নৈরঞ্জনা(৬)

তুলিরেখা's picture
Submitted by tuli1 on Fri, 27/07/2018 - 7:28am
Categories:

৬।
আমরা ফিরে যাচ্ছি আদিত্যনগর থেকে। প্রায় শেষরাত্রে উঠে তৈরী হতে হয়েছে, তারপরে আবার ঐ অত ভোরেও ডক্টর আদিত্য আমাদের জন্য ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছিলেন, কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়েন নি। আমি অবশ্য চা আর টোস্ট ছাড়া আর কিছু খাই নি। কাশ্মীরাও টোস্টও খায় নি, শুধু চা আর একটা বিস্কুট খেয়েছে।

ভোরের হাওয়া ঠান্ডা বেশ। একটু একটু শিরশির করে। আবার ভালোও লাগে। পাহাড়ী দেশের এক ভোর মনে পড়ে, সেখানে এইরকম এক বসন্তের ভোরে এক রেলস্টেশনে দাঁড়িয়েছিলাম ট্রেনের অপেক্ষায়, আমি আর ইন্দ্রজিৎ। আমরা একটা শর্ট অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে গিয়েছিলাম, কয়েকদিনের মধ্যেই নিজেদের শহরে ফেরার কথা ছিল। কিন্তু এমন অবস্থাতেই পড়লাম, ফিরতে ফিরতে মাস ঘুরে গেল। সে কতকাল আগের কথা। সামান্য শিরশির হাওয়াতে এত কিছু মনে পড়ে গেল। ইন্দ্রজিৎ তো এখন দেশের বাইরে, ক্ষীণ যোগাযোগ আছে।

কাশ্মীরা এইবারে সালোয়ার কামিজ পরেছে, মাথা আর গলা ঢেকে নিয়েছে। আমাদের বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিয়েই ডক্টর আদিত্য চলে গেলেন না, আমাদের একেবারে রওনা করিয়ে দিয়ে মানে বাস ছাড়লে তবে যাবেন। বাস ছাড়তে দেরি আছে এখনো।

বাসে উঠে গুছিয়ে বসে পড়ি আমরা। বাস ছেড়ে দেয় একসময়। পিছিয়ে যেতে থাকে নতুন চেনা জনপদ, পাহাড়, মাঠ, জঙ্গল। বাস ফিরছে আমাদের চেনা শহরে আবার। পৌঁছবে সেই সন্ধ্যেবেলা।
আবার সেই চেনা নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠা, সেই ছকে বাঁধা নদীবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিত্যকার কাজকর্ম আলোচনা ইত্যাদি। প্রতি সপ্তাহে সোম থেকে শুক্র সেই একই রুটিন। কেমন একটা ক্লান্তি ছেয়ে আসে সর্বাঙ্গে, সে কি আগের রাত্রে ভালো ঘুম হয় নি বলে নাকি সামনের ছকে বাঁধা রুটিনের কথা ভেবে কেজানে!

পাশে বসা কাশ্মীরার দিকে তাকাই। সে কেমন মগ্ন হয়ে আছে নিজের মধ্যে । চুপচাপ জানালা দিয়ে দেখছে দৃশ্য। হয়তো আদিত্যনগরের অভিজ্ঞতা ওকে মুগ্ধ করে রেখেছে। এরকম একটা জায়গা দেখবে আগে থেকে কোনো ধারণাই ছিল না হয়্ত ওর।
কোনো প্রশ্ন করে বা এমনি অন্য কথা বলে ওর মগ্নতাকে ভাঙতে ইচ্ছে করে না । জ্যাকেট খুলে ভাঁজ করে বালিশের মতন মাথার পিছনে দিয়ে চোখ বন্ধ করি।আহ ঘুম ঘুম ঘুম।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম খেয়াল নেই, একসময় শুনলাম, "আবীর ওঠো। বাস থেমে গেছে।"
চোখ মেলে মাথা সোজা করে দেখি কাশ্মীরা ডাকছিল। আমার ঘুমভাঙা চোখমুখ দেখে ও হাসছিল, বললো, "বাপরে তুমি তো সেই সক্কাল থেকে কেবল ঘুমোচ্ছ। কাল রাত্রে ঘুমাও নি নাকি? "
আমি হাসলাম, কোনো উত্তর দিলাম না। বাসের সীট থেকে ওঠার যোগাড় করলাম। ওহ, একটু হাত পা খেলানো দরকার।

