দিবসে নেই, বিজয় দিবসে নেই - প্রিন্স অফ ডেনমার্ক ছাড়া হ্যামলেট রচনার গুরুদায়িত্ব বর্তালো আমাদের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোতে। পুরনো সিনেমার কোর্টসিনের পেছন বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝাপসা করে দেওয়া হলো, কোন বইয়ের প্রচ্ছদের বঙ্গবন্ধু ছোট ছবি থাকলে অতি কৌশলে তার উপর বুড়ো আঙ্গুল রাখতেন উপস্থাপক। বঙ্গবন্ধু নামক এক বিশাল মানুষকে লুকিয়ে ফেলা সহজ কাজ নয়, সরকারী ঝানু আমলা, ৭১ এর ঘাতক, নীতিহীন রাজনীতিবিদ - সব্বাই উঠে পড়ে লাগলো - এই দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুকে চিরতরে সরিয়ে ফেলতে হবে। আমাদের নতুন নেতা কালো সানগ্লাস পড়েন, তিনি "পলিটিক্স ডিফিকাল্ট" করে দেওয়ার মূলমন্ত্র নিয়ে এসেছেন। আমাদের গোপন দোষগুণ তার জানা, পশ্চাৎদেশে সবারই মূল্য লেখা থাকে, শুধু কাপড় উঠিয়ে দেখে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। আমরা দ্রুত পরিবর্তনের পথে হাঁটলাম। ১৬ ডিসেম্বরের পত্রিকাতে লেখা হয় - এই দিন আমরা হানাদার মুক্ত হয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনি আর তাদের দোসরদের হাতে বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। কারা হানাদার, কারাই বা সে দোসর? সব প্রশ্ন করতে হয় না। হারিয়ে গেল জয়বাংলা, হারিয়ে গেল সাধের ধর্ম নিরপেক্ষতা, হারিয়ে গেল স্মৃতিময় রেসকোর্স, হারিয়ে গেল তর্জনীতে রাখা স্বাধীনতা ...আমরা বড় হতে থাকি এক অন্ধকার সময়ে।

১৯৯৬ সালের অগাস্ট মাস আমি দেশ ছাড়ি। সেই বছরই ২১ বছর পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। নির্বাচন সম্ভবত জুন মাসে হয়েছিল। ফলাফল আওয়ামী লীগের দিকে যেতে শুরু করার পর রাত দশটা সাড়ে দশটার দিকে হঠাৎ করে শুনি টেলিভিশনে ৭ই মার্চের ভাষণ হচ্ছে। ২১ বছর পর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু!!! আওয়ামীলীগ সরকার শপথও নেয় নি তখন। বিটিভির মহাপরিচালকও একই। একদিন আগেও যেখানে বঙ্গবন্ধু নামটা উচ্চারণও নিষিদ্ধ ছিল - সেইখানে রাতারাতি ৭ ই মার্চ? ক্ষমতার পালাবদলের গন্ধ টের পেতে এদের বেশি সময়ে লাগে না। চাটার দল তো সব সময়ে চেটেই যাবে।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে এই দেশের মানুষ ভুলে নি, সেই ঘোর দুঃসময়েও না। মানুষের হৃদয় বিলবোর্ড না, সিনেমার ফিল্ম না, বইয়ের প্রচ্ছদ না, টিভির পর্দা না, পত্রিকার মিথ্যে সম্পাদকীয় না। সবার অগোচরে বঙ্গবন্ধু রয়ে গেছেন মানুষের হৃদয়ের গভীরে। ঘাতকের বুলেট অতদূরে পৌঁছায় না, সরকারী ফরমান স্পর্শ করতে পারে না তাঁকে, আমলার কূটকৌশল সেইখানে গিয়ে বানচাল হয়ে যায়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম ঘাতকদের বিচার দাবীতে স্বতঃস্ফুর্ত মানুষের মুখে জয়বাংলা শ্লোগান, বুকের ভেতরে বঙ্গবন্ধু, যেই শাহবাগের কাছের বিলবোর্ড থেকে তাঁকে উপড়ে ফেলা হয়েছিল, তিনি সেইখানে ফিরে আসেন - সদর্পে, অকুতোভয় - বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে না।