তখন দুপুরের খাওয়ার জন্য বাস থেমেছে একটা বাজার মতন জায়্গার পাশে। যাত্রীরা একে একে নেমে পড়ছে। এখানে এক ঘন্টার ব্রেক। এইসময়ের মধ্যে সবাই খাওয়াদাওয়া করে ফিরবে, অন্য কোনো কেনাকাটা থাকলেও করে নেবে।
আমরা কাছেই একটা রেস্তরাঁ তে গেলাম। একটু ভিনদেশী টাইপের খাবারের জায়গা বলে খুব বেশী ভীড় ছিল না সেটায়। খাবারের অর্ডার দিলাম। কাশ্মীরা শুধুই সামান্য স্যুপ আর একটুকরো সেঁকা পাঁউরুটি খেল, ওর নাকি একেবারে খিদে নেই। আমি অবশ্য স্যান্ডউইচ, স্যুপ সবই খেলাম। ভালোই খিদে পেয়েছিল।

"আরে আরে এ কাদের দেখছি? এ যে আমাদের আবীর আর কাশ্মীরা! "
বেশ গমগমে গলায় কথা শুনে আমরা দু'জনেই চমকে উঠলাম। মুখ তুলে তাকিয়ে টেবিলের পাশেই যাকে দেখলাম, তাকে ঐ রেস্তরাঁতে একেবারেই দেখবো ভাবিনি।

ডক্টর প্রতাপ পালচৌধুরী। উনি ও আমাদের প্রতিষ্ঠানেই ছিলেন, অভিজ্ঞ ও বয়স্ক গবেষক। ডক্টর আদিত্যের কাজ নিয়ে ঐ বিতর্কিত ব্যাপারে উনি আমাদের দিকেই ছিলেন যেটা ব্যতিক্রমীই বলা যায়। কারণ বয়স্ক পুরনো গবেষকরা কেউই আমাদের দিকে ছিলেন না। সমালোচকরা অবশ্য বলে থাকে যে ওঁর তখন এমনিতেই রিটায়ারের সময় হয়ে গিয়েছিল বলে উনি আমাদের দলের সিমপ্যাথাইজার হয়েছিলেন।
যাই হোক, ঐ ঘটনার পর পরই উনি রিটায়ার করেন। তারপরে একেবারে আর কোনো যোগাযোগই রাখেন নি, একেবারে যেন মিলিয়ে গিয়েছিলেন। এত বছর পরে এইরকম একটা
অখ্যাত ছোটো জায়গায় ওঁকে দেখবো আমরা কেউ ভাবিনি।
ভদ্রলোক একেবারেই বৃদ্ধ বা অশক্ত হয়ে পড়েন নি, বেশ শক্তসমর্থ প্রৌঢ় বয়স পার করছেন। বেশ হাসিখুশি ও আছেন আগের মতনই। আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের টেবিলেই ওকে বসতে দিই। ওঁর খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল,বিল মিটিয়ে উঠে যাবার সময় আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন।

কাশ্মীরা হেসে বলে, "আরে স্যর, আপনি এখানে এইসময়ে? দারুণ সারপ্রাইজ। কেমন আছেন? "
উনিও হেসে বলেন, "আমিও তোমাদের এখানে দেখবো আগে ভাবিনি। কিন্তু জীবন সারপ্রাইজে ভরা, আরে তা না থাকলে বেঁচে কীসের আনন্দ?"
আমি হেসে বলি, "আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম, এখন ফিরে যাচ্ছি পুরনো ঘানিতে। আপনি তো স্যর একেবারেই মিলিয়ে গেলেন, অবসর নেবার পরে আর কোনোদিন এলেন না ইনস্টিটিউটে। আমাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতেও তো এক দু'বার আসতে পারতেন!"
উনি একটু হেসে বললেন, "আমি অবসর নেবার পরে পুরনো জীবনের সব সংসর্গই ত্যাগ করেছি। তখন থেকেই একটা মিশনারী স্কুলে স্বেচ্ছাশ্রম দিই। থাকার ব্যবস্থাও সেখানেই। তোমরা হয়তো জানো বা হয়তো জানো না যে আমার স্ত্রী গত হয়েছেন আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে, একমাত্র ছেলে চিরকাল হোস্টেলেই মানুষ হল, এখন সে বিদেশে কাজ করছে, সেখানকার জীবনের সঙ্গেই মিশে গিয়েছে। আমার সঙ্গে ক্ষীণ যোগাযোগ আছে, ফোনে আর চিঠিতে। কিন্তু তাতে দু'জনের কেউই আমরা কষ্টে নেই, সত্যি বলতে কি আমাদের বাপ ছেলের সম্পর্ক চিরকালই এরকম। এখন ঐ শহর থেকে অনেক দূরের গ্রামের মিশনারী স্কুলটিতেই ছাত্রদের মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছি। ওদেরই একটা দল নিয়ে এসেছি শিক্ষামূলক ভ্রমণে। কাছেই একটা মানমন্দির আছে, সেইখানেই আছি আমরা। তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভালো লাগলো খুব। তোমরা যদি চাও, একবার আমাদের স্কুলটি দেখতে এসো। আমার কার্ড দেবো তোমাদের, তাতে স্কুলটার ঠিকানা আছে। আজ আমি উঠি তবে, খুব ভালো লাগলো।"
উনি কার্ড দিলেন, তারপরে উঠে দাঁড়ালেন বিদায় নেবার জন্য। রেস্তঁরার মধ্যেই আমরা দু'জনে প্রণাম করলাম ওঁকে। কাশ্মীরার চোখ ছলছল করছিলো, আমারও মনটা কেমন মেদুর হয়ে এলো। ওঁর মতন নিঃস্বার্থ স্নেহময় মানুষ কজনই বা দেখা যায় আমাদের এই জটিল জগতে?
আমাদের খাওয়া তো আগেই হয়ে গিয়েছিল, বিল মিটিয়ে রেস্তরাঁ থেকে যখন বেরোলাম তখন বাস-বিরতির নির্ধারিত সময়ের অনেকটাই কেটে গিয়েছিল। বাজার মতন জায়্গার মধ্য দিয়ে দ্রুত বাসস্ট্যান্ডের দিকে চলতে থাকি, শপিং টপিং করা আর হয়ে ওঠে না। কাশ্মীরার মনে হয় স্থানীয় কিছু জিনিস কেনার ইচ্ছে ছিল,খেতে আসার সময় বলছিল বটে, কিন্তু এখন আর ওর সেসব দিকে মন নেই।

আসলে ডক্টর পালচৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে দু'জনেই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। চলতে চলতে কাশ্মীরা একবার শুধু অস্ফুটে বললো, "আশ্চর্য কান্ড! এখানে, এমন সময়ে, এই পরিস্থিতিতে ওঁর দেখা পাওয়া।।। জীবনে কতরকম চমকই না অপেক্ষা করে থাকে!"
আমি শুধু বললাম, "হুঁ, সত্যি অবাক কান্ড!" আর কিছু বলতেই ইচ্ছে করছিল না, বুকের ভিতরটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল, দুপুরের কড়া রোদ্দুরে গরম হয়ে থাকা মাটির উপরে বিকেলে বৃষ্টি পড়লে মাটি যেমন ভিজে ওঠে, সেইরকম। নিঃস্বার্থ, স্নেহময় মানুষ নিজের জীবনে এত কম দেখেছি যে, সামান্য যে ক'জনকে দেখেছি তাদের প্রতিকণা স্মৃতি মূল্যবান আমার কাছে।
বাসে এসে সীটে বসে পড়ি। বাস ছেড়ে দেয় একটু পরেই। আবার ঘুমোবার যোগাড় করি।
কিন্তু কাশ্মীরা বলে, "আবীর, আবার ঘুমোবে তুমি? "
আমি কেমন একটা নিস্তেজ গলায় বললাম, "কীই বা করবো তাহলে? "
ও ফিসফিস করে বলে, "কবিতা শুনবে আবীর?"
অবাক হয়ে বলি, "কবিতা? কোথা থেকে কবিতা শুনতে পাবো? তুমি শোনাবে? "
ও আস্তে আস্তে কাঁধের ঝোলাব্যাগ থেকে একটা পুরনো ডাইরি বার করে, কেমন করুণ আর কোমল গলায় বলে, "এই যে এখানে রয়েছে। আমার খুব প্রিয় এক মানুষের লেখা কবিতা। কোনোদিন প্রকাশিত হয় নি কোথাও। শুধু এই ডাইরিটাতে রয়ে গিয়েছে। শুনবে?"
খুব সাবধানে আস্তে আস্তে বলি, "শোনাবে আমায়?" সাবধানে কারণ ভয় ছিল গলার স্বরে যদি আবেগপ্রবণতা প্রকাশ হয়ে পড়ে। বৃষ্টিসিক্ত ঐ ভিতরটা যে কারুকে দেখতে দিতে চাই না!
কাশ্মীরা পড়তে শুরু করে, শুনতে শুনতে বিস্ময়ে আর আনন্দে আমার মন কেমন জানি করতে থাকে! এত সুন্দর কবিতা!
বেশ কিছু কবিতা পড়ার পর ও থামে। আমি আর থাকতে পারি না, বলি, "কী অপূর্ব সব কবিতা! মীরা, এসব কার লেখা? "