১৯৯৬ সালের পরে ৩ দফা সরকার গঠন করেছে। এখনও ক্ষমতাতেই তারাই আছে। কোন শক্ত প্রতিপক্ষ নেই যে তাদেরকে রাজপথে হারিয়ে দেবে। এখন সবাই আওয়ামী লীগ। জামাতীরাও লীগে যোগদান করছে দলে দলে। মুজিব কোটের মার্কেটও মন্দ না সম্ভবত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অশ্লীল চাটুকরিতা দেখে আর বিস্মিত হই না। কারো কাছে মাথা না নত করা মানুষটির দল মৌলবাদের কাছে অহরহই নতজানু হচ্ছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা চাহিয়া লজ্জা দিবেন না...বর্তমানের আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু আছেন পোস্টারে, প্ল্যাকার্ডে, শোকদিবসের র‍্যালির সামনের ছবিতে, বিরিয়ানির প্যাকেটে, সস্তা রাজনীতির ময়দানে, চাটার দলের চাটুকরিতাতে। এই অসম্মান তাঁর প্রাপ্য নয়।

আমি বিশ্বাস করি সেই দুঃসময়ে যেমন বহু বহু মানুষ আপনাকে হৃদয়ে ধারণ করে গেছে, এই নতুন দুঃসময়ে আপনি এখনও হৃদয়ে রয়ে গেছেন অনেক মানুষের। এরা কেউ টেন্ডার প্রত্যাশী নয়, নির্বাচনের প্রার্থী হওয়া খায়েশ নেই ওদের, সরকারের ভাণ্ডার লুট করার সামান্য ইচ্ছেও নেই তাদের, হল বা অন্যের জমি দখল করার গোপন বা প্রকাশ্য বাসনা নেই - এরা একদম সাধারণ মানুষ - এরাই ইতিহাসের ধারক ও বাহক, এরাই ইতিহাসকে লালন করে নেয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। এরা জানে বঙ্গবন্ধুকে কেনা যায় না, বিক্রি করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে শুধু ধারণ করতে হয়।

যতদিন এই মানুষগুলো আছে, আপনাকে কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।


Comments

ইয়ামেন's picture

তাসনীম ভাই, এই লেখার অংশবিশেষ মনে হয় আগে আপনার ফেসবুকেও পোস্ট হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন। তখনও অসম্ভব ভালো লেগেছিল, এখন আরো সম্পূর্ণরূপে পেয়ে আরো বেশী ভালো লাগলো।

বিগত কোটা এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আমার একটা জিনিস যা অভূতপূর্ব লেগেছিল তা হলো আন্দোলনকারীরা হোক বা জনসাধারণ, তাদের বর্তমান লীগ সরকার, ছাত্রলীগ ইত্যাদির উপর যতই ক্ষোভ থেকে থাকুক (সঙ্গত কারনেই অনেক ক্ষেত্রে), সেই ক্ষোভের লেশমাত্র বঙ্গবন্ধুর উপরে পড়তে দেখি নাই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন প্রকার ট্রলিং বা কটুক্তি দুই একজন ইডিওট ছাড়া কাউকেই করতে দেখি নাই।
লীগ যাই হোক, বঙ্গবন্ধু যে সবকিছুর উর্দ্ধে, গত এক দশকে অন্তত এই একটা জিনিস মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলেই আমার মনে হয়েছে। এইটাও একটা বড় প্রাপ্তি।

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

তাসনীম's picture

Quote:
বিগত কোটা এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে আমার একটা জিনিস যা অভূতপূর্ব লেগেছিল তা হলো আন্দোলনকারীরা হোক বা জনসাধারণ, তাদের বর্তমান লীগ সরকার, ছাত্রলীগ ইত্যাদির উপর যতই ক্ষোভ থেকে থাকুক (সঙ্গত কারনেই অনেক ক্ষেত্রে), সেই ক্ষোভের লেশমাত্র বঙ্গবন্ধুর উপরে পড়তে দেখি নাই। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন প্রকার ট্রলিং বা কটুক্তি দুই একজন ইডিওট ছাড়া কাউকেই করতে দেখি নাই।
লীগ যাই হোক, বঙ্গবন্ধু যে সবকিছুর উর্দ্ধে, গত এক দশকে অন্তত এই একটা জিনিস মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বলেই আমার মনে হয়েছে। এইটাও একটা বড় প্রাপ্তি।

আমিও তাই মনে করি।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

মন মাঝি's picture

চলুক আপনাকে অনেকদিন পরে আবার লিখতে দেখে ভালো লাগল!