কাশ্মীরা ধরা গলায় জবাব দেয়, "এইসব আমার দিদির লেখা। সবই এইরকম ডাইরিতে বা খাতায়। কোনোটাই কোনোদিন কোনো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় নি। "
আমি উৎসুক হই, বলি, "কেন মীরা? এসব রীতিমতন পাকা হাতের লেখা! কেন কোথাও পাঠাতে বলো নি তোমরা?"

কাশ্মীরা কেমন সজল চোখে চেয়ে থাকে দূরের দিকে, বলে, "জানো, দিদি যখন এইসব কবিতা লিখতো তখন ও কতটুকু বয়সের? ক্লাস এইটে আর নাইনে থাকতে এসব কবিতা লিখেছিল দিদি। আমার চেয়ে দিদি মাত্র দেড় বছরের বড় ছিল। ও এসব শুধু আমাকেই দেখাতো, আর কারুকে না। সবার কাছ থেকে লুকিয়ে আমায় শোনাতো। আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল যে এসব আমি আগলে রাখি যেন নিজের কাছে। একদিন ও এসে আমার থেকে ফেরৎ নেবে এসব। সেই থেকে আমি আগলেই রেখেছি এসব,কিন্তু দিদি আর আসে নি ফেরৎ নিতে। "
এবারে শক খাই যেন আমি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, "সে কি? কোথায় গেল তোমার দিদি?"

কাশ্মীরা ছলছলে চোখ মুছতে মুছতে বলে,"নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছে দিদি। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দিদি ক্লাস টেনে পড়তো। একদিন স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল কী যেন একটা কারণে, দুই বোন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এলাম একটা তেমাথার মোড়ে, রাস্তা দুই ভাগ হয়ে একটা চলে গেছে আমাদের পাড়ার দিকে,আরেকটা চলে গেছে দিঘি আর বটগাছের পাশ দিয়ে দূরের মাঠ আর পাহাড়ের দিকে। তেমাথায় থেমে দিদি বললো, "শোন, আমি একজায়গায় যাচ্ছি। তুই বাড়ী যা, আমার ফিরতে দেরি হবে। আমার বইয়ের ব্যাগটা তুই নিয়ে যা। এর মধ্যে কবিতার খাতা
রয়েছে একটা। তুই এই কবিতার খাতা আর কবিতার অন্য ডাইরিগুলো নিজের কাছে লুকিয়ে রাখিস। আমি ফিরে এসে তোর কাছে সব চেয়ে নেবো।" আর কিছু জিজ্ঞাসাই করতে পারলাম না, নিজের বইয়ের ব্যাগ আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে দিদি হনহন করে রওনা হলো ঐ দিঘি আর বটের দিকের রাস্তাটায়। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ না বাঁকের মুখে দিদির চলন্ত চেহারাখানা অদৃশ্য হয়ে যায়। তারপরে নিজের আর দিদির বইয়ের ব্যাগ দু'খানা নিয়ে বাড়ি চলে গেলাম। "

এইটুকু বলে কাশ্মীরা থেমে যায়, চুপ করে চেয়ে থাকে বাইরের দিকে। আমি বলি, "তারপর?"