****************************************

তাসনীম's picture

আমি নিজেও আনন্দিত হাসি

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

সোহেল ইমাম's picture

Quote:
এরা একদম সাধারণ মানুষ - এরাই ইতিহাসের ধারক ও বাহক, এরাই ইতিহাসকে লালন করে নেয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। এরা জানে বঙ্গবন্ধুকে কেনা যায় না, বিক্রি করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে শুধু ধারণ করতে হয়।

এই উপলব্ধিটাই একটা অর্জন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তাসনীম's picture

আমারও তাই মনে হয়েছে।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

নীলকমলিনী's picture

১৯৭৫ সালের আগস্টে আমি ইডেন কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। যু্দ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র চার বছর আগে। যু্দ্ধের সময়কার আতংক তখনো তাড়া করে। গোলাগুলির শব্দ শুনে ফ্লোরে শুয়ে পডা ছিল প্রতিরাতের ব্যপার। যুদ্ধের সময় আমরা ঢাকার বাইরে ছিলাম। ১৫ ই আগস্ট রাতে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেংগে যায়। আমি আমার রুম মেট দুজনে আমার খাটের নীচে শুয়ে থাকি সারারাত। আমরা ধানমন্ডি এবং বেইলী রোড মিন্টু রোডের গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছিলাম। সকালেও ঘর থেকে বের হইনি ভয়ে । কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। বাবা মার সাথে যোগাযোগের কোন উপায় নেই। এর মধ্যে শুনলাম আওয়ামী লীগের এক নেতার ( বিবাহিত) প্রেমিকাকে সকালে মিলিটারী ধরে নিয়ে গেছে হোস্টেল থেকে। সিনিয়র ঐ আপা প্রতি বিকেলে নেতার গাড়ী আসলে চলে যেতো সেটা আমরা প্রায় সবাই দেখেছি। একথা জানার পর আমরা কেউ আর ঘর থেকে বের হয়নি । হোস্টেলের গেইট বন্ধ। বাইরে যাবার উপায়ও ছিল না। এই মূহুর্তে মনে নেই আমরা কখন শুনেছিলাম যে বংগবন্ধু সপরিবারে মারা গেছেন। বেলা দেড়টার দিকে আমার লোকাল গার্জিয়ান খালা( উনি বাংলাদেশ টাইমসের সাব এডিটর ছিলেন, প্রাক্তন মর্নিং নিউজ) খালু দারোয়ান কে দিয়ে চিরকুট পাঠান যে উনারা গেইটের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি গেইটের কাছে গেলে আমাকে বলেন হোস্টেল থেকে যেন কোথাও না যাই। আমি ঠি ক আছি কিনা দেখতে এসেছেন। আমার রুম মেটের বাবা আওয়ালীগের একজন নেতা, ওর কাছে কেউ আসেনি।
এই ঘটনার কিছুদিন আগে আমি ঢাকার রাস্তায় একজন কে বমি করতে করতে মারা যেতে দেখেছি। ঢাকাতে তখন অসংখ্য কংকালসার গরীব লোক দেখেছি। হোস্টেলে দুই বেলা একটা করে রুটি দিত। ভাত দিত না। সাথে হাফ ডিম আর অসম্ভব পাতলা ডাল। তবে ছেলেদের হলে নাকি আস্ত ডিমই দিতো। আমার হাজব্যান্ডের কাছে পরে শুনেছি। দুর্ভিক্ষ লাগার পর এবং বাকশাল ঘোষনার পর বংগবন্ধুর জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। নানা রকম অরাজকতাও বাড়তে থাকে। আগস্টের সেই ভয়াবহ দিনে আমরা প্রকাশ্যে আমাদের পরম প্রিয় নেতার জন্য শোক করতে পারিনি। আমি ৮০ সালে দেশ ছাড়ি। ছাত্র ছিলাম বলে অনেক বছর পর পর দেশে গেছি। দেশের বহু ঘটনাই তখন জানিনি। এখন যেমন যেদিন যা হচ্ছে জানছি। খুব আশা ছিল আওয়ামী লীগ আবার কখনো ক্ষমতায় আসলে আগের ভুল গুলো করবে না। তাসনীম তোমার লেখা আমার অন্য সবার মতই খুব ভাল লাগে। আরো ঘন ঘন লিখো।

তাসনীম's picture

খুব ভালো লাগলো আপনার মন্তব্যটাও।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

আয়নামতি's picture

Quote:
বঙ্গবন্ধুকে কেনা যায় না, বিক্রি করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে শুধু ধারণ করতে হয়।

গুরু গুরু

তাসনীমভাই, হুট হাট এভাবে লিখে সচল পাঠকদের খুশি করবেন আশা করি। হাসি

তাসনীম's picture

ধন্যবাদ।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

ষষ্ঠ পাণ্ডব's picture

১.
১৯৭১ সালের বিশে ডিসেম্বর পালিয়ে থাকা জীবন থেকে বাড়ী ফিরে আসা, মুক্তিযুদ্ধে অস্থাবর সকল সম্পদ হারানো দুটি পরিবারের দুই নারী, সম্পর্কে তাঁরা পরস্পরের জা। বাড়ী ফিরে তাঁদের একজন প্রতিজ্ঞা করলেন ‘শেখ সাহেব’ যদি ভালোয় ভালোয় ফিরে আসতে পারেন তাহলে তিনি একটা খাসী সদকা দেবেন। সময়টা এমন যে পরের বেলায় তারা কী খাবেন সেটার নিশ্চয়তা নেই; সেখানে তিনি তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য একটা প্রতিজ্ঞা করে বসলেন। দ্বিতীয় জন জানেন তাঁর পক্ষে এমন ব্যয়বহুল প্রতিজ্ঞা করা সম্ভব নয়, তাই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন ‘শেখ সাহেব’ যদি ভালোয় ভালোয় ফিরে আসতে পারেন তাহলে তিনি ত্রিশটা রোজা রাখবেন। ১৯৭২ সালের দশই জানুয়ারী ‘শেখ সাহেব’ ভালোয় ভালোয় ফিরে এলে তাঁরা দুজনেই তাঁদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন — অনেক কষ্টে আর ত্যাগে। ব্যক্তিগতভাবে কোন কিছু লাভের আশায় তাঁরা একাজ করেননি। এই প্রকার আরও কয়েক মিলিয়ন ঘটনার কথা একটু খোঁজ করলে আমরা প্রত্যেকে জানতে পারবো। কোন ঘাতক বা তাদের সহযোগীদের সাধ্য আছে এমন মানুষদের মন-মগজ থেকে ‘শেখ সাহেব’-এর নাম মুছে ফেলে!

২.
কারো কাছে তিনি ‘খোকা’, কারো কাছে ‘মুজিব’, কারো কাছে ‘মুজিব ভাই’, কারো কাছে ‘মুজিবুর’, কারো কাছে ‘শেখ সাহেব’, কারো কাছে ‘শেখের ব্যাটা’ এমনকি কারো কারো কাছে ‘শ্যাখের পো’। এই সম্বোধনগুলো শুনতে যেমন শোনাক না কেন এগুলোর প্রত্যেকটিতে মিশে আছে প্রগাঢ় ভালোবাসা, স্নেহ, শ্রদ্ধা। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নামের এই মানুষটিকে দেশের বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-অবস্থানের মানুষের এমন বহু সম্বোধনে সম্বোধন করা বোঝায় যে, এই মানুষগুলোর প্রত্যেকের সাথে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’-এর এক একটা অলিখিত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে।

খুনী মোশতাকের দল, সামরিক শাসক জিয়া্র দল, পতিত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের দল, ’৭২-’৭৫-এ আওয়ামী লীগ সরকার আর দেশের মানুষের ঘুম হারাম করে দেয়া বাম হঠকারী দলগুলো, এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত থেকে অনেক ‘ত্যাগী’ নেতাকর্মী আজ রাতারাতি দল ত্যাগ করে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। এইসব ‘ত্যাগী’ নেতাকর্মীরা যখন প্রতিটি বাক্যে ‘বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে এবং পূর্বে উল্লেখিত লোকদের কেউ ‘বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ না করলে তেড়ে আসে তখন তারা মনে মনে ক্ষুদ্ধ হন। কিন্তু তারা জানেন এসব বকাবকি বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কটিকে স্পর্শ করতে পারবে না।

৩.
’৮০-এর দশকে যখন বিভিন্ন লাইব্রেরীতে যাবার সুযোগ হয় তখন সেখানে দেখতাম ’৭০-এর দশকের প্রথম ভাগে প্রকাশিত কোন বইয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম বা ছবি থাকলে কারা যেন সযত্মে ব্লেড দিয়ে তাঁর ছবি কেটে ফেলেছে বা কালি দিয়ে চিত্র-বিচিত্র করে তাঁর ছবি বিকৃত করেছে এবং নাম ঢেকে দিয়েছে। বোঝাই যায়, আড়ালে বেড়ে ওঠা একটা সংঘবদ্ধ চক্র সারা দেশজুড়ে এই বিকৃতির অভিযান চালিয়েছিল। মূর্খগুলি বোঝেনি তাদের এইসব কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে পাঠককূলের কৌতুহল কেবল বাড়িয়েই দিয়েছে।