কাশ্মীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, "তার আর পর নেই। দিদির সঙ্গে সেই শেষ দেখা। দিদি আর ফেরেনি। সেদিন আর তার পরদিনও যখন দিদি ফিরলো না,তখন সব কিছু পুলিশে জানানো হলো। তারা অনেক খোঁজ করেছে, কিন্তু দিদিকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি।"
স্তব্ধ হয়ে যাই। কাশ্মীরার একটা হাত নিজের দু'হাতের মধ্যে নিয়ে চুপ করে বসে থাকি, কিছু বলতে পারি না। কাশ্মীরা জলভরা চোখে বিস্ময় নিয়ে ফিরে তাকায়, কিন্তু হাত সরিয়ে নেয় না। আস্তে আস্তে সীটে মাথা এলিয়ে দেয়, চোখে বন্ধ করে।
ওর কোলের উপরে পড়ে থাকে ডাইরিটা, ওর নিরুদ্দিষ্টা দিদির অসংখ্য কবিতাসন্তান বুকে নিয়ে। সস্নেহে সেই ডাইরির উপরে অন্য হাতটা রেখেছে কাশ্মীরা।
আমার খোলা চোখ আস্তে আস্তে বুজে যায়। দেখতে পাই কুয়াশা কুয়াশা কুয়াশা চতুর্দিকে, শীতের এক ভোর। সেই কুয়াশা ভেদ করে শোনা যাচ্ছে রেলগাড়ীর ভোঁ। সকালের প্রথম ট্রেন যাচ্ছে আমাদের স্টেশন পার হয়ে। সেই কতকাল আগের জায়গাটি আমার, কতকাল আগে শেষ দেখেছি তাকে, তবু কিছুতেই বুকের ভিতর থেকে মুছে ফেলতে পারি না তাকে।
তারপরেই কুয়াশা ভেদ করে ফুটে ওঠে অন্য একটা দেশ, একটা মাঠের মধ্য দিয়ে রাস্তা, দুই কিশোরী গল্প করতে করতে আসছে সেই রাস্তা দিয়ে। অনেক দূর থেকে দেখছি যেন, ওদের মুখ চিনতে পারছি না। আরো খানিকটা এগিয়ে এলে দেখলাম ওদের গায়ে স্কুলের পোশাক, কাঁধে স্কুলব্যাগ। একজায়গায় রাস্তা দুইভাগ হয়ে গেছে, একটা রাস্তা চলে গেছে বটগাছ আর দিঘির দিকে। এরপর দেখি দুই রাস্তার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী আর আরেক কিশোরী চলে যাচ্ছে দিঘির দিকের রাস্তায়। দিঘির দিকে অনেকটা এগিয়ে এলে ওর মুখ স্পষ্ট দেখতে পাই, সে আমার
দিকে চোখ তুলে বিষন্ন হাসে। এ তো মনাইয়ের মুখ!
তীক্ষ্ণ একটা বেদনার মতন চমক লাগে, ঘুম ভেঙে যায়। ওহ, স্বপ্ন!আবারও! এপাশে ওপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে নিলাম প্রথমে। তারপরে জোর করে চোখ খুলে রইলাম। আর ঘুমোনো চলবে না।
বাস চলছে। কাশ্মীরা ঘুমিয়ে আছে পাশের সীটে। ওর কোলের উপরে সেই ডাইরিটা সেইভাবেই আছে, তার উপরে ওর একটা হাত। আমি যে হাতটা ধরে রেখেছিলাম সেই হাত সীটের উপরে এলিয়ে পড়েছে, ঘুমের ঘোরে কখন আমার হাত থেকে খসে গিয়েছে ওর হাত।
নিজের উপরে কেমন একটা অক্ষম রাগ হলো, কোনো কিছুই ধরে রাখতে পারি না,যারাই আমার কাছে এসেছে, ভালোবেসেছে, আশ্রয় নিতে চেয়েছে, তাদের কারুকেই ধরে রাখতে পারিনি। সব ছেড়ে কেবলই নিজের পথে দূর থেকে আরো দূরে চলে গিয়েছি। কেজানে আমার জন্মনক্ষত্রে রয়ে গিয়েছিল কোন ভবঘুরের স্পর্শ!
না, সাবধানে থাকতে হবে, এই কাশ্মীরা কোনোভাবে যেন জড়িয়ে না পড়ে আমার ভরসায়। অবশ্য এ শক্ত ধরণের মেয়ে, হয়তো এ ওভাবে জড়িয়ে যাবে না। তবু কে
বলতে পারে!
নিজের ইষ্টদেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম, "আমায় এবারে রক্ষা করো, এই মেয়েটিকে রক্ষা করো, আমায় আর অপরাধী কোরো না। "

(চলমান)


Comments

সোহেল ইমাম's picture

বাহ!! চলুক লেখা। চলুক
(এক একটা কিস্তিতে লেখার পরিমাণ আর সামান্য একটু বাড়ানো যায়না)

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

তুলিরেখা's picture

ধন্যবাদ । আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
দেখি পরের পর্বগুলিতে বেশি দিতে পারি কিনা । হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

কর্ণজয়'s picture

বলার ভাষায় ছবি ছবি একটা সুর

তুলিরেখা's picture

অনেক ধন্যবাদ । আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

আয়নামতি's picture

এ পর্বটা ফস্কে গিয়েছিল। পড়ে নিলাম। হাসি

তুলিরেখা's picture

আয়নামতি, কেমন লাগছে বললে না তো? হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

Post new comment

The content of this field is kept private and will not be shown publicly.