৪.
’৭০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে স্কুলে পাঠ্য ‘পরিবেশ পরিচিতিঃ সমাজ’ বইয়ে বাংলাদেশের যে ইতিহাস ছিল সেখানে একটা অদ্ভূত ব্যাপার ঘটেছিল। ১৯৮২ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত ছাপা হওয়া বইয়ে ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’, ‘হানাদার বাহিনী’ ইত্যাদি দুর্বোধ্য শব্দমালার সাথে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ছবি আর তার ২৭শে মার্চ-এর বেতার ভাষণ শুনে দেশের মানুষের ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে’ ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা লেখা ছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানী বাহিনী, রাজাকার-আলবদর ইত্যাদি শব্দমালা স্বাভাবিকভাবে অনুপস্থিত ছিল। এমনকি সেখানে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ টার্মটাও অনুপস্থিত ছিল। ১৯৮২ সালের চব্বিশে মার্চ পতিত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর বই আবার পাল্টালো। এই দফাতে আগের মতো ‘স্বাধীনতা যুদ্ধ’, ‘হানাদার বাহিনী’ ইত্যাদি দুর্বোধ্য শব্দমালা থাকলেও জিয়াউর রহমান সংক্রান্ত কথাবার্তা আর ছবি নাই হয়ে গেলো। যথারীতি এই আমলেও বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানী বাহিনী, রাজাকার-আলবদর ইত্যাদি শব্দমালা অনুপস্থিত ছিল। এইসব বানোয়াট ইতিহাসের বই যারা লিখেছিল তারা হয়তো এর জন্য কয়েক হাজার টাকা পেয়েছিলো বা সামান্য কিছু ব্যক্তিগত সুবিধা পেয়েছিল। এইসব নির্বোধ ভিখারীর দল এই সত্যটা জানতো না যে এভাবে ইতিহাসকে পালটে ফেলা যায় না।

৫.
পতিত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের আমলে এক বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে স্থানীয় উদ্যোগে দেখানো এক চলচিত্র উৎসবে প্যানোরামা পর্বে হঠাৎ কী করে যেনো বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ চলে আসলো, কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র — সারা অডিটোরিয়াম সমূদ্রের মতো উল্লাসে গর্জে উঠলো। লিখিত বা অলিখিত কোন কালাকানুন সাধারণ জনগণের বুকের ভেতর থেকে এই মানুষটাকে সরাতে পারবে?

৬.
বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্তও এই দেশের অনেক মানুষ মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ইত্যাদি পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী দলগুলো করে গেছে বা সমর্থন করে গেছে। এই মানুষগুলো, তাদের পরিবারের সদস্যরা, এমনকি তাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে সহ্য করতে পারে না এই কারণে যে, এই মানুষটার নেতৃত্বে এদেশের জনগণ তাদের সাধের পাকিস্তানের ভবশিঙ্গা বাজিয়ে দিয়েছিলেন। এই পাকমনপিয়ারু গোষ্ঠী সদা সর্বতোভাবে চেষ্টা করে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে, তাঁকে আড়াল করতে, তাঁর অবদান অস্বীকার করতে। তবে কথা হচ্ছে কী, দুনিয়ার কোন দেশেই তো নিমকহারামরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারে না তাই এই গোষ্ঠীদের অপচেষ্টা আখেরে ফলপ্রসূ হয় না।

৭.
গত একশ’ বছর ধরে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতি দফায় ট্রেন মিস করা, জনবিচ্ছিন্ন, ভূমিবিচ্ছিন্ন বাম বিপ্লবীরা মুক্তিযুদ্ধে সফল হওয়া ‘শেখ মুজিব’কে সহ্য করতে পারে না। তাদের ধারণায়, কোথাকার কোন অর্ধশিক্ষিত লোক হাঁকডাক দিয়ে চাষাভুষোদের দিয়ে লড়াই করে তাদের স্বপ্নের বিপ্লবের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। বাস্তবের দুনিয়ার বাইরে কোকুনের মধ্যে বাস করা এইসব ‘মহাজ্ঞানী’র দল বঙ্গবন্ধু যতো অবজ্ঞা করে তাদের নিজেদের দেউলিয়াত্ব ততো বেশি প্রকট হয়। নির্বাচন আসলে অবশ্য তারা সেই চাষাভুষোদের ‘নৌকা’য় ওঠার জন্য আকূল হয়ে যায়।

পুনশ্চঃ বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হয়ে গেলো। লেখকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাসনীম's picture

বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলা যায় না। আমারও একই উপলব্ধি। তোমার এই মন্তব্য আমার পোস্টকে ঋদ্ধ করেছে। ধন্যবাদ।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.